ঢাকা মঙ্গলবার, ১৪ জানুয়ারি ২০২৫

এক জনমে কত বদল

এক জনমে কত বদল

সেলিম আল দীন [১৮ আগস্ট ১৯৪৯–১৪ জানুয়ারি ২০০৮]

সমকাল ডেস্ক

প্রকাশ: ০৯ জানুয়ারি ২০২৫ | ২২:৪১

বাংলা ভাষার অন্যতম প্রধান নাট্যকার সেলিম আল দীন। অমিত প্রতিভাবান এই শিল্পী শিল্পের আঙ্গিকভেদে বিশ্বাস করতেন না। অদ্বৈত দ্বৈতাদ্বৈতবাদী সেলিম আল দীন শিল্পের সব  শাখাকে একীভূত করে তার নির্যাস পেতে চেয়েছেন। সেলিম আল দীনের দিনলিপিতে তার এই প্রয়াস স্পষ্ট। দিনলিপি থেকে কয়েক ছত্র পত্রস্থ হলো..

১৩ জুলাই ২০০৩ ইং
আজ ২৯শে আষাঢ় ১৩১৪। কাল রাতে খুব মজার একটা ঘটনা ঘটেছে। কিচেনে বাল্বের নিচে অদ্ভুত একটা প্রজাপতি ধরলাম। টিকটিকির হাত থেকে বাঁচবার মহৎ উদ্দেশ্য নিয়ে যথাসম্ভব আলতো হাতে প্রজাপতিটি ধরে ফেললাম। আলোর নিচে ডানা দেখে চোখ গলে যায়। একেবারে হীরামোতি প্রজাপতি। লালচে কানের মধ্যে স্বর্ণের দ্যুতি আবার ছোট ডানার ভেতর ময়ূর নীল। বোধ হয় মথ নয়। দিনের প্রজাপতি। ও হ্যাঁ-গায়ে বিচিত্র তিল ফোঁটা।
পারুলকে দেখালাম-কাজের ছেলে এমরানকে। তারপর কাজরীর ঘরে গিয়ে ওকে। জানালা দিয়ে সেটিকে ছেড়ে দিয়ে জানালা বন্ধ করে দেই পাছে আলোর আকর্ষণে ও না আবার ঘরে ফিরে আসে।
আজ ভোরে সেটি কি বেঁচে আছে তাই ভাবছি। কারণ ঘনবর্ষণ থামতেই ঘোলা আকাশের নিচে কাঁটা মেহেদির ঝোপে একটি ওর চেয়ে ছোটো মাপের প্রজাপতিকে মধু সঞ্চয়ে ডানার পাখা ওড়াতে দেখেছি।
পারুল চলে গেল টিচার্স ট্রেনিং-এ। কাজরী ঘুম থেকে উঠলো। রোদ উঠি উঠি করে।
ঘোলাটে আকাশ আমার মন খারাপ করে দেয়। তবু ভাবি প্রকৃতি যেমন তেমন আকারেই আনন্দিত মনে তাকে গ্রহণ করাটার অভ্যাস রপ্ত করা উচিত। কিন্তু পুরোটা নয়। মনুষ্য প্রকৃতি যে। সে কোনো না কোনো ভাবে তার ভালো লাগা মন্দ লাগার জায়গাটা তৈরি করে নেবেই। সেটা তার দুর্বলতা, সেটাই শক্তি। কিন্তু এই শক্তি প্রকৃতির বিনষ্ট ঘটালে পৃথিবীও হত্যাকারীর চোখে তাকায় মানুষের দিকে। হঠাৎ বন্যা-টাইফুনের সেই চোখ তো মানুষ আদিকাল থেকে দেখছে।
কিন্তু এখন তার আচরণ যথার্থরূপে মানুষের অমিত শক্তির অপচয়ের বিরুদ্ধে হুঁশিয়ারি।

 

