টাইগার নাজিরের অন্তর্ধান

রফিকুর রশীদ
প্রকাশ: ০৪ নভেম্বর ২০২১ | ১২:০০
এক.
আজ দু'দিন ভারি মজার এক খেলা পেয়েছে অঙ্কন। সেই খেলা নিয়ে বেশ আনন্দেই আছে সে। বাবার বুকশেল্কম্ফ থেকে বই নামানোর খেলা। এ খেলার কোনো নাম নেই, কিন্তু মজা আছে। বাবাকে কাছে পাবার মজা। দু-তিন দিন আগে শোকেস থেকে থালাবাসন, খেলনাপাতি, কাপড়চোপড় নামিয়ে খালি করা হয়েছে। অঙ্কনের মা একা হাতে সামলেছে সেসব। কিন্তু অঙ্কনকে মোটেই হাত লাগাতে দেয়নি। অথচ বুকশেল্কম্ফ খালি করার সময় বাবা নিজে থেকে তাকে ডেকে বলেছে,
আমাকে একটু হেল্প করবি অঙ্কন?
এমন আহ্বান শুনে তো সে মহাখুশি। ইশকুলে চলছে করোনাকালীন ছুটি। লকডাউনের মধ্যে বাইরে যাওয়াও যাবে না। একনাগাড়ে ঘরের ভেতরে সময় কাটে কী করে! এ সময়ে বাবাকে হেল্প করতে পারলে তো ভালোই হয়। অঙ্কনের বাবা নাজির মাহমুদ ছবি আঁকে, পটশিল্পী। কেউ কেউ বলে পটুয়া। বাবার ছবি আঁকা দেখতে খুব ভালো লাগে অঙ্কনের। বাবাকে হেল্প করা মানে রংতুলিটা এগিয়ে দেওয়া, ইজেলটা বাড়িয়ে ধরা, এই রকম টুকিটাকি। এসব হুকুম পালন করতেও ঢের আনন্দ তার। লাফিয়ে এসে বাবার কাছে সে জানতে চায়,
কী হেল্প বাবা?
অঙ্কনের বাবা বুকশেল্কম্ফ থেকে একটা বই নিয়ে ছেলের দিকে বাড়িয়ে দেয়,
নে, ধর। এটা নামিয়ে রাখ ওই ঘরের মেঝেতে।
অবাক হয় অঙ্কন, এটাই হেল্প করা নাকি! আজ তাহলে রংতুলির কাজ নেই!
কী যে হয়েছে, তার বাবাকে অনেক দিন ছবি আঁকতেই দেখা যায় না। মায়ের না হয় ইশকুল বন্ধ, তাই বলে বাবা আঁকাআঁকি তো বন্ধ হতে পারে না। অঙ্কন কলম ধরা শিখেছে তার মায়ের কাছে, আর তুলি ধরতে শিখিয়েছে তার বাবা। কত দিন সেই রংতুলির চর্চাই হচ্ছে না। বাবার হুকুম শুনে আজও হতাশ হয় অঙ্কন। তবু হাত বাড়িয়ে বইটা ধরে, বাবার মুখের দিকে তাকিয়ে বুঝতে চেষ্টা করে-মেঝেতে মানে ঠিক কোথায় বই রাখতে বলেছে তার বাবা। নাজির মাহমুদ প্রায় অকারণেই ফিক করে হেসে ছেলেকে নির্দেশ দেয়,
তোশকের পাশে দেয়াল ঘেঁষে রেখে দে অঙ্কন।
অঙ্কন সেটা ঠিকমতো রাখতেই বাবার হাতে আবার বই, বাবা বলে,
নে এটা ধর। রাখ ওর পাশে।
এরপর অঙ্কন ঠিকই বুঝে যায় হেল্প করা মানে বাবার বই বুকশেল্কম্ফ থেকে নামিয়ে মেঝেতে রাখা। শোবার খাটটা কয়েক দিন আগে ঘর থেকে বের করে ফেলার কারণে মেঝেটাই অনেক প্রশস্ত মনে হচ্ছে। নাজির মাহমুদের ইচ্ছে বইগুলো নামিয়ে ঘরের মেঝেতেই দেয়াল ঘেঁষে সাজিয়ে রাখবে। এ কাজে অঙ্কন সহযোগিতা করায় তারও খুব ভালো লাগে। আবার এই গৃহবন্দি দুঃসহ দিনে নয় বছরের অঙ্কন বই সরানোর কাজে হাত লাগিয়ে প্রবল আনন্দ পায়। তার মনে হয় অনেক দিন পর সে বাবার সঙ্গে মজার এক খেলায় অংশগ্রহণের সুযোগ পেয়েছে। সেই খেলা খেলতে খেলতে সে হঠাৎ জিজ্ঞেস করে,
আমাদের টেলিভিশনের কী হলো বাবা?
এ সময়ে নাজির মাহমুদের হাত থেকে একটা মোটা বই পড়ে যায় নিচে। অঙ্কন দ্রুত হাতে সেই বই তুলতে তুলতে বাবার মুখের দিকে তাকায়। লজ্জা ঢাকতে গিয়ে বাবার মুখে ফুটে ওঠে বিষণ্ণ হাসি। অঙ্কন আবারও শুধায়,
আজও সেটা মেরামত হয়নি?
এতক্ষণে নাজির মাহমুদের মনে পড়ে যায়- কবে যেন টেলিভিশন মেরামতের গল্পই সে বলেছিল। সেই গল্পের লেজ ধরেই এবার বলে,
কী মুশকিল, লকডাউন চলছে যে!
তা বটে। লকডাউনের কারণে সব দোকানপাট বন্ধ। টেলিভিশন মেরামত হবে কেমন করে! হাতে কাজ করতে করতে নাজির মাহমুদ মনে করিয়ে দেয়- এই লকডাউনের পর মামাবাড়ি গিয়ে সে বড় পর্দার টেলিভিশন দেখতে পাবে। ঢাকা ছেড়ে অনেক দিন কোথাও যাওয়া হয় না। মামাবাড়ি যাবার কথা অনেক দিন থেকে চলছে বটে, এ নিয়ে মা-বাবার মধ্যে বেশ তর্কাতর্কি হতেও শুনেছে অঙ্কন। তাই নিশ্চিত হবার জন্য সে জিজ্ঞেস করে,
সত্যি আমরা মামাবাড়ি যাচ্ছি তাহলে!
