ঢাকা মঙ্গলবার, ১৭ জুন ২০২৫

মোহ কাঠের নৌকা: বাস্তবতার এক প্রতিচ্ছবি

মোহ কাঠের নৌকা: বাস্তবতার এক প্রতিচ্ছবি

.

উমর শরীফ সোহাগ

প্রকাশ: ২৫ এপ্রিল ২০২৫ | ০০:১৮

‘মোহ কাঠের নৌকা’ উপন্যাসে আধুনিক সমাজের জটিলতা, পেশাগত টানাপোড়েন, ব্যক্তিগত সংকট ও মূল্যবোধের অবক্ষয়ের বাস্তব চিত্র উঠে এসেছে।
কেন্দ্রীয় চরিত্র রবীন গ্রাম থেকে শহরে এসে উচ্চশিক্ষা শেষে এক অখ্যাত অনলাইন সংবাদমাধ্যমে যোগ দেয় বড় স্বপ্ন নিয়ে। বাস্তবতা তাকে হতাশ করে তোলে। অফিসের রাজনীতি, অনিয়মিত বেতন ও ভবিষ্যৎ অনিশ্চয়তা তাকে এক ধরনের পেশাগত দুঃখবোধে ফেলে। এ ছাড়া রবীনের জীবনে একের পর এক সংকট আসে– নিজের একাকিত্ব, পরিবারের সঙ্গে দূরত্ব, সম্পর্কের টানাপোড়েন এবং সমাজের নানা অসংগতি। একসময় তার পরিচয় হয় জলি নামে এক মেয়ের সঙ্গে, যার বাবা গুমের শিকার। জলি চরিত্রের মাধ্যমে লেখক তুলে ধরেন গুম হওয়া পরিবারের কষ্ট, অনিশ্চয়তা ও অবহেলার যন্ত্রণা। অন্যদিকে, গ্রামের স্মৃতি রবীনের মনে গভীরভাবে গেঁথে থাকলেও বাস্তবতা সেখানে গিয়ে বদলে গেছে। বিদেশের অর্থে বদলে যাওয়া গ্রামীণ সমাজ, পারিবারিক মূল্যবোধে পরিবর্তন এবং দৃষ্টিভঙ্গির পার্থক্য তাকে আরও ব্যথিত করে তোলে। রবীনের জীবনে আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র রুবি– এক ব্যাংক কর্মকর্তা, যে নিজেও জীবন সংগ্রামে এগিয়ে এসেছে। রুবির মা চায় রবীনের সঙ্গে তার মেয়ের বিয়ে হোক। সম্ভবত রুবিও তা চায়। জীবনের নানা দোলাচলের মধ্যে রুবিই রবীনের জীবনে একমাত্র স্থিরতার প্রতীক হয়ে ওঠে। প্রশ্ন থেকে যায়, রবীন কি পারবে এই ‘মোহ কাঠের নৌকা’য় উঠে জীবনের নিরাপদ তীরে ভিড়তে? নাকি বাস্তবতার ঢেউ সেই নৌকাকে ডুবিয়ে দেবে?
রবীন: রবীন একজন স্বপ্নবান যুবক, যে সাংবাদিকতা দিয়ে সমাজে কিছু পরিবর্তন আনতে চায়। চারপাশের বাস্তবতায় ধীরে ধীরে তার ভেতরের স্বপ্নগুলো নিঃশব্দে ভেঙে পড়ে। রবীনের চরিত্রে দেখা যায় একজন সাধারণ ছেলের ভেতরের গভীর অনুভব, লড়াই আর স্বপ্নভাঙার হতাশা। সে জীবনের কাছে হেরে গিয়েও চুপচাপ বাঁচতে থাকে– যেমনটা করে অসংখ্য বাস্তব মানুষ।
রুবি: রুবি একজন সফল নারী– প্রাইভেট ব্যাংকের কর্মকর্তা। প্রেম, পারিবারিক টানাপোড়েন আর অতীতের জটিল স্মৃতি তাকে সব সময় তাড়া করে। মা অনেক ত্যাগে তাকে গড়েছেন, কিন্তু সেই মাও অসুখী। রুবির চরিত্রে উঠে এসেছে নারীর আত্মত্যাগ, গভীর আবেগ, জীবনের এমন অনিশ্চয়তা; যা মানুষকে ভেতর থেকে ভেঙে দেয়।
মানবসমাজের সহজাত প্রবণতা হলো, আমরা সত্যের মুখোমুখি হতে চাই না। আমরা চোখ ফিরিয়ে নিতে চাই কঠিন বাস্তবতা থেকে। অথচ    ‘ মোহ কাঠের নৌকা’ সেই তেতো সত্যের মুখোমুখি দাঁড় করায়। এই উপন্যাস কেবল একটি গল্প নয়, বরং আমাদের সময়, সমাজ এবং সম্পর্কের এক নির্মোহ আয়না। এদের মধ্য দিয়ে সমাজের মধ্যবিত্ত মানসিকতা, অতিমাত্রায় আত্মমর্যাদা বোধের চাপ এবং সম্পর্কের টানাপোড়েন অত্যন্ত সাবলীলভাবে ফুটে উঠেছে। লেখক এই উপন্যাসে একটি সময়কে ধরার চেষ্টা করেছেন যেখানে শহর ও গ্রামের দ্রুত পরিবর্তনশীল সমাজব্যবস্থা, আর্থসামাজিক অসংগতি, রাজনৈতিক বাস্তবতা এবং ব্যক্তিগত জীবনের অস্থিরতাগুলো একসঙ্গে চিত্রায়িত হয়েছে। 
সময়ের এই চলমান প্রবাহে লেখক সম্পর্কের জটিলতা নিয়েও অত্যন্ত সংবেদনশীল একটি মন্তব্য রেখেছেন– ‘আশ্রয়হীন মানুষরা আশ্রয়ের তিল পরিমাণ সন্ধান পেলেই ভুলে যায়, সব আশ্রয় তার জন্য ইতিবাচক নাও হতে পারে।’
এই বাক্যটিই যেন উপন্যাসের সারকথা হয়ে ওঠে। বাস্তবতা ও অনুভূতির দ্বন্দ্বে মানুষের ভেতরের একাকিত্ব, অস্থিরতা ও টিকে থাকার লড়াই– সবই মূর্ত হয়ে উঠেছে এই উপন্যাসে। এ ধরনের বাস্তবভিত্তিক উপন্যাস পাঠকের কাছ থেকে কিছুটা ধৈর্য দাবি করে। কারণ– এখানে রোমাঞ্চ নেই, নেই চমকজাগানো মোড়। অনেকটা যেন নিরবধি বয়ে চলা নদীর মতো, যার স্রোতের গভীরতা উপলব্ধি করতে হয় ধীরে ধীরে। মনে হয়েছে, ‘মোহ কাঠের নৌকা’ শুধু উপন্যাস নয়, এটি সমাজের বিবেকের কাছে একটি প্রশ্নপত্র– যেখানে এই সমাজে কি সত্যিই কারও নিজেকে গুছিয়ে নেওয়ার নৌকা আছে, নাকি বাস্তবতার ঢেউয়ে সবকিছুই তলিয়ে যায়?
যারা বাস্তববাদী সাহিত্য, সাংবাদিকতার ভেতরকার জটিলতা কিংবা সমাজের দ্রুত পরিবর্তনের অভিঘাত নিয়ে ভাবতে ভালোবাসেন, তারা এই উপন্যাস পাঠে গভীর আনন্দ পেতে পারেন। 

আরও পড়ুন

×