ঢাকা শুক্রবার, ০৬ ডিসেম্বর ২০২৪

মুক্তিযুদ্ধের গল্প

নদী

নদী

নাহিদা নাহিদ

প্রকাশ: ১০ ডিসেম্বর ২০২০ | ১২:০০

এখানে উথাল-পাথাল ঢেউ। ফেনার গর্জনে হিসহিস। যতদূর চোখ যায় ঠান্ডা বাতাসের উদ্দাম শব্দতরঙ্গের চিৎকার। সেই চিৎকারে রামিস পালিয়ে যেতে চায় এমন এক জগতে যেখানে হয়তো তার টুইন বেবিদের কেউ উল্টে পড়ে থাকে না মরে। সেখানে হয়তো তার অসুস্থ স্ত্রীকে পুলিশ খুঁজতে আসে না সন্তান হত্যার অপরাধে। যেখানে নিশ্চিত টিনি মিনি একসাথে সমুদ্র তটে বালি দিয়ে ঘর বানায়, শামুক কুড়োয়; সেই বাতাস কোথায়, সেই নদী কোথায় রামিস জানে না। সে শুধু হাতড়ায় অন্ধকার। তার জীবনে পুনঃ পুনঃ ঘটনার সংঘাত তাকে শুধু মৃত্যু দেখায় আর দেখায় নদী। চারপাশে এত নদী কেন এদেশে? কোন জন্মের কোন ঋণ, কোন জাহাঙ্গীর; কত আর পড়ে থাকা যায় সেই জাহাঙ্গীরের খোঁজে; এই জলের দেশে। রামিসের ক্লান্তি আসে; এক আঁজলা জল ছড়িয়ে দেয় মুখে। পচা ডুরিয়ান তেতো স্বাদ! ঠান্ডা বরফ পানির খোঁজে নৌকা ছেড়ে নেমে যায় স্রোতে। তারপর? গভীর কোনো জলের হাত, জলের পা তাকে টেনে নিয়ে যায় গভীর থেকে আরো গভীরে। ডুবে যায় রামিস প্রতিরোধহীন একা, শেষ পতনের আগে শুধু এক বৃদ্ধ হাত বাড়ায়; জাগায়, বলে-
-ওঠো
আহা পবিত্র সেই বুড়ো!
এ নদীর নাম কি মেঘনা ডাকাতিয়া নাকি রাইন? আঁজলায় তোলা জল ফেলে দেয় রামিস, ঘোলা পানি মুহূর্তেই হয় কালো থকথকে কাদা। জলজ সরিসৃপের মতো কানকো দিয়ে ঠেলে ঠেলে কাছে আসে একটা বিকট অদ্ভুত প্রাণী। জান্তব! প্রাণীটার কোনো অবয়ব নেই। মাথা জুড়ে শুধু চোখ। তার হা করা মুখে একটা তুলতুলে পুতুল শরীর! রামিস হতভম্বের মতো খেয়াল করে দেখে এই বীভৎস প্রাণীর হাতের পুতুলটা হাসলে কন্যা টিনি কাঁদলে সহোদরা চুমকি হয়ে যায়, অদ্ভুত! আকাশ কাঁপিয়ে চিৎকার দিতে গিয়ে থেমে যায় সে, শব্দ হয় না গলায়। জন্তুটার প্রতিটা কামড় তার গায়ে এসে লাগছে, যেন সেও এক ছোটশিশু, তার হাত নরম, পা নরম, নরম চোখ। কী এক অসহ্য যন্ত্রণায় হাঁসফাঁস করে রামিস, তার বোবা চিৎকারে বুড়ো গ্রাউনি আবার ঠকঠকিয়ে আসে, হাতে ধরে রাখা তার মোজেসের লাঠির মতো আঁকাবাঁকা ক্রাচ ছুড়ে দেয় কোথাও। হঠাৎ নদীটা শান্ত হয়ে যায়, কোমলে জড়ায় চারপাশ। প্রতিদিনের মতো ঠিক এ অবস্থায় ঘুম ভাঙে রামিসের। গ্রাউনি তাকে ফেরায় অন্ধকার গিরিখাদ থেকে নতুন সূর্য দেখা আলোর ভুবনে, এভাবেই প্রতিদিন।
রামিসের ডান হাতের মধ্যমায় ক্রুশ চিহ্নের মতো ক্ষত, বিগত শৈশবে এখানে দাঁত বসিয়ে দিয়েছিল এক অবোধ মুখ। তার সকল বিষণ্ণতা এখানেই। একটা জীবনে অজস্র মৃত্যু মগজে যে গভীর ক্ষত সৃষ্টি করেছে তার কাছে এই দাগ তুচ্ছই। তবু এ যেন বেশি পোড়ায়। গ্রাউনির কঠোর নির্দেশ ছিল 'নদী তো নদী, এ শুধু ঘোর, এ শুধু শূন্যতা; কান্নার ছলছল, ভুলে যাও, ভুলে যাও, ভুলে যাও' রামিসের খুব অসহায় লাগে। গ্রাউনি কেন বোঝেনি নদীকে ভুলে যাওয়ার উপায় নেই তার; নদীরা জীবন্ত, সারা ঘরময় কেঁচোর মতো ছুটে বেড়ায় কুৎসিত পিচ্ছিল আতঙ্ক নিয়ে; এদের ভেতরে কার আত্মা কে জানে!