বাবা একগাল হেসে জানায়,
হ্যাঁ যাচ্ছি। তবে তোমাদের রেখে আমি আবার চলে আসব ঢাকায়।
দিনাজপুরের পার্বতীপুরে অঙ্কনের মামাবাড়ি। দূরত্বের কারণে হোক, অথবা অন্য কোনো অসুবিধার জন্যই হোক, অনেক দিন সেখানে যাওয়া হয় না। তাই বলে এবার এমন এন্তার সুযোগ পাওয়া যাবে, এ কথা কে কবে ভাবতে পেরেছে! আনন্দে ডগমগ হয়ে সে জানতে চায়,
আমরা তাহলে কবে যাচ্ছি বাবা?
বাপরে বাপ! মামাবাড়ির কথায় আর তর সইছে না কেমন?
অঙ্কন একটা লাজুক হাসি দিয়ে বাবার বুকের কাছে এগিয়ে আসে। হাতে বই ধরিয়ে দিয়ে বলে,
লকডাউন শেষ হোক, তারপরই চলে যাব পার্বতীপুর, দেখিস।
দ্বিগুণ উৎসাহে কাজে মনোযোগ দেয় অঙ্কন। ছোট্ট এই ড্রয়িংরুমের বুকশেল্কম্ফ খালি হয়ে যাচ্ছে। বই নিয়ে যাচ্ছে শোবার ঘরে দেয়ালের পাশে। ঘরের মেঝেতে গুছিয়ে রাখছে। বই বহন করতে করতে এতক্ষণে তার মনোযোগ পড়ে ড্রয়িংরুমের দেয়ালে টানানো বাবার আঁকা ছবির দিকে। দেয়ালজোড়া বেশ কয়েকটা বাঘের ছবি। এই ছবিগুলোর মধ্যে কী যে বিশেষ পার্থক্য আছে, ছোট্ট অঙ্কন তা ধরতে পারে না। কিন্তু এ বাসায় যারা বেড়াতে আসে, তাদের মধ্যে অনেকেই তফাত বুঝতে পারে। ঘাড় পর্যন্ত বাবরি চুলের লিখন আঙ্কেল তো প্রত্যেক বার মনে করিয়ে দেয়- এজন্যই তো লোকে তোমাকে টাইগার নাজির বলে। শিল্পী নাজির মাহমুদ বিব্রত বোধ করে, লাজুক মুখ নামিয়ে বলে, মাথা খারাপ! টাইগার হওয়া অতই সোজা! বললেই হলো!
লিখন আঙ্কেল তার বন্ধুকে খোঁচায়,
তাহলে এত বাঘের ছবি আঁকো কেন?
অঙ্কনের বাবা অবলীলায় জানায়, আমি সাতক্ষীরা শরণখোলার মানুষ। সুন্দরবনের আঁচলের তলে জন্ম, রয়েল বেঙ্গল টাইগারের সঙ্গে বসবাস, বাঘ নিয়ে আমার অন্যরকম আনন্দ, অন্যরকম অহংকার। সেই জন্য আমি নানাভাবে বাঘের ছবি আঁকি, বাঘের ভেতরের নানান অভিব্যক্তি ফোটাতে চেষ্টা করি।
অঙ্কনের কাঁধে থাবা দিয়ে লিখন আঙ্কেল বলে,
এই যে বাঘের বাচ্চা বাঘ, শুনলে তোমার বাপের বক্তৃতা! বন্ধুকেও সে রীতিমতো উৎসাহ দেয়- একদিন তুমি সত্যিই টাইগার হয়ে যাবে ফ্রেন্ড। বাঘ নিয়ে এমন গভীর কথা তো কোনোদিন শুনিনি, ভাবিওনি।
নাজির মাহমুদ হা হা হেসে জানায়,
প্রত্যেক বাঙালিই কিন্তু টাইগার বন্ধু। তুমিও রয়েল বেঙ্গল টাইগার।
হাসির গমকে লিখনেরও কাঁধের ওপর বাবরি চুল দুলে ওঠে।
বড়দের আলোচনার মধ্যে অঙ্কনও বেশ মাথা গলিয়ে দেয়, মনে করিয়ে দেয়,
সাকিব, মুশফিক, তাসকিন- সবাই তো আমাদের টাইগার।
লিখন আঙ্কেল হাসতে হাসতে মন্তব্য করে, শাবাশ বেটা! এই জন্যই তো আমি বাঘের বাচ্চা বাঘ বলি!
দেয়ালের গায়ে টানানো বাঘের ছবিগুলোর ওপরে চোখ রেখে অঙ্কন শুধায়,
তোমার এই ছবিগুলোও কি নামিয়ে ফেলতে হবে বাবা?
হঠাৎ নাজির মাহমুদের বুকের ভেতর কেঁপে ওঠে, যেন ভূমিকম্পে দুলে ওঠে সারা শরীর। নিজের আঁকা ছবি, সংগ্রহ করা বই আর নানান প্রদর্শনী ক্যাটালগ- সবই তো সে বিক্রি করতে চায়। অঙ্কন কি সে কথা কোনোভাবে টের পেয়ে গেল! ওকে আড়াল করেই খাট-শোকেস- ডাইনিং সেট বেরিয়ে গেছে বাসা থেকে। ওর মায়ের শখের হারমোনিয়াম কিংবা টেলিভিশন আর কখনোই বাজার থেকে বাসায় ফিরবে না। তবু শেষরক্ষা হলো কই! বাড়িঅলা চূড়ান্ত নোটিশ দিয়ে গেছে তিন মাসের বকেয়া ভাড়া শোধ করে বাসা ছাড়তে হবে এ মাসেই। অঙ্কনকে আড়াল করে সেই তোড়জোড়ই চলছে কয়েক দিন থেকে। মা-বাবার আশঙ্কা- কখন যে ধরা পড়ে যায় ছোট্ট শিশুটির কাছে!
শিল্পী নাজির মাহমুদ বুকশেল্কম্ফ থেকে বের করা বই নিচে নামিয়ে রেখে নিজের আঁকা বাঘের ছবিগুলোর দিকে একবার চোখ বুলিয়ে ছেলেকে বলে,
না না, আপাতত ওগুলো থাক।
অঙ্কন জিজ্ঞেস করে,
এই ছবিগুলো তুমি বিক্রি করবে না বাবা?
