গ্রামবাংলার ঐতিহ্য বাঁশ-বেতশিল্প

পাবনার সাঁথিয়ায় মাধপুর বাজার এলাকার বাঁশ ও বেতশিল্পের কারিগর বিনয় চন্দ্র দাসের তৈরি হস্তশিল্প পণ্য
জালাল উদ্দিন
প্রকাশ: ০৬ জুলাই ২০২৪ | ০৯:১৩ | আপডেট: ০৭ জুলাই ২০২৪ | ১৩:৩৫
বাড়ির পাশে বাঁশঝাড় আর বেতবনের ঐতিহ্য গ্রামবাংলার চিরায়ত রূপ। যেখানে গ্রাম সেখানে বাঁশঝাড়– এমনটিই ছিল স্বাভাবিক। তবে বনাঞ্চলের বাইরেও এখন যেভাবে গ্রামীণ বৃক্ষরাজি উজাড় হচ্ছে, তাতে হারিয়ে যাচ্ছে এ জাতীয় অজস্র গাছপালা। বাংলাদেশের জনজীবন থেকে হারিয়ে যেতে বসেছে ঐতিহ্যবাহী বাঁশ ও বেতশিল্প। অথচ একসময় গ্রামীণ জনপদে বাংলার ঘরে ঘরে তৈরি হতো হাজারো পণ্যসামগ্রী। ঘরের কাছের ঝাড় থেকে তরতাজা বাঁশ ও বেত কেটে গৃহিণীরা তৈরি করতেন হরেক জিনিস। অনেকে এ দিয়ে জীবিকা নির্বাহ করতেন।
আধুনিক যুগে তৈরীকৃত বিভিন্ন ধরনের ধাতব ও প্লাস্টিক শিল্পের প্রভাবে বাঁশ ও বেতশিল্প ক্রমে মুখ থুবড়ে পড়ছে। ফলে এ পেশায় থাকা শত শত বাঁশ ও বেতশিল্পী জীবিকা হারানোর সংকটের মধ্যে রয়েছেন।
পাবনার সাঁথিয়ায় এ শিল্পের সঙ্গে জড়িত কারিগরের অনেকেই বাপ-দাদার আমলের পেশা ছেড়ে চলে যাচ্ছেন অন্য পেশায়। যে টাকা আয় হয়, তা দিয়ে পরিবারের ভরণ-পোষণ করতে কষ্ট হচ্ছে কারিগরদের। তাদের দাবি, এসব শিল্পকর্ম বিদেশে রপ্তানি করা সম্ভব। এ জন্য দরকার সরকারি-বেসরকারি পৃষ্ঠপোষকতা।
জানা গেছে, পাবনার সাঁথিয়া উপজেলায় প্রায় দুই শতাধিক পরিবার বাঁশ ও বেতের আসবাব তৈরির সঙ্গে যুক্ত। বর্তমানে মানুষের মধ্যে বাঁশ ও বেতের সামগ্রী থেকে প্লাস্টিক সামগ্রী কেনার প্রতি আগ্রহ বেশি। তা ছাড়া বাঁশ ও বেতের উৎপাদন কমে যাওয়ায় এর দামও বেড়ে গেছে। ফলে বাঁশ ও বেতের সামগ্রীর ব্যয় বেশি হচ্ছে। শৌখিন মানুষ ঘরে বাঙালির ঐতিহ্য প্রদর্শনের জন্য বাঁশ ও বেতের সামগ্রী বেশি দাম দিয়ে কিনলেও সাধারণ ক্রেতারা বেশি দাম দিতে চান না। তবে কয়েক বছর আগেও বাঁশ ও বেতের তৈরি জিনিসের বিশেষ কদর ছিল। যেমন– চেয়ার, টেবিল, বইয়ের সেলফ, মোড়া, কুলা, ঝুড়ি, বালতি, কলমদানি, আয়নার ফ্রেম, দাঁড়িপাল্লা, খালুই, দোলনা, কাঠা, বই রাখার তাক, চালুন, ধামা, দোয়াড়, খৈ চালনা, টুকরি, টোনা, হাপটা, ডোল, খাঁচা, গোলা, সোফা সেট, মাছ ধরার চাঁই, মাথাল, চাটাইসহ বিভিন্ন আসবাব তৈরিতেও বাঁশ ও বেত ব্যবহার করা হতো। এখন গ্রামীণ উৎসব বা মেলাতেও বাঁশ ও বেতজাত শিল্পীদের তৈরি পণ্য চোখে পড়ে খুব কম। যতই দিন যাচ্ছে ততই কমছে এ হস্তশিল্পের চাহিদা।
