প্রচ্ছদ
চলতি জীবনের চলচ্চিত্র থেকে

ছবি ::মিনহাজ আহমেদ
দ্বিতীয় সৈয়দ-হক
প্রকাশ: ০৭ অক্টোবর ২০২১ | ১২:০০
স্মৃতি- মানুষের চলতি জীবনের চলচ্চিত্রে থমকে যাওয়া সেই মুহূর্তগুলো- কীভাবে ধরে রাখি আমারা তাদের; কীভাবে ধরে রাখে তারাও আমাদের তাদের খপ্পরে? স্মৃতি বলতেই যে মধুর স্মৃতি, তা তো নয়। কিছু স্মৃতি ধরে রাখি আমরা, বুকের মধ্যে, জালি কবুতরের মতো, আবারও, কিছু স্মৃতি নিজেরাই আমাদের বুকের মাঝে তাদের ধারালো নখ দিয়ে বেয়োনেটের মতো খোঁচা দিয়ে চলে; তাদের থামাতে, তাদের আক্রমণ ক্ষণিকের জন্যও রোধ করতে আমরা অক্ষম হয়ে পড়ি। স্মৃতির এই বিদ্যমানতা নিয়ে লিখতে গেলে অনেক কিছুই লেখা যায়। লেখা যায়, জীবনের সেই চলচ্চিত্র থেকে ধরে রাখা কিছু ফ্রেম কেমনে আমাদের মনের, আমাদের চেতনার, আমাদের অস্তিত্বের ভেতরে গুঁজে রাখি- কখনও বা স্বেচ্ছায়, কখনও বা প্রচ অনিচ্ছা সত্ত্বেও। এবং, হয়েই থাকে যদি জীবন এমন একটি চলচ্চিত্র- যা দেখবার সুযোগ আমরা একবারই মাত্র পাই, যাকে আমরা না পারি এগোতে, না পারি পিছিয়ে ফের আরেকটি বারও করে দেখতে- তাহলে নিজের কাছেই প্রশ্ন করতে হয়- এই স্মৃতি-ক্ষমতা, স্মৃতিশক্তি বলে জিনিসটি থেকেও বা আমাদের লাভ কী? এটি কি কেবল আমাদের দুঃখের সময় সুখের কথা কিম্বা সুখের সময় দুঃখের কথা মনে করিয়ে দিতে? নাকি মানুষের এই স্মৃতি গঠন ও ধারণ করে রাখবার ক্ষমতা আমাদের বিবর্তনের একটি অপরিহার্য অংশ?
স্মৃতি এবং স্মরণশক্তি- এই দুটি জিনিস আমাদের ভেতরে একই সাথে কাজ করে, তবে ভিন্নভাবে। স্মরণশক্তি না থাকলে যেমন কোনো স্মৃতি গঠন করাই অসম্ভব হয়ে ওঠে, সেভাবে, স্মৃতি না থাকলে স্মরণ করবার মতোও আমাদের কিছু থাকে না। স্মরণশক্তি আমাদের মনে করিয়ে দেয় পূর্ব অভিজ্ঞতা, অনুভূতি, অর্জিত জ্ঞান বা পরামর্শের কথা। এগুলো থেকেই দেখা যায় কিছু কিছু ঘটনা পরবর্তী সময়ে আমাদের মনে স্মৃতির আকার নেয়। সেই স্মৃতিগুলোকেই আমরা আবার স্মরণ করে থাকি। তবে, স্মরণ করবার শক্তি, বা ক্ষমতা, কেবল আমাদের স্মৃতিচারণ করতে সাহায্য করে না। তার রয়েছে আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা আমাদের চলমান জীবনে। স্মরণশক্তি মনে করিয়ে দেয়, আগুনের খুব কাছে গেলে দেহ পুড়ে যায়, বলে চলন্ত গাড়ির সামনে কেন ঝাঁপ দিতে নেই, বলে কার সাথে, কীভাবে চলতে হয়, মনে করিয়ে দেয় এই দৈনন্দিন জীবনযাত্রায় এতসব খুঁটিনাটি সবকিছু, যা নিয়ে আমরা কখনও, একটি মুহূর্তের জন্যও, ভাববার কথা চিন্তা করি না। এই হলো স্মরণশক্তির আসল শক্তি; তার আসল গুণ। তবে, আমাদের দৈনন্দিন জীবনে স্মরণশক্তির এই অভীষ্ট উদ্দেশ্য নিয়ে আমরা সাধারণত ভেবে থাকি না। জীবন চলতে থাকে অটো-পাইলটে এবং সেই চলার মধ্যে আমাদের কতকিছু স্মরণ করতে হয়, তার হিসেব আমরা রাখিও না, রাখা সম্ভবও না। এই একই স্মরণশক্তিটিকেই আমরা প্রয়োগ করে থাকি যখন স্মৃতিচারণ করি।
স্মৃতি বলতে বুঝি সেই মুহূর্তগুলো, চলচ্চিত্রের ফিতে থেকে কাটা হাতেগোনা কয়েকটি ছবি, যাদের কাছে আমরা জীবন চলা-ক্রমে বারংবার ফিরে আসি, অথবা যারা বারংবার হাজিরা দিয়ে উপস্থিত হয় আমাদের সামনে। স্মৃতি আমাদের দৈনন্দিন জীবনে সেভাবে ঠিক প্রয়োজন হয় না, তবুও, আমাদের জীবনে প্রভাব ফেলে। এখানে, স্মরণশক্তি ও স্মৃতির এই সম্পূর্ণ ভিন্ন দুটি রূপ যে একে অপরের থেকে আলাদা, তাও ঠিক নয়। ব্যর্থ প্রেমে বিফল হয়ে যুবক দ্বিতীয়বার ভালোবাসার ঘরে পা ফেলতে ইতস্তত করে, আবারও যদি নতুন করে ব্যর্থ হতে হয়, সেই ভয়ে। স্বামীর অত্যাচারে ঘর-ছাড়া গৃহিণী দ্বিতীয়বার ঘর বাঁধতে অনিচ্ছুক হয়ে ওঠে, যদি দেখা যায় আবারও তার সেই একই দোযখে প্রবেশ করা হয়। এভাবেই, স্মৃতি আমাদের বর্তমান জীবনেও প্রতিটি দিন, প্রতিটি মুহূর্ত, অবিরাম কাজ করে যায়, এভাবেই, অতীতের কথা- এখানে এবং এখন- আমাদের বর্তমান জীবনে প্রভাব ফেলে এবং, এভাবেই মানুষ ক্রীতদাস হয়ে থাকে তার নিজেরই জীবন-কাহিনি, তার স্মৃতিমালার কাছে। স্বেচ্ছায় হোক বা অনিচ্ছায় হোক, পুরোনো দিনের কথা, অতীতের ঘটনাকে আমরা স্মৃতি বলে গুরুত্ব দিয়েই, সেগুলোকে ফের স্মরণ করে আমরা একেকজন নির্মাণ করে নিই নিজেদেরই জীবনের কারাগার।
