মুক্তিযুদ্ধের গল্প
পুনর্বাসন
অলংকরণ ::নাজিব তারেক
রেজাউর রহমান
প্রকাশ: ১০ ডিসেম্বর ২০২০ | ১২:০০
ফাল্কগ্দুনের মাঝামাঝি প্রায়। সকালের দিকটায় মনে হয় শীত যেতে আরও দেরি। শীত আসছে যত দেরিতে, যাবেও তত দেরিতে। আবার ভরদুপুরে তাতানো সূর্য যখন পশ্চিমমুখী টাল খায়, তখন মনে হয় শীত চলে গেছে। বড় ক্ষণস্থায়ী এ শীত।
আফজালের মাথার ওপর প্রচুর ধুলা জমা ঝাঁকড়া কদম গাছ। বাঁ পাশে শিশু-পেয়ারার চারা। পাতার গাঢ় রং প্রায় অদৃশ্য। এক পলেস্তারা ধুলা সবখানে। পঙ্গু পুনর্বাসন কেন্দ্রের শেষ ঘরটি থেকে সে যখন হুইলচেয়ারের চাকা ঘুরিয়ে নেমে আসছিল প্রধান সড়কের ফটকে, তখন মোয়াজ্জেম বালিশ থেকে মাথা উঁচিয়ে একবার দেখে নিয়েছিল আফজালকে। তারপর দেয়ালে টাঙানো ঘড়িটার দিকে সে একবার তন্দ্রা জড়ানো চোখে চায়। নাহ, প্রধান সড়কের সান্ধ্য-আড্ডার সময় হতে এখনও অনেক দেরি। আরও ঘণ্টা দুয়েক। আফজালের মনের ছটফটানি সে আঁচ করতে পারে। মোয়াজ্জেম তাকে চেনে সেই মুক্তিযুদ্ধের সময় থেকে, যখন ঘুটঘুটে অন্ধকার রাতে কম্বলের ভেতরে আগুনের স্ম্ফুলিঙ্গ লুকিয়ে সে বিড়ি টানত। আর বকে চলত, মোয়াজ্জেম ঘুমিয়েছিস? তুই শালা বড় ঘুমকাতুরে। শোন, পৃথিবীর যত বড় বড় কবি-সাহিত্যিক, সব শালায় যোদ্ধা। মুক্তিকামী মানুষের যোদ্ধা। হেমিংওয়ে, পল এলুয়ার, লুই আরাগ, মায়াকোভস্কি, ফকনার। স্থানকালবিশেষে অসি আর মসি এক হয়ে যায়। দেখ, অন্ধকার কত সুন্দর! অন্ধকার আছে বলে কৃষকের কুঁড়েঘরের সন্ধ্যাবাতি মনোরম। কৃষাণির কুমারী মেয়ের মুখরেখা কত তেলতেলে, প্রাণবন্ত। পান খাওয়া রাঙা ঠোঁটের হাসি কত মিষ্টি! ভাবতেও মন কেমন করে! কাঁদতে ইচ্ছা হয়। এ বিভীষিকাময় জীবনের অবসান হবেই। জানিস মোয়াজ্জেম, কাল হেলেনাকেও আমি তাই লিখেছি, আর দেরি নেই, আমরা আসছি...। ঐরাবত আসছে ওই গাঁয়ের দিগন্তরেখায় লাল ধুলা উড়িয়ে... হেলেদুলে... গলার ঘণ্টি ঠুন ঠুন বাজিয়ে...।
মোয়াজ্জেমের বিশ্বাস, আফজাল কবি। হেলেনাকে ভালোবাসে। সে কবিতা ভালোবাসে। সে সকালের শীতের রোদ পিঠে লাগিয়ে ঝালমুড়ি খেতে ভালোবাসে। আবেগাপ্লুত কণ্ঠে হেলেনাকে সে কবিতা শোনাতে ভালোবাসে। সে ভালোবাসে জ্যোৎস্না রাতে বিশাল আকাশে তারাদের ফিসফিসানি, তাদের রহস্যঘন মিটিমিটি। তাই তো সে মুক্তিযোদ্ধা। এসব কিছু ফিরে পেতেই সে যুদ্ধ করছে। বিড়ির অঙ্গার কম্বলে লুকিয়ে একটানা সে টানছে বিড়ি। হাসছে। বিকট হাসি। ফুটিয়ে চলেছে অজস্র কথার খই। আশার বাণী। ঘন নীল শান্ত আকাশে অজস্র তারার বাতির মতো।
-হেলেনা আমি এসে পড়লাম বলে। আমার তুমি... তুমি আমার কবিতা... তুমি আমার মুক্তিযুদ্ধের নেশা...। সে একটানা বলে যেত।
আফজালের জন্য সময় সময় তার বড় কষ্ট হয়। সে কবি, সে স্বপ্ন দেখে। কেবলই স্বপ্ন দেখে। অন্ধকার ছাড়িয়ে সে আলো দেখে।
পুনর্বাসন কেন্দ্রের পশ্চিম চত্বর ছাড়িয়ে কদম গাছের ছায়া গিয়ে পড়েছে পরের বাড়িটিতে, যার মেইন গেটের সবুজ জমিনে ঝুলছে কালো প্লেট, 'কুকুর হইতে সাবধান'।
আফজাল পশ্চিমে ঢলে পড়া সূর্যের প্রায় গ্রীষ্ফ্মের মতো উষ্ণ তেজ মাথা পেতে নিয়ে হুইলচেয়ার ঠেলে চলে যায় সরু প্রধান ফটকের কাছে। ভাঁজ করা চটা-ওঠা লোহার গেটের ধারে। যেখানে একসময় আসবে ফরাসি মেয়ে অ্যানিয়েস। অ্যানিয়েস ফিউরানি। সে বসবে এসে ফটকের পাশের অস্থায়ী টি-স্টলের বেঞ্চিতে। টানবে বিদেশি সিগারেট, ছাড়বে ধোঁয়ার রিং। একের পর এক। কী টুকটুকে লাল জিব তার। কমলা রঙের ঠোঁট। গালের রক্ত চলাচলও দেখা যায়। গাঢ় নীলচে চোখ, ঢেউ খেলানো লালচে চুলের ভাঁজ- সব প্রায় মুখস্থ হয়ে গেছে আফজালের। অ্যানিয়েস পরে একটা হালকা হলদে ফুলহাতা গেঞ্জি। ফিকে লাল জিন্স। গেঞ্জির ওপর সবুজ রঙা পাতলা উইন্ড ব্রেকার। পায়ে ঘন নীল কেডস। সুডৌল বাম ঊরুর ওপর ডান ঊরু ভাঁজ করে ফেলে অ্যানিয়েস যখন সহজ-স্বচ্ছন্দ ভঙ্গিতে কথা বলে চলে, ফরাসি একসেন্টে, ভাঙা-ভাঙা ইংরেজিতে, আফজালকে এগিয়ে দেয় 'ডানহিল' সিগারেটের জমাট রক্তলাল প্যাকেট, তখনও তার সহ্য হয়। কিন্তু যখন সে দেশলাইয়ের জ্বলন্ত কাঠি নিয়ে এগিয়ে আসে তখন আর সহ্য হয় না।
কপালের দু'পাশের শিরা তার দাপাদাপি করে। ছিঁড়ে যেতে চায়। অ্যানিয়েসের ভরা নরম রক্তিম স্তন ও পাকা লাল আঙুরের মতো গাঢ় রঙের বোঁটা দুটোও আফজালের মুখের কাছে এগিয়ে আসে। একটু এগোলেই যেন আলতো মুখ লাগানো যায়। ধরা যায় সেই অপরূপ রূপসম্ভার। কেমন নেশা ধরা তার প্রশ্বাস, চুল আর গায়ের ঘ্রাণ। ভীষণ মাতাল করা।
কাঁপা হাতে সিগারেট ধরায় আফজাল। ধোঁয়ার অস্পষ্ট আঁকিবুঁকি বাতাসের ফুৎকারে হারাতে থাকে। সে সিগারেট টানতে ভুলে যায়। তার হুইলচেয়ারের হাতল ধরে কখন মর্জিনা এসে দাঁড়িয়ে থাকে, সে টেরও পায় না।
- ভাইজান, তোমার শিরদাঁড়ার ব্যথাটা আজ কেমন?