নাজির মাহমুদের ছবি বিক্রির বিষয়টা কারও অজানা কিছু নয়। এটাই তার জীবিকার প্রধান অবলম্বন। প্রদর্শনী থেকেই কত ছবি বিক্রি হয়ে যায় উচ্চমূল্যে। দেশে-বিদেশে এ নাগাদ তার বেশ কয়েকটি প্রদর্শনী হয়েছে বিভিন্ন গ্যালারিতে। মাথায় জাতীয় পতাকার ব্যান্ড বাঁধা অবস্থায় নাজির মাহমুদের সহাস্য ছবিসহ প্রদর্শনীর ভালো কাভারেজ ছাপা হয়েছে কাগজে, ইলেকট্রনিক মিডিয়াও যথেষ্ট কাভার করেছে। গুলশান-বনানীর কোনো কোনো দূতাবাসেও তার ছবি বিক্রি হয়েছে। অথচ এই শেষবেলায় ড্রয়িংরুমের ছবি বিক্রির কথায় ছেলের সামনে কেন যে এভাবে চমকে ওঠে শিল্পী নাজির, কে বলবে সেই কথা!
প্রকৃতপক্ষে করোনার এই দুঃসময়ে ছবি কেনার মানুষ পাওয়া ভার। একসময় চারুকলার সামনে দাঁড়িয়েই কত ছবি বিক্রি হয়েছে। পটুয়া নাজিরের হাতের বাঘ নিয়ে কাড়াকাড়ি পর্যন্ত হয়েছে। এখন পেটের দায়ে সেই বাঘের পট বিক্রির ঘোষণা দিয়েও লোক পাওয়া যায় না। এ এমনই দুঃসময়! কিন্তু এসব কথা অঙ্কনকে না বলে নাজির মাহমুদ কৌশলে জানিয়ে দেয়,
কত ছবিই তো বিক্রি করেছি এ জীবনে, এগুলো থাক। এর মধ্যে দুটো ছবি তুই বরং তোর মামার জন্য নিয়ে যাস। সেটাই ভালো হবে।
এ প্রস্তাবে অঙ্কন মহাখুশি। সুযোগ বুঝে সে আরও এক বাড়তি প্রস্তাব দিয়ে বসে,
আর ছোট খালার জন্য একটা নিলে হয় না বাবা?
নিবি?
একটা ছবি নেব বাবা। ছোট খালা খুব খুশি হবে।
কিন্তু তোর খালু তো খুশি হবে না। ছবিটবি একদম পছন্দ করে না সে।
তা হোক। লামিয়া আছে যে!
ফিক করে হেসে ওঠে অঙ্কনের বাবা। ভারি এক চিত্র সমঝদার পাওয়া গেছে! অঙ্কনের চেয়ে দু'বছরের ছোট লামিয়া, ওর খালাতো বোন। তার জন্য প্রিয় উপহার হিসেবে একটা ছবি তো নেওয়াই যায়। হাসিমুখে সম্মতি দেয় বাবা,
তাহলে নিস একটা।
আনন্দে আটখানা হয়ে অঙ্কন দুম করে প্রস্তাব দিয়ে বসে,
আমরা কিন্তু ট্রেনে যাব বাবা।
ট্রেনে যাবি?
হ্যাঁ, খুব মজা হবে। মাও কিন্তু রাজি।
তাই নাকি! মায়ের সঙ্গেও যুক্তি হয়ে গেছে?
ট্রেনে যাওয়াই ভালো বাবা। অঙ্কন বেশ যুক্তি দেখায়, তোমার ছবিটবি নেবারও সুবিধা হবে।
হা হা করে উচ্চ স্বরে হেসে ওঠে অঙ্কনের বাবা। ছেলেকে বলে,
আমার ছবি নেওয়াটাই বড় হলো তাহলে! আচ্ছা বেশ, তবে ট্রেন জার্নিই হবে, যা।
খুশিতে বাবাকে জড়িয়ে ধরে অঙ্কন। হাতের বই দেখিয়ে বাবা মনে করিয়ে দেয়,
আমাদের বই সরানোর কাজ কিন্তু অর্ধেকও হয়নি অঙ্কন মাহমুদ।
অঙ্কনও বেশ পাকামো করে উত্তর দেয়,
হবে হবে। আজ না হোক কাল সারা হবে। চিন্তা করো না তো!
পুত্র যখন আশ্বস্ত করে, তখন পিতার আবার ভাবনা কীসের! নাজির মাহমুদ সস্নেহে পুত্রের কাঁধে হাত রেখে জানায়,
এই জন্যই তো আমার ছেলেটাকে সবাই গুড বয় বলে!
অঙ্কন হেসে বলে,
কই থামলে কেন! বই নামিয়ে দাও!
একদিনে এত কাজ করতে গিয়ে হাঁপিয়ে যাবি যে!
অঙ্কন খুব মজার জবাব দেয়,
এসব গুছিয়ে তারপর মামাবাড়ি যেতে হবে না!
ওরে পাজি! তাহলে মামাবাড়ি যাবার জন্য তোমার এত তাড়াহুড়ো?
হাতের বই দেয়ালের পাশে রেখে এসে অঙ্কন বলে,
না বাবা, তা নয়।
ছেলের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে বাবা। ছেলে মনে করিয়ে দেয়,
আমরা তো মামাবাড়ি যাব এবারের লকডাউনের পরে।
সেটা মনে আছে তাহলে!
আমি একটা কথা বলব বাবা?
একটা কেন, হাজার কথা বলবি তুই।
তার আগেই যদি নতুন ভাড়াটিয়া চলে আসে এ বাসায়!
নাজির মাহমুদের হাত থেকে আবার খসে পড়ে মোটা একটা বই। পুরোনো বই বলে পুটের বাঁধন আলগা হয়ে গেছে। তাই মেঝেতে পড়া মাত্র বইয়ের পাতা ছিটিয়ে যায়। নাজির মাহমুদ ভেতরে ভেতরে চমকে ওঠে- অঙ্কনের চোখে কিছুই এড়ায় না তাহলে! হোক উঁচুতে, তবু বাসার সামনে লটকে দেওয়া 'টু-লেট' তার নজরেও পড়েছে! বাকরুদ্ধ হয়ে যায় নাজির মাহমুদের।
ঢাকায় বাসা ভাড়া হওয়া এখন সোজা নয়। মানুষ এখন ঢাকা ছাড়ছে। সর্বস্ব খুইয়ে দাঁতে দাঁত পিষে থাকার পরও এই দুঃসময়ে আর টিকে থাকতে না পেরে নাজির মাহমুদের মতো অনেকেই রণাঙ্গন ছেড়ে পালাচ্ছে। তবু হয়তো একদিন এই 'টু-লেট' নামানো হবে, নতুন কোনো ভাড়াটিয়া আসবে। সে হয়তো জানবেই না- দীর্ঘ পনেরো বছর ধরে এইটুকু ছাদের নিচে কোনো এক শিল্পী দম্পতি অসংখ্য স্বপ্ন রচনা করেছিল, একজন ছবি এঁকে আর একজন গান গেয়ে এ বাসার দেয়ালে দেয়ালে মধুময় স্বপ্নের আবির ছড়িয়েছিল, কোনো এক অবুঝ বালক সেই স্বপ্নসমুদ্রে সাঁতার কাটতে কাটতে বেড়ে উঠছিল। কেউ জানবে না এসব স্বপ্ন এবং স্বপ্নভঙ্গের কথা। বুকশেল্কেম্ফর গল্গাস টেনে দিয়ে নাজির মাহমুদ হাতের ময়লা ঝাড়তে ঝাড়তে ছেলেকে বলে,
আজ এইটুকুই থাক বাবা, ভাড়াটিয়া আসতে দেরি আছে।
দুই.