যদি বলি, তাহলে, যে এই স্মৃতি বিষয়টিকে নিয়ে খুব বেশি মাথা ঘামাবার তেমন কিছু নাই? বলিই, যদি, যে মানুষের স্মৃতিশক্তি ও স্মরণ করবার ক্ষমতার ব্যাপারটি একদিক থেকে দেখতে গেলে খুবই সাদাকালো? এর ব্যাখ্যা খুব একটি কঠিনও নয়- একটু ভেবে দেখলেই দেখা যায় যে আমাদের প্রতিটি স্মৃতির গোড়ায়, প্রতিটি স্মৃতির তৃণমূলে রয়েছে একটিমাত্র অনুভূতি, সেই অভীষ্ট উদ্দেশ্যের পেছনেও একটি গুপ্ত উদ্দেশ্য- এবং, সেই উদ্দেশ্যটির মূলে যেই অনুভূতি, তার নাম ভালোবাসা। অগত্যা দুটি মানবের মধ্যে কেবল প্রেম-ভালোবাসা নয়, বরং একটি বৃহত্তর প্রেক্ষাপটে ভালোবাসা, বা, যাকে বলা যায় সুখ- মানুষের মধ্যে, নিজের মধ্যে, অন্যের প্রতি, নিজের প্রতি, ভূমির প্রতি, নেতার প্রতি ও জাতির প্রতি। এর পরিপ্রেক্ষিতে, ভালোবাসাকে আমরা একধরনের সুখ বলে মনে করতে পারি। এমন একটি কিছু, যার কারণে আমরা সুখ পেয়ে থাকি এবং যার অভাবে আমরা "অ-সুখ" অনুভব করি। জীবন চলা-ক্রমে কতকিছু ঘটে যায়, প্রতিটি দিন, প্রতিটি মুহূর্তে, যেগুলোকে আমরা কোনো গ্রাহ্যই করি না। যদি আমরা স্মরণ করতে চেষ্টা করি দু-সপ্তাহ আগে কোনো এক রাতে কী আহার পান করেছিলাম, খুব সম্ভব, সেটি আমাদের মনে থাকবে না। মনে থাকবে না, কেননা, আমরা নিজেই সেই ঘটনাটিকে সেভাবে গুরুত্ব দিই নাই। তবে, যদি এমন হতো, যে একটি মানুষ অভাবে পড়ে দীর্ঘদিন প্রায় না খেয়ে-থাকা অবস্থায় থাকবার পর একটি দাওয়াতের আমন্ত্রণ পায়, যেখানে সে অবশেষে মনের আনন্দে পেট ভরে দুটো খেতে পারে, খুব সম্ভব সেই ঘটনাটি মানুষটির মনে স্মৃতি হয়ে গেঁথে থাকবে। কেন তা থাকবে? কেননা, দীর্ঘদিন না খেয়ে থাকবার পর সেই আমন্ত্রণটি তার জন্য একটি অতি সুখের সময়, আনন্দের সময় এবং- এটি জানা কথা- যে সুখ আর আনন্দ দুটিই ভালোবাসার অপর নাম। সেই অনাহারের দিনগুলোর কথা যেমন মনে থাকবে তার সুখের অভাবে, আমন্ত্রণটির কথা মনে থাকবে তার সুখ অনুভব করে। দুটিই বিপরীত অনুভূতি দুদিকে স্মৃতির দাগ কাটবে মানুষটির মনে।
তাই, বলা যায় যে ভালোবাসা কিম্বা সুখ পাবার অথবা ভালোবাসা হারাবার অভিজ্ঞতা, অনুভূতি বা আশঙ্কা থেকেই স্মৃতির গড়ে ওঠা। একথা বোঝাতে গেলে কয়েকটি উদাহরণ বিবেচনা করে দেখলেই হয়- সেই প্রথম প্রেম, সেই শুভ বিবাহের দিন, সেই পরীক্ষা পাস করবার সময়টি, বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডায় সেই মজাদার খাওয়ার কথা, প্রথম চাকরিতে মাসের শেষে প্রথম মাইনে হাতে পাবার সেই সময়, মোটরসাইকেল ছিটকে পড়ে পা ভেঙে যাবার পর দিনের পর দিন শয্যায়স্ত "অ-সুখী" অবস্থায়- তারও পর, পিতা-মাতা, সন্তান হারাবার বুক-ভাঙা শোক, যার কথা ভাবলে এখনও ভেতর বিঁধে থাকা সেই বেয়োনেটটি আবারও নাড়া দিয়ে ওঠে। এই বিস্তৃত প্রতিটি কাহিনির মূলে কি ভালোবাসা পাবার কি হারাবার অনুভূতি নয়? এখানে দুটি মানবের ভেতরে প্রেম, বা জীবনসঙ্গী হবার কথা বাদই দেওয়া যাক। বন্ধুবান্ধবের সাথে আনন্দময় সময় কাটানো কি ভালোবাসার অনুভূতি নয়? হাতে মাহিনা পাবার সেই খুশিটা কি নিজের প্রতি, স্বজনের প্রতি ভালোবাসার অনুভূতি নয়? আরেকদিকে, আঘাত পাওয়া, কাছের কাওকে হারানো, এগুলো কি সবই আমাদের কাছ থেকে কোনো না কোনো এক প্রকারে ভালোবাসা কেড়ে নেওয়া হয় না?
