ঢাকা মঙ্গলবার, ১৪ জানুয়ারি ২০২৫

রহস্য গল্প

জিনাত মহল

জিনাত মহল

প্রচ্ছদ :: আনিসুজ্জামান সোহেল

ধ্রুব এষ

প্রকাশ: ০৯ জানুয়ারি ২০২৫ | ২২:৪৭ | আপডেট: ০৯ জানুয়ারি ২০২৫ | ২২:৪৭

রহস্যময়ী জিনাত মহল। তাকে আমি একবার মাত্র দেখেছি। কবি শাদাব কালামের বাসায়। কবিপত্নী অতিথিপরায়ণা শত্রু-মিত্র কেউ বলবে না। সেদিন যা ঘটেছিল সেটা ব্যতিক্রম। কবিপত্নী স্বয়ং চা বিস্কুট দিয়ে আপ্যায়ন করেছিলেন অতিথিবৃন্দকে। অতিথি জিনাত মহল, সাইড অতিথি আমি, বেরসিকের মতো সেই সকালে কবির ড্রয়িং রুমে উপস্থিত হয়েছিলাম। কবি বিরক্ত হয়েছিলেন। বিরক্তি প্রকাশ করেছিলেন, ‘আজ আমি নরসিংদী যাব। কবিতা পাঠের অনুষ্ঠান আছে। নরসিংদীর তরুণ কবিরা ধরেছে।’
‘কখন যাবেন? নরসিংদী। নরসিংদীর বাজির মোড় এলাকায় আমার বন্ধু আলতাফ কারিগর থাকে। নরসিংদী গার্লস হাইস্কুলের মিস্ট্রেস রোকেয়া জান্নাত বীথির হাজব্যান্ড আলতাফ কারিগর স্বর্ণ ব্যবসায়ী। বাজুসের মেম্বার। বাংলাদেশ জুয়েলারি সমিতি। উনি কে চিনলাম না কবি।’
‘কেন? তোমার কি চেনার কথা নাকি? পৃথিবীর সব মানুষকে তুমি চেনো? সেনেগালের নোরোং টুরডুকে চেনো? কাতারের মুস্তফা আল ফায়েদকে চেনো?’
মানীর মান খোদায় রাখে/ ছাগলের গলায় বান্ধা থাকে। আগা মাথা ছাড়া প্রবাদ। ছাগলের গলায় মান বাঁধা থাকবে কেন? মানপত্র বাঁধা থাকতে পারে।– সর্বসহায় হলেন মহিলা, ‘ইয়াং ম্যান আমি জিনাত মহল। কবির একজন অনুরাগিণী।’
‘থ্যাঙ্ক ইউ ম্যাম। আমি ফারুক। টাকিলা ফারুক। আমার বন্ধু আছে মারলোবোরো শাকিল। আমরা বাংলা কবিতার এসকর্ট।’
‘আই সি!’
কবি চেতলেন, ‘এসকর্ট! তোমরা বাংলা কবিতার নাইটগার্ড ফারুক! খাকি হাফপ্যান্ট পরা নাইটগার্ড!’
জিনাত মহল প্রগলভা হলেন, ‘কী বলো তুমি শাদাব? এই ছেলে, মুয়াম্মার ফারুক, তুমি তাকাও, এদিকে তাকাও।’
এদিকে কোনদিকে? আমি জিনাত মহলের দিকে তাকালাম। তাকিয়ে থাকলাম। বয়স কত হবে জিনাত মহলের? বেয়াল্লিশ-তেতাল্লিশ। সাদা রঙের জামদানি শাড়ির সঙ্গে ময়ূর নীল রঙের ব্লাউজ পরেছেন। হীরার নাকফুল। আর কোনো গহনা পরেন নাই।–গর্জিয়াস।
‘জিনাত!’
জিনাত একটা ডিম যদি হয় সেই ডিম ফাটল। কবি ফাটালেন। নিঃসন্তান বয়স্ক মানুষ, অসুখী দাম্পত্য, কাক কোকিল বিচার না করে কবি ডিমে তা দিতে বসেন।
‘ইফ ইউ ডোন্ট মাইন্ড ইয়াং ম্যান, তোমার বয়স?’
‘ম্যাম, ছাব্বিশ।’
‘দ্যান আর দুই বছর, ওকে? দেশে কিছুদিন থাকছো না তুমি।’
কী বলে রে! দেশে থাকব না? পাসপোর্টই নাই আমার।
