যে গ্রামে শুধু একটি বাড়ি...
ময়মনসিংহের ঈশ্বরগঞ্জ উপজেলার রাজীবপুর ইউনিয়নের ৮ নম্বর ওয়ার্ডের এই বাড়ি ঘিরেই উমানাথপুর গ্রাম
ইমতিয়াজ আহমেদ
প্রকাশ: ২২ নভেম্বর ২০২৪ | ২৩:৪১ | আপডেট: ২৪ নভেম্বর ২০২৪ | ১২:১৩
সকালের কুয়াশা কেটে শনশন করে বইছে হেমন্তের দখিন হাওয়া। আধাকাঁচা, আধাপাকা আমন ধানের ম-ম ঘ্রাণে হলদে সরোবর উমেদপুরের ছবির মতো গ্রামটি। দূরের একটি মাচায় কয়েকটি কুমড়ো-লাউ ঝুলছে। বাতাসের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বেড়ে উঠছে নতুন ডগাগুলো। তারাও বাতাসে মৃদু দুলছে। দুই পাশে ধান ক্ষেত, মাঝখানে ক্ষেতের বুক চিড়ে সাপের মতো ধেয়ে গেছে একটি মেঠোপথ, পথটার শেষ গিয়ে ঠেকেছে একটি পুরোনো ভিটেবাড়িতে।
বাড়ির আশপাশ বসতিহীন, নীরব নিস্তব্ধ। তবে বেশ কয়কটি বুলবুলি পাখি আস্তানা গেড়েছে অনেকদিন ধরেই। তাদের নিমন্ত্রণে আরেক গ্রাম থেকে রোজ আসে শালিক, দোয়েল, কাকাতুয়া, টিয়া পাখিরা। তখন পাখির শব্দে মুখর হয়ে ওঠে পুরো বাড়ি। ঠিক তখন শোকের নীরবতা নেমে আসে বাড়ির উত্তর পাশে নির্জন দাঁড়িয়ে থাকা আধবয়সী আমগাছটার তলে। কেননা সেই গাছের ছায়ায় অনন্ত ঘুমে এই গ্রামের বাসিন্দা সিরাজুল ইসলামের আদরের ছেলেটা। চার মাস আগে একমাত্র সন্তানকে হারিয়েছেন তিনি। এখনও শোকে বিহ্বল, এখনও কবরের কাঁচা মাটি শুকায়নি। সকাল-বিকাল কিংবা সন্ধ্যা সারাক্ষণ ছেলের কবরের পাশে অবাক দাঁড়িয়ে থাকেন এই বাবা।
জল ছলছল চোখে বাবা চোখ মোছেন, বিড়বিড় করে ছেলের উদ্দেশে কথা বলেন, কবরের দোয়া পাঠ করেন। ধূসর দৃষ্টিতে যতদূর তাঁর ঘোলা হয়ে আসা দৃষ্টি সীমানা পেরোয়, ততদূর তাকান তিনি। সিরাজুল ইসলাম সরকার নীরবতা চেয়েছিলেন ঠিকই, হয়তো এমন নির্জনতা তিনি কখনোই চাননি।
ময়মনসিংহের ঈশ্বরগঞ্জ উপজেলার রাজীবপুর ইউনিয়নের ৮ নম্বর ওয়ার্ডের এই একটি বাড়ি ঘিরেই উমানাথপুর গ্রাম। এটিই হয়তো পৃথিবীর একটি বাড়ি, একটি গ্রাম। গ্রামের বেপারীপাড়ার মালেকের দোকানে জিজ্ঞেস করতেই একবাক্যে সবাই দেখিয়ে দেন জমিদারের বাড়ি।
আমরা জানি, কয়েকটি পাড়া নিয়ে একটি গ্রাম অথবা গ্রাম হলো জনবসতি একটি এলাকা, যেখানে বিভিন্ন শ্রেণিপেশার মানুষের বসবাস। গ্রাম প্রধানত কৃষিভিত্তিক অঞ্চলে ছোট বসতি। যেখানে ছোটখাটো কাজের মাধ্যমে মানুষ জীবনযাপন করে থাকে। সেই সঙ্গে থাকে রাস্তাঘাট, মসজিদ-মাদ্রাসা অথবা অন্য কোনো প্রতিষ্ঠান।