কমলাপুর রেলওয়ে স্টেশন।
অঙ্কনরা খুব ভোরবেলা চলে এসেছে স্টেশনে। বাপরে বাপ! সকালবেলা একের পর এক এতগুলো ট্রেন যে ছেড়ে যায় এখান থেকে, সে তথ্য জানা ছিল না অঙ্কনের। বিস্ময়ের সঙ্গে বিভিন্ন গন্তব্যের ট্রেনগুলো সে দ্যাখে। সিটি বাজিয়ে একে একে চলে যায় ট্রেনগুলো। এই দৃশ্য দেখে সে খুব আনন্দ পায়। তিন নম্বর পল্গ্যাটফর্মে দাঁড়ানো ট্রেন দেখিয়ে বাবা বলে- চলো, এটাই আমাদের ট্রেন। মায়ের হাত ধরে উঠে পড়ো।
বিক্রি কিংবা বিতরণ করে হোক, অথবা এখানে-সেখানে ছড়ানো-ছিটানোর পরও পনেরো বছরের সংসারের টুকিটাকি এটা-সেটা বাঁধাছাঁদা করে সাকল্যে ব্যাগ-ব্যাগেজ নিতান্ত কম হয়নি। নাজির মাহমুদ সেসব লাটবহর গুছিয়ে নিজেদের কামরায় তোলার পর সবশেষে বিশেষ যত্নে নিয়ে আসে বাঘের ছবি তিনটি। খুব কায়দা করে মাথার ওপরে বাঙ্কে রাখা হয় সেই ছবি। অঙ্কন তখনই দু'হাতে তালি বাজিয়ে বলে ওঠে- কী মজা! কী মজা! বাঘ চলেছে মামাবাড়ি।
ট্রেন ছাড়তে তখনও খানিক দেরি।
অঙ্কনের মা ব্যাগ-ব্যাগেজের তদারকি শেষে শাড়ির আঁচলে মুখ মুছতে মুছতে বলে,
বাঘ নয়, বাঘের বাচ্চা চলেছে মামাবাড়ি।
ফিক করে হেসে ফেলে অঙ্কন। বাবার মুখের দিকে তাকিয়ে শুধায়,
লিখন আঙ্কেলের কথা মা জানল কেমন করে!
সে প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে শিল্পী নাজির মাহমুদ বলে,
আমিই যদি বাঘ না থাকি, তুই কেমন করে বাঘের বাচ্চা হবি?
অঙ্কনের মা জিজ্ঞেস করে,
লোকে আর টাইগার নাজির বলবে না তো!
কী যে বলো রূপা, টাইগার হওয়া অতই সোজা?
নাজির মাহমুদ এরপর নিজে থেকেই বাঘ-বিষয়ক বিবরণ দেয়। সে জানায় বাংলার বাঘ ছিলেন শেরেবাংলা, এই বাংলাদেশের অহংকার। ওপার বাংলায় ছিলেন আশুতোষ মুখোপাধ্যায়, নাম শুনেছ? বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকীর নাম হয়েছিল বাঘা সিদ্দিকী। অনেকে টাইগার সিদ্দিকীও বলে। কীসের টাইগার নাজির! বললেই হলো! বাঘ কখনও পিছিয়ে আসে!
বাঘ-বিষয়ক এই বিবরণ আশেপাশের দু'চারজন যাত্রীও কান খাড়া করে শোনে। একজন বয়স্ক যাত্রী, মাথায় চুল নেই, ঠোঁটের ওপরে তার সাদা ঘন গোঁফ, নাজির মাহমুদের দিকে আঙুল তুলে বলেন,
একাত্তরে আমরা আরও এক টাইগারের নাম শুনেছি ভাইয়া, তিনি নিজেই নিজেকে টাইগার নিয়াজী বলতে ভালোবাসতেন।
অচেনা এক সহযাত্রীর কথাতেও যেন বড্ড মজা পায় শিল্পী নাজির মাহমুদ। হো হো করে হেসে তার সঙ্গে যোগ করে,
নিয়াজীও টাইগার! হুঁ! টাইগার! সে হলো পিছিয়ে আসা টাইগার। রয়েল বেঙ্গল টাইগারদের সামনে দাঁড়াতেই পারেনি, তার আবার তর্জন গর্জন!
এরই মাঝে তীব্র স্বরে সিটি বাজিয়ে ট্রেন ছেড়ে দেয়। কামরার ভেতরের কথাবার্তা বিশেষ শোনা যায় না। তবু সেই ভদ্রলোক ভাঙা টিন বাজাবার মতো বলেই চলেছেন- দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে কী যেন বিরাট ভূমিকা পালন করার সুবাদে 'টাইগার' হয়েছিলেন নিয়াজী।
দিনের শেষে পার্বতীপুরের মাটিতে পা দিয়েই নাজির মাহমুদ স্ত্রীর কানের কাছে মুখ নামিয়ে পুনর্বার ঘোষণা করে- তোমাদের রেখে আমি কিন্তু সত্যি সত্যি ঢাকায় ফিরে যাব রূপা। একটা মেসটেস দেখে উঠে পড়ব। লড়াইটা আমি ঢাকা থেকেই করতে চাই।
রূপার দু'চোখ ছলছল করে ওঠে। স্বামীর প্রস্তাবের সমর্থনে সে জানায়,
আচ্ছা, তাই হবে। তুমি আমাদের টাইগার-নাজির, পিছিয়ে আসবে কেন!