গ্রাউনি যখন এনশিয়েন্ট ট্রাইবাল রিলিজিয়ন নিয়ে গবেষণার কাজ করত, তখন দেশ-বিদেশ ঘুরে নানারকম অতিপ্রাকৃত রহস্যের সন্ধান খুঁজত। যেখানে মৃত্যু সেখানেও সে, যেখানে জীবন সেখানেও। ইজিপ্ট থেকে ফেরার পথে হঠাৎ এ দেশে এসেছিল কোনো এক যুদ্ধদিনে, সেই তার রামিস আবিস্কার! প্রাচীন সন্তর মত যাযাবর জীবনে কাপড়ের ঝোলায় বয়ে বেড়াত গোটা পৃথিবী; তুকতাক, তাবিজ কবজ থেকে সুগন্ধি মানুষের হাড়! একবার গ্রাউনি রামিসের জন্য এনেছিল আস্ত একটা বাইসনের মাথা, কিছু কুমিরের ডিম, বলেছিলো এবারকার দাওয়াই তাকে ভুলিয়ে দেবে নদীর বিভ্রম।
অথচ রামিসের মতো খাপছাড়া যুদ্ধশিশু কিংবা অরফান যারা তাদের তো নদী থাকেই এমন; গোপন সংবেদ্য। রামিস কর গুনে দেখে স্টাডি রুমের মস্ত মস্ত পুঁথির মাঝে মুখ গুঁজে পড়ে থাকা এলিস, প্রার্থনা কক্ষের জিওসি-রিহা, দানখানার হিসাবপত্র বুঝে রাখা ব্রুকাই কিংবা আদিবা নামের ওই আফ্রিকান মেয়েটা, যার দায়িত্ব ছিলো খাবার তৈরির, তাদের তো সবই ঠিকঠাক, শুধু সময়-সময় এরা এমনসব ভয়ংকর কিছু করে উঠত যে, ওদের ভেতরের নিঃসঙ্গ নদীটা চকচক করে ছলকাতো রামিসের চোখে। তবে সে এও জানে শুধু মাত্র গ্রাউনিই পারে এসব 'নদী দেখা মানুষ' সামলে রাখতে। রামিসের বুক ভেঙে দীর্ঘশ্বাস নামে। মুখে অনুভব করে দুঃখস্বাদ! অস্ম্ফুটে শুধায় বাতাসে গ্রাউনি, তুমি কেন চলে গেলে? তুমি কেন মরে গেলে! আমাকে আবার কেন আসতে হলো সেই দেশে, সেই নির্মম শব্দহীন কান্নার জলে।
একসময় রামিসের নাম ছিল রমিজ। গ্রাউনির জিভ তাকে রামিস বানিয়েছে। গ্রাউনি বলেছে- রামিস মানে সুন্দর, রামিস মানে ক্ষমাশীল, রামিস মানে মহাত্মা। রামিসদের ভালো হতে হয় খুব। দুঃখ পুষে ছুটতে হয় না এদিক-ওদিক। কিন্তু মধ্যরাতে ঘুম ভেঙে গেলে তাকে ছুটতে হয় না কোথাও নদী নিজেই ছুটে আসে স্টাডিরুম বা রিসার্চের পাতায়। বাক্সপেটরায় বা অতসীকাচটার মাঝ বরাবর। বহু যুগের পুরোনো প্রাচীন পুথির সংরক্ষিত পাতায় তাকে তখন সেই পুরোনো নদীই খুঁজতে হয় আবার! বুক অব রাজিয়েলে একটা অদ্ভুত বইয়ের কথা উল্লেখ আছে রামিস জানে; সে এও জানে তার কয়েকটা পৃষ্ঠা