না এভাবে ঢাকায় যাবার পথে এক কালের গতিময় তুরাগের বিশাল হ্রদ মাটি ভরাট করে হাউজিং সোসাইটি বানাবার কোনো মানে হয় না।
১৬.০৭.০৩
কাল সন্ধ্যায় আসাদের জন্মদিন পালিত হলো। সারাদিন খেটেখুটে যখন উৎসবে যাই তখন শরীর বেশ বিকল। তবে উৎসবের আনন্দের ঘাটতি ছিল না। ফেরার তাড়া ছিল বলে–ততক্ষণ থাকতে পারিনি–যতক্ষণ থাকলে সবাই খুশি হতো। বিভাগ থেকে-ছাত্রছাত্রীদের তরফ থেকে-আমার আর বর্তমান সভাপতি প্রিয়ভাজন রশীদ হারুণ-আরও সবাই নানা গিফট নিয়ে এসেছিল।
প্রচুর সিডেটিভ খেয়েও রাতে পাঁচ ঘণ্টার বেশি ঘুম হলো না। অথচ ডাক্তারের নির্দেশ ছয় থেকে সাত লাগবে। ফের সিডেটিভ খেয়ে যাচ্ছি শুতে। এর মধ্যে পারুল ট্রেনিং-এ চলে যাচ্ছে। ফিরবে সন্ধ্যাবেলা।
ভোর অন্ধকার থেকে পাঁচটার সিঁড়িতে মেঘগম্ভীর পা ফেলছে। ঘুম ভেঙে গেল। তার আলো নয়-আভায় সম-বিকীর্ণ গোলার্ধের এবং বাঙলাদেশীয় অংশ। পশ্চিমে উত্তরে দক্ষিণে পুবে-ঘন মেঘ।
দূরে উত্তরের আকাশে হয়তো তিন চার কুড়ি কবুতর পশ্চিম থেকে উড়ে গেল। জানালায় এই দৃশ্য হয়তো এসময়ে এ জন্মের মতো হয়তো প্রথম। তারপর লক্ষ্য করি আরো দূরে একদল পাখি।
ভোর। দীপ্তিহীন ভোর। তবু ওদের পালক ঢাকা বুকে এই আলো অন্ধকারের ভেতর আরো বেশি আলো দেখে। ওদের নাসারন্ধ্রে লেবু কচলানোর তীব্র সুগন্ধ জাগে। কিংবা মেঘ বাগানের কাঁঠালি চম্পার শাখায় ফুটন্ত ফুলের সুগন্ধ টানছে
ওদের।
আর তারপরও জানি-ওটা খাদ্য সংগ্রহের ওড়া। কিন্তু সে ওড়ায় মেঘের জলীয় বাষ্প ওদের ডানায় কতটুকু লাগলো সে ভাবতে বসি।
এমন ভোরের একটা বর্ণনা যৈবতী কন্যার মনের কোথাও আছে খানিকটা। সেখানে যাত্রাদল ছিল-লঞ্চ ছিল।
১৬.০৭.০৩
আষাঢ়ের পূর্ণিমা গিয়েছে চার পাঁচদিন আগে। এখন যা লিখছি শুধু সেদিন সন্ধেবেলার স্মৃতি। স্মৃতির একটা অদ্ভুত ব্যাপার আছে ভাঙ্গ-ভুঙ্গা আলো অন্ধকার, ফিকে রঙ তার। আগ গলুই পাছ গলুই নেই। খুব স্পষ্ট নয় তবু তা থেকে আনন্দ হর্ষ বেদনা শোকের বিচ্ছুরণ।

কিন্তু যেই লিখতে শুরু করলাম অমনি চাঁদটা পুব দক্ষিণে দিগন্তরেখার উপর লাফিয়ে উঠলো, লেকের ওপারে মেয়েদের হল, কেমন একটা প্রাচীন দুর্গের আভাস, ফিকে আলোর ছায়া, কিছু শারদীয় মেঘের মুখ এইসব জমা হতে হতে একটা স্পষ্টতা তৈরি করে।
চিত্রের চেয়ে তা মহৎ এই জন্য যে, চিত্রে সবটা আসে না আমার মনের ভাব ঐ ফটোগ্রাফির সাধ্য নেই যে ধরে।
এভাবে হোমারের পঙ্‌ক্তিমালা ইজিয়ান সাগর থেকে বঙ্গোপসাগরে বয়ে চলেছে। শাহনামার রণক্ষেত্রে ঘোড়ার খুরে ছড়ানো ধূলি মেঘে মেঘে। এভাবে ভাবনার মৃদু ঝরনা বয়ে যায় প্রাচীন দুর্গের ধার বেয়ে।
আহা, সেই পূর্ণিমা আজ আর নেই। সেই চকিত দেখার পথ চলতে চলতে। সুকি কি বেঁচে আছো বনপাংশুল জোৎস্নার নিচে। আর আমার সেই ময়ূরজানের কী খবর, যার সৌন্দর্যের খ্যাতি শুনে, এক স্কুল মাস্টার কি কৃষাণ যুবক বেরিয়ে পড়েছিল নৌকায়। সে লেখা কি এ জীবনে হবে না আর। হে আয়ুর অধিপতি বর্ধিষ্ণু করো, বর্ধিষ্ণু করো আয়ু। শুধু সেই সব লেখা লিখার জন্য, যা পৃথিবীর অগোচরে আমারি জন্য তুমি রেখে গিয়েছ।