অঙ্কন কিছুই বলে না। বাবার আঁকা বাঘের ছবি আগলে সে দাঁড়িয়ে থাকে।
আজ দু'দিন ভারি মজার এক খেলা পেয়েছে অঙ্কন। সেই খেলা নিয়ে বেশ আনন্দেই আছে সে। বাবার বুকশেল্কম্ফ থেকে বই নামানোর খেলা। এ খেলার কোনো নাম নেই, কিন্তু মজা আছে। বাবাকে কাছে পাবার মজা। দু-তিন দিন আগে শোকেস থেকে থালাবাসন, খেলনাপাতি, কাপড়চোপড় নামিয়ে খালি করা হয়েছে। অঙ্কনের মা একা হাতে সামলেছে সেসব। কিন্তু অঙ্কনকে মোটেই হাত লাগাতে দেয়নি। অথচ বুকশেল্কম্ফ খালি করার সময় বাবা নিজে থেকে তাকে ডেকে বলেছে,
আমাকে একটু হেল্প করবি অঙ্কন?
এমন আহ্বান শুনে তো সে মহাখুশি। ইশকুলে চলছে করোনাকালীন ছুটি। লকডাউনের মধ্যে বাইরে যাওয়াও যাবে না। একনাগাড়ে ঘরের ভেতরে সময় কাটে কী করে! এ সময়ে বাবাকে হেল্প করতে পারলে তো ভালোই হয়। অঙ্কনের বাবা নাজির মাহমুদ ছবি আঁকে, পটশিল্পী। কেউ কেউ বলে পটুয়া। বাবার ছবি আঁকা দেখতে খুব ভালো লাগে অঙ্কনের। বাবাকে হেল্প করা মানে রংতুলিটা এগিয়ে দেওয়া, ইজেলটা বাড়িয়ে ধরা, এই রকম টুকিটাকি। এসব হুকুম পালন করতেও ঢের আনন্দ তার। লাফিয়ে এসে বাবার কাছে সে জানতে চায়,
কী হেল্প বাবা?
অঙ্কনের বাবা বুকশেল্কম্ফ থেকে একটা বই নিয়ে ছেলের দিকে বাড়িয়ে দেয়,
নে, ধর। এটা নামিয়ে রাখ ওই ঘরের মেঝেতে।
অবাক হয় অঙ্কন, এটাই হেল্প করা নাকি! আজ তাহলে রংতুলির কাজ নেই!
কী যে হয়েছে, তার বাবাকে অনেক দিন ছবি আঁকতেই দেখা যায় না। মায়ের না হয় ইশকুল বন্ধ, তাই বলে বাবা আঁকাআঁকি তো বন্ধ হতে পারে না। অঙ্কন কলম ধরা শিখেছে তার মায়ের কাছে, আর তুলি ধরতে শিখিয়েছে তার বাবা। কত দিন সেই রংতুলির চর্চাই হচ্ছে না। বাবার হুকুম শুনে আজও হতাশ হয় অঙ্কন। তবু হাত বাড়িয়ে বইটা ধরে, বাবার মুখের দিকে তাকিয়ে বুঝতে চেষ্টা করে-মেঝেতে মানে ঠিক কোথায় বই রাখতে বলেছে তার বাবা। নাজির মাহমুদ প্রায় অকারণেই ফিক করে হেসে ছেলেকে নির্দেশ দেয়,
তোশকের পাশে দেয়াল ঘেঁষে রেখে দে অঙ্কন।
অঙ্কন সেটা ঠিকমতো রাখতেই বাবার হাতে আবার বই, বাবা বলে,
নে এটা ধর। রাখ ওর পাশে।
এরপর অঙ্কন ঠিকই বুঝে যায় হেল্প করা মানে বাবার বই বুকশেল্কম্ফ থেকে নামিয়ে মেঝেতে রাখা। শোবার খাটটা কয়েক দিন আগে ঘর থেকে বের করে ফেলার কারণে মেঝেটাই অনেক প্রশস্ত মনে হচ্ছে। নাজির মাহমুদের ইচ্ছে বইগুলো নামিয়ে ঘরের মেঝেতেই দেয়াল ঘেঁষে সাজিয়ে রাখবে। এ কাজে অঙ্কন সহযোগিতা করায় তারও খুব ভালো লাগে। আবার এই গৃহবন্দি দুঃসহ দিনে নয় বছরের অঙ্কন বই সরানোর কাজে হাত লাগিয়ে প্রবল আনন্দ পায়। তার মনে হয় অনেক দিন পর সে বাবার সঙ্গে মজার এক খেলায় অংশগ্রহণের সুযোগ পেয়েছে। সেই খেলা খেলতে খেলতে সে হঠাৎ জিজ্ঞেস করে,
আমাদের টেলিভিশনের কী হলো বাবা?
এ সময়ে নাজির মাহমুদের হাত থেকে একটা মোটা বই পড়ে যায় নিচে। অঙ্কন দ্রুত হাতে সেই বই তুলতে তুলতে বাবার মুখের দিকে তাকায়। লজ্জা ঢাকতে গিয়ে বাবার মুখে ফুটে ওঠে বিষণ্ণ হাসি। অঙ্কন আবারও শুধায়,
আজও সেটা মেরামত হয়নি?
এতক্ষণে নাজির মাহমুদের মনে পড়ে যায়- কবে যেন টেলিভিশন মেরামতের গল্পই সে বলেছিল। সেই গল্পের লেজ ধরেই এবার বলে,
কী মুশকিল, লকডাউন চলছে যে!
তা বটে। লকডাউনের কারণে সব দোকানপাট বন্ধ। টেলিভিশন মেরামত হবে কেমন করে! হাতে কাজ করতে করতে নাজির মাহমুদ মনে করিয়ে দেয়- এই লকডাউনের পর মামাবাড়ি গিয়ে সে বড় পর্দার টেলিভিশন দেখতে পাবে। ঢাকা ছেড়ে অনেক দিন কোথাও যাওয়া হয় না। মামাবাড়ি যাবার কথা অনেক দিন থেকে চলছে বটে, এ নিয়ে মা-বাবার মধ্যে বেশ তর্কাতর্কি হতেও শুনেছে অঙ্কন। তাই নিশ্চিত হবার জন্য সে জিজ্ঞেস করে,
সত্যি আমরা মামাবাড়ি যাচ্ছি তাহলে!
