ঢাকা বৃহস্পতিবার, ২২ মে ২০২৫

নদীযোদ্ধা তরুণদের গল্প জানল বিশ্ব

নদীযোদ্ধা তরুণদের গল্প জানল বিশ্ব

রিভারাইন পিপলের নদীযোদ্ধার একাংশ

আইরিন সুলতানা

প্রকাশ: ১৬ মার্চ ২০২৪ | ০৫:৪৬ | আপডেট: ১৬ মার্চ ২০২৪ | ১৪:২৬

বিশ্বের নানা প্রান্তে অজানা অনেকেই নদী সুরক্ষায় লড়াই-সংগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছেন। তাদের সেসব উদ্যোগ জানানোর দায়িত্ব কাঁধে তুলে নিয়েছে ‘লুইস পাগ ফাউন্ডেশন’।

আমরা যুদ্ধের দামামা চাই না, নদী নিয়ে তো নয়ই। তবু নদীকে প্রবহমান রাখা এক যুদ্ধ হয়ে উঠেছে। এই যুদ্ধ নদী দখল ও দূষণকারীদের বিরুদ্ধে। নদীবর্তী মানুষ এক রকম যুদ্ধ করছে তাদের জীবনযাপন, খাদ্যাভাস এবং আয়-রোজগারে নদীনির্ভরতা টিকিয়ে রাখতে। কিন্তু দখল ও দূষণে নদী এতটাই পালটেছে, নদীতে স্নান তো দূরের কথা, পাড় ধরে হেঁটে চলাই মুশকিল। নদীর পানি ফুটিয়েও পান করা যায় না। নদীর মাছ খাওয়া যায় না। নদীবর্তী মানুষই শেষ পর্যন্ত নদীর কাছাকাছি ছিল। তাদেরও এখন নদী থেকে মুখ ফিরিয়ে অন্য জীবিকার খোঁজে ছুটতে হয়। এই শহর তো আরও আগেই নদীর দিকে পেছন রেখেছে। 
নদীর প্রতি এসব অনাচারের কথা বলতে নদীর পাশে এসে দাঁড়াল কেউ কেউ। মানুষ যুক্ত হলো মানুষের সঙ্গে। নদী সুরক্ষার এ যুদ্ধে যোগ দিল যূথবদ্ধ মানুষের সংগঠন। 

রিভার লাভিং পিপল থেকে ২০০৯ সালের দিকে শুরু হলো রিভারাইন পিপল। প্রতিষ্ঠাতা শেখ রোকনের এ সংগঠনের ব্রত হলো নদীর প্রতি নিবেদিত থাকা। ২০০৫ সালে বিশ্ব নদী দিবস জাতিসংঘের সমর্থন পায়। বাংলাদেশে এই দিবস প্রথমবারের মতো উদযাপন করে রিভারাইন পিপল। ২০১০ সাল থেকে নদী দিবস উদযাপনে বাংলাদেশের প্রতিপাদ্য নির্ধারণ ও ঘোষণার সূচনাও করে দেয় রিভারাইন পিপল। ‘নদী ডাকছে, আমরা সাড়া দেব না’– ছিল বাংলাদেশের প্রথম প্রতিপাদ্য। 

২০১৪ সাল থেকে এই দিবস উদযাপনে ‘নদীর জন্য পদযাত্রা’ আয়োজন করে আসছিল অন্যান্য পরিবেশবাদী সংগঠনের সঙ্গে যৌথভাবে। এককভাবেও কর্মসূচি ছিল তাদের। পুরান ঢাকার বাহাদুর শাহ পার্ক থেকে শুরু হয়ে বুড়িগঙ্গা নদীর পাড়ে গিয়ে থামা সেই পদযাত্রা আপাত স্থগিত; কিন্তু থামেনি নদীর জন্য এ আন্দোলন, এই যুদ্ধ তো চলছেই। 

