ঢাকা শনিবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৫

বইয়ের ভুবন

সহজ কবিতায় গভীর জীবনবোধ

সহজ কবিতায় গভীর জীবনবোধ

শেষ নিঃশ্বাসের প্রথম গান, লেখক-হাইকেল হাশমী, প্রকাশক-দি রয়েল পাবলিশার্স, প্রকাশকাল-২০১৮ সাল, প্রচ্ছদ- সৈয়দ ইকবাল, মূল্য-১৮০ টাকা

লাবণী মণ্ডল

প্রকাশ: ০৪ নভেম্বর ২০২১ | ১২:০০

শিল্প-সাহিত্যে আলোচনা-সমালোচনা-পর্যালোচনা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এ নিয়ে সন্দেহের অবকাশ নেই। কোনো সাহিত্যকর্ম বা বইয়ের রিভিউ বা সমালোচনা পত্রিকায় ছাপা হলে সংশ্নিষ্ট সাহিত্যকর্মটি সম্পর্কে পাঠক আগে থেকেই একটি ধারণা পেতে পারেন। আর তাই সাহিত্যে বই আলোচনার বিশেষ গুরুত্বও রয়েছে।
বহুমাত্রিক লেখক হাইকেল হাশমী। একাধারে কবি, গল্পকার, প্রাবন্ধিক, অনুবাদক। আবার পেশায় ব্যাংকার। হাইকেল হাশমীর কবিতা সহজ সরল ও সাবলীল উচ্চারণে গভীর বোধের কথা বলে। লেখার স্বতঃস্টম্ফূর্ততা তাঁর রচনাকে সুখপাঠ্য করে তোলে।
কবিতা সাহিত্যের আদিমতম একটি শাখা। মানুষ তার মনের ভেতরের যে কোনো ভাব, চিন্তা-ভাবনা, আবেগ-অনুভূতিগুলো যখন ছন্দবদ্ধ আকারে প্রকাশ করে, তখনই সেটা হয়ে ওঠে কবিতা। হাইকেল হাশমী সে কাজটিই করেছেন। তাঁর কবিতার ভেতরে ব্যক্তিগত দুঃখ, কষ্ট, সুখ, আনন্দ আছে; যা প্রত্যেক ব্যক্তির অনুভূতির সঙ্গেই সাধারণত মিলে যায়; আর একজন লেখক যখন সাধারণের ভেতরে প্রবেশ করতে পারে, সেটিই তার সার্থকতা।
হাইকেল হাশমীর কবিতা সম্পর্কে একুশে ও বাংলা একাডেমি পদকপ্রাপ্ত কবি আসাদ চৌধুরী যথার্থই বলেছেন- 'মাতৃভাষা উর্দু হলেও বাংলাভাষায় তাঁর মিহিন কাজ যুক্ত হওয়ায় কবিতার স্বাদই পাল্টে যেতে পারে, এটা আমি আগে ভাবিনি।'
হাইকেল হাশমীর পারিবারিক আবহও নিশ্চিতভাবেই তাঁর ভেতরে কবি সত্তার বিকাশে অবদান রেখেছে। উল্লেখ্য, তাঁর বাবা উপমহাদেশের অন্যতম বরেণ্য উর্দু কবি নওশাদ নূরী। তবে কবি নওশাদ নূরীর কবিতায় যুটা না ভারিক্কি রয়েছে; কবি হাইকেল হাশমীর রচনা ঠিক ততটাই হালকা মেজাজের। কবি নিজেও বাবার কবিতার ধাঁচের সঙ্গে নিজের কবিতাকে মেলাতে রাজি নন। কবি হাইকেল হাশমী তাঁর কবিতাকে 'সহজ কবিতা' হিসেবে উল্লেখ করেছেন। অথচ সহজবোধ্য এসব কবিতায় রয়েছে গভীর জীবনবোধ। যে কোনো বই, রচনা বা কবিতায় পাঠক আদতে নিজেকে খুঁজে ফেরেন। হাইকেল হাশমীর 'শেষ নিঃশ্বাসের প্রথম গান' শীর্ষক কবিতা সংকলনে পাঠক আদতে নিজেকেই খুঁজে ফিরবেন।
সহজ-সাবলীলতার বিশেষ গুণ রয়েছে কবিতাগুলোয়। 'শেষ নিঃশ্বাসের প্রথম গান' কাব্যগ্রন্থে মোট ৭২টি কবিতা রয়েছে। প্রেম, দ্রোহ, ক্ষোভ, আকাঙ্ক্ষা- সবকিছুই কবিতার ছকে তুলে ধরার চেষ্টা করা হয়েছে। 'বিদীর্ণ আরশিনগর' শীর্ষক কবিতা দিয়ে বইটির শুরু; আর শেষে রয়েছে 'সময়ের লিপিকার'।
একবিংশ শতাব্দীর প্রথম ও দ্বিতীয় দশকে বাংলাদেশের কবিতা বিশ্নেষণ করলে দেখা যাবে যে, 'একাকিত্ব ও বিচ্ছিন্নতাবোধ' একটি উল্লেখযোগ্য প্রবণতা। কবি হাইকেল হাশমীর কবিতায় এই প্রবণতা গভীরভাবে পাওয়া যায়। কবি তাঁর 'মন খারাপের মৌসুম' কবিতায় লিখেছেন-
'মন খারাপের কি কোন মৌসুম আছে?
চোখ যখন অজান্তে ছলছল
বুকের ভিতরে না জানা এক ব্যথা,
হৃদয়ের খুব গভীরে খাঁখাঁ শূন্যতা
সম্পূর্ণ অস্তিত্বে প্রচণ্ড জ্বালা।