সাঁথিয়ার মাধপুর বাজার এলাকার বাঁশ ও বেতশিল্পের কারিগর বিনয় চন্দ্র দাসের (৫৫) জায়গাজমি নেই, বসবাস করেন সরকারি খাসজমিতে। ৬ সদস্যের পরিবার। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির কারণে সংসার চালাতে এবং সন্তানদের লেখাপড়া করাতে হিমশিম খেতে হচ্ছে বলে জানান তিনি। এ ছাড়া প্রতিমাসে ঋণের কিস্তিও দিতে হয়। তিনি বলেন, ‘বাপ-দাদার আমল থেকে এ পেশায় আছি। কিন্তু আধুনিক যুগে প্লাস্টিকের পণ্য বাজার দখল করায় আমাদের তৈরি পণ্য আর আগের মতো চলে না। এ ছাড়া পণ্য তৈরির উপকরণের দাম বেশি। সে তুলনায় আমাদের পণ্যের দাম কম। খরচ বাদে যা আয় হয়, তা দিয়ে পণ্য তৈরির উপকরণ কিনব কী করে আর সংসারই বা চালাব কী করে! অন্য পেশার মতো সহজ শর্তে ঋণ ও সরকারি ভর্তুকি পেলে একটু ভালোভাবে চলা যেত।’ একই কথা জানালেন অশোক চন্দ্র দাস ও প্রদীপ চন্দ্র দাস। তারা জানান, সাঁথিয়ার অনেকেই এ পেশা ছেড়ে কেউ নাপিতের কাজ, স্বর্ণকার ও দিনমজুর হিসেবে কাজ করছেন।
সাঁথিয়ার জোড়গাছা ডিগ্রি কলেজের সহকারী অধ্যাপক মিজানুর রহমান বলেন, আগে গ্রামবাংলার প্রতিটি ঘরেই বাঁশ ও বেতের তৈরি জিনিসপত্র ব্যবহার করা হতো। এখন সেই জায়গা দখল করেছে প্লাস্টিকের সামগ্রী। ঐতিহ্য ধরে রাখতে এ পেশার সঙ্গে জড়িতদের সরকারি সুযোগ-সুবিধার পাশাপাশি সবাইকে সহযোগিতা করতে হবে।
সাঁথিয়া উপজেলা মহিলাবিষয়ক কর্মকর্তা আলমগীর কবির বলেন, ‘বাঁশ ও বেত কুটির শিল্পের মধ্যে পড়ে। বাঁশ-বেত না থাকলে কুটির বা হস্তশিল্পের ওপর প্রভাব পড়বে। সে জন্য বৃক্ষরোপণ কর্মসূচির মাধ্যমে আলাদাভাবে বাঁশ ও বেতের প্রকল্প নিয়ে বাঁশ-বেত রোপণ ও সংরক্ষণ করা জরুরি।’
পাবনা বিসিক শিল্পনগরীর উপমহাব্যবস্থাপক রফিকুল ইসলাম বলেন, ‘প্রতিষ্ঠার পর থেকে শিল্প ও কুটির শিল্প নিয়ে বিসিক কাজ করে থাকে। যদি কেউ কোনো ঋণ বা আর্থিক সহযোগিতার জন্য আসেন, তাহলে অবশ্যই আমরা তাকে সহায়তা করব।’
- বিষয় :
- ঐতিহ্য