ঢাকা বুধবার, ২২ জানুয়ারি ২০২৫

মুক্তিযুদ্ধের গল্প

পারদ রঙের শহর

পারদ রঙের শহর

প্রচ্ছদ :: আনিসুজ্জামান সোহেল

মাসুদুল হক

প্রকাশ: ১২ ডিসেম্বর ২০২৪ | ২৩:১৫

এক.
সরোজ আর শশী বিকেলের প্রথম লগ্নে সেই বাড়িটা দেখতে যায়। নিশিরও আসার কথা ছিল। কিন্তু ওর মায়ের প্রেশারটা বেড়ে যাওয়াতে ও থেকে গেছে। অন্যদিকে কুদ্দুস মামা কী যেন একটা জরুরি মিটিংয়ে গেছেন।
সরোজ আর শশী হেঁটেই বাড়িটার দিকে যেতে থাকে। বাড়ি প্রসঙ্গে সরোজ শশীকে প্রাথমিক ধারণা দেবার জন্য বলল, বাড়িটা আপনাদের জন্য খুব বেশি মানানসই বলা যাবে না। মেঝে পাকা কিন্তু ছাদ অ্যাসবেস্টরের। থাকার ঘর, রান্নাঘর, কল আর স্নানঘর দিয়ে ঘেরা একটা উঠান। একেবারে পৃথক ব্যবস্থা। মনে হয় আপনাদের পছন্দ হবে না।
–আপাত জনসংখ্যা স্ফীত এই শহরে এ রকম একটা বাসা পেলেই আমরা খুশি।
–তা ঠিক। তবে শহরে লোকসংখ্যা হঠাৎ বেড়ে যাওয়াতে ভাড়াও বেড়ে গেছে। তা ছাড়া এখানে ভাড়া দেওয়ার মতো বাড়ি বিশেষ নেই বললেই চলে।
–তা অবশ্য আমি জানি সরোজ বাবু। হিসেবটা এখন এমনই হবে। চাহিদা কয়েক গুণ বেড়ে যাওয়াতে ভাড়া ডবল হবেই। আর মুসলমান বলে তো কিছু অতিরিক্ত ঝামেলা থাকবেই।
–তুমি ঠিকই বলেছ শশী, কথাটা বলেই জিব কাটে সরোজ। –এই রে, তুমি বলে ফেললাম!
–না ঠিকই বলেছেন। তুমি বললেই সবকিছুর একটা অর্থ দাঁড়ায়।
–হ্যাঁ, তা ঠিক, কিন্তু বিষয়টা উভয় পক্ষে ঘটলে ভালো হয় না?
–সে ঠিক করে নেওয়া যাবে।
সরোজ হেসে বলে, তোমার আইডিয়া একশ পারসেন্ট ঠিক। এই গন্ডগোলের আগেও এ শহরে কোনো মুসলমানের বাড়ি ভাড়া পাওয়া কঠিনই হতো। মুসলমান সরকারি কর্মচারীরাও বাসা জোগাড় করতে পারত না। এ শহরে মুসলমান নেই বললেই চলে। শশী এবার সরোজের মুখের কথা কেড়ে নিল,
–অথচ, অতবড় একটা মসজিদ আছে! এ মসজিদটা দেখে নিঃসন্দেহে বলা যায়, এ শহরে একসময় প্রচুর মুসলমান ছিল।