বাবা একগাল হেসে জানায়,
হ্যাঁ যাচ্ছি। তবে তোমাদের রেখে আমি আবার চলে আসব ঢাকায়।
দিনাজপুরের পার্বতীপুরে অঙ্কনের মামাবাড়ি। দূরত্বের কারণে হোক, অথবা অন্য কোনো অসুবিধার জন্যই হোক, অনেক দিন সেখানে যাওয়া হয় না। তাই বলে এবার এমন এন্তার সুযোগ পাওয়া যাবে, এ কথা কে কবে ভাবতে পেরেছে! আনন্দে ডগমগ হয়ে সে জানতে চায়,
আমরা তাহলে কবে যাচ্ছি বাবা?
বাপরে বাপ! মামাবাড়ির কথায় আর তর সইছে না কেমন?
অঙ্কন একটা লাজুক হাসি দিয়ে বাবার বুকের কাছে এগিয়ে আসে। হাতে বই ধরিয়ে দিয়ে বলে,
লকডাউন শেষ হোক, তারপরই চলে যাব পার্বতীপুর, দেখিস।
দ্বিগুণ উৎসাহে কাজে মনোযোগ দেয় অঙ্কন। ছোট্ট এই ড্রয়িংরুমের বুকশেল্কম্ফ খালি হয়ে যাচ্ছে। বই নিয়ে যাচ্ছে শোবার ঘরে দেয়ালের পাশে। ঘরের মেঝেতে গুছিয়ে রাখছে। বই বহন করতে করতে এতক্ষণে তার মনোযোগ পড়ে ড্রয়িংরুমের দেয়ালে টানানো বাবার আঁকা ছবির দিকে। দেয়ালজোড়া বেশ কয়েকটা বাঘের ছবি। এই ছবিগুলোর মধ্যে কী যে বিশেষ পার্থক্য আছে, ছোট্ট অঙ্কন তা ধরতে পারে না। কিন্তু এ বাসায় যারা বেড়াতে আসে, তাদের মধ্যে অনেকেই তফাত বুঝতে পারে। ঘাড় পর্যন্ত বাবরি চুলের লিখন আঙ্কেল তো প্রত্যেক বার মনে করিয়ে দেয়- এজন্যই তো লোকে তোমাকে টাইগার নাজির বলে। শিল্পী নাজির মাহমুদ বিব্রত বোধ করে, লাজুক মুখ নামিয়ে বলে, মাথা খারাপ! টাইগার হওয়া অতই সোজা! বললেই হলো!
লিখন আঙ্কেল তার বন্ধুকে খোঁচায়,
তাহলে এত বাঘের ছবি আঁকো কেন?
অঙ্কনের বাবা অবলীলায় জানায়, আমি সাতক্ষীরা শরণখোলার মানুষ। সুন্দরবনের আঁচলের তলে জন্ম, রয়েল বেঙ্গল টাইগারের সঙ্গে বসবাস, বাঘ নিয়ে আমার অন্যরকম আনন্দ, অন্যরকম অহংকার। সেই জন্য আমি নানাভাবে বাঘের ছবি আঁকি, বাঘের ভেতরের নানান অভিব্যক্তি ফোটাতে চেষ্টা করি।
অঙ্কনের কাঁধে থাবা দিয়ে লিখন আঙ্কেল বলে,
এই যে বাঘের বাচ্চা বাঘ, শুনলে তোমার বাপের বক্তৃতা! বন্ধুকেও সে রীতিমতো উৎসাহ দেয়- একদিন তুমি সত্যিই টাইগার হয়ে যাবে ফ্রেন্ড। বাঘ নিয়ে এমন গভীর কথা তো কোনোদিন শুনিনি, ভাবিওনি।
নাজির মাহমুদ হা হা হেসে জানায়,
প্রত্যেক বাঙালিই কিন্তু টাইগার বন্ধু। তুমিও রয়েল বেঙ্গল টাইগার।
হাসির গমকে লিখনেরও কাঁধের ওপর বাবরি চুল দুলে ওঠে।
বড়দের আলোচনার মধ্যে অঙ্কনও বেশ মাথা গলিয়ে দেয়, মনে করিয়ে দেয়,
সাকিব, মুশফিক, তাসকিন- সবাই তো আমাদের টাইগার।
লিখন আঙ্কেল হাসতে হাসতে মন্তব্য করে, শাবাশ বেটা! এই জন্যই তো আমি বাঘের বাচ্চা বাঘ বলি!
দেয়ালের গায়ে টানানো বাঘের ছবিগুলোর ওপরে চোখ রেখে অঙ্কন শুধায়,
তোমার এই ছবিগুলোও কি নামিয়ে ফেলতে হবে বাবা?
হঠাৎ নাজির মাহমুদের বুকের ভেতর কেঁপে ওঠে, যেন ভূমিকম্পে দুলে ওঠে সারা শরীর। নিজের আঁকা ছবি, সংগ্রহ করা বই আর নানান প্রদর্শনী ক্যাটালগ- সবই তো সে বিক্রি করতে চায়। অঙ্কন কি সে কথা কোনোভাবে টের পেয়ে গেল! ওকে আড়াল করেই খাট-শোকেস- ডাইনিং সেট বেরিয়ে গেছে বাসা থেকে। ওর মায়ের শখের হারমোনিয়াম কিংবা টেলিভিশন আর কখনোই বাজার থেকে বাসায় ফিরবে না। তবু শেষরক্ষা হলো কই! বাড়িঅলা চূড়ান্ত নোটিশ দিয়ে গেছে তিন মাসের বকেয়া ভাড়া শোধ করে বাসা ছাড়তে হবে এ মাসেই। অঙ্কনকে আড়াল করে সেই তোড়জোড়ই চলছে কয়েক দিন থেকে। মা-বাবার আশঙ্কা- কখন যে ধরা পড়ে যায় ছোট্ট শিশুটির কাছে!
শিল্পী নাজির মাহমুদ বুকশেল্কম্ফ থেকে বের করা বই নিচে নামিয়ে রেখে নিজের আঁকা বাঘের ছবিগুলোর দিকে একবার চোখ বুলিয়ে ছেলেকে বলে,
না না, আপাতত ওগুলো থাক।
অঙ্কন জিজ্ঞেস করে,
এই ছবিগুলো তুমি বিক্রি করবে না বাবা?