- হ্যাঁ। ওহ... তুই... তুই কখন এসেছিস! হকচকিয়ে উঠবে আফজাল।
- এই তো...। তুমি না ঢাকাই কুল খেতে চেয়েছিলে- এই নাও।
- অ্যানিয়েস প্লিজ... দিস ইজ বেরি। টিপিক্যাল বাংলাদেশি ফ্রুট... বাংলাদেশি... প্লিজ...। কাঁপা হাতে আফজাল বরইয়ের ঠোঙা এগিয়ে দেয় তাকে। অ্যানিয়েস, শি ইজ মাই লিটল সিস্টার...! স্টিল আনম্যারেড! বাট শি হ্যাজ এ বয়...। প্লিজ টেইক অ্যানাদার। ওহ, মাই লাভিং সিস্টার... শি ইজ সো গুড... আই এম মাদারলেস ফ্রম মাই চাইল্ডহুড। দো শি ইজ ইয়ঙ্গার... বাট শি প্লেইজ মাদার ফর মি। শি ইজ গ্রেট... সিম্পলি গ্রেট... অ্যানিয়েস...।
চার-চারটে হুইলচেয়ার এসে ঘিরে থাকে অ্যানিয়েসকে। ছাপরা চায়ের দোকানে কুপি জ্বলে। বার কয়েক চায়ের অর্ডার হয়। অ্যানিয়েস চায়ে চিনি খায় না। দোকানদার তা জেনে গেছে। তবু আফজাল তাকে স্মরণ করিয়ে দেয়। বাচ্চা ছেলে লোকমান গল্গাসে গল্গাসে চা এগিয়ে দেয়। অ্যানিয়েস-মর্জিনা ছাড়া সবাই ধূমায়িত গরম গল্গাসে ঠোঁট লাগানোর চেষ্টা করে। অ্যানিয়েস চায়ের গল্গাসটি সযত্নে তার পাশের টুলে রাখে। সে চা ঠান্ডা করে খায়। মর্জিনা এক পায়ে ভর দিয়ে সামান্য বেঁকে দাঁড়িয়ে থাকে। তার বাঁ হাতে ছোট চায়ের গল্গাস। ডান হাত হুইলচেয়ারের পেছনে। আফজালের পিঠ ছুঁয়ে। যেখানটায় সব সময় একটা ব্যথা চিনচিনিয়ে ওঠা-নামা করে। সময় সময় সারা পিঠেও ছড়িয়ে যায়। মর্জিনা বিষণ্ণ-কাতর-পরিশ্রান্ত ভঙ্গিতে একঠায় দাঁড়িয়ে থাকে। সে দেখে, সবার চোখের তারায় জ্বলছে কামনা- যন্ত্রণার আগুন। দাবানলের মতো। আগুন জ্বলছে তার ভাইয়ের চোখেও। জ্বলজ্বলে, ধিকিধিকি। আগুন জ্বলছে কাঠমিস্ত্রি মোয়াজ্জেমের চোখে, বৈলামপুরের মাঝবয়সী কৃষক সতীশের চোখে। প্রৌঢ় পাট কারবারি আজমত আলীর চোখে। চোখের সামনে তাদের অপ্সরা পানসির মতো এক উদ্ভিন্ন যৌবনার দেহ-সৌষ্ঠব হেলছে-দুলছে। ছন্দময় হয়ে ফুলে ফুলে উঠছে তার ভরা বুক। সুডৌল ঊরু, ভারী নিতম্ব। রমণীর মোহময়ী রক্ত-মাংস, রূপের আগুনে পুড়ছে সবাই। পঙ্গু আফজাল, মোয়াজ্জেম, সতীশ, আজমত আলী বেপারী।
এই সান্ধ্য আসরের প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় দিনে পঙ্গু পুনর্বাসন কেন্দ্রের অনেকেই বুঝে গেল, ফরাসি এই মেয়েটি অত্যন্ত সংবেদনশীল ও আশ্চর্য রকমের ভালো মানুষ। দুস্থ মানুষের দুঃখে সে দুঃখী। আর্তের সেবায় নিবেদিত এক প্রাণ। সে ফ্রান্সের ভার্সাই বিশ্ববিদ্যালয়ের ওরিয়েন্টাল স্টাডিজের ছাত্রী। ছুটিতে বাবা-মায়ের কাছে বেড়াতে এসেছে। তার বাবা এম্বাসিতে কাজ করে। কোনো সাহায্য সংস্থার সঙ্গে অ্যানিয়েস জড়িত। ভেঙে পড়া মানুষের মানসিক শক্তি জোগান দেওয়ার ব্যাপারে তার আগ্রহ স্বতঃস্ম্ফূর্ত। আফ্রিকাতেও সে একবার এ ধরনের এক প্রকল্পের সঙ্গে জড়িত ছিল। দুর্ভিক্ষ, খরাকবলিত গহিন অরণ্যের নানা গ্রামে-পাড়ায় তারা ঘুরে বেড়িয়েছে। ঘরে ঘরে গিয়ে খোঁজ-খবর নিয়েছে। খাবার-পানীয় জুগিয়েছে। মৃতের সৎকার করেছে। সন্তানহারা জননীকে সান্ত্বনা দিয়েছে।