সরোজ আবার হেসে বলে একদম ঠিক। ঐ যে দেশভাগ, তারই ফলে এমনটি ঘটেছে।
শশী এবার প্রসঙ্গ পাল্টায়, কিন্তু আর কতদূর হাঁটতে হবে, তোমার সে বাড়িতে কখন পৌঁছাব?
–এই তো আর দু’তিন মিনিটের পথ।
–যাক বাবা রক্ষে হলো। একদম ঘেমে উঠেছি।
এভাবে হাঁটতে হাঁটতে একটা টিলার মতো জায়গা পার হয়ে একটা ছোট্ট ঝোপের পাশ দিয়ে হেঁটে যেতেই সেই বাড়িটার দরজার সামনে গিয়ে পৌঁছায় ওরা। শশীর বাসাটা পছন্দ হয়ে যায়। পাশেই আরেকটা বাড়িতে বাড়ির মালিক থাকেন। শশীর সঙ্গে টাকা ছিল। ও একশ টাকা অ্যাডভান্স করে দেয়।
বাড়ির মালিক ওদের চা খাওয়াতে চায়। কিন্তু শশীর আপত্তি থাকাতে সরোজ উঠে পড়ে। ওরা বেরিয়ে আসে। তখনও সন্ধ্যা হতে অনেক দেরি। শশী বলে, বাব্বারে একদম হাঁপিয়ে উঠলাম, আশেপাশে বসার কোনো জায়গা নেই? সরোজের উৎসাহ বেড়ে যায়, আছে তো, এই তো, ঐ যে টিলাটার পাশেই তুলাই নদী। ওখানে বসা যায়।
–তাই চলো, একটু বসে জিরিয়ে নিই।
ওরা হাঁটতে হাঁটতে নদীর পাড়ে গিয়ে বসে। সরোজ বুঝতে পারে, শশীর চরিত্র নিশির ঠিক উল্টো। শশীর মুখে কিছু আটকায় না, স্ট্রেইট-ফরোয়ার্ড। ফলে সরোজও সেখানে সাবলীল। ও বুঝতে পারে শশী সবকিছু সহজেই দখলে আনতে চায় আবার সবকিছুর ওপরেই ওর যেন এক ধরনের আক্রোশও কাজ করে। ভারি অস্থির সে। অন্যদিকে নিশি খুব রিজার্ভ এবং ভাবগম্ভীর। যে কারণে নিশি কাছে থাকলে এতটা সহজ হতে পারত না সরোজ।
সরোজ আর শশী মুখোমুখি বসে থাকে অনেকক্ষণ। শশীর সাদা শাড়ির হলুদ পাড়ে গুনে গুনে দশটি বাসুকির ফণা। শশীর শাড়ির পাড়ে যে বাসুকির ছোপ তা কি শশী জানে? সরোজের সে বিষয়ে কৌতূহল বাড়ে কিন্তু দ্বিধায় প্রশ্ন করতে পারে না। তারপর শশীদের পরিবারের ইতিহাস-প্রসঙ্গে জানতে চায়, তোমার বাবা কীভাবে মারা গেলেন?
–আমার বাবা ছিলেন কমিউনিস্ট, কবি ও অধ্যাপক।
সরোজ মৃদু স্বরে প্রশ্ন করে, মস্কোপন্থি, না চীনপন্থি?