নাজির মাহমুদের ছবি বিক্রির বিষয়টা কারও অজানা কিছু নয়। এটাই তার জীবিকার প্রধান অবলম্বন। প্রদর্শনী থেকেই কত ছবি বিক্রি হয়ে যায় উচ্চমূল্যে। দেশে-বিদেশে এ নাগাদ তার বেশ কয়েকটি প্রদর্শনী হয়েছে বিভিন্ন গ্যালারিতে। মাথায় জাতীয় পতাকার ব্যান্ড বাঁধা অবস্থায় নাজির মাহমুদের সহাস্য ছবিসহ প্রদর্শনীর ভালো কাভারেজ ছাপা হয়েছে কাগজে, ইলেকট্রনিক মিডিয়াও যথেষ্ট কাভার করেছে। গুলশান-বনানীর কোনো কোনো দূতাবাসেও তার ছবি বিক্রি হয়েছে। অথচ এই শেষবেলায় ড্রয়িংরুমের ছবি বিক্রির কথায় ছেলের সামনে কেন যে এভাবে চমকে ওঠে শিল্পী নাজির, কে বলবে সেই কথা!
প্রকৃতপক্ষে করোনার এই দুঃসময়ে ছবি কেনার মানুষ পাওয়া ভার। একসময় চারুকলার সামনে দাঁড়িয়েই কত ছবি বিক্রি হয়েছে। পটুয়া নাজিরের হাতের বাঘ নিয়ে কাড়াকাড়ি পর্যন্ত হয়েছে। এখন পেটের দায়ে সেই বাঘের পট বিক্রির ঘোষণা দিয়েও লোক পাওয়া যায় না। এ এমনই দুঃসময়! কিন্তু এসব কথা অঙ্কনকে না বলে নাজির মাহমুদ কৌশলে জানিয়ে দেয়,
কত ছবিই তো বিক্রি করেছি এ জীবনে, এগুলো থাক। এর মধ্যে দুটো ছবি তুই বরং তোর মামার জন্য নিয়ে যাস। সেটাই ভালো হবে।
এ প্রস্তাবে অঙ্কন মহাখুশি। সুযোগ বুঝে সে আরও এক বাড়তি প্রস্তাব দিয়ে বসে,
আর ছোট খালার জন্য একটা নিলে হয় না বাবা?
নিবি?
একটা ছবি নেব বাবা। ছোট খালা খুব খুশি হবে।
কিন্তু তোর খালু তো খুশি হবে না। ছবিটবি একদম পছন্দ করে না সে।
তা হোক। লামিয়া আছে যে!
ফিক করে হেসে ওঠে অঙ্কনের বাবা। ভারি এক চিত্র সমঝদার পাওয়া গেছে! অঙ্কনের চেয়ে দু'বছরের ছোট লামিয়া, ওর খালাতো বোন। তার জন্য প্রিয় উপহার হিসেবে একটা ছবি তো নেওয়াই যায়। হাসিমুখে সম্মতি দেয় বাবা,
তাহলে নিস একটা।
আনন্দে আটখানা হয়ে অঙ্কন দুম করে প্রস্তাব দিয়ে বসে,
আমরা কিন্তু ট্রেনে যাব বাবা।
ট্রেনে যাবি?
হ্যাঁ, খুব মজা হবে। মাও কিন্তু রাজি।
তাই নাকি! মায়ের সঙ্গেও যুক্তি হয়ে গেছে?
ট্রেনে যাওয়াই ভালো বাবা। অঙ্কন বেশ যুক্তি দেখায়, তোমার ছবিটবি নেবারও সুবিধা হবে।
হা হা করে উচ্চ স্বরে হেসে ওঠে অঙ্কনের বাবা। ছেলেকে বলে,
আমার ছবি নেওয়াটাই বড় হলো তাহলে! আচ্ছা বেশ, তবে ট্রেন জার্নিই হবে, যা।
খুশিতে বাবাকে জড়িয়ে ধরে অঙ্কন। হাতের বই দেখিয়ে বাবা মনে করিয়ে দেয়,
আমাদের বই সরানোর কাজ কিন্তু অর্ধেকও হয়নি অঙ্কন মাহমুদ।
অঙ্কনও বেশ পাকামো করে উত্তর দেয়,
হবে হবে। আজ না হোক কাল সারা হবে। চিন্তা করো না তো!
পুত্র যখন আশ্বস্ত করে, তখন পিতার আবার ভাবনা কীসের! নাজির মাহমুদ সস্নেহে পুত্রের কাঁধে হাত রেখে জানায়,
এই জন্যই তো আমার ছেলেটাকে সবাই গুড বয় বলে!
অঙ্কন হেসে বলে,
কই থামলে কেন! বই নামিয়ে দাও!
একদিনে এত কাজ করতে গিয়ে হাঁপিয়ে যাবি যে!
অঙ্কন খুব মজার জবাব দেয়,
এসব গুছিয়ে তারপর মামাবাড়ি যেতে হবে না!
ওরে পাজি! তাহলে মামাবাড়ি যাবার জন্য তোমার এত তাড়াহুড়ো?
হাতের বই দেয়ালের পাশে রেখে এসে অঙ্কন বলে,
না বাবা, তা নয়।
ছেলের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে বাবা। ছেলে মনে করিয়ে দেয়,
আমরা তো মামাবাড়ি যাব এবারের লকডাউনের পরে।
সেটা মনে আছে তাহলে!
আমি একটা কথা বলব বাবা?
একটা কেন, হাজার কথা বলবি তুই।
তার আগেই যদি নতুন ভাড়াটিয়া চলে আসে এ বাসায়!
নাজির মাহমুদের হাত থেকে আবার খসে পড়ে মোটা একটা বই। পুরোনো বই বলে পুটের বাঁধন আলগা হয়ে গেছে। তাই মেঝেতে পড়া মাত্র বইয়ের পাতা ছিটিয়ে যায়। নাজির মাহমুদ ভেতরে ভেতরে চমকে ওঠে- অঙ্কনের চোখে কিছুই এড়ায় না তাহলে! হোক উঁচুতে, তবু বাসার সামনে লটকে দেওয়া 'টু-লেট' তার নজরেও পড়েছে! বাকরুদ্ধ হয়ে যায় নাজির মাহমুদের।
ঢাকায় বাসা ভাড়া হওয়া এখন সোজা নয়। মানুষ এখন ঢাকা ছাড়ছে। সর্বস্ব খুইয়ে দাঁতে দাঁত পিষে থাকার পরও এই দুঃসময়ে আর টিকে থাকতে না পেরে নাজির মাহমুদের মতো অনেকেই রণাঙ্গন ছেড়ে পালাচ্ছে। তবু হয়তো একদিন এই 'টু-লেট' নামানো হবে, নতুন কোনো ভাড়াটিয়া আসবে। সে হয়তো জানবেই না- দীর্ঘ পনেরো বছর ধরে এইটুকু ছাদের নিচে কোনো এক শিল্পী দম্পতি অসংখ্য স্বপ্ন রচনা করেছিল, একজন ছবি এঁকে আর একজন গান গেয়ে এ বাসার দেয়ালে দেয়ালে মধুময় স্বপ্নের আবির ছড়িয়েছিল, কোনো এক অবুঝ বালক সেই স্বপ্নসমুদ্রে সাঁতার কাটতে কাটতে বেড়ে উঠছিল। কেউ জানবে না এসব স্বপ্ন এবং স্বপ্নভঙ্গের কথা। বুকশেল্কেম্ফর গল্গাস টেনে দিয়ে নাজির মাহমুদ হাতের ময়লা ঝাড়তে ঝাড়তে ছেলেকে বলে,
আজ এইটুকুই থাক বাবা, ভাড়াটিয়া আসতে দেরি আছে।
দুই.