১৭.০৭.০৩
আজ ভোর আটটায়। আমার লিখবার টেবিলের জানালার অদূরবর্তী হ্রদের জলের এককোণে মাছের পোনা-আলো আর হাওয়ার ভেতর খেলা করছিল। তারপর গোসল করতে গেলাম। সাবান পেস্ট ট্যাপের জলস্রোতের ভেতর থেকে হঠাৎ বলে উঠি–শুদ্ধ হও শুদ্ধ হও। নামতার মতো করে বলি। কিন্তু কেন। দৈনন্দিনের অপচ্ছায়া-যৌনতা-ক্লান্তি থেকে বেরিয়ে আসবার এ একটা আহ্বান। কেবলি নিজেকে নিজে শোনাবার জন্য। কিন্তু শুদ্ধ হও বলে-আমি ক্যাথিড্রলে ঢুকতে রাজি নই। সেখানে যিশুর মৃত্যুর চিরায়ত ভঙ্গিমা কিংবা অন্যত্র-শীঘ্রই বেহেশত পাবার প্রলোভন। এর মধ্যে মানুষ নিজেকে ইতোমধ্যে এতটা ছোট করে ফেলেছে। এক একজন ধর্মপ্রচারকের মুখ দেখলে মনে হয়–ঈশ্বর ছাড়া বাসনা নেই-স্বৰ্গ ব্যতিরেকে পাবার কিছু নেই। আমার নিজের শ্মশ্রু কি কর্তিত গুম্ফ-মুখটি মনে হয়। হায়রে-কী পাপ–এই পৃথিবীতে জন্মে কী যে একটা অপরাধ করে ফেলেছি।
ভোরবেলাতে উঠেই মোবাইল টেলিফোনে দুটো খবর পেলাম। একটা আমার সুইডিশ অনুবাদক ইয়াম আসবে ১৮.০৭.০৩ তারিখে, দু’নম্বর সম্ভবত দৈনিক ভোরের কাগজের লেখা।
সে লেখাটি রাষ্ট্রের ধারণা ও রাষ্ট্রের ভাঙন বিষয়ে। আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগে প্রবন্ধটি পড়বার প্রস্তাব দেয়া হলে ওরা খুব উৎসাহ দেখালো। পরে জানতে পারি–ওখানে যে কয়জন শিক্ষক আছেন তারা দ্বিধাবিভক্ত। ইনি বলছেন এ তারিখের মধ্যে হলে ভালো আর একজন বলছেন না তার আগে। এই দ্বিধান্বিত পঠন তারিখ নিয়ে বেশ বিব্রত বোধ করছে।