শশী এবার সপ্রতিভ হয়ে বলল, মাওপন্থি, এক্কেবারে নিখাদ আসল সোনা, কমিউনিস্ট বিপ্লবী।
–তো কী হলো তোমার বাবার?
–আইয়ুবি শাসনের পরপর বেশ কয়েকবার জেলে গেছেন। জেল থেকে ফিরে ক্ষয়রোগ। এই তো যুদ্ধ শুরু হবার মাস চারেক আগে হার্ট অ্যাটাকে মারা গেলেন।
সরোজের কণ্ঠে একটু সহমর্মিতা কাজ করে।
–না, না, এ নিয়ে আপনাকে কষ্ট পেতে হবে না। এ তো অনিবার্য একটা ব্যাপার।  
–আচ্ছা, তোমরা কি ঢাকায় থাকতে?
–হ্যাঁ, পুরাতন ঢাকার জিন্দাবাহারে আমাদের বাড়ি আছে।
–তুমিও কি চায়নাপন্থি?
–অবশ্যই।
সরোজ এবার খুব গভীরভাবে শশীর চোখের দিকে তাকিয়ে থাকে। শশী আত্মপ্রত্যয় নিয়ে আবার বলতে শুরু করে: এই কয়েক মাস আগেও আমরা এই পূর্ববাংলা পাকিস্তান থেকে বিচ্ছিন্ন হোক, এটা চাইতাম না। কিন্তু এখন চাই।
সরোজের মনেও চায়নাপন্থি মতবাদ আর চারু মজুমদার ঘুরপাক খাচ্ছে। কিন্তু এই মুহূর্তে সে একদম নিশ্চুপ। কিছুই স্পষ্ট করতে পারছে না। তবে সরোজ এই অল্পবয়সী মেয়েটির কথার ভঙ্গিতে চমৎকৃত হচ্ছিল। শশীর নাকের পাটা ফুলে উঠছিল। দৃশ্যতই সে উত্তেজিত হয়ে বলতে থাকে, পূর্ব পাকিস্তানে পশ্চিম পাকিস্তানের শাসকদের অবহেলা, লাঞ্ছনা আর বৈষম্য তো আমরা দেখেই এলাম। আর যুদ্ধ! ২৫ মার্চের পর থেকে কী যে দুঃসহ জীবন কাটিয়ে এলাম! সে এক ভয়াবহ স্মৃতি। শশী একটু শান্ত হয়ে ওর অভিজ্ঞতার কথা বর্ণনা করে, ২৬ মার্চ আমাদের বাড়ির প্রিয় মানুষ কুদ্দুস মামার ছোট ভাই কাদের মামাকে ওরা নিয়ে গেল। আমরা কেউ আটকাতে পারিনি। ঘটনাটা ঘটল এক থেকে দেড় মিনিটের মধ্যে। মামাকে যখন টানতে টানতে সিঁড়ি দিয়ে নিয়ে যাচ্ছিল– নিশি দিদির হাতটা মামা জোরে ধরে রেখেছিল। পাষণ্ডদের নারকীয় হাত থেকে ছোট মামা বাঁচতে পারল না। ফিরে ফিরে কেবলই পেছনে তাকাল। আমার চোখের সামনে পৃথিবীর সব রং ধূসর হয়ে গেল। আমার আর কিছু মনে পড়ে না। শশীর চোখে পানি চলে আসে, শাড়ির আঁচল দিয়ে চোখের পানি মুছে নেয়। সরোজ আলতো করে ওর পিঠে হাত রাখে। এরপর শশী আবার বলতে শুরু করে, শুধু কি মামা, এপ্রিল মাসের শেষদিকে ওরা আমাকেও ধরে নিয়ে গিয়েছিল। আমার দু-হাতে কড়া লাগাল এবং দুই বাহু পিছমোড়া করে বাঁধা। আমাকে চিৎ করে শুইয়ে দেয়। তারপর কয়েকজন অফিসার ... এইভাবে চলতে থাকে। আমি ঘৃণা আর ভয়ে জড়ো হয়ে যেতে থাকি। যখন সংবিৎ ফিরে পেলাম তখন আমার শরীর থেকে ওরা সবাই সরে গেছে। কিন্তু পিপাসায় আমার প্রাণ ওষ্ঠাগত। পানি খেতে চাইলাম। কেউ ভ্রুক্ষেপও