দুর্বোধ্য, সেখানে আছে নীলনদের জলসূত্র, আছে ফিরাউনের পতন। পৃথিবীর পুনর্বিন্যাসে অক্ষমতার নদীতে বিসর্জিত অসীম ক্ষমতাধরদের পুনর্জন্ম আছে। রামিস জানে না চুমকি আবার জন্মাবে কিনা অথবা আবার হাসবে কিনা তার ছোট্ট টিনি কিন্তু কেউ যদি আবিস্কার করে দুর্বোধ্য রহস্যের সমাধান; রামিস আবার জন্ম নিতে চায় প্রাচীন অতীতে, শাসক হয়ে। পৃথিবীর ইতিহাস পাল্টে দিতে চায় সে। অথবা থামিয়ে দিতে চায় একটা মানুষ জন্ম; জাহাঙ্গীর। অর্থোদ্ধার না হলেও সমস্যা নেই। পিতৃহত্যার অপরাধে নরকবাস এ আর এমন কী।
নিঃসঙ্গ রামিসকে একবার দত্তক দেওয়া হয়েছিল এক ফিলিপো ঘরে। আরো ছ'ভাইবোনের সাথে বছর দুয়েকের বেশি টেকেনি সেখানে। গ্রাউনির মতো পৃথিবীর উত্তর, দক্ষিণ, পুব আর পশ্চিমে, তাদেরও যাযাবর বৃত্তি! সে এক ভিন্ন পরিবার। কারো সাথে কারো রক্তযোগ নেই অথচ এ ওর ভাই, ও এর বোন। হায় গ্রাউনি! রামিসকে ভালো রাখার কত আয়োজন। তবুও তার জীবনে তার শৈশব সত্য, জাহাঙ্গীর সত্য আর সত্য যৌবনের মানসিক বিকারগ্রস্ত পলিন। গ্রাউনি যেদিন তাদের আস্তানায় পলিনকে নিয়ে এলো সেদিনও বোঝেনি তার জীবনে বিষাদ-নদীর আরেক অধ্যায় হবে সে। চেরি ফলের মতো দেখতে মেয়েটা সব সময়ই ভালো থাকতো, শুধু নদী দেখলেই পাগল হয়ে ছুড়ে মারতো ইট-পাথর বা মানুষ। কে জানে হয়তো তার জীবনেও নদীর সাথে জড়িয়ে ছিল গাঢ় থকথকে কোনো অন্ধকার কিংবা অহমের তীক্ষষ্ট লক্ষ্যভেদী শর। ঈশ্বর তাকে ক্ষমা করুক।
হোমাগ্নির ধোঁয়ার আবরণ সরিয়ে সবশেষে জাহাঙ্গীরকে পাওয়া গেলেও রামিস ভাবেনি পেয়েছে। এই সেই জাহাঙ্গীর যার জন্য রামিস তার শৈশব ফেলে গিয়েছে ফেলে গিয়েছে মাতৃভূমি। এমনকি বর্তমানেও ফেলে এসেছে রাইন নামক তার দুঃখের নদীটা। তেলচিকস্ফণ চকচকে শরীরের তেজি মানুষটার কণ্ঠের জোর, তীব্র হুঙ্কার ঘাড়-গলায় সব চুপসে আছে এখন একাকিত্বের ছোপ ছোপ দাগ। এই তো বিষ মানুষটা শুয়ে আছে একা। লোকটা আট নম্বর সেক্টরের মুক্তিযোদ্ধা ছিলো নাকি বেঙ্গল প্লাটুন কর্মী- এ নিয়ে দ্বিধা থাকলেও তাকে নিয়ে রামিসের সন্দেহ হয় না এই সেই পিতা! এই সেই মাটি প্রেমে অন্ধ আত্মনিগ্রাহক!