দ্বিতীয় দিনেই কথাটি চাউর হয়ে গিয়েছিল। অ্যানিয়েস ফরাসি ঢঙে ভাঙা ইংরেজিতে কৌতূহল প্রকাশ করেছিল।
- আই উড লাইক টু অ্যাডমায়ার সাম অব ইউর এক্সপেরিয়েন্স অব ফ্রিডম ফাইট... মুক্তিযুদ্ধ... গ্রেট লিবারেশন ওয়ার...।
আর যায় কোথা, আফজাল মুখর হয়ে ওঠে। সে আর এক দফা চায়ের অর্ডার দেয়।
- চিতপুরের সেই ব্রিজটি ছোট হলেও বেশ গুরুত্বপূর্ণ ছিল। ঢাকা ক্যান্টনমেন্ট থেকে ফ্রন্টের পাকিস্তানি সেনাদের জন্য খাবার-রসদ-গোলাবারুদ যেত এ পথে।
উত্তেজনায় ফুলে ফুলে ওঠে আফজালের বুক। সে বলে চলে,
- ঘুটঘুটে অন্ধকার রাত। চরাচরের বালুর গায়ে জোনাকি বসছে, উঠছে। ঝোপের ধারে ভেসে বেড়াচ্ছে, উড়ছে। বড় রোমান্টিক রাত। আমরা ছিলাম সাতজন। আমি দলনেতা। রাতের শেষ প্রহরে ব্রিজটি দিলাম উড়িয়ে। কিন্তু সবাই ফিরে আসতে পারলাম না। পাকিস্তানি সেনাদের ভারী কামানের গোলার আওতায় পড়ে গেলাম আমরা। যখন হুঁশ হলো, তখন আমি আগরতলার হাসপাতালের ছাউনিতে মৃত্যুর সঙ্গে লড়ছি। লড়ছে মোয়াজ্জেমও। বাকি পাঁচজনের খবর পেয়েছিলাম অনেক পরে। প্রাণেশ, আতিক সেই গোলার ঝড়ে প্রাণ হারিয়েছিল।
আফজাল হাঁপাতে থাকে। মর্জিনা তার পিঠে হাত রেখে দাঁড়িয়ে থাকে।
- ইট ওয়াজ আ গ্রেট ওয়ার, নো ডাউট। অন্যমনস্ক হয়ে উঠে দাঁড়ায় অ্যানিয়েস।
- মেহসি, দ্যাটস অল ফর টুডে। বাই... বাই... ও ভোয়া...।
ব্যস্ত বড় সড়কের অপর পারের নারকেল পাতা ছুঁয়ে অন্ধকার নামছে ঘরে ঘরে। কুয়াশা ছাতা মেলছে লাইটপোস্টের মাথায়। আফজাল জানে, ওই নারকেল বাগানের ডান পাশে একটা শজনে গাছও কষ্টেসৃষ্টে দাঁড়িয়ে আছে। নিজের হালকা অস্তিত্ব নিয়ে। ফুলে ফুলে ছেয়ে আছে গাছটা। আফজালের মন ছুটে চলে। যেখানে সারি সারি সুপারির বন মাথা দোলায়। আমের ডালে গেরুয়া বোল এসেছে অজস্র। মাঠে, বিলের ধারে ফুটেছে শিমুল। চিতপুরের তিরতিরে নদী শুকিয়ে যেতে বসেও শুকায়নি। সেই গ্রামে থাকে হেলেনা...। ঐরাবত ছুটছে... হেলে... দুলে... দিগন্তরেখায় লাল ধুলা উড়িয়ে। এগিয়ে যাচ্ছে আফজাল। আকাশে উড়ছে তার হাত। স্টেনগানের ঝাঁঝরা নল।
মোয়াজ্জেম, সতীশ, আজমত- ক্লান্ত ভঙ্গিতে হুইলচেয়ারের হাতল ঘুরিয়ে উঠে যায়। যার যার রাতের আস্তানায়। শুধু চায়ের দোকানের কুপি জ্বলা আধো আলোয় বসে থাকে আফজাল। দাঁড়িয়ে থাকে মর্জিনা।
- আচ্ছা মর্জিনা, হেলেনার আর কোনো খোঁজ-খবর জানিস? আফজালের গলার স্বর কেঁপে ওঠে।
- ও তো... ও তো... কুয়েত না কোথায় চলে গেছে জামাইয়ের সঙ্গে। ঢোঁক গেলে মর্জিনা।
- এয়ারপোর্টে নাকি সে কার কাছে তোমার ঠিকানা চেয়েছিল। কান্নায় ভেঙে পড়ে মর্জিনা। ... ভাইয়া, আমাদের কী যে হয়ে গেল... আমরা সবাই...
- কাঁদিস না মর্জিনা। সব ঠিক হয়ে যাবে। দেখিস না, পৃথিবীতে কত ভালো মানুষ এখনও আছে। এই... এই... অ্যানিয়েস... আরও কত ভালো মানুষ...।
আফজালের কণ্ঠ ভিজে আসে। আর কথা সরে না তার। মর্জিনা নীরব অন্ধকারে চোখের জল সামলানোর চেষ্টা করে। প্রকৃতিস্থ থাকার চেষ্টা করে আফজালও।
- কাশেম তোকে নিয়মিত চিঠিপত্র দেয়?