১৮.০৭.০৩ ইং
শ্রাবণ এসেছে। আজ তার তেসরা। ছোটোবেলা থেকে প্রকৃতির সঙ্গে আমার একটা গভীর সম্বন্ধ ঘটেছে বলে এই বয়সেও বিশ্বাস করি। সপ্তম কি অষ্টম শ্রেণিতে পড়বার সময়। ঋতু দিন এবং প্রতিদিনের আবহাওয়ার উপর খুব মনোযোগ দিতাম। দেবার কারণটা ব্যক্তিগত-মাঠে খেলতে যেতে পারবো কিনা–স্কুলে পৌঁছাতে পারবো কিনা। আর উপকূলীয় সেই সব খ্যাতিমান ঝড়।
এইসব দেখে দেখে বুঝতে পারি-কোনো কোনো বছর শ্রাবণেই শরৎ উঁকিঝুঁকি দেয়। বিশেষত বাঙলা মাসের মধ্যভাগে পরবর্তী মাসের প্রস্তুতিটা শুরু হয়ে যায়।
আজ তেসরা শ্রাবণ। পৃথিবীর বুকের উপর দিয়ে কত ঋতু বয়ে গেছে। মানুষেরা ব্যক্তিগতভাবে কোনো এক ঋতুতে মুখ থুবড়ে পড়েছে। তবু তার চাকা বন্ধ হয় নাই। একটা কঙ্কাল কাঠামোর উপর স্নায়ু মগজ মাংসের অপূর্ব গড়ন, তার মধ্যে যাই করি সে তো লীলা। লীলার ভেতর আছে বিস্ময় ও ক্ষণিক দ্যুতি-যদিও তার ক্রিয়া বহমান। তারপর সেই মাংস ঝরে যাবে-দুইটা চোখ গলে যাবে পচনের ঘন অন্ধকারে।
তবু তো আজ তেসরা শ্রাবণ। ভোর সাতটায় ঘুম ভেঙেছে। ঝলমলে মাজা পিতলের কলসে আলো ঠিকরে পড়া আলো।
কয়েকটি শাদাটে মেঘের রেখা। আর কি অবাক-আকাশে আকাশে ভোরের স্নিগ্ধতার মধ্যে লিখতে ঘোলাটে মেঘের আলো লেখার উপর এসে পড়েছে।
তবে পাঠ করো ভোর। এইসব লেখার ভেতর আমার আনন্দ-উপলব্ধি সব তো তোমারই প্রশস্তি। পাঠ করো।
আমার টেবিলটা ইন্দ্রনীল পুষ্পগুচ্ছে ভরে দাও। ভরে দাও না হে আকাশ।

২০.০৭.০৩ ইং
ভোর। শ্রাবণের ভোর। আকাশে কিছু মেঘ তবু নীলে রৌদ্রে মিলেমিশে শরৎ ভোরের আভাস নিয়ে আসে। শিউলি তুমি কতদূর এলে। শিকড়ে এসেছো তো জলাশয়ের আঁচলে তেমনি বৃক্ষরাজির নকশি ছায়া মৃদু কম্পন।
গেলো বৎসর শরত ও হেমন্তে দেখা সেই মাছরাঙা কি সেই দৃশ্যগুলা মনে আসে। যা লিখিনি খাতায়, যা লিখেছি। সব মিলিয়ে সেদিন আর আজ আমার মনের ভিতর উচ্চারিত এই স্তোত্রগুলি পাঠ করছে–

২১.০৭.০৩ ইং
শুভ দিনের আলোয় কল্লোলিত নদী বহে যায়
প্রভু পৃথিবীকে আরও শুভ্র করো
কেননা অসীমতা যেই দিকে ব্যাপ্ত সেই দিকে
তোমার বিচ্ছুরণের আরম্ভ।
অনন্ত আকাশের নিচে উঁচু নিচু মৃত্তিকার উপর
এই স্ত্রোত্র পাঠ করি প্রভু-তোমার সূর্য কিরণ
শ্রাবণপুষ্ট নদী স্রোতে যে বিচ্ছুরণ রচনা করেছে
তার দিকে তাকিয়ে চোখে আসুক আনন্দ প্লাবন।
বিশাল আকাশের ঐ বলয়ে ঘুরতে থাকা
সৌরজগতের তুলনায় নিতান্ত তুচ্ছ এই গ্রহে তবে
কি করে অনন্তের আভাস রচিত হলো।
পাখিরা গান করলো কৃষ্ণচূড়া কাঁঠাল সেগুন বনে
এই স্তোত্র গ্রহণ করে আমার কবির অন্তর থেকে
উচ্ছিত দেবদূতগণ যেন পাঠ করে।
: দাও পৃথিবীর অনন্ত যৌবন-নদী-বৃক্ষ-মানব
পুষ্ট হোক ভোরের আলোয়।
গত রাত্রির দুঃস্বপ্ন-কাম ঘাম ধুয়ে যাক
স্বচ্ছ জলের ধাবমান স্রোতে কেননা আমরা
অবগাহন করে উঠে এসেছি এই খোলা মাঠে
তোমার বয়ন করা অজানা অনন্তের দিকে... [অসমাপ্ত]
মুখ করে। সমবেত স্বরে।
আবার ঘন হয়ে নামুক বৃষ্টি। আকাশ কালো হোক
পরিপূর্ণ শ্রাবণের আনন্দে
রোদ ও মেঘের এই বিপরীত খেলায় মুগ্ধ হোক
মুগ্ধ হোক পৃথিবীর সকল মানুষের চোখ।।

 

আরও পড়ুন

×