রামিস তাকিয়ে থাকে অনেকক্ষণ। তার দৃষ্টি ঝাপসা হয়ে এলে চোখ নামায়; কী এক লক্ষণ বিচারে গ্রাউনি তাকে বলেছিল তার নাকি যিশুর পুনর্জীবন। তাকে ধৈর্যে জ্ঞানে হতে হবে পৃথিবীশ্রেষ্ঠ মহৎ। তাকে প্রতি রবিবার চার্চে নিয়ে যেতো গ্রাউনি একা, ফিসফিস করে বলতো- ''ভুলে যাও বীভৎসতা, মুছে ফেলো ঘৃণা। তুমি জীবশ্রেষ্ঠ। মনে আলো জ্বেলে রেখো, হাজার প্রদীপের আলো।'' চার্চে যাওয়া আর আসার সময়টায় এক যোসেফকে বহুভাবে চিনিয়েছে গ্রাউনি। গ্রাউনি জীবনের কথা বলত, অথচ এও বলত মৃত্যু জীবনের অনির্বাণ সত্য। এর পেছনেই প্রকৃতির কল্যাণ। গড প্রাণ দিয়ে নিয়ে যাওয়ার ক্ষমতা রাখেন বলেই তিনি গড। তাকে ভালোবাসলে মৃত্যুকেও ভালোবাসতে হয়। হয়তো সবই সত্য কিন্তু রামিস কখনো পারেনি মৃত্যুকে ভালোবাসতে। তার ভেতরের ছিপি আঁটা ক্রোধের দৈত্য কেবলই গজরায় অক্ষম আক্রোশে। গ্রাউনি জাদুকরের মতো বলে যেতেন প্রাচীন উপজাতিদের বীভৎস আত্মজ হত্যার কাহিনি, নরবলি উৎসব। রামিসের গা শিরশির করতো, মনে হতো গ্রাউনির এই ঘোরের গল্পের নায়ক সে একাই, বলি হওয়া উপজাতি শিশুকন্যাটি তার চেনা! যার আত্মা ঘুরছে এখনো তার সাথে সাথেই। তখন অন্য রকম এক ভয় হতো তার! ঘাড়ে বা কানের কাছে বড় বড় নিঃশ্বাস বা দীর্ঘশ্বাস শুনতে শুনতে মনে হতো সে কখনো যিশু হতে চায় না। কখনো না। সে ক্ষমা করবে না কখনো সেই জাহাঙ্গীরকে। ক্ষমা করবে না পলিনকে। হোক সে দেশপ্রেমিক অথবা বিকারগ্রস্ত মা।
অথচ আজ তার কী ভাগ্য! এই তো লোকটা তার পাশে শুয়ে আছে। চাইলেই সে রক্তস্রোতে উৎসব করতে পারে হত্যার। গলা টিপে ধরতে পারে তার। দিতে পারে মাথায় পেরেক ঠুকে। পলিনকে তার রাষ্ট্র শাস্তি দিয়েছে আর তাকে? আচ্ছা লোকটা কি জানে তার সামনে বসে থাকা এই সাহেবি মানুষটা একসময় ছিল কড়ে আঙুল সমান অতি তুচ্ছ এক ছোট মানুষ। যার জীবনে একমাত্র আনন্দ ছিল ঝিনুক বিন্দুর চেয়ে ছোট পুতুল বোন চুমকি। সাদা স্টম্ফটিকের মতো চকচকে সে সুন্দর মুখে শক্ত তিনটে দাঁত উঠেছিল, দুধ দাঁত। ঝুমঝুমির ঝুমঝুমে ফিকফিক করে হাসত মেয়েটি। কাঁধে না নিলে সে কী অভিমান-রাগ! রামিস তার আঙুলে আলতো হাত বোলায় আহা বোনের দুধ দাঁত।
রামিস ভাবনা সরিয়ে লোকটার দিকে তাকায়। সে আর জাহাঙ্গীর পরস্পর পরস্পরে পূর্ণদৃষ্টি। কেউ কোনো কথা বলে না কিন্তু দুজনই শুনতে পায় দুজনকে। জানে তারা পিতা-পুত্র, দুজনই সমান অহংকারী!
- আপনার দেশ এখন কত স্বাধীন, সুখ আছে তো আপনার মহামান্য যোদ্ধা?
-দেশ তো তোমারও, তা যেমনই থাকি।
- না এই দেশ আমার না। যে দেশের আপনার মতো ত্যাগী, মহৎপ্রাণ একজন বাবা থাকে, স্ত্রী নিরুদ্দেশ করে দেওয়ার মতো দায়িত্ববান স্বামী থাকে সে দেশ আমার না।
- হ্যাঁ দায়িত্ব আমার ছিল, মাটির। এখনো আছে। তোমার তো তাও নেই।
- মানুষ ভাবেন নিজেকে?