- হ্যাঁ।
- তোরা বিয়েটা সেরে ফেল। আর দেরি করে কী লাভ? চাকরিটা যখন মোটামুটি স্থায়ী, তখন আর দেরি...।
মর্জিনা কথা বলে না। সে তখনও কাঁদছে। সারা রাত ধরে কাঁদবে। কয়েক রাত ধরে আফজাল ঘুমাতে পারে না। শুধু একের পর এক সিগারেট পুড়িয়ে চলে। ছটফট করে। জেগে জেগে স্বপ্ন দেখে। সে ভাবে, এমন কি হতে পারে না! - অ্যানিয়েস তার পাশে এসে দাঁড়াল দৃঢ় পায়ে। উন্নত দেশে কত ধরনের চিকিৎসা হয়! প্যারিসগামী বিমানের ফটক দিয়ে ঢুকে যাচ্ছে তার হুইলচেয়ার। বিশ্ববিখ্যাত পঙ্গু হাসপাতালের বেডে শুয়ে আছে সে। পা দুটো তার ওপরে ঝোলানো। কী তকতকে ঝকঝকে পরিবেশ! সাদা ধবধবে পোশাকে পরীর মতো সুন্দরী নার্সরা করছে তার তত্ত্ব-তালাশ। সে সেরে উঠছে...। শিল্প-সাহিত্যের দেশ প্যারিস। কবিতার দেশ, স্বপ্নের দেশ, প্যারিস। অ্যানিয়েস ক্লাস শেষে প্রতিদিন বিকেলে তার কাছে আসে। হাতে তার গোছা গোছা ফুল। কখনও গোলাপ। কখনও টিউলিপ। কিংবা পপি। আর ভাবতে পারে না আফজাল। উঠে বসে। দড়ির মতো ঝুলে পড়া পা দুটিতে হাত বোলায়। সোহরাওয়ার্দী পঙ্গু হাসপাতালের বড় ডাক্তারের শেষ কথাগুলো আজও তার কানে গ্রেনেড ফাটার মতো শব্দ করে সব সময়- এর আর চিকিৎসা নেই। এ অবস্থা মেনে নেওয়ার চেষ্টা করুন।
পাশের ঘরে সতীশ পাল নাক ডাকছে। মোয়াজ্জেমও ঘুমে অচেতন। বাইরের পোর্চের আলো চুইয়ে তার বিছানায়ও এসে পড়েছে। সিগারেট ধরায় আফজাল। বিছানার তলায়, অগোছালো পাশের টেবিল হাতড়ে আধো অন্ধকারে সে কাগজ-কলম জোগাড় করার চেষ্টা করে। কাগজ এক টুকরা যাও পেল, কলম পেল না। কয়েক বছর পর আবার তার বড় কবিতা আবৃত্তি করতে ইচ্ছা হলো, উচ্চকণ্ঠে। লিখতে ইচ্ছা করল কী সব আবোল-তাবোল!
রাত বাড়ছে। আফজাল সিগারেট টানছে একটানা। অ্যানিয়েসের দেহসৌষ্ঠব তার চোখের সামনে জ্বলছে, নিভছে। তার ঢেউ খেলানো লালচে চুল। তরমুজ-ফালির মতো রাঙা ঠোট। পুষ্ট নরম থলথলে স্তনরেখা, ভারী নিতম্ব। তার সব অঙ্গভঙ্গি জীবন্ত হয়ে আফজালকে আচ্ছন্ন করে ফেলতে থাকে। বুনো এক মোষ যেন তার রক্তধারায় নেচে নেচে ওঠে। সারা রাত ধরে চলবে সেই বিবশ প্রাণীটির তুমুল দাপাদাপি, আর্তচিৎকার।
আফজালের মন হু হু করে ওঠে। কান্নায় ভেঙে পড়ে সে।
হলেনা... হেলেনা... গো... তুমি আমায় ফেলে চলে গেলে... কোথায় রেখে গেলে... তুমি আমাকে যে বড় কষ্ট...
দুপুর গড়িয়ে সূর্য পশ্চিমে টাল খেতে থাকলেই আফজাল বড় রাস্তার দিকে ঘুরেফিরে তাকায়। সূর্য আরও তেজি হয়ে ঢলে পড়তে শুরু করলে সে পঙ্গু পুনর্বাসন কেন্দ্রের ভাঁজ করা ছোট্ট প্রধান ফটকের মুখে এসে বসে থাকে। আরও ঘণ্টা দুয়েক পর আসবে মোয়াজ্জেম, সতীশ, আজমত। আরও কেউ কেউ। আসবে মর্জিনা। হাতে থাকবে তার কুল বরইয়ের পোঁটলা, নয়তো বিস্টু্কটের প্যাকেট। জমে উঠবে সান্ধ্য-আড্ডা। চায়ের আসর। কিন্তু কয়েক দিন ধরে অ্যানিয়েস আসছে না। প্রতিদিনই তারা প্রত্যাশা নিয়ে বসে থাকে। চা হয়ে ওঠে বিরস। আড্ডটি প্রাণহীন। রাত বাড়লে মর্জিনাও একরাশ হতাশার বোঝা নিয়ে ফিরে যায়। আর ভাবে, আজ রাতেই কাশেমকে সে লিখবে, আর দেরি করে কী লাভ? তুমিও যখন অধৈর্য হয়ে উঠেছ, ঠিক আছে আসছে মাসেই না হয় বিয়েটা...। কিন্তু সেই চিঠি আর লেখা হয় না। লিখতে বসলেই একতাল অন্ধকার, একরাশ ক্লান্তি ও অনিশ্চয়তা এসে তাকে ঘিরে ধরে।
অনিয়মের ষষ্ঠ দিনে অ্যানিয়েস এলো। আয়েশি ভঙ্গিতে। হেঁটে নয়, বড় স্টেশন ওয়াগন চালিয়ে। পাশে তার সুদর্শন এক যুবক। পেছনে গাড়িভর্তি লাগেজপত্র। সুটকেস-ব্যাগ।
স্বচ্ছন্দ ভঙ্গিতে নেমে এলো অ্যানিয়েস।
- আমি আজ সন্ধ্যায় চলে যাচ্ছি প্যারিস। ওখান থেকে ভার্সাই। আমার ছুটি প্রায় শেষ।
আফজাল বজ্রাহতের মতো হকচকিয়ে কী যেন বলতে যাচ্ছিল। হয়তো বা এক কাপ চায়ের কথা। নয়তো অন্য কিছু। শেষবারের মতো। তা আর বলা হলো না।
- আবার আসব। দেখা হবে হয়তো। আসি... বাই... বাই... ওভোয়া। গাড়িতে উঠে বসে অ্যানিয়েস। ধোঁয়ার বোমা ফাটিয়ে গাড়ি ২৭ নম্বর রোডে মোড় নেয়। অদৃশ্য হয়ে যায়।
মেসে ফিরে মর্জিনা কাশেমকে চিঠি লিখতে বসে। সে লেখে, যত দিন না তার ভাইয়ের সঠিক পুনর্বাসন হচ্ছে, তত দিন তার পক্ষে বিয়ে করা সম্ভব নয়।
বাইরে তখন মাঝরাতের ফাল্কগ্দুনী বাতাসের বেসামাল দাপাদাপি।
