ঢাকা মঙ্গলবার, ১৪ জানুয়ারি ২০২৫

গ্রামবাংলার ঐতিহ্য মাটির ঘর

গ্রামবাংলার ঐতিহ্য মাটির ঘর

ফাইল ছবি

হালিমা আক্তার হানি

প্রকাশ: ১০ জানুয়ারি ২০২৫ | ২৩:৪১

বাংলাদেশ একটি কৃষিপ্রধান দেশ, যেখানে গ্রামবাংলার প্রকৃতি ও মাটির বাড়ি ছিল এক সময় আভিজাত্য ও ঐতিহ্যের প্রতীক। এখানকার মাটির ঘর, সবুজ শ্যামল ক্ষেত-খামার এবং সহজ-সরল জীবনযাপন গ্রামবাংলার একটি বিশেষ চিত্র তুলে ধরে। ঐতিহ্যবাহী এই গ্রামীণ পরিবেশ বাংলাদেশের সংস্কৃতির মূল ভিত্তি হিসেবে পরিচিত। যুগ যুগ ধরে এ দেশের মানুষ তাদের গ্রামীণ জীবনযাপন ও প্রকৃতির সঙ্গে মিলেমিশে বসবাস করে এসেছে, যা দেশের অর্থনীতি ও সংস্কৃতিকে করেছে সমৃদ্ধ।
বর্তমানে নগরায়ণের ফলে গ্রামীণ পরিবেশ দ্রুত পরিবর্তিত হচ্ছে। আধুনিক সুযোগ-সুবিধার জন্য মানুষ শহরের দিকে ঝুঁকছে এবং গ্রামাঞ্চলে কংক্রিটের দালান ও শিল্পাঞ্চল গড়ে উঠছে। এই নগরায়ণ একদিকে দেশের আর্থিক উন্নতি ও আধুনিকায়নের প্রতীক হলেও অন্যদিকে তা বাংলাদেশের ঐতিহ্যবাহী গ্রামীণ জীবনের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। হারিয়ে যাচ্ছে মাটির ঘর, কাঁচা রাস্তা ও গ্রামীণ ঐতিহ্যের স্বাভাবিক সৌন্দর্য।
উন্নতির প্রয়োজনে পরিবর্তন জরুরি হলেও গ্রামবাংলার ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি সংরক্ষণ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। নগরায়ণের সঙ্গে পরিবেশবান্ধব উন্নয়ন পরিকল্পনা ও ঐতিহ্য রক্ষার উদ্যোগ নেওয়া প্রয়োজন, যাতে গ্রামের আভিজাত্য ও ঐতিহ্য অটুট থাকে। গ্রামীণ ঐতিহ্য রক্ষা করেই বাংলাদেশের উন্নয়ন টেকসই হতে পারে।
একসময় গ্রামবাংলার মাটির বাড়ি শুধু বাসস্থান নয়; ছিল আবেগ, ঐতিহ্য আর মানুষের মিলনের প্রতীক। এসব বাড়িতে বসবাস করত যৌথ পরিবার, যেখানে বাবা-মা, সন্তান, দাদা-দাদি সবাই একসঙ্গে থাকত। উঠোনে একসঙ্গে গল্প করা, পিঠা বানানোর উৎসব, সন্ধ্যায় লণ্ঠনের আলোতে পারিবারিক সময় কাটানো– এসব দৃশ্য মাটির বাড়ির অপরিহার্য অংশ ছিল। মানুষের মধ্যে আন্তরিকতা, সহযোগিতা, ভালোবাসার বন্ধন গভীর ছিল। মাটির দেয়ালের গায়ে এঁকে রাখা আলপনা আর উঠোনজুড়ে খেলার দৃশ্য এক বিশেষ পরিবেশ সৃষ্টি করত, যা আজও স্মৃতিতে ভাসে।
কিন্তু আধুনিক ফ্ল্যাট সংস্কৃতি এই চিত্র বদলে দিয়েছে। এখন পরিবারের সদস্যরা আলাদা ঘরে, এমনকি আলাদা শহরে বসবাস করে। মানুষে মানুষে মনের দূরত্ব বেড়েছে। যৌথ পরিবারের ধারণা তো বিলুপ্তপ্রায়। ফ্ল্যাটে বাস করা মানুষের মধ্যে পাশের বাসার কাউকে চেনার তাগিদও কম। মাটির বাড়ির সেই আন্তরিক পরিবেশ আর মিলনের সুযোগ আধুনিক বাসস্থানে অনুপস্থিত, যা আমাদের সামাজিক ও সাংস্কৃতিক বন্ধনকে দিন দিন দুর্বল করে দিচ্ছে।
বর্তমান সময়ে আধুনিকতার ছোঁয়া মানুষের জীবনযাত্রার প্রতিটি ক্ষেত্রে পরিবর্তন এনেছে, বিশেষ করে বাসস্থানের নকশায়। গ্রামবাংলার ঐতিহ্যবাহী মাটির বাড়ি ছিল প্রাকৃতিক পরিবেশের সঙ্গে সম্পূর্ণ মানানসই। এসব বাড়ি প্রাকৃতিক উপাদানে তৈরি হওয়ায় গরমকালে ঠান্ডা আর শীতকালে উষ্ণ পরিবেশ তৈরি করত। মাটির দেয়াল, খোলামেলা উঠোন, চারপাশে গাছপালার ছায়ায় পাওয়া যেত নির্মল হাওয়া। মাটির বাড়িতে  মানুষ প্রকৃতির সঙ্গে মিশে বাস করত, যা স্বাস্থ্য ও মানসিক প্রশান্তির জন্য অত্যন্ত উপকারী।
কিন্তু আধুনিক ফ্ল্যাট বাড়িগুলোতে এসি-ফ্যানের কৃত্রিম বাতাস ব্যবহার করা হচ্ছে, যা একদিকে আরাম দিলেও স্বাস্থ্যের জন্য দীর্ঘ মেয়াদে ক্ষতিকর। এসির বাতাস ঘরের আর্দ্রতা কমিয়ে ফেলে, যা ত্বক ও শ্বাসযন্ত্রের সমস্যা সৃষ্টি করে। পাশাপাশি এর অতিরিক্ত ব্যবহারে পরিবেশের ওপরেও নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। মাটির বাড়ির সহজ-স্বাস্থ্যকর পরিবেশ এখন কংক্রিটের দেয়ালে হারিয়ে গেছে। আধুনিক বাসস্থানের এই পরিবর্তন আমাদের গ্রামীণ ঐতিহ্য থেকে শুধু দূরে সরিয়ে দেয়নি, বরং প্রকৃতির সঙ্গেও মানুষের সম্পর্কের একটি বড় ফারাক তৈরি করেছে।

হালিমা আক্তার হানি: শিক্ষার্থী, রাজশাহী কলেজ

আরও পড়ুন

×