কমলাপুর রেলওয়ে স্টেশন।
অঙ্কনরা খুব ভোরবেলা চলে এসেছে স্টেশনে। বাপরে বাপ! সকালবেলা একের পর এক এতগুলো ট্রেন যে ছেড়ে যায় এখান থেকে, সে তথ্য জানা ছিল না অঙ্কনের। বিস্ময়ের সঙ্গে বিভিন্ন গন্তব্যের ট্রেনগুলো সে দ্যাখে। সিটি বাজিয়ে একে একে চলে যায় ট্রেনগুলো। এই দৃশ্য দেখে সে খুব আনন্দ পায়। তিন নম্বর পল্গ্যাটফর্মে দাঁড়ানো ট্রেন দেখিয়ে বাবা বলে- চলো, এটাই আমাদের ট্রেন। মায়ের হাত ধরে উঠে পড়ো।
বিক্রি কিংবা বিতরণ করে হোক, অথবা এখানে-সেখানে ছড়ানো-ছিটানোর পরও পনেরো বছরের সংসারের টুকিটাকি এটা-সেটা বাঁধাছাঁদা করে সাকল্যে ব্যাগ-ব্যাগেজ নিতান্ত কম হয়নি। নাজির মাহমুদ সেসব লাটবহর গুছিয়ে নিজেদের কামরায় তোলার পর সবশেষে বিশেষ যত্নে নিয়ে আসে বাঘের ছবি তিনটি। খুব কায়দা করে মাথার ওপরে বাঙ্কে রাখা হয় সেই ছবি। অঙ্কন তখনই দু'হাতে তালি বাজিয়ে বলে ওঠে- কী মজা! কী মজা! বাঘ চলেছে মামাবাড়ি।
ট্রেন ছাড়তে তখনও খানিক দেরি।
অঙ্কনের মা ব্যাগ-ব্যাগেজের তদারকি শেষে শাড়ির আঁচলে মুখ মুছতে মুছতে বলে,
বাঘ নয়, বাঘের বাচ্চা চলেছে মামাবাড়ি।
ফিক করে হেসে ফেলে অঙ্কন। বাবার মুখের দিকে তাকিয়ে শুধায়,
লিখন আঙ্কেলের কথা মা জানল কেমন করে!
সে প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে শিল্পী নাজির মাহমুদ বলে,
আমিই যদি বাঘ না থাকি, তুই কেমন করে বাঘের বাচ্চা হবি?
অঙ্কনের মা জিজ্ঞেস করে,
লোকে আর টাইগার নাজির বলবে না তো!
কী যে বলো রূপা, টাইগার হওয়া অতই সোজা?
নাজির মাহমুদ এরপর নিজে থেকেই বাঘ-বিষয়ক বিবরণ দেয়। সে জানায় বাংলার বাঘ ছিলেন শেরেবাংলা, এই বাংলাদেশের অহংকার। ওপার বাংলায় ছিলেন আশুতোষ মুখোপাধ্যায়, নাম শুনেছ? বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকীর নাম হয়েছিল বাঘা সিদ্দিকী। অনেকে টাইগার সিদ্দিকীও বলে। কীসের টাইগার নাজির! বললেই হলো! বাঘ কখনও পিছিয়ে আসে!
বাঘ-বিষয়ক এই বিবরণ আশেপাশের দু'চারজন যাত্রীও কান খাড়া করে শোনে। একজন বয়স্ক যাত্রী, মাথায় চুল নেই, ঠোঁটের ওপরে তার সাদা ঘন গোঁফ, নাজির মাহমুদের দিকে আঙুল তুলে বলেন,
একাত্তরে আমরা আরও এক টাইগারের নাম শুনেছি ভাইয়া, তিনি নিজেই নিজেকে টাইগার নিয়াজী বলতে ভালোবাসতেন।
অচেনা এক সহযাত্রীর কথাতেও যেন বড্ড মজা পায় শিল্পী নাজির মাহমুদ। হো হো করে হেসে তার সঙ্গে যোগ করে,
নিয়াজীও টাইগার! হুঁ! টাইগার! সে হলো পিছিয়ে আসা টাইগার। রয়েল বেঙ্গল টাইগারদের সামনে দাঁড়াতেই পারেনি, তার আবার তর্জন গর্জন!
এরই মাঝে তীব্র স্বরে সিটি বাজিয়ে ট্রেন ছেড়ে দেয়। কামরার ভেতরের কথাবার্তা বিশেষ শোনা যায় না। তবু সেই ভদ্রলোক ভাঙা টিন বাজাবার মতো বলেই চলেছেন- দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে কী যেন বিরাট ভূমিকা পালন করার সুবাদে 'টাইগার' হয়েছিলেন নিয়াজী।
দিনের শেষে পার্বতীপুরের মাটিতে পা দিয়েই নাজির মাহমুদ স্ত্রীর কানের কাছে মুখ নামিয়ে পুনর্বার ঘোষণা করে- তোমাদের রেখে আমি কিন্তু সত্যি সত্যি ঢাকায় ফিরে যাব রূপা। একটা মেসটেস দেখে উঠে পড়ব। লড়াইটা আমি ঢাকা থেকেই করতে চাই।
রূপার দু'চোখ ছলছল করে ওঠে। স্বামীর প্রস্তাবের সমর্থনে সে জানায়,
আচ্ছা, তাই হবে। তুমি আমাদের টাইগার-নাজির, পিছিয়ে আসবে কেন!
অঙ্কন কিছুই বলে না। বাবার আঁকা বাঘের ছবি আগলে সে দাঁড়িয়ে থাকে।
- বিষয় :
- অন্তর্ধান
- রফিকুর রশীদ