এভাবে, দীর্ঘ এক জীবনের ঘোলা পানি থেকে তুলে আনা প্রতিটি স্মৃতির মধ্যেই দেখা যায় যে সেই স্মৃতির মূলে রয়েছে কোনো এক বেশে ভালোবাসা কিম্বা সেটিকে হারাবার অনুভব। জন্মের পর থেকে আমাদের শেষ নিঃশ্বাস পর্যন্ত প্রতিটি মুহূর্তের ভেতরেই থাকে একটি স্মৃতি হবার অঙ্কুর; থাকে সম্ভাবনা। কিন্তু, বরাবর দেখা যায় যে, জীবন শেষে, আমরা সকলেই বড়জোর হাতেগোনা দু-এক গোছা স্মৃতি নিয়ে কবরে যাই। কেন যাই এভাবে? প্রতিটি মুহূর্তের ভেতরেই যদি থেকে থাকে একটি স্মৃতির বীজ, তাহলে এতো কম স্মৃতি নিয়ে আমরা কীভাবে প্রায় এক শতাব্দী জীবন অনায়াসে পার করে দিতে পারি? এর কারণ, যে জীবনে প্রকৃত সুখ একটি অতি দুর্লভ বস্তু। বারংবার আমরা দেখতে পাই যে টাকা হলেই সুখ কেনা যায় না, বিশ্বের সুন্দরতম নারী ও পুরুষের মাঝেও বিভেদ চলে অবিরাম, মাঝ বয়স পার করে আমাদের মধ্যে কতজনই না ভেবেছি- আহা, আরেকবার যদি সুযোগ পেতাম, তবে জীবনটা অন্যরকম, নতুন করে গড়ে তুলতাম। এ-জীবনে প্রকৃত, অকৃত্রিম ভালোবাসা, প্রকৃত সুখ এমনই দুর্লভ যে আমরা সেই সময়গুলোকে বুকের সাথে আঁখরে ধরে রাখি, বারবার ফিরে যাই আবারও সেই সুখ অনুভব করতে। তার ঠিক বিপরীতভাবে, ভালোবাসা যখন আমাদের কাছ থেকে কেড়ে নেওয়া হয়, সেই মুহূর্তগুলোও আমরা সেই কারণেই ভুলতে পারি না; বারবার ফিরে আসে তারা আমাদের কাছে, রয়ে যায় তারা সারাজীবন।
কেন রয়ে যায় তারা? কেন আমরা খারাপটি বাদ দিয়ে শুধু মধুর স্মৃতি নিয়ে কবরে যেতে সক্ষম হই না? কারণ, ওই অপ্রীতিকর স্মৃতিগুলোও আমাদের বেঁচে থাকবার একটি উপায়- আমাদের বিবর্তনের একটি অপরিহার্য অংশ। রাস্তায় চলতে চলন্ত গাড়ির সামনে পা ফেলতে নেই, রাতে অন্ধকার পথ ধরে একা চলতে নেই, জ্বলন্ত কয়লায় হাত দিতে নেই। এগুলোর প্রতিটি যে আমাদের ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা, তাও নয়। মানবজাত হিসেবে আমাদের একটি যৌথ স্মৃতিও কাজ করে, ঠিক যেভাবে থাকে আমাদের যৌথ চেতনা, এবং, কার্ল ইয়াং-এর মতে যৌথ অবচেতন মন। যৌথ স্মৃতি আমাদের গঠন হয় লোকের মুখে মুখে, খবরের কাগজের অক্ষরে ও বইয়ের পাতায়। এগুলোও স্মৃতি হয়ে রয়ে যায় আমাদের মনে। রাতের অন্ধকারে পথ দিয়ে একা হাঁটি না, কারণ আমরা পড়েছি, কারণ শুনেছি, কারণ প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে দেখেছি মানুষের কী হয় বা হতে পারে এমনটি কাজ করলে। ঘরপোড়া গরুর দশা দেখে অন্য গরুরাও দেখা যায় সিঁদুরে মেঘ দেখে ভয় পায়। এভাবেই কাজ করে আমাদের মধ্যে যৌথ স্মৃতি। এতক্ষণ ব্যক্তিগত স্মৃতি নিয়ে বলেছি, এবারে দেখা যাক ব্যক্তিগত স্মৃতির সাথে যৌথ স্মৃতিও, সেই থেকে, যৌথ চেতনার সম্পর্কটি।
প্রথমেই বোঝা চায় যে স্মৃতি আসে অভিজ্ঞতা থেকে এবং, সেই কারণেই, যৌথ স্মৃতি আসে যৌথ অভিজ্ঞতা থেকে। কারও জন্য সেই অভিজ্ঞতা হয় প্রত্যক্ষ, কারও জন্য সেটি হয় পরোক্ষ, তবে স্মৃতিগুলো রয়ে যায় সকলের। এমনটি যখন হয়, তখন দেখা যায় যে এক প্রজন্ম থেকে আরেক প্রজন্মে সহজে হস্তান্তর হয়ে যায় সেই স্মৃতি। আমাদের পূর্বমানবগণদের স্মৃতি হয়ে যায় আমাদের নিজেরও এবং সেই থেকেই নির্মাণ হয় একটি যৌথ চেতনা। তাই, দেখা যায় বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধের অর্ধ-শতাব্দী পেরিয়ে যাওয়া সত্ত্বেও তরুণ সমাজের মধ্যে এখনও জেগে থাকা মুক্তিযুদ্ধের চেতনা। তাই, দেখা যায়, তারা আজও ধরে রাখে তাদের ভেতরে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বপ্ন, আদর্শ ও নৈতিকতা-বোধ। এই স্মৃতি তাদের নয়- এই স্মৃতি তাদের বাবার, তাদের বাবারও বাবার, তবুও এগুলো জাতীয় চেতনায় পরিণত হবার ফলে তারা হয় নিরবধি ও অসীম। এভাবে দেখা যায় কেমনে দুঃখের ও বেদনাদায়ক স্মৃতিও পরিণত হতে পারে শক্তিতে; কীভাবে পরাজয়ের মুখেও হতে পারে জয়। রক্তে গড়া আমাদের এই দেশটির কথা মনে রেখে ব্যক্তিগত ক্ষেত্রে প্রয়োগ করে আমরাও সেভাবে দুঃখের স্মৃতিকে করে তুলতে পারি শক্তির উৎস; তার প্রমাণ রয়েছে আমাদেরই সামনে।