‘বিদেশ থেকে ফিরে বিয়ে করবে তুমি। যাকে বিয়ে করবে তার নামের প্রথম অক্ষর হবে সম্ভবত ঝ। বাংলা শ-ও হতে পারে। তোমাদের মেয়ে হবে। আটবার চেষ্টা করলে আট মেয়ে হবে। তবে তুমি এটা করবে না।’
ভবিষ্যদ্বাণী?
মাথায় থাকে?
জিনাত মহলের সঙ্গে আমার আর কখনও কোথাও দেখা হয় নাই। দুই বছর পর আমি আমেরিকার আইওয়া গেলাম লেখক কর্মশালায়। দেশে ফিরে বিয়ে করলাম আরমিন নাওয়ারকে। বড় আপা, মেজ আপার তত্ত্বাবধানে। আরমিন নাওয়ারের ডাক নাম শশী। ঝ দিয়ে বা শ দিয়ে।
শশী কনসিভ করল। মেয়ে বিয়োলো।
শশীর মেয়ের নাম হলো কাইতান। কার্তিকের বৃষ্টিকে বলে কাইতান। ঘোর এক কাইতানের দিনে জন্ম কাইতানের। তাই বলে কাইতান নাম রাখতে হবে বেচারির?
শশী বলল, ‘আমি রাখলাম।’
আর কথা কী?
শশীর কাইতানকে দেখে কে এখন? চার বছর বয়স এখন কাইতানের। কথা বলতে শিখে গেছে বাচ্চা। বড় আপা তার বড় আম্মা, মেজো আপা মেজো আম্মা। দুই আম্মার সঙ্গে থাকে সারাদিন। কুটুর কুটুর করে কথা বলে দুনিয়ার। বড় ভাই হলেন বড় আব্বা। আমেরিকার মিনিয়াপোলিসে থাকেন। মোবাইল ফোনে বড় আব্বার সঙ্গে কথা বলে কাইতান। ক্রিসমাসের পরদিন বলেছে, ‘বড় আব্বা, সান্তা তোমাকে নিকস দিয়ে যায় নাই?’
‘না গো আম্মা।’
‘কেন? সান্তা কি আসে নাই? স্নো পড়ছিল বুঝি তোমাদের ওখানে?’
‘তা পড়ছিল। সান্তাও এসেছিল। আমি তো স্নো পড়ছে বলে তিনটা কম্বল গায়ে দিয়ে ঘুমিয়েছিলাম। সান্তা সেই কম্বল উঠিয়ে আমার মুখ দেখেই দৌড় কী দৌড় রে–!’
‘কী? হি হি হি! কেন বড় আব্বা? হি হি হি! সান্তা তোমাকে দেখে আরেক সান্তা মনে করেছে বলো?’
বড় ভাই শ্বেতশুভ্র দাড়ি-গোঁফমণ্ডিত ব্যক্তি। সান্তা ক্লজ মনে করাই যায়।
মায়ের কথা কখনও মনে পড়ে কাইতানের? মা সম্পর্কিত কী কী স্মৃতি তার মগজে সঞ্চিত আছে, যা সে মনে করতে পারে না? করোনা এপিডেমিকের আগে জন্মেছে। মাকে পেয়েছে আট মাস ছয় দিন। আরমিন নাওয়ার শশী করোনায় থাকে নাই।
জিনাত মহলের কথা আমার এর মধ্যে মনে পড়েছে অনেকবার। সুইডেনে থাকেন মহিলা। ফেসবুকে নাই, ইনস্ট্রাগ্রামে নাই। গুগলে সার্চ দিয়ে পাই নাই। গল্পকার আনিসুর রহমান সুইডেনের উপসালা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক। জিনাত মহল আনিস ভাইয়ের পরিচিত এবং পারিবারিক সম্পর্ক তাদের। মহিলার মোবাইল ফোন এবং হোয়াটসঅ্যাপ নাম্বার দিলেন আনিস ভাই। হোয়াটসঅ্যাপ নাম্বার এক্সপেক্ট করলেন না মহিলা। ফোনে কল দিলাম। ধরলেন।
‘ম্যাম আমি বাংলাদেশ থেকে বলছি। আমার নাম মুয়াম্মার ফারুক। আমি একজন কবি।’
‘আই সি, মুয়াম্মার ফারুক। আপনার জন্য আমি কী করতে পারি?’
