ঢাকা রবিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৫

প্রচ্ছদ

মুখ দেখে চমকে উঠেছিলাম

মুখ দেখে চমকে উঠেছিলাম

জাকির তালুকদার

প্রকাশ: ০৪ নভেম্বর ২০২১ | ১২:০০

কখনোই পুরো একটি আখ্যান একসাথে মাথায় নিয়ে গল্প লিখতে বসা হয়নি এ পর্যন্ত। একটি কোনো দৃশ্য, ভিড়ের মধ্যে বাতাসে ভেসে আসা একটি কোনো শোনা বাক্য, কোনো রোরুদ্যমানা মুখ, এমনকি কোনো বই পড়তে পড়তে তার একটি বাক্য করোটির মধ্যে স্থায়ী আসন নিয়ে নেয়। সেই বীজ যে কতদিন পরে গল্প হয়ে উঠবে বা আদৌ হয়ে উঠবে কিনা তা-ও জানি না। মাথার মধ্যে নাড়াচাড়া, মনের মধ্যে দলাপাকানো সেইসব বীজের কোনো-কোনোটি হারিয়ে যায়। প্রকৃতির মতোই। আমের মৌসুমে যত মুকুল বৃক্ষকে ম-ম গন্ধে ভরিয়ে দেয়, তাদের গুটি হয়ে ওঠার অনুপাত অনেক কম। সেই গুটিগুলোও সবাই প্রাকৃতিক নানা ঝঞ্ঝা, দুর্বিপাক পেরিয়ে ফল হয়ে উঠতে পারে না। সেই রকমই অনেক বীজ থেকেই কোনো গল্প যথার্থ অবয়ব নিয়ে ফুটে ওঠার আগেই অপমৃত্যুর শিকার হয়। বীজটি শুরুতে যতখানি আলোড়ন তুলেছিল মনে-হৃদয়ে, পরবর্তী সময়ে দেখা যায় অনেকটাই ফিকে হয়ে গেছে সেই আবেগ। চাপা পড়েছে আরও অনেক নতুন নতুন ঘটনার নিচে। লিখতে বসে দেখা যায় শুরুর সময় যতখানি মর্মস্পর্শী মনে হচ্ছিল, পরে আর ঠিক ততখানি নয়, যাকে জমাট বাঁধিয়ে গল্প নির্মাণ করা যায়।
আবার কোনো দৃশ্য করোটির মধ্যে স্থায়ী আসন তৈরি করে নেয়। যতদিন বা যত বছরই পেরিয়ে যাক না কেন, সে তার জায়গা ছেড়ে নড়ে না। মাঝেমধ্যেই গভীর পানির তলার মাছের মতো ঘাই মেরে ভেসে ওঠে মনের পর্দায়। তাই দেখা গেছে, দশ বছর আগে যে বীজটি প্রোথিত হয়েছিল আমার মনে, সে তিন হাজার ছয়শ পঞ্চাশ দিন পরে ঠিকই গল্প হয়ে ফুটে উঠেছে ল্যাপটপের পর্দায়।
উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, আমার লেখা একটি বহুল পঠিত গল্প 'আজগর আলির হিসাববিজ্ঞান' লেখা হয়েছিল সেভাবেই।
নব্বই দশকের শুরুতে একদিন রাজশাহী থেকে নাটোরে যাচ্ছিলাম। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের বিনোদপুর গেটে বাস জ্যামে আটকে আছে। বিনোদপুরে তখন রাস্তার দুই ধারে মাছ-মাংস-সবজি-কাঁচামালের বাজার বসে। বিশেষ করে সকালের দিকে। সেখানে খাল-বিল সেচে আনা টাটকা সব দেশি মাছ পাওয়া যায় বলে মৎস্যপ্রিয় মানুষের বেশ ভিড় হয়। বিশেষ করে ছুটির দিন সকালে। বাস জ্যামে আটকে আছে। আর বাসের জানালা দিয়ে আমার চোখ আটকে আছে ষাটোর্ধ্ব এক বৃদ্ধের মুখে। তার পরনে হাতাওয়ালা হ্যান্ডলুমের পুরোনো গেঞ্জি, লুঙ্গি। বাম কাঁধে গামছা। রাস্তার দুই পাশে কোনো না কোনো কনস্ট্রাকশনের কাজ হয়। তাই রাস্তায় ইটের টুকরো খুব একটা দুর্লভ নয়। সেই রকম একটা ইটের ওপর বসে আছেন বৃদ্ধ। তার সামনে একটা খালি ডালি। আর হাতে কয়েকটা এক টাকা