তাই স্মৃতি হয়ে থাকে, একই সাথে, একের আবার সকলের, গুপ্ত অথবা প্রকাশ্য, ব্যক্তিগত, অন্তর্গত, এমনকি, যৌথ। ভালোবাসা পাবার কিম্বা না পাবার লেন্স দিয়ে জীবনের অভিজ্ঞতার কিছু ফালি ফালি টুকরোই রয়ে যায় আমাদের কাছে স্মৃতি হয়ে। এই নিয়ে কয়েকবার উল্লেখ করেছি চলচ্চিত্রের কথা; তার কারণও রয়েছে। স্মৃতির কোনো ভাষা নাই- স্মৃতি থাকে আমাদের মনের ভেতরে ছবি ও সংবেদন আকারে- যা দেখেছি, যা করেছি, যা অনুভব করেছি, সেই সাথে আকাশের রং, রোদ্দুরের তাপ, ফুলের ঘ্রাণ, এসব হিসেবে। সেই স্মৃতিগুলো পরবর্তীকালে আমরা প্রকাশ করতে পারি ভাষার মাধ্যমে- কথায়, লেখায়- তবে সেই কথা ও সেই লেখাগুলো হয় কেবল মনের ভেতরে সেসব ছবি ও অনুভূতিকে বর্ণনা করবার কাজ। এই কারণেই দেখা যায় অনেক সময় আমরা কোনো একটি জায়গায় গেলে, কোনো একটি ছবি দেখলে, কারও সাথে দেখা হলে কিম্বা কোনো একটি ঘ্রাণ নাকে এলে, এসব ধরনের অনুপ্রাণনার সম্মুখে হলে, সেগুলো আমাদের মনের ভেতরে ভুলে-যাওয়া বা চেপে-রাখা কোনো স্মৃতির জাগরণ সৃষ্টি করে। আমার বাবা মারা যাবার সময় বলে গেছিলেন মা-কে "ফুলের গন্ধের মতো থেকে যাবো তোমার রুমালে"। এতেই বোঝা যায় তিনি অনুভূতি ও স্মৃতির এই বিস্ময়কর সংযোগ কতটি গভীরভাবে উপলব্ধি করতেন।
লিখতে বসেছিলাম আজ স্মৃতি নিয়ে; এই বিষয়ে লেখার কথা ভাবতেই মনের মধ্যে তৎক্ষণাৎ আমারও নিজস্ব কত শত স্মৃতি জেগে ওঠে। ভালো-খারাপ মিলিয়ে সবকটির মধ্যে মনে পড়ে প্রথমেই দীর্ঘ তিন যুগ আগের কথা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রথম বর্ষের একটি ছাত্র টিএসসি চত্বরে বসে একের পর এক চা ও সিগারেট খেয়ে যায়। চারদিকে ঘিরে বন্ধুদের আড্ডা, হাসাহাসি, খেলাধুলা, মারামারি, কত আনন্দ, কত ফুর্তি আর কত চিন্তা-বিহীন জীবন! মনে পড়ে আজও চেনা-পরিচিত যে ক'জনের সাথে আলাপ আছে- মনে পড়ে, কীভাবে, তখনও তাদের মুখে সময়ের কালি, জীবনের বোঝা টানবার ছাপ পড়ে নি; ঝুঁকে পড়ে নি কারও কাঁধ। আরও মনে পড়ে, কাছেই, পুরান ঢাকার মুখে বদরুন্নেসা কলেজের একটি টুকটুকে মেয়ে, যার পরনে ছিল প্রতিদিনই কলেজের সেই একই সাদা রঙের সালওয়ার-কামিজ, কোমরে চওড়া বেল্ট। কীভাবে আসতো সে, থেকে থেকেই আসতো, আমার চা খাওয়া দেখতে আর আমার জীবনের প্রতিটি অসাধিত স্বপনের কথা শুনতে। মনে পড়ে, তারই মধ্যে একটি দিন- হঠাৎ! চারদিকে কালো মেঘ ঘনিয়ে আসা, মুহূর্তের মধ্যে ঝমঝমে বৃষ্টি; টিএসসির চত্বর ভেসে একাকার! এ কী কা ! তার বাবা-মা তো জানে না যে সে কলেজ থেকে এসেছে আমার সাথে কেবল একটু বসতে! জানলে তো আমাদের দুজনাকেই হয়তোবা নাই করে দেবে! ওদিকে তার গাড়ি রাখা রোকেয়া হলের সামনে। দু-চার পা ফেললেই পৌঁছানো যায় সেই গাড়িতে, কিন্তু না- মুষলধারা বৃষ্টির মধ্যে দু-চার পা ফেলা মানেই চুপচুপে ভিজে যাওয়া। ফেললাম, সেই দু-চার পা। ভিজে গেলাম দুজনাই সাথে সাথে মাথা থেকে পা পর্যন্ত। টিএসসির সামনে ভিজে মুরগির মতো এক সারি শিক্ষার্থী সেই দুজনার পাগলামি দেখে মুখ হাঁ করে তাকিয়ে। তার পরেই, দুজনার ছেলেমানুষি হাসি, বৃষ্টির পানির মধ্যে খেলাধুলা, ছুটোছুটি; গাড়িতে যাবার কথা সম্পূর্ণ ভুলে যাওয়া, বৃষ্টির মধ্যে খালি আনন্দ অবিরাম।