‘ম্যাম আপনার সাথে আমার একবার দেখা হয়েছিল পুরানা পল্টন লাইনে। কবি শাদাব কালামের বাসায়। আপনি আমাকে কিছু কথা বলেছিলেন–।’
‘সরি মিস্টার মুয়াম্মার ফারুক। কবি শাদাব কালামের কথা কি বলেছেন? তার বাসায় আমি কোনোদিন যাই নাই।’
‘আট বছর ম্যাম, না নয় বছর, নয় বছর আগের এক সকালের কথা বলছি। আপনি সাদা রঙের জামদানি আর ময়ূর নীল রঙের ব্লাউজ পরেছিলেন। আমাকে বলেছিলেন দুই বছরের মধ্যে আমি বিদেশ যাব। বিদেশ থেকে ফিরে বিয়ে করব। আমার ওয়াইফের নামের আদ্যাক্ষর হবে বা হতে পারে ঝ। আমাদের মেয়ে হবে।’
‘আমি এসব বলেছি, মুয়াম্মার ফারুক? আমি কি ক্লেয়ার ভয়েন্ট? ফোরটেলার? নাকি জ্যোতিষী? অ্যাস্ট্রোলজার? আপনি নয় বছরের কথা বলছেন, পারিবারিক ডিজাস্টারের কারণে গত উনিশ বছর ধরে আমি দেশে আসি না ভাই। শাদাব কামালের বাসায় যাব কীভাবে? আপনার সঙ্গে দেখা হবে কীভাবে? দেখা হলে আমি কেন ফোরটেলারদের মতো কথা বলব, বলেন?’
‘ম্যাম, আমি সে সময় টাকিলা ফারুক নামে কবিতা লিখতাম। আপনাকে বলি নাই আমার প্রকৃত নাম মুয়াম্মার ফারুক। কবিও আমার সামনে সেটা আপনাকে বলেন নাই। কিন্তু আপনি আমাকে কয়েকবার মুয়াম্মার ফারুক সম্বোধন করেছিলেন।’
‘কীভাবে? আপনার সঙ্গে তো আমার দেখাই হয় নাই। আচ্ছা আপনি ফ্রড না তো মিস্টার মুয়াম্মার ফারুক?’
আনিস ভাই কি জিনাত মহলের একটা ছবি আমাকে পাঠাতে পারেন? না। জিনাত মহল কঠিন প্রাইভেট পারসন। বলতে গেলে লোকচক্ষুর আড়ালে বসবাস করেন। বহুদূরে থাকেন উপসালা থেকে। তবুও একটা চেষ্টা করলেন আনিস ভাই। বারো-চৌদ্দজনের একটা গ্রুপ ছবি ম্যানেজ করে পাঠালেন। মাঝখানের জন, তার ডানদিকের জন, তার ডানদিকের জন জিনাত মহল। সাদা রঙের জামদানি শাড়ি, ময়ূর নীল রঙের ব্লাউজ পরে আছেন। গর্জিয়াস। এই মহিলার সঙ্গে আমার কোনোদিনই দেখা হয় নাই?
কাইতান বড় হয়ে যাচ্ছে। বড় আপা, মেজো আপা আদাজল খেয়ে লেগেছে।
‘কাইতানের দায়িত্ব আমাদের। তুই সারাজীবন একা থাকবি ভাই?’
দুই বছর আগে মনে হতো থাকব। দেড় বছর আগে মনে হতো থাকব। এক বছর ধরে আর মনে হয় না। শশীকে যদিও ভুলি নাই, ভুলব না। কিন্তু আমার একজন মানুষ তো দরকার। জিনাত মহল যদি সেই আরেকজনের নামের প্রথম অক্ষর বলে দিতেন সেদিন?
ছ বা ঈ?
য বা ণ?
ক বা ছ?
কলোনির মম আপার দূর সম্পর্কের এক ননদকে এবার খুবই মনে ধরেছে বড় আপার। রংপুরের সেই মেয়ে কারমাইকেল কলেজে পড়ে। লম্বা আছে, চাপার দিকে রং, মিষ্টি মুখটা– আমার সঙ্গে মানাবে। তার নাম কী?
জিনাত মহল। v

 

আরও পড়ুন

×