এবং দু'টাকার নোট। বোধহয় পাশের কোনো গ্রাম থেকে শাকপাতা বা তরকারি বা মৌসুমি ফল বেচতে এসেছিলেন। যেহেতু ডালি এখন শূন্য, তাই ধারণা করাই যায় যে তার জিনিসগুলো বিক্রি হয়ে গেছে। বৃদ্ধ হাতের নোটগুলো খুব যত্ন করে গুনলেন। একটা একটা করে গুনলেন। টাকা গোনার সময় মানুষের মুখে-চোখে একধরনের বাড়তি মনোযোগ এবং আত্মপ্রসাদও ফুটে ওঠে। বৃদ্ধের মুখেও সেই ছাপ। টাকা গুনতে গুনতে ঘোলাটে চোখ দুটোকে আরও কাছে নিয়ে যাবার জন্য নিজের অজান্তেই তার মাথা অনেকখানি নুয়ে এসেছে টাকার নোটগুলোর দিকে। সমস্ত মুখটিতেই একটু বাড়তি চকচকে ভাব। টাকা গণনা শেষ করার পরে এবার মাথাটা সোজা হলো। সামনে তাকিয়ে আছেন সোজাসুজি। কিন্তু আমার মনে হলো কিছুই দেখছেন না তিনি। হিসাব করছেন মনে মনে। বেচাবিক্রির পালা শেষ। এবার তাকে কিনতে হবে। সেই কেনার জিনিসগুলোর তালিকা নিজের মনে মনে আরেকবার ঝালাই করে নিচ্ছেন। আমি তো জানি না তার কেনার তালিকায় কী কী আছে। হয়তো কিনতে হবে কেরোসিন, স্ত্রী বা পুত্রবধূর কোনো কাপড় বা চাহিদার জিনিস, পান-সুপারি, নাতি-নাতনির বায়না করা জিলিপি বা কোনো খেলনা, হয়তো চাল-ডালও। সেই সঙ্গে হয়তোবা রয়েছে পাড়ার মুদির কাছে বাকি, যা আজকে হাট থেকে সদাইপাতি সেরে ফিরে গিয়ে শোধবার কথা। কিন্তু তার হাতের নোটগুলোর দিকে তাকানো আর মনে মনে হিসাব করার পরবর্তী ভঙ্গি বলেই দিচ্ছে এই টাকা তার এই সময়ের আশু করণীয়গুলোর জন্যও যথেষ্ট নয়। বৃদ্ধের বলিরেখাময় মুখের ওপর কি আরও নতুন বলিরেখা যোগ হচ্ছে! তার বুক মোচড়াচ্ছে নিশ্চয়ই। আর তাকে ওই অবস্থায় দেখে আমার বুকও মোচড়াতে থাকে। নিজের মানসিক অবস্থা কল্পনা করে আমি নিজেই অবাক হয়ে যাই। ওই বৃদ্ধ কি ঢুকে পড়েছেন আমার বুকের মধ্যে? নাকি আমিই ঢুকে পড়েছি ওই বৃদ্ধের বুকের মধ্যে? এদিকে জ্যাম ছুটে গেছে রাস্তার। আমাদের বাসের চাকাও গড়াতে শুরু করেছে। আমি জানালা দিয়ে আকুল চোখ নিয়ে তাকিয়ে থাকি বৃদ্ধের দিকে। তাকে যতক্ষণ দেখা যায় চোখ দিয়ে ততক্ষণই শুষে নিতে চাই তার অবয়ব, তার সমস্ত নড়াচড়া, তার মুখে বলিরেখাগুলোর ওপর আরও নতুন ভাঁজ পড়ার চিহ্নগুলো।
তারপরে আর কোনোদিন সেই বৃদ্ধের সঙ্গে দেখা হয়নি। হবার কথাও নয়। কিন্তু বৃদ্ধের সেই মুখ আমি কিছুতেই ভুলতে পারি না। আর এই ভুলতে না পারাটা যেমন যন্ত্রণার, তেমনই চিন্তারও। চিন্তার। কারণ এমন কত ধরনের মানুষের মুখই তো আমাকে দেখতে হয় প্রতিদিন। এমন তো নয় যে এ দেশে অভাবী মানুষের সংখ্যা বিরল। তার চাইতে কত মর্মস্পর্শী দৃশ্যই আমি দেখেছি। প্রতিনিয়তই দেখি। অভাবের ধাক্কায় কত মানুষকেই তো এক ঝটকায় মনুষ্যত্বের সংজ্ঞার বাইরে ছিটকে পড়তে দেখেছি। এই দেশে বসবাস করলে অমন আরও কত দেখতে হবে। তাহলে কেন সেই বৃদ্ধের মুখ আমাকে এমনভাবে দখল করে রেখেছে? কেন সে