মন খারাপের কি কোনো ঋতু আছে?
স্মৃতির অন্ধ হাওয়া
যখন কালবৈশাখীর ঝড় হয়ে
মনের বন্ধ কপাটে আঘাতরত, সারাক্ষণ।...'

কবি আব্দুল মান্নান সৈয়দ তাঁর গবেষণাধর্মী 'শুদ্ধতম কবি' গ্রন্থে বিংশ শতাব্দীর তৃতীয় দশকের কবি জীবনানন্দ দাশকে 'বাংলা কবিতা রাজ্যের নিঃসঙ্গতম বরপুত্র' বলে উল্লেখ করেছেন। জীবনানন্দ দাশের কবিতায় নিঃসঙ্গতা ও বিষাদময়তা একটি অনন্য উপাদান। তাঁর পূর্ববর্তী ও পরবর্তী অনেক কবির ক্ষেত্রেও বিষাদময়তা ও নিঃসঙ্গতার উপস্থিতি লক্ষ্য করা যায়। তবে ওই সময়কালে এই প্রবণতা প্রাধান্যে থাকেনি। একবিংশ শতাব্দীর কথিত ইলেক্ট্রনিক যুগ, মোবাইল আর দ্রুতগতির ইন্টারনেটের গতিময়তা মানুষকে কেবলই একীভূত করেনি; বরং মানুষের ভেতরে পুঁতে দিয়েছে আরেক বিচ্ছিন্নতার বীজ। আর এই একাকীত্ব, বিষাদময়তা কবিতায় উঠে এসেছে।
'নিসঙ্গতার সাথে কথোপকথন' শীর্ষক কবিতায় হাইকেল হাশমী লিখেছেন-
'...একাকীত্বের সাথে বসবাস
নিসঙ্গতার সাথে সহবাস,
নিসঙ্গতা যে কথা বলে
নিসঙ্গতা যে কথা শোনে
শোনো মনের কান পেতে শোনো!'

কবিতা হলো হৃদয় নিঃসৃত ভাবের সংক্ষিপ্ত প্রকাশ, যা হৃদয় দিয়েই বুঝে নিতে হয়। অনেক অব্যক্ত বা সংক্ষিপ্ত ভাবটি কবির মানসিকতার প্রেক্ষিতে পাঠকের চিন্তায় নিজের মতো করে ধরা দেয়। এখানে কবি তার প্রকাশ দেখিয়েছেন। পৃষ্ঠার পর পৃষ্ঠা মেলবন্ধন ঘটিয়েছেন। যা কবি হাইকেল হাশমী সঠিকভাবেই করতে পেরেছেন। একজন কবি, যার মাতৃভাষা উর্দু হওয়া সত্ত্বেও বাংলাভাষায় তার দক্ষতা, ছন্দবদ্ধতা রীতিমতো বিস্ময়কর।
'ইতিহাস সাক্ষী
আমি আমার যুগের কথা লিখিনি
আমি আমার সময়ের কথা বলিনি।
এমন কি আমার অতীত সম্বন্ধে কোন মন্তব্য করিনি
বর্তমান আর অতীতের ইতিহাস
আমার জন্য নির্মল সাদা কাগজ...' বইটির শেষ কবিতা 'সময়ের লিপিকার' থেকে উদ্ধৃত।

আরও পড়ুন

×