দখল ও দূষণের বিপরীতে মানুষের মধ্যে নদী নিয়ে সচেতনতা বেড়েছে। নদীর জন্য আইনের প্রয়োগ বেড়েছে। ২০১৯ সালে বাংলাদেশের উচ্চ আদালত তুরাগসহ দেশের সব নদীকে ‘লিভিং এনটিটি’ বা ‘জীবন্ত সত্তা’ হিসেবে ঘোষণা করে। অর্থাৎ নদীকে দেখার দৃষ্টিভঙ্গি রাষ্ট্রের উচ্চ পর্যায় থেকে পাল্টাতে শুরু করেছে। তুরাগ ও বুড়িগঙ্গা পাড়ে অবৈধ বসতি উচ্ছেদে দীর্ঘদিন অভিযান চালিয়েছে বিআইডব্লিউটিএ। নদী পুনরুদ্ধার ও সংরক্ষণে মহাপরিকল্পনা করছে সরকার। রাষ্ট্রের এসব উদ্যোগ আশা জাগায় নদীতে প্রবাহ ফিরবে। কিন্তু সেজন্য যুদ্ধ চালু রাখতে হবে। 

রিভারাইন পিপল বলছে, নদীকে জানতে নদীর কাছে যেতে হবে। নদীর জল কতটুকু গরল হয়েছে, তা পরীক্ষা করে দেখতে হবে। নদীর বাতাস কেমন অস্বাস্থ্যকর হয়েছে, তাও মেপে দেখতে হবে। নদীর মৎস্য সম্পদ কি আগের মতো আছে? আজকের নদীতে কি পাখি আসে? 

এসব প্রশ্নের উত্তর মিলবে গবেষণায়। সামগ্রিকভাবে সচেতনতা গড়ে তুলতে হলে নদীর হাল নিয়ে আরও অনেক তথ্য প্রয়োজন সবার। এ তথ্যের প্রবাহ নিশ্চিত করবে গবেষণা। রিভারাইন পিপল নদীর জন্য গবেষণায় সম্পৃক্ত হয়েছে তাই। দৃক পিকচার লাইব্রেরি এবং ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক সোসাইটির উদ্যোগে বুড়িগঙ্গা নিয়ে গত ৫ মার্চ এক গবেষণার ফল প্রকাশ পেয়েছে। এ গবেষণায় সহযোগী ছিল রিভারাইন পিপল। শুধু বুড়িগঙ্গা নয়, সারাদেশের নদী নিয়েই কাজ করে চলেছে রিভারাইন পিপল। নদীর হাল-হকিকত কী, তা জানার একটি জানালা হয়ে উঠছে রিভারাইন পিপল। 

‘লুইস পাগ ফাউন্ডেশন’ কাজ করে সমুদ্র নিয়ে। এর প্রতিষ্ঠাতার নামই লুইস পাগ। সমুদ্র নিয়ে কাজ করতে গিয়ে তারা নদী ভুলে যায়নি। কেনই বা ভুলে যাবে? নদী তো সাগরে গিয়েই মেশে। নদী ভালো থাকলেই তো সাগর এমন ঝকঝকে নীল দেখাবে। তাই নদীকে বাঁচাতে যারা যুদ্ধ করছে সারাবিশ্বে তাদের খুঁজেছে এ সংস্থাটি। 

২০২৩ সালে রিভার ওয়ারিওর বা নদী যোদ্ধাদের নাম প্রকাশ করেছে লুইস পাগ ফাউন্ডেশন। সংস্থাটির ওয়েবসাইটে এই তালিকা প্রকাশের সময় একটি ভূমিকা দিয়েছে তারা। সংস্থাটি বলছে, ‘নদী আমাদের ধরিত্রীর ধমনি। নদী লাখ লাখ মানুষ, প্রাণী এবং বাস্তুতন্ত্রের জীবনরেখা। এসবই তো শেষ পর্যন্ত সাগরে গিয়ে পৌঁছে। নদী থেকে যা ভেসে আসে তা ধারণ করা ছাড়া তো সাগর ও মহাসাগরের কাছে আর কোনো বিকল্প নেই। উপহার হিসেবে নদী থেকে পলল ও আরও উপাদান আসে সাগরে; যা বিশাল এ জলরাশির বাস্তুতন্ত্র, জীববৈচিত্র্য এবং সামুদ্রিক খাদ্য শৃঙ্খল টিকিয়ে রাখতে জরুরি। অথচ আজকের দিনে নদী থেকে ভেসে আসছে বিষাক্ত ভারী ধাতু, পয়ঃবর্জ্য, প্লাস্টিক বর্জ্য।’