এর সম্পূর্ণ ব্যতিক্রম ময়মনসিংহের ঈশ্বরগঞ্জ উপজেলার রাজীবপুর ইউনিয়নের ‘উমানাথপুর’ নামের গ্রামটি। ইউনিয়নের ৮ নম্বর ওয়ার্ডে অবস্থিত ৭০ বছর বয়সী সিরাজুল ইসলাম সরকারের বাড়ি। যেখানে দুটি বসতঘর, একটি গোয়ালঘর, আছে একটি ছোট পুকুর ও একটি টয়লেট ছাড়াও কিছু গাছগাছালি। বাস করেন স্ত্রী মনোয়ারাকে সঙ্গে নিয়ে। সংসারজীবনে এই দম্পতির দুই সন্তান রয়েছে। মাস চারেক আগে তাদের একমাত্র ছেলে শরফুল আলম দুরারোগ্য ক্যান্সারে মারা যান। মেয়েকে বিয়ে দিয়েছেন পার্শ্ববর্তী নান্দাইল উপজেলায়। তারপর থেকে নিঃসঙ্গতার পাশাপাশি অনেকটা শোকে কাতর পরিবারটি। অন্যের জমির আইল দিয়ে এ বাড়িতে প্রবেশ করতে হয়। এ বাড়ি ঘিরেই ‘উমানাথপুর’ গ্রাম। এ গ্রামের বর্তমান লোকসংখ্যা ২ জন, ভোটারও ২ জন।
পেশায় দলিল লেখক সিরাজুল ইসলাম সরকার শিক্ষাজীবনে ইন্টারমিডিয়েট পর্যন্ত পড়াশোনা করছেন। বাবা ছিলেন তৎকালীন পাকিস্তান আমলের জনপ্রতিনিধি। তিনিও পরপর দুইবার ছিলেন ইউপি সদস্য। মাত্র ১৯ বছর বয়সে বাবা-মাকে হারান। ব্যক্তিজীবনে খুব সাদামাটা, কথা বলেন সোজাসাপটা, নিরহংকারী প্রকৃতিপ্রেমী সিরাজুল অল্প কিছু জমিজমা আর দলিল লিখে যা পান তাই দিয়ে চলে তাঁর এই ছোট্ট সংসার। আশপাশের অন্য মানুষের জমি থাকলেও আদৌ এই গ্রামে কেউ প্রতিবেশী হয়ে বাসা বাঁধেনি সিরাজুলের।
জানা যায়, ব্রিটিশ আমলে এ অঞ্চলে একজন তালুকদার ছিলেন, তাঁর নাম ছিল উমানাথ চৌধুরী। তাঁর একমাত্র সন্তান যামিনীনাথ চৌধুরী। তিনি নায়েবের কাজ করতেন। তাঁর তিন ছেলে– প্রথম নলিনীনাথ চৌধুরী, দ্বিতীয় অবনীনাথ চৌধুরী এবং তৃতীয় বরেন্দ্রনাথ চৌধুরী। তাঁর একমাত্র কন্যা, যাঁর নাম ছিল শতদলবাসিনী দেবী। ১৯৪৭ সালের দেশ ভাগের সময় উমানাথ চৌধুরীর ছেলেমেয়েরা চলে যান ভারতে।
পরবর্তী সময়ে ব্রিটিশরা যখন জরিপ কাজ শুরু করেন তখন উমানাথ চৌধুরীর অনেক সম্পদ থাকায় তাঁর নামে এই গ্রামের নামকরণ হয় উমানাথপুর। গ্রামের নামকরণ হলেও গ্রামটা ছিল জনবসতিশূন্য। ব্রিটিশরা তাদের নকশায় এ গ্রামের নাম তুলে গেছেন। পার্শ্ববর্তী আরেকটি গ্রামে ছিল সিরাজ সরকারদের পূর্বপুরুষদের বাড়ি। ওই পরিবারে লোকসংখ্যা বেড়ে যাওয়ায় সিরাজের বাবা রমজান আলী সরকার ১৯৬৫ সালে তাঁর পরিবার নিয়ে চলে আসেন জনবসতিশূন্য উমানাথপুরের এই গ্রামে। বংশ পরম্পরায় একটি মৌজায় ছোট্ট এই গ্রামের একটি বাড়িতে এখনও একঘর মানুষের বাস আর তা হলো সিরাজ সরকারের বাড়ির মানুষ।
কোলাহল ছেড়ে জনশূন্য, প্রতিবেশী শূন্য এই গ্রামে বাস করে কেমন লাগে আপনার– এমন প্রশ্নের জবাবে একগাল হাসি গুঁজে দিয়ে সিরাজুল বলেন, ‘মানুষ আমাকে বলে এক গ্রামের এক জমিদার আমি। এমনকি ভোট দিতে গেলে এক মৌজা, ভোটার সিরিয়ালও ১ থাকায় কোনো সিরিয়াল ছাড়াই ভোট দিয়া চলে আসতে পারি। এখন সারাদেশ আমারে চেনে, আমার বাড়ি চেনে, খুব ভালো লাগে বিষয়টা আমার কাছে। খুব ইচ্ছা ছিল পোলাটা এ সংসারটা আগলে রাখবে কিন্তু তা হলো না, বাঁচব আর কতদিন? এতদিন ছিল গ্রামটা শূন্য, এখন ঘরটাও শূন্য পইড়া আছে।’