আফজালের মাথার ওপর প্রচুর ধুলা জমা ঝাঁকড়া কদম গাছ। বাঁ পাশে শিশু-পেয়ারার চারা। পাতার গাঢ় রং প্রায় অদৃশ্য। এক পলেস্তারা ধুলা সবখানে। পঙ্গু পুনর্বাসন কেন্দ্রের শেষ ঘরটি থেকে সে যখন হুইলচেয়ারের চাকা ঘুরিয়ে নেমে আসছিল প্রধান সড়কের ফটকে, তখন মোয়াজ্জেম বালিশ থেকে মাথা উঁচিয়ে একবার দেখে নিয়েছিল আফজালকে। তারপর দেয়ালে টাঙানো ঘড়িটার দিকে সে একবার তন্দ্রা জড়ানো চোখে চায়। নাহ, প্রধান সড়কের সান্ধ্য-আড্ডার সময় হতে এখনও অনেক দেরি। আরও ঘণ্টা দুয়েক। আফজালের মনের ছটফটানি সে আঁচ করতে পারে। মোয়াজ্জেম তাকে চেনে সেই মুক্তিযুদ্ধের সময় থেকে, যখন ঘুটঘুটে অন্ধকার রাতে কম্বলের ভেতরে আগুনের স্ম্ফুলিঙ্গ লুকিয়ে সে বিড়ি টানত। আর বকে চলত, মোয়াজ্জেম ঘুমিয়েছিস? তুই শালা বড় ঘুমকাতুরে। শোন, পৃথিবীর যত বড় বড় কবি-সাহিত্যিক, সব শালায় যোদ্ধা। মুক্তিকামী মানুষের যোদ্ধা। হেমিংওয়ে, পল এলুয়ার, লুই আরাগ, মায়াকোভস্কি, ফকনার। স্থানকালবিশেষে অসি আর মসি এক হয়ে যায়। দেখ, অন্ধকার কত সুন্দর! অন্ধকার আছে বলে কৃষকের কুঁড়েঘরের সন্ধ্যাবাতি মনোরম। কৃষাণির কুমারী মেয়ের মুখরেখা কত তেলতেলে, প্রাণবন্ত। পান খাওয়া রাঙা ঠোঁটের হাসি কত মিষ্টি! ভাবতেও মন কেমন করে! কাঁদতে ইচ্ছা হয়। এ বিভীষিকাময় জীবনের অবসান হবেই। জানিস মোয়াজ্জেম, কাল হেলেনাকেও আমি তাই লিখেছি, আর দেরি নেই, আমরা আসছি...। ঐরাবত আসছে ওই গাঁয়ের দিগন্তরেখায় লাল ধুলা উড়িয়ে... হেলেদুলে... গলার ঘণ্টি ঠুন ঠুন বাজিয়ে...।
মোয়াজ্জেমের বিশ্বাস, আফজাল কবি। হেলেনাকে ভালোবাসে। সে কবিতা ভালোবাসে। সে সকালের শীতের রোদ পিঠে লাগিয়ে ঝালমুড়ি খেতে ভালোবাসে। আবেগাপ্লুত কণ্ঠে হেলেনাকে সে কবিতা শোনাতে ভালোবাসে। সে ভালোবাসে জ্যোৎস্না রাতে বিশাল আকাশে তারাদের ফিসফিসানি, তাদের রহস্যঘন মিটিমিটি। তাই তো সে মুক্তিযোদ্ধা। এসব কিছু ফিরে পেতেই সে যুদ্ধ করছে। বিড়ির অঙ্গার কম্বলে লুকিয়ে একটানা সে টানছে বিড়ি। হাসছে। বিকট হাসি। ফুটিয়ে চলেছে অজস্র কথার খই। আশার বাণী। ঘন নীল শান্ত আকাশে অজস্র তারার বাতির মতো।
-হেলেনা আমি এসে পড়লাম বলে। আমার তুমি... তুমি আমার কবিতা... তুমি আমার মুক্তিযুদ্ধের নেশা...। সে একটানা বলে যেত।
আফজালের জন্য সময় সময় তার বড় কষ্ট হয়। সে কবি, সে স্বপ্ন দেখে। কেবলই স্বপ্ন দেখে। অন্ধকার ছাড়িয়ে সে আলো দেখে।
পুনর্বাসন কেন্দ্রের পশ্চিম চত্বর ছাড়িয়ে কদম গাছের ছায়া গিয়ে পড়েছে পরের বাড়িটিতে, যার মেইন গেটের সবুজ জমিনে ঝুলছে কালো প্লেট, 'কুকুর হইতে সাবধান'।
আফজাল পশ্চিমে ঢলে পড়া সূর্যের প্রায় গ্রীষ্ফ্মের মতো উষ্ণ তেজ মাথা পেতে নিয়ে হুইলচেয়ার ঠেলে চলে যায় সরু প্রধান ফটকের কাছে। ভাঁজ করা চটা-ওঠা লোহার গেটের ধারে। যেখানে একসময় আসবে ফরাসি মেয়ে অ্যানিয়েস। অ্যানিয়েস ফিউরানি। সে বসবে এসে ফটকের পাশের অস্থায়ী টি-স্টলের বেঞ্চিতে। টানবে বিদেশি সিগারেট, ছাড়বে ধোঁয়ার রিং। একের পর এক। কী টুকটুকে লাল জিব তার। কমলা রঙের ঠোঁট। গালের রক্ত চলাচলও দেখা যায়। গাঢ় নীলচে চোখ, ঢেউ খেলানো লালচে চুলের ভাঁজ- সব প্রায় মুখস্থ হয়ে গেছে আফজালের। অ্যানিয়েস পরে একটা হালকা হলদে ফুলহাতা গেঞ্জি। ফিকে লাল জিন্স। গেঞ্জির ওপর সবুজ রঙা পাতলা উইন্ড ব্রেকার। পায়ে ঘন নীল কেডস। সুডৌল বাম ঊরুর ওপর ডান ঊরু ভাঁজ করে ফেলে অ্যানিয়েস যখন সহজ-স্বচ্ছন্দ ভঙ্গিতে কথা বলে চলে, ফরাসি একসেন্টে, ভাঙা-ভাঙা ইংরেজিতে, আফজালকে এগিয়ে দেয় 'ডানহিল' সিগারেটের জমাট রক্তলাল প্যাকেট, তখনও তার সহ্য হয়। কিন্তু যখন সে দেশলাইয়ের জ্বলন্ত কাঠি নিয়ে এগিয়ে আসে তখন আর সহ্য হয় না।
কপালের দু'পাশের শিরা তার দাপাদাপি করে। ছিঁড়ে যেতে চায়। অ্যানিয়েসের ভরা নরম রক্তিম স্তন ও পাকা লাল আঙুরের মতো গাঢ় রঙের বোঁটা দুটোও আফজালের মুখের কাছে এগিয়ে আসে। একটু এগোলেই যেন আলতো মুখ লাগানো যায়। ধরা যায় সেই অপরূপ রূপসম্ভার। কেমন নেশা ধরা তার প্রশ্বাস, চুল আর গায়ের ঘ্রাণ। ভীষণ মাতাল করা।
কাঁপা হাতে সিগারেট ধরায় আফজাল। ধোঁয়ার অস্পষ্ট আঁকিবুঁকি বাতাসের ফুৎকারে হারাতে থাকে। সে সিগারেট টানতে ভুলে যায়। তার হুইলচেয়ারের হাতল ধরে কখন মর্জিনা এসে দাঁড়িয়ে থাকে, সে টেরও পায় না।
- ভাইজান, তোমার শিরদাঁড়ার ব্যথাটা আজ কেমন?