- অন্তত নিজের কাছে, আমার কাছে স্ত্রী-পুত্র-কন্যা এমনকি নিজের জীবনের চেয়েও একজন যোদ্ধার জীবন গুরুত্বপূর্ণ।
- মিথ্যে কথা, আপনি সহযোদ্ধাদের দেখাতে চেয়েছেন নিজের আত্মত্যাগ, এই তো দেয়ালে ঝুলছে সার্টিফিকেট। বীরবিক্রম। এটাইতো চেয়েছিলেন তাই না, বাহ!
- নাহ শুধু এটাই চাইনি। তবে তোমার বাহবা বেশ লাগছে কারণ তুমি তো কখনো প্রাণহত্যা করোনি, এমনকি তুচ্ছ পিপীলিকাও নয়। তুমি নিশ্চয়ই সিদ্ধার্থ!
- আপনি নৃশংস পুরোহিতের বলিদান দেখেছেন? দেখেছেন জাহেলিয়াত যুগের ছোট্ট শিশুর জ্যান্ত কবর হওয়ার দৃশ্য? অথচ আমাকে কিন্তু দেখতে হলো। কারণ আমি বছর দশের শিশু হলেও আপনার সহযাত্রী ছিলাম।
- হ্যাঁ ছিলে। শৈশবে আমার সহযাত্রী কিংবা পুত্র যেমন ছিলে, তেমনি যৌবনে ছিলে পলিনের স্বামী, টিনির বাবা। পলিনকে তো এখনো ভালোবাসো তাহলে আমায় কেন ঘৃণা? শৈশব বলেই? আমার পক্ষে যুক্তি ছিল, পলিনের ছিল বিকৃতি।
- আপনার যুক্তি শুনি?
- ধর্ম রক্ষায় নিজ পুত্রের গলায় ছুরি চালানো ইব্রাহীমের কথা মক্তবে পড়ে যাওনি? আমার ধর্ম দেশ।
- আপনার ধর্ম এই বলে? শুধু বিসর্জন?
- তোমার নতুন ধর্মও তাই বলে। পবিত্র যিশু কেন স্বেচ্ছায় কোরবানে এগিয়ে দিলেন নিজের জীবন? সে ও তো একটা প্রাণই!
- আপনাকে আমি ঘৃণা করি।
- আমিও। কিন্তু পলিনকে ভালোবেসো, কারণ সন্তান হত্যায় পিতার অপরাধ অমার্জনীয়, মাতার নয়।
রামিসের মনে পড়ে যায় ডুমুরের কষের মতো ঘোলা ঘোলা কুয়াশার দিনে পুকুরের হিম পানিতে অজু করে মক্তবে যাবার দিনগুলো। কাঁচাপাকা দাড়ি তির তির করে কাঁপিয়ে হুজুর বলে যেতেন দরুদ, আত্তাহিয়াতু, দোআ মাসুরা। সেসব ভুলে গেছে রামিস। আবছা মনে পড়ে- সুরমা দেওয়া চোখে ঝরে ঝরে পড়া আদরে ওস্তাদ বলতেন, বেটা, হুব্বুল ওয়াতন মিনাল ঈমান। ইয়ে হামারা দেশ হ্যায়, তুমহারা দেশ হ্যায়। দেশকে লিয়ে জান দে না ভি পাড়ে না বেটা, ও ভি বহত গৌরবের আছে...