সেই মুষলধারে বৃষ্টি এগিয়ে যায় নিমেষের মধ্যে তিন যুগ। দাঁড়িয়ে আছি ঢাকা শহরের কোনো এক হাসপাতালের আঙিনায়। চারদিকে বৃষ্টি আর বৃষ্টি আর হাসপাতালের ছয়-তলার কেবিনে শুয়ে একজন বাবা, যার এই পৃথিবীতে বেঁচে থাকবার অনুমতি আল্লাহ্ কোনোরকমে আরও একটি দিন বাড়িয়ে দিয়েছেন। আর আমি, সেই আমি, কী করছি? পকেট থেকে নোটবই বের করে, কাঁপা হাতে ইংরেজিতে কবিতা টুকছি; প্রশ্ন করছি, সেই মুহূর্তে, সেই বৃষ্টির মধ্যে, কাঁদবার কথা তো আমার- আকাশ কেনো কাঁদে? সে কি আমার সাথে সমবেদনা জানিয়ে কাঁদে? তার মানে কী, বিধাতা সবই দেখতে পারেন, এবং, তাই যদি হয়, কেন এতো নিষ্ঠুরভাবে নিয়ে যাচ্ছেন তিনি আমার একটিমাত্র বাবাকে? সেই একই বৃষ্টি- মাঝখানে কেবল তিন যুগ সময় পেরিয়ে- সেই একই বৃষ্টি সৃষ্টি করে আমার মাঝে একই সাথে কিছু পাবার, কিছু হারাবার অনুভূতি। বিপরীত দুই তিরে দুটি ভিন্ন অনুভূতি উপভোগ করি, গা শিরশির করে ওঠে, আনন্দে, বেদনায়। লেখাটি শেষ হয়ে আছে; আর কিছুই বলার নাই। লেখাটি আমার কাছে এবং পাঠকেরও মন ক্ষণিকের জন্য হলেও একটি স্মৃতি হয়ে থেকে যায়।
স্মৃতি এবং স্মরণশক্তি- এই দুটি জিনিস আমাদের ভেতরে একই সাথে কাজ করে, তবে ভিন্নভাবে। স্মরণশক্তি না থাকলে যেমন কোনো স্মৃতি গঠন করাই অসম্ভব হয়ে ওঠে, সেভাবে, স্মৃতি না থাকলে স্মরণ করবার মতোও আমাদের কিছু থাকে না। স্মরণশক্তি আমাদের মনে করিয়ে দেয় পূর্ব অভিজ্ঞতা, অনুভূতি, অর্জিত জ্ঞান বা পরামর্শের কথা। এগুলো থেকেই দেখা যায় কিছু কিছু ঘটনা পরবর্তী সময়ে আমাদের মনে স্মৃতির আকার নেয়। সেই স্মৃতিগুলোকেই আমরা আবার স্মরণ করে থাকি। তবে, স্মরণ করবার শক্তি, বা ক্ষমতা, কেবল আমাদের স্মৃতিচারণ করতে সাহায্য করে না। তার রয়েছে আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা আমাদের চলমান জীবনে। স্মরণশক্তি মনে করিয়ে দেয়, আগুনের খুব কাছে গেলে দেহ পুড়ে যায়, বলে চলন্ত গাড়ির সামনে কেন ঝাঁপ দিতে নেই, বলে কার সাথে, কীভাবে চলতে হয়, মনে করিয়ে দেয় এই দৈনন্দিন জীবনযাত্রায় এতসব খুঁটিনাটি সবকিছু, যা নিয়ে আমরা কখনও, একটি মুহূর্তের জন্যও, ভাববার কথা চিন্তা করি না। এই হলো স্মরণশক্তির আসল শক্তি; তার আসল গুণ। তবে, আমাদের দৈনন্দিন জীবনে স্মরণশক্তির এই অভীষ্ট উদ্দেশ্য নিয়ে আমরা সাধারণত ভেবে থাকি না। জীবন চলতে থাকে অটো-পাইলটে এবং সেই চলার মধ্যে আমাদের কতকিছু স্মরণ করতে হয়, তার হিসেব আমরা রাখিও না, রাখা সম্ভবও না। এই একই স্মরণশক্তিটিকেই আমরা প্রয়োগ করে থাকি যখন স্মৃতিচারণ করি।
স্মৃতি বলতে বুঝি সেই মুহূর্তগুলো, চলচ্চিত্রের ফিতে থেকে কাটা হাতেগোনা কয়েকটি ছবি, যাদের কাছে আমরা জীবন চলা-ক্রমে বারংবার ফিরে আসি, অথবা যারা বারংবার হাজিরা দিয়ে উপস্থিত হয় আমাদের সামনে। স্মৃতি আমাদের দৈনন্দিন জীবনে সেভাবে ঠিক প্রয়োজন হয় না, তবুও, আমাদের জীবনে প্রভাব ফেলে। এখানে, স্মরণশক্তি ও স্মৃতির এই সম্পূর্ণ ভিন্ন দুটি রূপ যে একে অপরের থেকে আলাদা, তাও ঠিক নয়। ব্যর্থ প্রেমে বিফল হয়ে যুবক দ্বিতীয়বার ভালোবাসার ঘরে পা ফেলতে ইতস্তত করে, আবারও যদি নতুন করে ব্যর্থ হতে হয়, সেই ভয়ে। স্বামীর অত্যাচারে ঘর-ছাড়া গৃহিণী দ্বিতীয়বার ঘর বাঁধতে অনিচ্ছুক হয়ে ওঠে, যদি দেখা যায় আবারও তার সেই একই দোযখে প্রবেশ করা হয়। এভাবেই, স্মৃতি আমাদের বর্তমান জীবনেও প্রতিটি দিন, প্রতিটি মুহূর্ত, অবিরাম কাজ করে যায়, এভাবেই, অতীতের কথা- এখানে এবং এখন- আমাদের বর্তমান জীবনে প্রভাব ফেলে এবং, এভাবেই মানুষ ক্রীতদাস হয়ে থাকে তার নিজেরই জীবন-কাহিনি, তার স্মৃতিমালার কাছে। স্বেচ্ছায় হোক বা অনিচ্ছায় হোক, পুরোনো দিনের কথা, অতীতের ঘটনাকে আমরা স্মৃতি বলে গুরুত্ব দিয়েই, সেগুলোকে ফের স্মরণ করে আমরা একেকজন নির্মাণ করে নিই নিজেদেরই জীবনের কারাগার।