- হ্যাঁ। ওহ... তুই... তুই কখন এসেছিস! হকচকিয়ে উঠবে আফজাল।
- এই তো...। তুমি না ঢাকাই কুল খেতে চেয়েছিলে- এই নাও।
- অ্যানিয়েস প্লিজ... দিস ইজ বেরি। টিপিক্যাল বাংলাদেশি ফ্রুট... বাংলাদেশি... প্লিজ...। কাঁপা হাতে আফজাল বরইয়ের ঠোঙা এগিয়ে দেয় তাকে। অ্যানিয়েস, শি ইজ মাই লিটল সিস্টার...! স্টিল আনম্যারেড! বাট শি হ্যাজ এ বয়...। প্লিজ টেইক অ্যানাদার। ওহ, মাই লাভিং সিস্টার... শি ইজ সো গুড... আই এম মাদারলেস ফ্রম মাই চাইল্ডহুড। দো শি ইজ ইয়ঙ্গার... বাট শি প্লেইজ মাদার ফর মি। শি ইজ গ্রেট... সিম্পলি গ্রেট... অ্যানিয়েস...।
চার-চারটে হুইলচেয়ার এসে ঘিরে থাকে অ্যানিয়েসকে। ছাপরা চায়ের দোকানে কুপি জ্বলে। বার কয়েক চায়ের অর্ডার হয়। অ্যানিয়েস চায়ে চিনি খায় না। দোকানদার তা জেনে গেছে। তবু আফজাল তাকে স্মরণ করিয়ে দেয়। বাচ্চা ছেলে লোকমান গল্গাসে গল্গাসে চা এগিয়ে দেয়। অ্যানিয়েস-মর্জিনা ছাড়া সবাই ধূমায়িত গরম গল্গাসে ঠোঁট লাগানোর চেষ্টা করে। অ্যানিয়েস চায়ের গল্গাসটি সযত্নে তার পাশের টুলে রাখে। সে চা ঠান্ডা করে খায়। মর্জিনা এক পায়ে ভর দিয়ে সামান্য বেঁকে দাঁড়িয়ে থাকে। তার বাঁ হাতে ছোট চায়ের গল্গাস। ডান হাত হুইলচেয়ারের পেছনে। আফজালের পিঠ ছুঁয়ে। যেখানটায় সব সময় একটা ব্যথা চিনচিনিয়ে ওঠা-নামা করে। সময় সময় সারা পিঠেও ছড়িয়ে যায়। মর্জিনা বিষণ্ণ-কাতর-পরিশ্রান্ত ভঙ্গিতে একঠায় দাঁড়িয়ে থাকে। সে দেখে, সবার চোখের তারায় জ্বলছে কামনা- যন্ত্রণার আগুন। দাবানলের মতো। আগুন জ্বলছে তার ভাইয়ের চোখেও। জ্বলজ্বলে, ধিকিধিকি। আগুন জ্বলছে কাঠমিস্ত্রি মোয়াজ্জেমের চোখে, বৈলামপুরের মাঝবয়সী কৃষক সতীশের চোখে। প্রৌঢ় পাট কারবারি আজমত আলীর চোখে। চোখের সামনে তাদের অপ্সরা পানসির মতো এক উদ্ভিন্ন যৌবনার দেহ-সৌষ্ঠব হেলছে-দুলছে। ছন্দময় হয়ে ফুলে ফুলে উঠছে তার ভরা বুক। সুডৌল ঊরু, ভারী নিতম্ব। রমণীর মোহময়ী রক্ত-মাংস, রূপের আগুনে পুড়ছে সবাই। পঙ্গু আফজাল, মোয়াজ্জেম, সতীশ, আজমত আলী বেপারী।
এই সান্ধ্য আসরের প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় দিনে পঙ্গু পুনর্বাসন কেন্দ্রের অনেকেই বুঝে গেল, ফরাসি এই মেয়েটি অত্যন্ত সংবেদনশীল ও আশ্চর্য রকমের ভালো মানুষ। দুস্থ মানুষের দুঃখে সে দুঃখী। আর্তের সেবায় নিবেদিত এক প্রাণ। সে ফ্রান্সের ভার্সাই বিশ্ববিদ্যালয়ের ওরিয়েন্টাল স্টাডিজের ছাত্রী। ছুটিতে বাবা-মায়ের কাছে বেড়াতে এসেছে। তার বাবা এম্বাসিতে কাজ করে। কোনো সাহায্য সংস্থার সঙ্গে অ্যানিয়েস জড়িত। ভেঙে পড়া মানুষের মানসিক শক্তি জোগান দেওয়ার ব্যাপারে তার আগ্রহ স্বতঃস্ম্ফূর্ত। আফ্রিকাতেও সে একবার এ ধরনের এক প্রকল্পের সঙ্গে জড়িত ছিল। দুর্ভিক্ষ, খরাকবলিত গহিন অরণ্যের নানা গ্রামে-পাড়ায় তারা ঘুরে বেড়িয়েছে। ঘরে ঘরে গিয়ে খোঁজ-খবর নিয়েছে। খাবার-পানীয় জুগিয়েছে। মৃতের সৎকার করেছে। সন্তানহারা জননীকে সান্ত্বনা দিয়েছে।