হানা দিচ্ছে আমার ঘুমের মধ্যে? কেন সে আমার আনন্দময় মুহূর্তগুলোতেও নিজেকে উপস্থিত করছে আমার সামনে? অবস্থা এমন হয় যে আমার প্রেমিকাসান্নিধ্যের উচ্ছল মনোদৈহিক আবেশময় আলোর শামিয়ানা ফুটো করেও সে মাঝে মাঝে উঁকি দিতে থাকে। আমি প্রেমিকার মুখের দিকে তাকিয়ে প্রেমিকাকে দেখতে পাই না। অনুযোগ এলে সচেতন হই। কিন্তু সে যায় না। মনের এক কোণে দাঁড়িয়ে থাকে দাঁতের ফাঁকে আটকে থাকা ছোট্ট মাংসের আঁশের মতো অস্বস্তিকর উপস্থিতি হয়ে। কেন এমন হচ্ছে? আমাকে কি মানসিক রোগের চিকিৎসকের শরণাপন্ন হতে হবে শেষ পর্যন্ত!
হঠাৎ-ই উত্তর পাওয়া যায়। আবিস্কৃত হয় এক নিস্করুণ সত্য। কোনো এক মুহূর্তে আমি চমকে উঠে খেয়াল করি যে আসলে ওই বৃদ্ধের মুখ আমাকে বারবার মনে করিয়ে দিচ্ছে আমার জনক, আমার পিতার মুখের কথা। আশৈশব আমি আমার পিতাকে দেখে আসছি ওইভাবে প্রয়োজনের সাথে সংগতির অসামঞ্জস্য নিয়ে গলদঘর্ম হতে। তাকে প্রতিনিয়ত দেখেছি হাতে সঞ্চিত ও উপার্জিত মুদ্রাগুলো নিয়ে সংসারের প্রয়োজনীয় ব্যয়ের তুলনায় তার অপ্রতুলতা নিয়ে অপ্রস্তুত থাকতে। দেখেছি কখনও কখনও উদাস দৃষ্টিতে অনিশ্চিত ভবিষ্যতের দিকে তাকিয়ে থাকতে। দেখেছি কখনও কখনও পুরোপুরি ভেঙেও পড়তে। আসলে প্রতিদিনের বাস্তবতাকে দেখেও না দেখা, তার মধ্যে বসবাস করেও তাকে মানবিক দৃষ্টিতে ভালো করে লক্ষ্য না করার আমাদের অমানবিক প্রবণতার কারণেও আমরা আমাদের পরিবারপ্রধানের অনভূতিগুলোকে বোঝার কোনো চেষ্টাই করি না। তাই তার সংগতিহীনতাকে আমরা ধরে নিই ক্ষমার অযোগ্য অপরাধ হিসেবে। বুদ্ধি দিয়ে দেখতে শেখার বয়সে পৌঁছানোর পর থেকে যে পিতার অসহায়, কখনও কখনও সসেমিরা-আক্রান্ত মুখ দেখেও আমার মধ্যে কোনো ভাবান্তর হয়নি, সেই পিতার মুখকে মনে করিয়ে দিল অন্য একজন অসহায় মানুষের মুখ। নিজের ওপর ঘৃণা কিছুটা তৈরি হয়েছিল বইকি! সেই অসম্ভব গ্লানিময় আত্ম-উপলব্ধি আমাকে বিমূঢ় করে দেয়- আমি আমার জনকের দিকে ইতোপূর্বে কোনোদিনই মানবিক দৃষ্টিতে তাকাইনি পর্যন্ত! শুধু তাকে উপার্জন এবং আমাদের পরিপোষণের যন্ত্র হিসেবেই বিবেচনা করেছি! তার কাছে আমাদের চাহিদার কোনো শেষ ছিল না। নিত্যপ্রয়োজন, লেখাপড়ার খরচ, ফ্যাশনেবল কাপড়চোপড়ের খরচ, বেড়ানোর খরচ, অন্য শখ মেটানোর খরচ- এসবের জন্য তার কাছে দাবির পর দাবি তুলেছি প্রতিনিয়ত। আর যখনই তিনি আমাদের দাবি মেটাতে ব্যর্থ হয়েছেন, যে ব্যর্থতা ছিল প্রতিনিয়ত, তখনই তাকে কখনও নিঃশব্দ গঞ্জনা, কখনও নীরব ক্ষোভ, কখনও সশব্দ বাক্যবাণেও জর্জরিত করেছি আমরা পরিবারের সদস্যরা। অক্ষমতার বেদনা যে আমাদের চাইতে তাকে অনেক বেশি পোড়ায়, সেই সত্যটি কোনোদিনই আসেনি আমাদের উপলব্ধিতে।
এরপরে সেই বৃদ্ধের মুখ আমার অন্তর্দহন বাড়ানোর কাজে বিরতি দেয়। তবে সে কখনোই একবারে মিলিয়ে যায়নি। মনে করিয়ে দেবার জন্য পিতার মুখটি তো সবসময়ই সামনে থেকেছে, সামনে আছে।