সিরাজ সরকার জানান, তাঁর বাবা সাবেক ইউপি সদস্য রমজান আলী সরকার ও ভাই মজিবুর রহমান সরকার ও মা সমরত্ত্যবান ছিলেন এ বাড়ির মূল মালিক। তাদের উত্তরসূরি হিসেবে পরিবারসহ এখনও বসবাস করছেন তিনি। পরিবারে মোট সদস্য পাঁচজন। এক ছেলে চার মাস আগে মারা গেলে, নাতিরাও চলে গেছে। এখন তিনি আর স্ত্রী ও পুত্রবধূ ভোটার। তবে বাড়িতে এখন দু’জন মানুষই থাকেন। তিনি এবং তাঁর স্ত্রী মনোয়ারা। নিজের কিছু জমিজমা চাষাবাদ করে ও উপজেলা সদরে সাবরেজিস্ট্রি অফিসে দলিল লেখক হিসেবে কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করেন। রাস্তাঘাট না থাকায় অন্যের জমির আইল দিয়ে বাড়িতে প্রবেশ করতে হয়। বর্ষাকালে একরকম ঘরবন্দি থাকতে হয়। নিজের বোনেরা থাকেন বাড়ির পেছনে অন্য গ্রামে।
ঈশ্বরগঞ্জ উপজেলা সদর থেকে প্রায় ১২-১৫ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত রাজীবপুর ইউনিয়নের ৮ নম্বর ওয়ার্ডের উমানাথপুর গ্রাম। কাগজপত্রে মৌজার নামও উমানাথপুর। এর আশপাশে গ্রামগুলো হলো– উত্তরে রামগোবিন্দপুর, দক্ষিণে হরিপুর, পূর্বে উদয়রামপুর ও পশ্চিমে রামগোবিন্দপুর ও হরিপুর। সিরাজ সরকারের নামীয় ২৫ শতক জমির ওপর বাড়িটি অবস্থিত। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, এই ইউনিয়নে মোট গ্রামের সংখ্যা ৪৩।
গ্রামের বেপারীপাড়ার মালেকের দোকানে অবসর সময় কাটান তিনি। ছোটবেলার মায়ের হাতে আলু দিয়ে চিংড়ির তরকারির স্বাদ এখনও লেগে আছে তাঁর মুখে। হেমন্তকালে বাড়ি বাড়ি নতুন ধানের পিঠাপুলির আয়োজন থাকলেও এখন তা আর হয় না। কেউ কারও খোঁজ রাখে না। মানুষের এত রেষারেষি, হিংসা-বিদ্বেষ থেকে দূরে থাকতেই তাঁর এই বসবাস।
এখন নিঃসঙ্গতা ভালোই লাগে সিরাজুল ইসলামের। কথা হয় বাড়ির চারপাশে তাঁর লাগানো গাছপালা, পাখি, কবরে শুয়ে থাকা সন্তানের সঙ্গে। সারাদিন কাজ শেষে গোধূলি লগ্নে বাড়ি ফেরেন মেঠোপথ ধরে উমানাথপুরের জমিদার সিরাজুল ইসলাম সরকার। সন্ধ্যার পর কুয়াশা নামে পুরো গ্রামে। দূর থেকে ভেসে আসে খেলা শেষে শিশুদের বাড়ি ফেরার কোলাহল। উঠোনের জবা ফুল গাছটার সব ফুল শীতে মুড়িয়ে যায়। ঝিঝিরা ঘিরে ধরে পুরো বাড়ি; রাত নেমে আসে। হেমন্তের জোছনারা বৃষ্টির মতোই ঝরে পড়ে উমানাথপুরের সিরাজুলের এই বাড়ির উঠোনে। তারপর একসময় সিরাজুল ঘুমান, ঘুমায় বুলবুলি পাখিরা, কবর ঘুমায়– শুধু নিঃসঙ্গতার শঙ্কায় ঘুমায় না উমানাথপুর গ্রামটা।