দ্বিতীয় দিনেই কথাটি চাউর হয়ে গিয়েছিল। অ্যানিয়েস ফরাসি ঢঙে ভাঙা ইংরেজিতে কৌতূহল প্রকাশ করেছিল।
- আই উড লাইক টু অ্যাডমায়ার সাম অব ইউর এক্সপেরিয়েন্স অব ফ্রিডম ফাইট... মুক্তিযুদ্ধ... গ্রেট লিবারেশন ওয়ার...।
আর যায় কোথা, আফজাল মুখর হয়ে ওঠে। সে আর এক দফা চায়ের অর্ডার দেয়।
- চিতপুরের সেই ব্রিজটি ছোট হলেও বেশ গুরুত্বপূর্ণ ছিল। ঢাকা ক্যান্টনমেন্ট থেকে ফ্রন্টের পাকিস্তানি সেনাদের জন্য খাবার-রসদ-গোলাবারুদ যেত এ পথে।
উত্তেজনায় ফুলে ফুলে ওঠে আফজালের বুক। সে বলে চলে,
- ঘুটঘুটে অন্ধকার রাত। চরাচরের বালুর গায়ে জোনাকি বসছে, উঠছে। ঝোপের ধারে ভেসে বেড়াচ্ছে, উড়ছে। বড় রোমান্টিক রাত। আমরা ছিলাম সাতজন। আমি দলনেতা। রাতের শেষ প্রহরে ব্রিজটি দিলাম উড়িয়ে। কিন্তু সবাই ফিরে আসতে পারলাম না। পাকিস্তানি সেনাদের ভারী কামানের গোলার আওতায় পড়ে গেলাম আমরা। যখন হুঁশ হলো, তখন আমি আগরতলার হাসপাতালের ছাউনিতে মৃত্যুর সঙ্গে লড়ছি। লড়ছে মোয়াজ্জেমও। বাকি পাঁচজনের খবর পেয়েছিলাম অনেক পরে। প্রাণেশ, আতিক সেই গোলার ঝড়ে প্রাণ হারিয়েছিল।
আফজাল হাঁপাতে থাকে। মর্জিনা তার পিঠে হাত রেখে দাঁড়িয়ে থাকে।
- ইট ওয়াজ আ গ্রেট ওয়ার, নো ডাউট। অন্যমনস্ক হয়ে উঠে দাঁড়ায় অ্যানিয়েস।
- মেহসি, দ্যাটস অল ফর টুডে। বাই... বাই... ও ভোয়া...।
ব্যস্ত বড় সড়কের অপর পারের নারকেল পাতা ছুঁয়ে অন্ধকার নামছে ঘরে ঘরে। কুয়াশা ছাতা মেলছে লাইটপোস্টের মাথায়। আফজাল জানে, ওই নারকেল বাগানের ডান পাশে একটা শজনে গাছও কষ্টেসৃষ্টে দাঁড়িয়ে আছে। নিজের হালকা অস্তিত্ব নিয়ে। ফুলে ফুলে ছেয়ে আছে গাছটা। আফজালের মন ছুটে চলে। যেখানে সারি সারি সুপারির বন মাথা দোলায়। আমের ডালে গেরুয়া বোল এসেছে অজস্র। মাঠে, বিলের ধারে ফুটেছে শিমুল। চিতপুরের তিরতিরে নদী শুকিয়ে যেতে বসেও শুকায়নি। সেই গ্রামে থাকে হেলেনা...। ঐরাবত ছুটছে... হেলে... দুলে... দিগন্তরেখায় লাল ধুলা উড়িয়ে। এগিয়ে যাচ্ছে আফজাল। আকাশে উড়ছে তার হাত। স্টেনগানের ঝাঁঝরা নল।
মোয়াজ্জেম, সতীশ, আজমত- ক্লান্ত ভঙ্গিতে হুইলচেয়ারের হাতল ঘুরিয়ে উঠে যায়। যার যার রাতের আস্তানায়। শুধু চায়ের দোকানের কুপি জ্বলা আধো আলোয় বসে থাকে আফজাল। দাঁড়িয়ে থাকে মর্জিনা।
- আচ্ছা মর্জিনা, হেলেনার আর কোনো খোঁজ-খবর জানিস? আফজালের গলার স্বর কেঁপে ওঠে।
- ও তো... ও তো... কুয়েত না কোথায় চলে গেছে জামাইয়ের সঙ্গে। ঢোঁক গেলে মর্জিনা।
- এয়ারপোর্টে নাকি সে কার কাছে তোমার ঠিকানা চেয়েছিল। কান্নায় ভেঙে পড়ে মর্জিনা। ... ভাইয়া, আমাদের কী যে হয়ে গেল... আমরা সবাই...
- কাঁদিস না মর্জিনা। সব ঠিক হয়ে যাবে। দেখিস না, পৃথিবীতে কত ভালো মানুষ এখনও আছে। এই... এই... অ্যানিয়েস... আরও কত ভালো মানুষ...।
আফজালের কণ্ঠ ভিজে আসে। আর কথা সরে না তার। মর্জিনা নীরব অন্ধকারে চোখের জল সামলানোর চেষ্টা করে। প্রকৃতিস্থ থাকার চেষ্টা করে আফজালও।
- কাশেম তোকে নিয়মিত চিঠিপত্র দেয়?