তারও বছর দশেক পরের কথা। চাকরিসূত্রে আমি দিনাজপুর জেলায়। ততদিনে আমি গল্প লিখতে শুরু করেছি। কথাসাহিত্যকে ধরে নিয়েছি আমার প্রধান কাজ হিসেবে। চাকরি আমাকে সুযোগ করে দিয়েছে একেবারে তৃণমূল পর্যায়ের মানুষের সাথে মেলামেশার। সপ্তাহের ছয়টি দিন আমি তাদের সঙ্গে সঙ্গে থাকি। বৃহস্পতিবার বিকেলে পার্বতীপুর থেকে তিতুমীর এক্সপ্রেস ট্রেন ধরে নাটোরে আসি। শনিবার ভোরে সেই একই ট্রেনে কর্মস্থলে যাই। ট্রেনে মানুষ বই-পত্রিকা পড়ে। আগে আমিও পড়তাম। কিন্তু এখন আর বই পড়ার সময় হয় না। মানুষ দেখি। মানুষের সাথে যেচে কথা বলি। পাশের সিটের প্যাসেঞ্জার তো বটেই, যে কোনো লোককে অন্যরকম মানুষ মনে হলেই তার সাথে গল্প জুড়ে দিই। এভাবে পরিচয় ঘনিষ্ঠ হতে থাকে হকারদের সাথে, ব্ল্যাকারদের সাথে, চেকারদের সাথে, রেলপুলিশের লোকজনের সাথে, ট্রেনের নিয়মিত ভিখিরিদের সাথে। পথচলতি দু'জন শিক্ষিত মানুষ একত্রিত হলেই তারা অবধারিতভাবে রাজনীতির নামে বিএনপি-আওয়ামী লীগের গল্প তোলে। রাজনীতির প্রতি আমারও তীব্র আগ্রহ। কিন্তু আমি বিএনপি-আওয়ামী লীগকে নিয়ে গল্প করতে বা বিতর্ক করতে রাজি নই। তাই শিক্ষিত ভদ্রলোকদের সাথে আমার আলাপ জমে না। তেমন গল্পের মধ্যে পড়ে গেলে আমি নিজেকে গুটিয়ে রাখি। সেই সময় আমি দেখলাম ধানকাটা দলের মানুষদের। ধানকাটার মৌসুম এলেই এই মানুষরা দলে দলে বেরিয়ে পড়ে নিজেদের গ্রামগুলোকে পুরুষশূন্য করে। নিজেদের এলাকায় মঙ্গা। কাজের সংস্থান নেই। আর তারা কাজ বলতে জানে ক্ষেত-ফসলের কাজ। সেই কাজের সন্ধানে তারা বেরিয়ে পড়ে দলে দলে। চলে যায় নাটোর-রাজশাহী-কুষ্টিয়ায়। ভিড় করে নিজের শ্রম বিক্রির লাইনে- মোক ন্যান বাহে! মুই ধান কাটিবার কামত আইছঁ।
কয়েক সপ্তাহ এই রকম মানুষের সাথে দেখা হতে থাকে। পরিচয় হয় ছবরুদ্দি, আলেকালি, মকবের হোসেন, দোস্ত মহম্মদদের সাথে। তাদের মধ্যে একজন আজগর আলিও। আজগর আলির সাথে দেখা হয়েছিল অবশ্য ফিরতি পথে। সে এক মাস ধানকাটার কাজ করে মজুরি নিয়ে বাড়ি ফিরছিল। ট্রেনে যে সিটটিতে বসেছিল, সেটি আমার জায়গা থেকে একটু দূরে। কিন্তু তার মুখ দেখে আমি চমকে উঠেছিলাম দশ বছর আগের মতো আরও একবার। বিনোদপুরের সেই বৃদ্ধ! সেই একই ভঙ্গিতে হাতের মুঠোয় একশ-পঞ্চাশ-দশ-বিশ টাকার নোট গুনছে। তারপর মুখ উঁচিয়ে হিসাব করছে মনে মনে। হিসাবের খাতায় খরচের খাতের সাথে উপার্জনের টাকার কোনো সামঞ্জস্য বিধান করতে পারছে না। ফলে প্রতিবার টাকা গোনার পরে আরও বেশি উদাস হয়ে পড়ছে। আরও শূন্যতা ভর করছে ঘোলাটে দুই চোখে।
তারপর দুই সপ্তাহ একটানা বুক মোচড়ানি, চোখের পানি ফেলা, নিদ্রাহীনতার সাথে সাথে জন্ম নিল গল্প- 'আজগর আলির হিসাববিজ্ঞান'।

আরও পড়ুন

×