করল না। শশীর ভঙ্গির তীব্রতা এবং তীক্ষ্ণতা সরোজকে প্রভাবিত করছিল। সঙ্গে সঙ্গে নিজের ভেতরে ওদের আন্দোলনের জন্য একটা প্রস্তুতি মস্তিষ্কের গভীরে খেলে যেতে থাকে। শশীর প্রতি সরোজের শ্রদ্ধাবোধ বেড়ে যায়। এ রকম সাহসী মেয়ে লাখে দু’একটা মেলে, যে দেশের জন্য কি দুঃসহ ত্যাগ স্বীকার করেছে। শশী আবার নিজেকে খুলে বসে, ‘ওরা আমাকে একটা হাসপাতালে নিয়ে যায়, যতদিন হাসপাতালে ছিলাম ততদিনই অত্যাচার হয়েছে আমার ওপর। পাকিস্তানি সৈন্যরা যখন-তখন আমার পা দুটো ফাঁক করে বেঁধে রেখে ...। সবচেয়ে কষ্টকর ব্যাপার ছিল– আমি চিৎকার করতে পারব না, করলে সৈন্যরা আবার অত্যাচার শুরু করবে। এভাবে বেশ কয়েক দিন কেটে যায়। তারপর ওরা আমাকে একটা বন্দিশিবিরে নিয়ে রাখে। সেখানে আমার মতো আরও অনেক রমণী। সেই আর্ত বিপদমলিন রমণীদের সবার দেহে অত্যাচারের চিহ্ন। মুখ, স্তন, ঊরু এবং বাহুতে ক্ষতের চিহ্ন। আমরা যেন সবাই তখন পাথরের স্ট্যাচু। কারও চোখে পানি নেই। এরপর এক দিন বদর বাহিনী আমাদের বাসে করে নিয়ে চলল। কৌশলে চোখের বাঁধন আলগা রাখার সুযোগ হলো বলে দেখতে পেলাম সামনে বিরাট এক বটগাছ। তার সম্মুখে একটা বিরাট বিল। মাঝে-মাঝে কোথাও পুকুরের মতো রয়েছে। বটগাছের আরও কাছে গিয়ে দেখতে পেলাম শ দেড়েক নারীকে বসিয়ে রাখা হয়েছে। জল্লাদের দল গুলি ছুড়ে হত্যালীলা শুরু করে দিয়েছে। চারদিকে আর্তচিৎকার। আমি অজ্ঞান হয়ে পড়ি। কীভাবে যে বেঁচে গেলাম সে এক রহস্য। সরোজ আর শুনতে পাচ্ছিল না; ভয়ে আর ক্রোধে দু’হাতে কানচাপা দিয়ে চোখ বন্ধ করে ফেলে। শশী তা লক্ষ করে স্বাভাবিক কণ্ঠে বলে, এসব কিছুই না। একটা যুদ্ধের আরও অনেক অনেক ক্ষরণ থাকবে। আরও অনেক কিছুই আমাদের যাবে। কিন্তু এটা ঠিক, বিজয় আমাদের আসবেই।
সরোজ এবার বলল, শশী থাক আর বলতে হবে না। তুমি একটু শান্ত হয়ে বসো।
শশী এবার হো হো করে হেসে ওঠে। আমরা তো শান্ত হয়েই আছি। কিন্তু বলছিলাম যুদ্ধ এবং শান্তির সময়ের তফাতের কথা; মতাদর্শের পার্থক্য– এইসব মানুষের আচার-আচরণে কোনো তফাত করে না। আমি জানি না তুমি কী মতে বিশ্বাসী। তবে মনে হয় তুমিও কোনো আন্দোলনে বিশ্বাসী। স্কুলের মাঠে, সেদিন রাতের অন্ধকারে তোমার আর রথিনদার কথাগুলো আমি আর নিশি দিদি শুনে ফেলেছিলাম।
সরোজ একটু চঞ্চল হয়ে ওঠে। তারপর নিজেকে সামলে নিয়ে বলে, শশী তোমাকে আমি সবকিছু খুলে বলব পরে। চলো আজ উঠি। সন্ধ্যা গভীর হয়ে আসছে।
শশী সরোজের হাত ধরে উঠে আসে।