যদি বলি, তাহলে, যে এই স্মৃতি বিষয়টিকে নিয়ে খুব বেশি মাথা ঘামাবার তেমন কিছু নাই? বলিই, যদি, যে মানুষের স্মৃতিশক্তি ও স্মরণ করবার ক্ষমতার ব্যাপারটি একদিক থেকে দেখতে গেলে খুবই সাদাকালো? এর ব্যাখ্যা খুব একটি কঠিনও নয়- একটু ভেবে দেখলেই দেখা যায় যে আমাদের প্রতিটি স্মৃতির গোড়ায়, প্রতিটি স্মৃতির তৃণমূলে রয়েছে একটিমাত্র অনুভূতি, সেই অভীষ্ট উদ্দেশ্যের পেছনেও একটি গুপ্ত উদ্দেশ্য- এবং, সেই উদ্দেশ্যটির মূলে যেই অনুভূতি, তার নাম ভালোবাসা। অগত্যা দুটি মানবের মধ্যে কেবল প্রেম-ভালোবাসা নয়, বরং একটি বৃহত্তর প্রেক্ষাপটে ভালোবাসা, বা, যাকে বলা যায় সুখ- মানুষের মধ্যে, নিজের মধ্যে, অন্যের প্রতি, নিজের প্রতি, ভূমির প্রতি, নেতার প্রতি ও জাতির প্রতি। এর পরিপ্রেক্ষিতে, ভালোবাসাকে আমরা একধরনের সুখ বলে মনে করতে পারি। এমন একটি কিছু, যার কারণে আমরা সুখ পেয়ে থাকি এবং যার অভাবে আমরা "অ-সুখ" অনুভব করি। জীবন চলা-ক্রমে কতকিছু ঘটে যায়, প্রতিটি দিন, প্রতিটি মুহূর্তে, যেগুলোকে আমরা কোনো গ্রাহ্যই করি না। যদি আমরা স্মরণ করতে চেষ্টা করি দু-সপ্তাহ আগে কোনো এক রাতে কী আহার পান করেছিলাম, খুব সম্ভব, সেটি আমাদের মনে থাকবে না। মনে থাকবে না, কেননা, আমরা নিজেই সেই ঘটনাটিকে সেভাবে গুরুত্ব দিই নাই। তবে, যদি এমন হতো, যে একটি মানুষ অভাবে পড়ে দীর্ঘদিন প্রায় না খেয়ে-থাকা অবস্থায় থাকবার পর একটি দাওয়াতের আমন্ত্রণ পায়, যেখানে সে অবশেষে মনের আনন্দে পেট ভরে দুটো খেতে পারে, খুব সম্ভব সেই ঘটনাটি মানুষটির মনে স্মৃতি হয়ে গেঁথে থাকবে। কেন তা থাকবে? কেননা, দীর্ঘদিন না খেয়ে থাকবার পর সেই আমন্ত্রণটি তার জন্য একটি অতি সুখের সময়, আনন্দের সময় এবং- এটি জানা কথা- যে সুখ আর আনন্দ দুটিই ভালোবাসার অপর নাম। সেই অনাহারের দিনগুলোর কথা যেমন মনে থাকবে তার সুখের অভাবে, আমন্ত্রণটির কথা মনে থাকবে তার সুখ অনুভব করে। দুটিই বিপরীত অনুভূতি দুদিকে স্মৃতির দাগ কাটবে মানুষটির মনে।
তাই, বলা যায় যে ভালোবাসা কিম্বা সুখ পাবার অথবা ভালোবাসা হারাবার অভিজ্ঞতা, অনুভূতি বা আশঙ্কা থেকেই স্মৃতির গড়ে ওঠা। একথা বোঝাতে গেলে কয়েকটি উদাহরণ বিবেচনা করে দেখলেই হয়- সেই প্রথম প্রেম, সেই শুভ বিবাহের দিন, সেই পরীক্ষা পাস করবার সময়টি, বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডায় সেই মজাদার খাওয়ার কথা, প্রথম চাকরিতে মাসের শেষে প্রথম মাইনে হাতে পাবার সেই সময়, মোটরসাইকেল ছিটকে পড়ে পা ভেঙে যাবার পর দিনের পর দিন শয্যায়স্ত "অ-সুখী" অবস্থায়- তারও পর, পিতা-মাতা, সন্তান হারাবার বুক-ভাঙা শোক, যার কথা ভাবলে এখনও ভেতর বিঁধে থাকা সেই বেয়োনেটটি আবারও নাড়া দিয়ে ওঠে। এই বিস্তৃত প্রতিটি কাহিনির মূলে কি ভালোবাসা পাবার কি হারাবার অনুভূতি নয়? এখানে দুটি মানবের ভেতরে প্রেম, বা জীবনসঙ্গী হবার কথা বাদই দেওয়া যাক। বন্ধুবান্ধবের সাথে আনন্দময় সময় কাটানো কি ভালোবাসার অনুভূতি নয়? হাতে মাহিনা পাবার সেই খুশিটা কি নিজের প্রতি, স্বজনের প্রতি ভালোবাসার অনুভূতি নয়? আরেকদিকে, আঘাত পাওয়া, কাছের কাওকে হারানো, এগুলো কি সবই আমাদের কাছ থেকে কোনো না কোনো এক প্রকারে ভালোবাসা কেড়ে নেওয়া হয় না?