- হ্যাঁ।
- তোরা বিয়েটা সেরে ফেল। আর দেরি করে কী লাভ? চাকরিটা যখন মোটামুটি স্থায়ী, তখন আর দেরি...।
মর্জিনা কথা বলে না। সে তখনও কাঁদছে। সারা রাত ধরে কাঁদবে। কয়েক রাত ধরে আফজাল ঘুমাতে পারে না। শুধু একের পর এক সিগারেট পুড়িয়ে চলে। ছটফট করে। জেগে জেগে স্বপ্ন দেখে। সে ভাবে, এমন কি হতে পারে না! - অ্যানিয়েস তার পাশে এসে দাঁড়াল দৃঢ় পায়ে। উন্নত দেশে কত ধরনের চিকিৎসা হয়! প্যারিসগামী বিমানের ফটক দিয়ে ঢুকে যাচ্ছে তার হুইলচেয়ার। বিশ্ববিখ্যাত পঙ্গু হাসপাতালের বেডে শুয়ে আছে সে। পা দুটো তার ওপরে ঝোলানো। কী তকতকে ঝকঝকে পরিবেশ! সাদা ধবধবে পোশাকে পরীর মতো সুন্দরী নার্সরা করছে তার তত্ত্ব-তালাশ। সে সেরে উঠছে...। শিল্প-সাহিত্যের দেশ প্যারিস। কবিতার দেশ, স্বপ্নের দেশ, প্যারিস। অ্যানিয়েস ক্লাস শেষে প্রতিদিন বিকেলে তার কাছে আসে। হাতে তার গোছা গোছা ফুল। কখনও গোলাপ। কখনও টিউলিপ। কিংবা পপি। আর ভাবতে পারে না আফজাল। উঠে বসে। দড়ির মতো ঝুলে পড়া পা দুটিতে হাত বোলায়। সোহরাওয়ার্দী পঙ্গু হাসপাতালের বড় ডাক্তারের শেষ কথাগুলো আজও তার কানে গ্রেনেড ফাটার মতো শব্দ করে সব সময়- এর আর চিকিৎসা নেই। এ অবস্থা মেনে নেওয়ার চেষ্টা করুন।
পাশের ঘরে সতীশ পাল নাক ডাকছে। মোয়াজ্জেমও ঘুমে অচেতন। বাইরের পোর্চের আলো চুইয়ে তার বিছানায়ও এসে পড়েছে। সিগারেট ধরায় আফজাল। বিছানার তলায়, অগোছালো পাশের টেবিল হাতড়ে আধো অন্ধকারে সে কাগজ-কলম জোগাড় করার চেষ্টা করে। কাগজ এক টুকরা যাও পেল, কলম পেল না। কয়েক বছর পর আবার তার বড় কবিতা আবৃত্তি করতে ইচ্ছা হলো, উচ্চকণ্ঠে। লিখতে ইচ্ছা করল কী সব আবোল-তাবোল!
রাত বাড়ছে। আফজাল সিগারেট টানছে একটানা। অ্যানিয়েসের দেহসৌষ্ঠব তার চোখের সামনে জ্বলছে, নিভছে। তার ঢেউ খেলানো লালচে চুল। তরমুজ-ফালির মতো রাঙা ঠোট। পুষ্ট নরম থলথলে স্তনরেখা, ভারী নিতম্ব। তার সব অঙ্গভঙ্গি জীবন্ত হয়ে আফজালকে আচ্ছন্ন করে ফেলতে থাকে। বুনো এক মোষ যেন তার রক্তধারায় নেচে নেচে ওঠে। সারা রাত ধরে চলবে সেই বিবশ প্রাণীটির তুমুল দাপাদাপি, আর্তচিৎকার।
আফজালের মন হু হু করে ওঠে। কান্নায় ভেঙে পড়ে সে।
হলেনা... হেলেনা... গো... তুমি আমায় ফেলে চলে গেলে... কোথায় রেখে গেলে... তুমি আমাকে যে বড় কষ্ট...
দুপুর গড়িয়ে সূর্য পশ্চিমে টাল খেতে থাকলেই আফজাল বড় রাস্তার দিকে ঘুরেফিরে তাকায়। সূর্য আরও তেজি হয়ে ঢলে পড়তে শুরু করলে সে পঙ্গু পুনর্বাসন কেন্দ্রের ভাঁজ করা ছোট্ট প্রধান ফটকের মুখে এসে বসে থাকে। আরও ঘণ্টা দুয়েক পর আসবে মোয়াজ্জেম, সতীশ, আজমত। আরও কেউ কেউ। আসবে মর্জিনা। হাতে থাকবে তার কুল বরইয়ের পোঁটলা, নয়তো বিস্টু্কটের প্যাকেট। জমে উঠবে সান্ধ্য-আড্ডা। চায়ের আসর। কিন্তু কয়েক দিন ধরে অ্যানিয়েস আসছে না। প্রতিদিনই তারা প্রত্যাশা নিয়ে বসে থাকে। চা হয়ে ওঠে বিরস। আড্ডটি প্রাণহীন। রাত বাড়লে মর্জিনাও একরাশ হতাশার বোঝা নিয়ে ফিরে যায়। আর ভাবে, আজ রাতেই কাশেমকে সে লিখবে, আর দেরি করে কী লাভ? তুমিও যখন অধৈর্য হয়ে উঠেছ, ঠিক আছে আসছে মাসেই না হয় বিয়েটা...। কিন্তু সেই চিঠি আর লেখা হয় না। লিখতে বসলেই একতাল অন্ধকার, একরাশ ক্লান্তি ও অনিশ্চয়তা এসে তাকে ঘিরে ধরে।
অনিয়মের ষষ্ঠ দিনে অ্যানিয়েস এলো। আয়েশি ভঙ্গিতে। হেঁটে নয়, বড় স্টেশন ওয়াগন চালিয়ে। পাশে তার সুদর্শন এক যুবক। পেছনে গাড়িভর্তি লাগেজপত্র। সুটকেস-ব্যাগ।
স্বচ্ছন্দ ভঙ্গিতে নেমে এলো অ্যানিয়েস।
- আমি আজ সন্ধ্যায় চলে যাচ্ছি প্যারিস। ওখান থেকে ভার্সাই। আমার ছুটি প্রায় শেষ।
আফজাল বজ্রাহতের মতো হকচকিয়ে কী যেন বলতে যাচ্ছিল। হয়তো বা এক কাপ চায়ের কথা। নয়তো অন্য কিছু। শেষবারের মতো। তা আর বলা হলো না।
- আবার আসব। দেখা হবে হয়তো। আসি... বাই... বাই... ওভোয়া। গাড়িতে উঠে বসে অ্যানিয়েস। ধোঁয়ার বোমা ফাটিয়ে গাড়ি ২৭ নম্বর রোডে মোড় নেয়। অদৃশ্য হয়ে যায়।
মেসে ফিরে মর্জিনা কাশেমকে চিঠি লিখতে বসে। সে লেখে, যত দিন না তার ভাইয়ের সঠিক পুনর্বাসন হচ্ছে, তত দিন তার পক্ষে বিয়ে করা সম্ভব নয়।
বাইরে তখন মাঝরাতের ফাল্কগ্দুনী বাতাসের বেসামাল দাপাদাপি।
- বিষয় :
- মুক্তিযুদ্ধের গল্প