দুই.
আগস্টের শেষদিকটায় প্রায় সব সময়ই বৃষ্টি ধরে থাকে উত্তরের জেলাগুলোয়। তখন আর উত্তর দিনাজপুর, পূর্ব ও পশ্চিম দিনাজপুরকে সীমানা ভাগ করে দেখা যায় না; দুই দেশেই প্রবল বৃষ্টিপাত। কুশমন্ডীর তুলাই নদীটির পাড় প্রায় উপচে পড়ার মতো হয়ে ওঠে। কিন্তু সব সময় বন্যা হয় না। সেপ্টেম্বর পড়তে পড়তে আকাশ পরিষ্কার হয়ে গেল এবং প্রকৃতিতে শরতের স্নিগ্ধতা চলে আসে।
এ রকম এক দিন এক সন্ধ্যার পর পরিষ্কার আকাশে রুপার থালার মতো চাঁদ ওঠে। শহরটা কেমন যেন অগোছালো যুবতী নারীর মতো পড়ে আছে পাড় বাঁধানো নদীর ধারে। শশী একা একাই মাঝেমধ্যে নদীর পাড় ধরে ঘুরে বেড়ানোর অভ্যাস করে নিয়েছে। কিন্তু সেদিনের চাঁদ শশীকে উত্তেজিত করে। বৃষ্টিতে ধুলোবালি ধুয়ে যাওয়াতে এবং নদীর পানি পাড় পর্যন্ত ডুবিয়ে দেওয়াতে শহরটা আর চাঁদ– একই মাত্রায় পরিষ্কার হয়ে ওঠে। শশী পুব বরাবর হাঁটতে হাঁটতে বাঁধের কাছে চলে আসে। বাঁধের ওপর আর কোনো লোক ঘুরে বেড়ায় না– এ ব্যাপারটা সে আগেও লক্ষ করেছে। পাড়ের কাছাকাছি জেলেরা ছইয়ের তলায় মিটমিটে হারিকেন জ্বালিয়ে হয়তো মাছ ধরার প্রস্তুতি নিচ্ছে। বাঁধ পর্যন্ত এসে শশী আবার ঘুরে দাঁড়ায়। কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে আবার হেঁটে আসতে থাকে বাড়ি বরাবর। হাঁটতে হাঁটতে শশী বিচিত্র এবং ভয়ংকর সব কথা ভাবতে থাকে। বধ্যভূমির কথা মনে আসে। বেঁচে যাবার পর যেভাবে লাশগুলো গাছের নিচে জড়ো করেছিল ও এবং আরও কয়েকজন। কতগুলো লাশ এভাবে বহন করেছিল, তা আর মনে আসে না। একটা লাশের স্মৃতি মনে পড়ে, সে লাশটার শরীর তখনও গরম। আচানক যেন নদীতে দেখতে পায় শত শত লাশ পচে গলে ঢোল হয়ে ভেসে যাচ্ছে। শশী সে স্মৃতি আর কল্পনার মোড় পাল্টায়। আচ্ছা সরোজ মানুষটা কেমন, ও তাহলে কোন রাজনীতি করে? নিশ্চয়ই আন্ডারগ্রাউন্ড, মনে হয় নকশাল আন্দোলন। তাহলে চারু মজুমদার ওদের নেতা। শশী ভাবতে ভাবতে পথ হাঁটতে লাগল। ভারতীয় বাহিনী মুক্তিযোদ্ধাদের কতখানি স্বাধীনতা দিয়েছে? পূর্ব পাকিস্তানের চায়নাপন্থি কিংবা রাশিয়াপন্থিদের এখানকার সরকার কী চোখে দেখে? শহরের পুলিশ প্রশাসনের ওপর কী নির্দেশ? হাঁটতে হাঁটতে শশী নিজের অজান্তেই বাড়ি ফিরে আসে। বাড়িতে বিদ্যুতের আলো নেই। নিশি হারিকেন হাতে এগিয়ে আসে।
–তোর হাঁটা হলো? তোকে নিয়ে আর পারা যায় না।
–কেন?
তখন ওদের মা এসে বলল, কেন আবার? এ তো আর আমাদের দেশ না। পরদেশে যুবতী মেয়ে, রাতবিরেতে বেড়াতে যাস!
–শশী এবার নিজেকে সামলে নিয়ে বলল, মা আমরা আর কেউই ছোট নই এবং আমাদের চরিত্র নষ্ট হওয়ার ভয় নেই। অন্তত এই সন্ধ্যাকে তুমি যেভাবে রাত ভেবে পরদেশের যুক্তি আনলে! কী আর বলব!
ওদের মা রহিমা বেগম, কথা আর না বাড়িয়ে, কেবল একটা মেজাজের ভঙ্গি এনে ‘হায় আল্লাহ, এ মেয়ের মুখে কি কিছুই আটকায় না?’ বলে পাশের ঘরে চলে যায়। এবার নিশি বলল, নে, বসার ঘরে যা, সরোজদা এসেছে। অপ্রত্যাশিত প্রাপ্তির উদ্ভাস শশীর কণ্ঠস্বরে চাপা থাকল না– ও, তাই নাকি?