রামিস এক নদী ঘৃণা নিয়ে পিতার দিকে তাকাতে গিয়েও তাকাতে পারে না। কুমারী মেরির গৌরব এখানে পিতার ঘাতক দৃষ্টির সামনে ম্লান হয়ে যাচ্ছে ক্রমশ। আসলে যিশুর পুনর্জনম কে পেয়েছে, সে নাকি তার পিতা রামিস জানে না, তার কেবলি পরাজিত লাগে। ক্লান্ত লাগে।
রামিস ভেবে পায় না কথাগুলো সত্যি তারা বলেছে নাকি বলেনি। সে এও জানে না আধো- ভৌতিক এই ঘরে শুয়ে থাকা এই বৃদ্ধের বাকশক্তি আছে কি নেই। দ্বিধায় দ্বিধায় রাত হয়ে যায়। কেউই কারো সাথে কথা বলে না কোনো। অথবা তারা আর কথা খুঁজে পায় না। রামিস উঠে দাঁড়ায়, জাহাঙ্গীর পাশ ফিরে শোয়। দুজনের নিঃশব্দ যন্ত্রণার অদৃশ্য বাতাস পরস্পরে ছুঁয়ে যায় দীর্ঘসময়; কোথা থেকে যেনো একটা টিকটিকি টিকটিক করে ওঠে। কিন্তু কি ঠিক কিংবা কে ঠিক তাদের দু'জনের কারোরই হিসাব মেলে না। ফিরতি পথে রামিস আবার মনে করে সেই ভয়ংকর যুদ্ধকালের রাত। নৌকা বোঝাই মানুষ, ইন্ডিয়া বর্ডারের দিকে যাত্রা। বাবার সাথে সে আর তার ছোট্ট বোন চুমকি। অন্যান্য শরণার্থীর সাথে এক বিদেশি আর বাবার তিনজন সহযোদ্ধা। তাদের মধ্যে একজন আবার ট্রেনিংপ্রাপ্ত প্লাটুন কমান্ডার। একদিকে হানাদার বাহিনীর ক্রুদ্ধ গর্জন- কাঁহা যায়ে? কোনসে? আরেকদিকে ক্ষুধার্ত, অসুস্থ চুমকির মাতৃদুগ্ধতৃষ্ণা কিংবা অন্য কোনো পানীয়ের অভাবে গগনবিদারী চিৎকার। বাবার টকটকে লালচোখ! এরপর ঝুপ করে কিছু একটা পতনের শব্দ। বিমূঢ় স্তব্ধ সকল পলাতকের পলকহীন চোখের সামনে জাহাঙ্গীর, যাকে রামিস স্বীকার করতে চায় না তার পিতা, উন্মত্তের মতো একটুও হাত না কাঁপিয়ে সর্বশক্তি দিয়ে ছুড়ে মারে ক্রন্দনরত কন্যার ছোট্ট মানব-শরীর।
রামিস বুক ভরে শ্বাস নেয়। সেই ছোট্ট পুঁটলির মতো মেয়েটা যে তার তৃষ্ণার শ্বাস আর নিতে পারেনি তার শ্বাসটুকুও টেনে নেয় বাতাস থেকে। মুখের থুতুটুকু গিলে ফেলে গলাতেই।
রামিস জানে না তার মায়ের কী হয়েছিল, বেঁচে আছে না মরে গেছে। মা কেন পালিয়েছিল এই স্বর্গের ফুল রেখে, কোন অপমানে রামিস জানে না। তার আবছা স্মরণে আসে বাবার চিৎকার
'কোনো কুলাঙ্গার বিশ্বাসঘাতক রাজাকারের বেটির লগে জাহাঙ্গীরের সংসার নাজায়েজ, জেনা; তালাক তালাক তালাক!' এরপর ছয় ছয়টা মাস রামিস একা সামলেছিল বোন চুমকিকে।
নৌকার সেই বিদেশি লোকটা; রামিসের গ্রাউনি সেইভ করেছিল তাকে, কারণ সে তখন ট্রমাটিক চাইল্ড। গ্রাউনি বলতেন গডের অনেক শক্তি, গড দেখতে চায় মানুষের সহ্য শক্তির ক্ষমতা। মানুষ কখনো গডকে অতিক্রম করতে পারে না, কারণ গড একাই ধারণ করেন পৃথিবীর সকল অন্যায় পাপ তাপ শোক। রামিস ভেবে পায় না গ্রাউনি সত্য বলতো নাকি মিথ্যে। গড কি চাইলেই পারতো না একটা যুদ্ধ থামিয়ে দিতে? তিনি চাইলেই তো কত নদী হয়ে যায় প্রেম, অথচ পৃথিবীজুড়ে শুধু রক্তস্রোত! আসলে পৃথিবীতে মানুষের চেয়ে গডই হয়তো বেশি অসহায়। গডের এই ব্যর্থতায়-অক্ষমতায় রামিসের হাসি পায় খুব। আচ্ছা জাহাঙ্গীর না হয়ে সে যদি যিশু হয় তবে এই জল তার ক্রুশ না নদী? সে যাই হোক, রামিস জেনে গেছে রক্তেও নদী হয় জলেও, এ জন্যই তার চারপাশে কেবল নদী আর শুধু নদী।
whatsapp follow image

আরও পড়ুন

×