এভাবে, দীর্ঘ এক জীবনের ঘোলা পানি থেকে তুলে আনা প্রতিটি স্মৃতির মধ্যেই দেখা যায় যে সেই স্মৃতির মূলে রয়েছে কোনো এক বেশে ভালোবাসা কিম্বা সেটিকে হারাবার অনুভব। জন্মের পর থেকে আমাদের শেষ নিঃশ্বাস পর্যন্ত প্রতিটি মুহূর্তের ভেতরেই থাকে একটি স্মৃতি হবার অঙ্কুর; থাকে সম্ভাবনা। কিন্তু, বরাবর দেখা যায় যে, জীবন শেষে, আমরা সকলেই বড়জোর হাতেগোনা দু-এক গোছা স্মৃতি নিয়ে কবরে যাই। কেন যাই এভাবে? প্রতিটি মুহূর্তের ভেতরেই যদি থেকে থাকে একটি স্মৃতির বীজ, তাহলে এতো কম স্মৃতি নিয়ে আমরা কীভাবে প্রায় এক শতাব্দী জীবন অনায়াসে পার করে দিতে পারি? এর কারণ, যে জীবনে প্রকৃত সুখ একটি অতি দুর্লভ বস্তু। বারংবার আমরা দেখতে পাই যে টাকা হলেই সুখ কেনা যায় না, বিশ্বের সুন্দরতম নারী ও পুরুষের মাঝেও বিভেদ চলে অবিরাম, মাঝ বয়স পার করে আমাদের মধ্যে কতজনই না ভেবেছি- আহা, আরেকবার যদি সুযোগ পেতাম, তবে জীবনটা অন্যরকম, নতুন করে গড়ে তুলতাম। এ-জীবনে প্রকৃত, অকৃত্রিম ভালোবাসা, প্রকৃত সুখ এমনই দুর্লভ যে আমরা সেই সময়গুলোকে বুকের সাথে আঁখরে ধরে রাখি, বারবার ফিরে যাই আবারও সেই সুখ অনুভব করতে। তার ঠিক বিপরীতভাবে, ভালোবাসা যখন আমাদের কাছ থেকে কেড়ে নেওয়া হয়, সেই মুহূর্তগুলোও আমরা সেই কারণেই ভুলতে পারি না; বারবার ফিরে আসে তারা আমাদের কাছে, রয়ে যায় তারা সারাজীবন।
কেন রয়ে যায় তারা? কেন আমরা খারাপটি বাদ দিয়ে শুধু মধুর স্মৃতি নিয়ে কবরে যেতে সক্ষম হই না? কারণ, ওই অপ্রীতিকর স্মৃতিগুলোও আমাদের বেঁচে থাকবার একটি উপায়- আমাদের বিবর্তনের একটি অপরিহার্য অংশ। রাস্তায় চলতে চলন্ত গাড়ির সামনে পা ফেলতে নেই, রাতে অন্ধকার পথ ধরে একা চলতে নেই, জ্বলন্ত কয়লায় হাত দিতে নেই। এগুলোর প্রতিটি যে আমাদের ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা, তাও নয়। মানবজাত হিসেবে আমাদের একটি যৌথ স্মৃতিও কাজ করে, ঠিক যেভাবে থাকে আমাদের যৌথ চেতনা, এবং, কার্ল ইয়াং-এর মতে যৌথ অবচেতন মন। যৌথ স্মৃতি আমাদের গঠন হয় লোকের মুখে মুখে, খবরের কাগজের অক্ষরে ও বইয়ের পাতায়। এগুলোও স্মৃতি হয়ে রয়ে যায় আমাদের মনে। রাতের অন্ধকারে পথ দিয়ে একা হাঁটি না, কারণ আমরা পড়েছি, কারণ শুনেছি, কারণ প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে দেখেছি মানুষের কী হয় বা হতে পারে এমনটি কাজ করলে। ঘরপোড়া গরুর দশা দেখে অন্য গরুরাও দেখা যায় সিঁদুরে মেঘ দেখে ভয় পায়। এভাবেই কাজ করে আমাদের মধ্যে যৌথ স্মৃতি। এতক্ষণ ব্যক্তিগত স্মৃতি নিয়ে বলেছি, এবারে দেখা যাক ব্যক্তিগত স্মৃতির সাথে যৌথ স্মৃতিও, সেই থেকে, যৌথ চেতনার সম্পর্কটি।
প্রথমেই বোঝা চায় যে স্মৃতি আসে অভিজ্ঞতা থেকে এবং, সেই কারণেই, যৌথ স্মৃতি আসে যৌথ অভিজ্ঞতা থেকে। কারও জন্য সেই অভিজ্ঞতা হয় প্রত্যক্ষ, কারও জন্য সেটি হয় পরোক্ষ, তবে স্মৃতিগুলো রয়ে যায় সকলের। এমনটি যখন হয়, তখন দেখা যায় যে এক প্রজন্ম থেকে আরেক প্রজন্মে সহজে হস্তান্তর হয়ে যায় সেই স্মৃতি। আমাদের পূর্বমানবগণদের স্মৃতি হয়ে যায় আমাদের নিজেরও এবং সেই থেকেই নির্মাণ হয় একটি যৌথ চেতনা। তাই, দেখা যায় বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধের অর্ধ-শতাব্দী পেরিয়ে যাওয়া সত্ত্বেও তরুণ সমাজের মধ্যে এখনও জেগে থাকা মুক্তিযুদ্ধের চেতনা। তাই, দেখা যায়, তারা আজও ধরে রাখে তাদের ভেতরে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বপ্ন, আদর্শ ও নৈতিকতা-বোধ। এই স্মৃতি তাদের নয়- এই স্মৃতি তাদের বাবার, তাদের বাবারও বাবার, তবুও এগুলো জাতীয় চেতনায় পরিণত হবার ফলে তারা হয় নিরবধি ও অসীম। এভাবে দেখা যায় কেমনে দুঃখের ও বেদনাদায়ক স্মৃতিও পরিণত হতে পারে শক্তিতে; কীভাবে পরাজয়ের মুখেও হতে পারে জয়। রক্তে গড়া আমাদের এই দেশটির কথা মনে রেখে ব্যক্তিগত ক্ষেত্রে প্রয়োগ করে আমরাও সেভাবে দুঃখের স্মৃতিকে করে তুলতে পারি শক্তির উৎস; তার প্রমাণ রয়েছে আমাদেরই সামনে।