শশী দ্রুত সরোজের পাশে বিছানায় গিয়ে বসে। হারিকেনের আবছা আলোতে সরোজ ওর মুখ পড়তে চেষ্টা করে। চায়ে চুমুক দিয়ে দেখল তা আর তেমন গরম নেই। বরং শশীর অনুপ্রবেশে সে বেশ গরম হয়ে ওঠে। শশী ওর দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করল, অনেকক্ষণ ধরে বুঝি বসে আছো?
–না এই বিশ মিনিট হবে। তা তুমি কোথায় গিয়েছিলে?
–এই একটু নদীর পাড় ধরে হাঁটলাম আর ভাবলাম।
–এ জায়গায় সন্ধ্যার পর কেউ বিশেষ হাঁটে না। বলা যায় না, হয়তো বিপদে পড়ে যেতে পার।
–মেয়েমানুষ বলে বুঝি বলছো?
–ঠিক তা না, আমাদের দেশেও তো এক ধরনের আন্দোলন, সন্ত্রাস, উগ্রতা এবং তোমাদের মুক্তির মানুষজন রয়েছে না? এমনকি পাকিস্তানি গুপ্তচরও থাকতে পারে। কিছু বলা যায় না। হঠাৎ করে আক্রমণ করে বসতে পারে।
–ওসব আমার দেখা হয়ে গেছে। পাকিস্তানি সেনাদের পর্যন্ত আক্রমণ করেছি আর অ্যাবরশনও করেছি একবার। আর এসব নিয়ে ভাবি না।
–শশী, এই যুদ্ধ এবং রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসে তোমাকে অনেক বেশি মূল্য দিতে হয়েছে তা আমি জানি। কিন্তু তার পরেও তোমাকে নিয়ে আমার ভাবনা হয়।
–সে কি করুণার ভাবনা।
–ছি ছি! কী বলছো!
–তাহলে?
–তোমার সাহসী কাজের জন্য তোমাকে আমার চুমু খেতে ইচ্ছে করে।
তৎক্ষণাৎ হেসে শশী বলে, খাও না কেন, আটকাচ্ছে কে?
সরোজ নিজের কানকে যেন বিশ্বাস করতে পারছিল না। কথাটি কি সত্যিই শশী বলছে? সে উঠে গিয়ে দু’হাতে শশীর মুখখানা তুলে ধরল।
শশী সরোজের চোখের দিকে তাকিয়েছিল। স্নেহকাতর অথচ রূপসী ভিখারির মতো ওর চোখ, যেন একটু আদরেই শরীর-মন সবকিছুই মোমের মতো গলতে থাকল। সরোজ ওর ঠোঁটে ঠোঁট রাখল এবং জীবনের মধু বিনিময়ে দু’জন দু’জনকে সজোরে চেপে ধরে। দু’জনের উষ্ণ নিঃশ্বাস এবং ঘামের গন্ধ দু’জনকেই আচ্ছন্ন করে ফেলে।
বাইরে দরজায় কড়া নড়ে ওঠে। শশী ছিটকে গিয়ে ওর শাড়ি ঠিক করতে থাকে। সরোজ তার পূর্বের চেয়ারে গিয়ে বসে। নিশি ঘরে আসতে থাকলে সরোজ বলতে থাকে, তুমি আর নিশি কিন্তু তোমাদের মানে পূর্ব দিনাজপুরের সংগঠন নবরূপীর কালচারাল প্রোগ্রামে যোগ দিতে পার। ওরা এখানেও মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে কাজ করছে। নিশি সরোজকে দেখল এবং সঙ্গে সঙ্গে শশীর দিকে মুখ ঘুরিয়ে বলল, সরোজ বাবু আরেক কাপ নিয়ে আসব?
সরোজ একধরনের অস্বস্তি নিয়ে বলল, তবে তো ভালোই হয়।
–আচ্ছা তাহলে চা করেই আনছি।
শশী কিছুই বলে না। পাথরের মতো কিছুক্ষণ খাটের ওপর বসে থাকে। সরোজ বলল, কী করে যে এমনটা হয়ে গেল!
হঠাৎ খুব কাছেই দুটো গোলাফাটার শব্দ শোনা যায়। এ কি ভারতীয় বাহিনীর গোলাদাগার গম্ভীর শব্দ? নাকি পাকিস্তানিরা বিমান আক্রমণ করছে? কিছুই ঠাহর করতে পারে না সরোজ। তারপর আবার একটা গোলাফাটার সঙ্গে সঙ্গে শশী চিৎকার আর উৎকণ্ঠা নিয়ে সরোজকে চেপে ধরে মুখ লুকায়। অন্যদিকে গোলন্দাজরা অজ্ঞাত কোনো স্থান থেকে পারদ রঙের শহরে গোলা ফেলেই যাচ্ছিল।

আরও পড়ুন

×