এ কারণেই নদীযোদ্ধাদের সঙ্গে যোগাযোগ জরুরি মনে করেছে লুইস পাগ ফাউন্ডেশন। বিশ্বের ৪৫টিরও বেশি ব্যক্তি ও সংগঠনকে বেছে নিয়ে তালিকা করেছে তারা। এ তালিকায় হাডসন নদী নিয়ে কাজ করার সংগঠন রয়েছে। রয়েছে নদী নিয়ে অনুসন্ধানী প্রতিবেদকদের উদ্যোগ। রয়েছে বাংলাদেশ থেকে রিভারাইন পিপল।

পাগ ফাউন্ডেশন লিখেছে, ‘নদী ও জলাভূমি সুরক্ষা, পুনরুদ্ধার ও টেকসই ব্যবস্থাপনা বিষয়ক আন্দোলনের মাধ্যমে পরিচিত হয়ে ওঠা গতিশীল, তারুণ্য-চালিত নাগরিক আন্দোলন রিভারাইন পিপলের আরও অনেক উদ্যোগের একটি হচ্ছে রিভার অলিম্পিয়াড। নদী অলিম্পিয়াড হচ্ছে এমন একটি আয়োজন, যার মধ্য দিয়ে বাংলাদেশে হাজার হাজার শিক্ষার্থী একত্র হয় এবং তাদের ধারণা ও উদ্যোগ দিয়ে নদী সংরক্ষণে অবদান রাখে।’

এমনিতে আমাদের মনে হয় বিদেশে নদী খুব ভালো আছে। কথাটা একদম মিথ্যেও নয়। তবু ওই ভালোর মধ্যেও মন্দটুকু রয়েছে। এসব কারণে ওখানেও নদীর জন্য বিশেষ সাংবাদিকতা হচ্ছে, নদী পরিষ্কার করতে সংগঠন কাজ করছে, নদী নিয়ে গবেষণা হচ্ছে। দেশের নদী আর বিদেশের নদী দুঃখ কি একই? ওই দুঃখের কারণই কি একই রকম? নদী উদ্ধারে সচেতনতা বাড়াতে কী করা হয় ওদিকে? আইনের প্রয়োগ কি ওখানে নদী ফিরিয়ে আনতে পেরেছে? নদী পুনরুদ্ধারে প্রযুক্তির ভূমিকা কী রয়েছে উন্নত দেশে? রিভারাইন পিপল এসব জানতে সবসময় আগ্রহী ছিল এবং আছে। সেই সুযোগটি রিভারাইন পিপলের জন্য সহজ করে এনে দিল লুইস পাগ ফাউন্ডেশন। লুইস পাগ ফাউন্ডেশনের এ সম্মাননা নদীর জন্যই নিবেদন করতে চায় রিভারাইন পিপল। 

তরুণদের উদ্বুদ্ধ করে নদীর কণ্ঠ হয়ে ওঠার যে চর্চা অনলাইন ও অফলাইনে শুরু করেছিল রিভারাইন পিপল, তা আসলে বৃথা যায়নি। রিভারাইন পিপলের এ প্রচেষ্টা উদাহরণ হয়ে উঠল লুইস পাগ ফাউন্ডেশনের ওয়েবসাইটের পাতাতেও। এতে শুধু  রিভারাইন পিপলের ভাবমূর্তি বেড়েছে তা নয়; বরং বাংলাদেশের তরুণরা যে নদীবন্ধু এবং নদীযোদ্ধা, তা এখন বিশ্বের আরেক প্রান্তে থাকা নদীযোদ্ধারাও জেনে গেল। একটা নদীবান্ধব প্রজন্ম থাকলে কোনো দেশের নদীই ধুঁকে ধুঁকে মারা যাবে না, এ কথা রিভারাইন পিপল অবলীলায় বলতে পারে। এ কথা বলার আত্মবিশ্বাস রিভারাইন পিপলকে নদীযোদ্ধারাই দিয়েছে। 

আরও পড়ুন

×