তাই স্মৃতি হয়ে থাকে, একই সাথে, একের আবার সকলের, গুপ্ত অথবা প্রকাশ্য, ব্যক্তিগত, অন্তর্গত, এমনকি, যৌথ। ভালোবাসা পাবার কিম্বা না পাবার লেন্স দিয়ে জীবনের অভিজ্ঞতার কিছু ফালি ফালি টুকরোই রয়ে যায় আমাদের কাছে স্মৃতি হয়ে। এই নিয়ে কয়েকবার উল্লেখ করেছি চলচ্চিত্রের কথা; তার কারণও রয়েছে। স্মৃতির কোনো ভাষা নাই- স্মৃতি থাকে আমাদের মনের ভেতরে ছবি ও সংবেদন আকারে- যা দেখেছি, যা করেছি, যা অনুভব করেছি, সেই সাথে আকাশের রং, রোদ্দুরের তাপ, ফুলের ঘ্রাণ, এসব হিসেবে। সেই স্মৃতিগুলো পরবর্তীকালে আমরা প্রকাশ করতে পারি ভাষার মাধ্যমে- কথায়, লেখায়- তবে সেই কথা ও সেই লেখাগুলো হয় কেবল মনের ভেতরে সেসব ছবি ও অনুভূতিকে বর্ণনা করবার কাজ। এই কারণেই দেখা যায় অনেক সময় আমরা কোনো একটি জায়গায় গেলে, কোনো একটি ছবি দেখলে, কারও সাথে দেখা হলে কিম্বা কোনো একটি ঘ্রাণ নাকে এলে, এসব ধরনের অনুপ্রাণনার সম্মুখে হলে, সেগুলো আমাদের মনের ভেতরে ভুলে-যাওয়া বা চেপে-রাখা কোনো স্মৃতির জাগরণ সৃষ্টি করে। আমার বাবা মারা যাবার সময় বলে গেছিলেন মা-কে "ফুলের গন্ধের মতো থেকে যাবো তোমার রুমালে"। এতেই বোঝা যায় তিনি অনুভূতি ও স্মৃতির এই বিস্ময়কর সংযোগ কতটি গভীরভাবে উপলব্ধি করতেন।
লিখতে বসেছিলাম আজ স্মৃতি নিয়ে; এই বিষয়ে লেখার কথা ভাবতেই মনের মধ্যে তৎক্ষণাৎ আমারও নিজস্ব কত শত স্মৃতি জেগে ওঠে। ভালো-খারাপ মিলিয়ে সবকটির মধ্যে মনে পড়ে প্রথমেই দীর্ঘ তিন যুগ আগের কথা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রথম বর্ষের একটি ছাত্র টিএসসি চত্বরে বসে একের পর এক চা ও সিগারেট খেয়ে যায়। চারদিকে ঘিরে বন্ধুদের আড্ডা, হাসাহাসি, খেলাধুলা, মারামারি, কত আনন্দ, কত ফুর্তি আর কত চিন্তা-বিহীন জীবন! মনে পড়ে আজও চেনা-পরিচিত যে ক'জনের সাথে আলাপ আছে- মনে পড়ে, কীভাবে, তখনও তাদের মুখে সময়ের কালি, জীবনের বোঝা টানবার ছাপ পড়ে নি; ঝুঁকে পড়ে নি কারও কাঁধ। আরও মনে পড়ে, কাছেই, পুরান ঢাকার মুখে বদরুন্নেসা কলেজের একটি টুকটুকে মেয়ে, যার পরনে ছিল প্রতিদিনই কলেজের সেই একই সাদা রঙের সালওয়ার-কামিজ, কোমরে চওড়া বেল্ট। কীভাবে আসতো সে, থেকে থেকেই আসতো, আমার চা খাওয়া দেখতে আর আমার জীবনের প্রতিটি অসাধিত স্বপনের কথা শুনতে। মনে পড়ে, তারই মধ্যে একটি দিন- হঠাৎ! চারদিকে কালো মেঘ ঘনিয়ে আসা, মুহূর্তের মধ্যে ঝমঝমে বৃষ্টি; টিএসসির চত্বর ভেসে একাকার! এ কী কা ! তার বাবা-মা তো জানে না যে সে কলেজ থেকে এসেছে আমার সাথে কেবল একটু বসতে! জানলে তো আমাদের দুজনাকেই হয়তোবা নাই করে দেবে! ওদিকে তার গাড়ি রাখা রোকেয়া হলের সামনে। দু-চার পা ফেললেই পৌঁছানো যায় সেই গাড়িতে, কিন্তু না- মুষলধারা বৃষ্টির মধ্যে দু-চার পা ফেলা মানেই চুপচুপে ভিজে যাওয়া। ফেললাম, সেই দু-চার পা। ভিজে গেলাম দুজনাই সাথে সাথে মাথা থেকে পা পর্যন্ত। টিএসসির সামনে ভিজে মুরগির মতো এক সারি শিক্ষার্থী সেই দুজনার পাগলামি দেখে মুখ হাঁ করে তাকিয়ে। তার পরেই, দুজনার ছেলেমানুষি হাসি, বৃষ্টির পানির মধ্যে খেলাধুলা, ছুটোছুটি; গাড়িতে যাবার কথা সম্পূর্ণ ভুলে যাওয়া, বৃষ্টির মধ্যে খালি আনন্দ অবিরাম।
সেই মুষলধারে বৃষ্টি এগিয়ে যায় নিমেষের মধ্যে তিন যুগ। দাঁড়িয়ে আছি ঢাকা শহরের কোনো এক হাসপাতালের আঙিনায়। চারদিকে বৃষ্টি আর বৃষ্টি আর হাসপাতালের ছয়-তলার কেবিনে শুয়ে একজন বাবা, যার এই পৃথিবীতে বেঁচে থাকবার অনুমতি আল্লাহ্ কোনোরকমে আরও একটি দিন বাড়িয়ে দিয়েছেন। আর আমি, সেই আমি, কী করছি? পকেট থেকে নোটবই বের করে, কাঁপা হাতে ইংরেজিতে কবিতা টুকছি; প্রশ্ন করছি, সেই মুহূর্তে, সেই বৃষ্টির মধ্যে, কাঁদবার কথা তো আমার- আকাশ কেনো কাঁদে? সে কি আমার সাথে সমবেদনা জানিয়ে কাঁদে? তার মানে কী, বিধাতা সবই দেখতে পারেন, এবং, তাই যদি হয়, কেন এতো নিষ্ঠুরভাবে নিয়ে যাচ্ছেন তিনি আমার একটিমাত্র বাবাকে? সেই একই বৃষ্টি- মাঝখানে কেবল তিন যুগ সময় পেরিয়ে- সেই একই বৃষ্টি সৃষ্টি করে আমার মাঝে একই সাথে কিছু পাবার, কিছু হারাবার অনুভূতি। বিপরীত দুই তিরে দুটি ভিন্ন অনুভূতি উপভোগ করি, গা শিরশির করে ওঠে, আনন্দে, বেদনায়। লেখাটি শেষ হয়ে আছে; আর কিছুই বলার নাই। লেখাটি আমার কাছে এবং পাঠকেরও মন ক্ষণিকের জন্য হলেও একটি স্মৃতি হয়ে থেকে যায়।
- বিষয় :
- প্রচ্ছদ
- দ্বিতীয় সৈয়দ-হক