ঢাকা রবিবার, ২৫ মে ২০২৫

বাবার জন্মদিন ও শূন্যতা

বাবার জন্মদিন ও শূন্যতা

হুমায়ূন আজাদ [২৮ এপ্রিল ১৯৪৭–১২ আগস্ট ২০০৪]

মৌলি আজাদ

প্রকাশ: ২৫ এপ্রিল ২০২৫ | ০০:২৩

গত বছরের সেপ্টেম্বরে মাকে হারানোর পর এখনও স্বাভাবিক হতে পারিনি আমি। বাবাকে হারিয়েছি ২১ বছর আগে। তাঁর মৃত্যুর ঠিক ২০ বছর পর মাকেও হারালাম। এখন আমার মা-বাবা কেউ রইল না। হয়ে গেলাম এতিম। তাই আমার দিনগুলো এখন বড্ড ফ্যাকাশে। জীবনের প্রয়োজনে কাজ চালিয়ে নিচ্ছি, কিন্তু মনের ভেতরে হাহাকার, শূন্যতা। অনেকে আমাকে এ পরিস্থিতিতে নানা কাজে জড়িয়ে নিতে বলছেন। আমার ভেতরের পুরোনো সেই ইচ্ছে, শক্তি, উদ্যম সব যেন শূন্যের কোঠায় এসে নেমেছে। এরই মধ্যে সমকাল পত্রিকার সাহিত্য পাতার মাহবুব আজীজ ভাইয়ের ফোন পেলাম। বাবার জন্মদিনে তাঁকে নিয়ে কিছু লেখার নরম অনুরোধ জানালেন তিনি। ভাবলাম তাহলে বাবাকে নিয়ে কিছু লিখেই বরং নিজেকে ব্যস্ত রাখি। 
জন্মদিন মানে হলো আনন্দ/আনন্দের নানা স্মৃতি মনে পড়া। পেছন ফিরে তাকিয়ে এই প্রথমবার মনে হলো ২১ বছরে বাবার চেহারা আমার চোখের সামনে ঝাপসা হয়ে আসছে যেন। তাই বাসার দেয়ালে ঝোলানো বাবার ছবির পাশে এসে দাঁড়াই। বড় বড় চশমার ভেতরে তাঁর মেধাবী দুটো চোখ, মুখে লেগে রয়েছে স্মিত হাসি। মাথাভরা কোঁকড়ানো চুল। পরনে সাধারণ গেঞ্জি-শার্ট। কতদিন মানুষটাকে দেখি না। আর দেখবও না কোনোদিন।
তিনি অনেকের কাছে বাংলাসাহিত্যের পণ্ডিত ব্যক্তি। কারও কাছে জ্ঞানী শিক্ষক হিসেবে পরিচিত। কেউ তাঁকে বলেন বড্ড ঠোঁটকাটা লোক ছিলেন তিনি। তাঁর নামের আগে নন্দিত-নিন্দিত সব রকম উপাধিতে ভরা থাকে। আমার কাছে কেবলই তিনি আমার বাবা। কত যে স্মৃতি! আসলেই কি অনেক স্মৃতি?
আমার জীবনের মাত্র ২৭ বছর তাঁকে পেয়েছি আমি। ২৭ বছরে বাবাকে দেখেছি বাইরে ভীষণ রাগী, কিন্তু ভেতরে ছিলেন প্রচণ্ড অনুভূতিশীল একজন মানুষ। আমাদের তিন ভাইবোনের পড়াশোনার দিকে খেয়াল রাখতেন খুব। তাঁর কাছে পড়তে চাইতাম না। ভীষণ বকা খেতাম। ছোটবেলায় বাবার কাছে ‘নামতা’ পড়া দেওয়ার আগে মনে হতো এখনই যদি পৃথিবীর শেষ সময় হয় তাহলে বেশ হয়! কৈশোরে যখন বিকেলে বাইরের দিকে মন থাকত তখনই বাবার সেই গলা শুনতাম– ‘মৌলি, ইংরেজি গ্রামার বইটা নিয়ে আয়।’ তখন রাগ লাগত। আর আজ বিকেলে মৌলি বলে ডাকার সেই মানুষটা নেই। এসএসসি, এইচএসসি, এমনকি এলএলএম পরীক্ষা দিয়ে হল থেকে বেরিয়ে এলে দেখতাম বাবা পরীক্ষা হলের গেটে দাঁড়িয়ে আছেন। আমাদের ভাইবোনের ভালো ফলাফল হলে তিনি নিয়ে যেতেন শেরাটন হোটেলের বুফেতে। দু্‌ই-একবার বন্ধুদের জন্য আমি তাঁর সঙ্গে খেতে যেতে পারিনি। আজ তা বড্ড মিস করি। একবার বইমেলায় বন্ধুদের সঙ্গে গিয়েছিলাম, কিন্তু তাঁর সঙ্গে আগামী প্রকাশনীর স্টলে দেখা করিনি। তিনি তাতে খুব রাগ করেছিলেন। মা বলেছিলেন, ‘তুমি দেখা না করায় তোমার বাবা বড্ড কষ্ট পেয়েছেন।’ আমি তখন কষ্টটা বুঝতে পারিনি, আর আজ তা ভেবে কাঁদি। 
লিখতে বসে এত কান্না পাচ্ছে, ভুলেই গেছি যে বাবার জন্মদিন উপলক্ষে লেখা লিখছি। 
মনে আছে, আমাদের বাসায় অনেক লেখকের জন্মদিন আয়োজনের পরিকল্পনা হতো কিন্তু বাবা নিজের জন্মদিন উদযাপনে উৎসাহী ছিলেন না। সাদামাটাভাবে বাসায় আমাদের মা তাঁর জন্মদিন আয়োজন করতেন। জন্মদিনে অতিথি হিসেবে আসতেন আগামী প্রকাশনীর কর্ণধার ওসমান গনি চাচা ও বাবার কিছু ভক্ত। তিনি বেঁচে ছিলেন মাত্র ৫৭ বছর। ৫০তম জন্মদিনে তিনি প্রকাশ করেছিলেন বই– ‘বহুমাত্রিক জ্যোতির্ময়’, যার 
উৎসর্গে তিনি বলেছেন– ‘উদ্ভিদ পতঙ্গ পাখি নক্ষত্র জলধারা কুয়াশা জ্যোৎস্না রোদ অন্ধকার গ্রন্থ নারী-পুরুষ যাদের ভালোবেসে ভালোবাসা পেয়ে বেঁচে আছি পঞ্চাশ বছর।’ সে বছরেই চ্যানেল আই বাবাকে নিয়ে একটি অটোবায়োগ্রাফি তৈরি করে। বাবা রাজিও হলেন। অনেকে বলেছিলেন, এত তাড়াতাড়ি অটোবায়োগ্রাফি (ডকুমেন্টারি) করার কী আছে? লেখককে নিয়ে অটোবায়োগ্রাফি তৈরি হয় অনেক বয়স হওয়ার পর। বাবা কি কারও কথা শুনতেন? তিনি চ্যানেল আইয়ের অনুরোধে রাজি হলেন। তাঁর প্রিয় জায়গা রাড়িখাল গ্রাম আর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় তাঁর নানা কথা, কবিতা, ভবিষ্যতের ইচ্ছে ডকুমেন্টারিতে তুলে ধরা হলো। আজ মনে হয়, সেদিন যদি তিনি রাজি না হতেন তবে তাঁকে আজ যে অবসরে ডকুমেন্টারির মাধ্যমে তাঁকে দেখি/তাঁর গলার স্বর শুনি– তা তো আমার সম্ভব হতো না? ধন্যবাদ চ্যানেল আইকে।
মা বেঁচে থাকতে বাবার জিনিসপত্র তিনিই গুছিয়ে রাখতেন। মা চলে যাওয়ার পর বাবার রেখে যাওয়া জিনিসপত্রগুলো নেড়েচেড়ে দেখার আবার ইচ্ছে হলো। আলমারির বেশ কয়েকটি ড্রয়ার খোঁজার পর কয়েকটি জিনিস পেলাম, যা আগে আমার চোখে পড়েনি। দেখলাম, বাবার মানিব্যাগে শেষ রেখে যাওয়া টাকাগুলো মা সেভাবেই রেখে দিয়েছেন। কয়েকটা ১০০ টাকা (পুরোনো নোট), ২ টাকা, ৫ টাকার নোট মানিব্যাগে। এসব নাড়াচাড়ার সময় বুকের ভেতরটা কেমন যে দুমড়েমুচড়ে যাচ্ছিল, তা বলে বোঝাতে পারব না। কয়েকটি কাগজ নাড়ার পর পেলাম তাঁর হাতে লেখা দুটো ভিউকার্ড। কেন এই দুটো লেখা কাগজ আমার আগে নজরে আসেনি? একটি ভিউকার্ডে তিনি তাঁর ক্লাসের সময়সূচি লিখেছেন। ‘৪১২ অনুশীলনী, ২৫/১/৮৯, বুধবার, দুপুর ২টা, কক্ষ ২০২৭। খাতা জমা ৬/১/৮৯, ১টায়, সোমবার।’ ভিউকার্ডটির দিকে তাকালে মায়া লাগে। তাঁর সেই সুন্দর হাতের লেখা আর গোছানো কাজ। এরপর যেটা পেলাম সেটা খুব ইন্টারেস্টিং। চিঠিটি তিনি আমার বড় খালা শামসুন নাহার গফুরকে এডিনবরা থেকে লিখেছিলেন। চিঠির কথা হলো, ‘আশা করছি আপনি এবং সবাই ভালো আছেন। কয়েকদিন আগে আমি পূর্বের হল ছেড়ে দিয়েছি। নতুন ঠিকানা দিলাম। যদি চিঠি লিখেন, তবে এ ঠিকানায় লিখবেন। আশা করছি আমার গত চিঠি পেয়েছেন এবং প্রস্তাবটি মেনে নেবেন। হুমায়ুন।’ ঘরের ভেতরের মানুষ না হলে বোঝা যায় না চিঠির অর্থ। তবে বুঝতে পারি (যা আমি অনেকবার শুনেছি) চিঠিটা আমার মাকে বিয়ে করার যে প্রস্তাব তিনি মায়ের বাড়িতে পাঠিয়েছিলেন, তার সম্মতির বিষয়েই বুঝিয়েছেন। কী সুন্দর করে জানতে চাওয়ার ইচ্ছে, সেই সঙ্গে চিঠিতে রহস্যের ছাপ। বাবা যে এরকম চিঠি লিখেছিলেন তা আমি বাসায় খালাদের কাছে শুনেছিলাম। এতদিন পর পুরোনো আলমারি হাতড়াতে গিয়ে ড্রয়ারে খুঁজে পেলাম। বাবা ভিউকার্ড পছন্দ করতেন, তাতে লিখতেনও। জার্মানি থেকে আমাদের তিন ভাইবোনের কাছে যে শেষ তিনটি চিঠি লিখে রেখে গিয়েছিলেন তাও ছিল কার্ডের উল্টো পাশে লেখা। এরপর আর কিছু আমার খুঁজতে ইচ্ছে হয় না। শুধু মনে হয়... আর কোনোদিন বাবাকে দেখব না। হারানো দিনের মতো আমি বাবাকে হারিয়ে ফেলেছি। বাবা আজ স্মৃতি। আজ অতীত। আমার ইচ্ছে হলেও কাউকে বাবা ডাকার জো নেই। আমার বাবাকে নিয়ে ভাবতে হলে ফিরে যেতে হবে কেবল অতীতে। পড়ার ঘরে তাঁর লেখা বইগুলো যেন আমাকে ডেকে বলে– ‘মৌলি আমাকে পড়, আমাকে পড়। মা-বাবা সারাজীবন থাকে না, কিন্তু সৃষ্টিশীল বাবার লেখাগুলো নিয়ে তো তাঁর সন্তান বেঁচে থাকতে পারে।’ সৃষ্টিশীল প্রথাবিরোধী লেখকের মেয়ে হয়েও বাবার না থাকাটা (অপমৃত্যু) আজও মেনে নিতে পারি না। আমি যে তাঁকে ডাকতে পারি না। আমার বাবা নামের যে চরম আশ্রয়স্থল তা যে হারিয়ে গেছে, তাই তাঁর জন্মদিনে আমার চোখ দিয়ে কেবল জল গড়িয়ে পড়ে। 

আরও পড়ুন

×