রংবাহারে হাছন রাজা
হাছন রাজা [২১ ডিসেম্বর ১৮৫৪–৬ ডিসেম্বর ১৯২২]
শিশির কুমার নাথ
প্রকাশ: ৩০ নভেম্বর ২০২৪ | ০০:০৩ | আপডেট: ০১ ডিসেম্বর ২০২৪ | ১১:৩৭
হাছন রাজা দেশের অন্যতম সংগীত রচয়িতা ও মরমি সাধক। তাঁর অন্যতম শখ ছিল গান রচনা ও তাতে সুর দেওয়া। এর বাইরেও হাছন রাজার বিভিন্ন শৌখিনতার পরিচয় জানা যায়।
হাছন রাজাকে নিয়ে রচিত একাধিক গ্রন্থে তাঁর শৌখিন জীবনাচরণ নিয়ে আলোকপাত করা হয়েছে। প্রভাতচন্দ্র গুপ্তের লেখা ‘গানের রাজা হাছন রাজা’ গ্রন্থে সেসবের উল্লেখ পাওয়া যায়। প্রভাতচন্দ্রের মতে, গান রচনার প্রেরণায় তাঁর মন সব সময় উদ্বুদ্ধ হয়ে ওঠে না, সৃষ্টির ডাক আসার জন্য ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করতে হয়। এই ক্লান্তিকর প্রতীক্ষার অবকাশ কাটানোর জন্যই হয়তো হাছন রাজা কতকগুলো চিত্তবিনোদনের নেশায় নিজেকে ভুলিয়ে রাখতে চাইতেন। এর মধ্যে ছিল কোড়া শিকার, ঘোড়দৌড়, হাতিপোষা, মাছধরা, দাবা খেলা, নৌকাবাইচ প্রভৃতি।
হাছন রাজা প্রসঙ্গে মুহম্মদ মনসুর উদ্দীন লিখেছেন, ‘অশ্বারোহণে তিনি সুপটু ছিলেন। তাঁহার ঐশ্বর্যের অভাব ছিল না। হাতিশালে হাতি ছিল, অশ্বশালে অশ্ব ছিল, তিনি ঘোড়দৌড় প্রতিযোগিতায় যোগদান করতেন। এ সম্পর্কে তাঁহার অশ্বগুলির যথেষ্ট সুখ্যাতি ছিল।’ (হারামণি, ৭ম খণ্ড)
দেওয়ান মোহাম্মদ তাছাওয়ার রাজা তাঁর ‘হাছন রাজা সমগ্র’ গ্রন্থে হাছন রাজা সম্পর্কে উল্লেখ করেছেন, ‘অশ্বারোহণে তিনি যেমন সুপটু ছিলেন; ঘোড়া সম্বন্ধে তাঁর জ্ঞানও ছিল তেমনি অগাধ। বিভিন্ন রঙের চমৎকার সব ঘোড়া ছিল তাঁর। সিলেট, সুনামগঞ্জ, হবিগঞ্জ, করিমগঞ্জ ইত্যাদি জায়গায় প্রতি বছর ঘোড়দৌড়ের মেলাতে তাঁর ঘোড়া অংশ নিত এবং প্রায়ই জয়ী হতো।
হাছন রাজা ঘোড়ার বিভিন্ন অঙ্গ দেখে বলতে পারতেন ঘোড়ার গুণাবলি।’ তাঁর ঘোড়াগুলোর নামও ছিল বেশ বাহারি। যেমন- জং বাহাদুর, কদমবাজ, দুলদুল, ২৭৫ টেকি আড়ুয়া, নিউ হোপ, চান্দ মুসকি, চান্দা, মাসুদ পিয়ারী। এমন ৭৮টি ঘোড়ার নাম রেখেছেন তিনি। একটি ঘোড়ার নাম রেখেছিলেন ‘বাংলা বাহাদুর’। কথিত আছে, বাঙালিদের প্রতি ইংরেজদের অবজ্ঞার সমুচিত জবাব দিতেই তিনি ওই নাম রাখেন।
প্রভাত চন্দ্র গুপ্তের তথ্যমতে জানা যায়, একবার হাছন রাজা ঢাকায় ঘোড়া নিয়ে প্রতিযোগিতায় গিয়েছিলেন। সেখানে নবাব স্যার খাজা আহসানউল্লার অপ্রতিদ্বন্দ্বী ‘দরিয়াবাজ’ ঘোড়ার সঙ্গে প্রতিযোগিতায় হাছন রাজার ‘জং বাহাদুর’ জয়ী হয়ে সবার বিস্ময় উদ্রেক করেছিল। এই স্মৃতিকে চিরজাগ্রত রাখতে তিনি তাঁর জমিদারিতে একটি নতুন গ্রামের নামকরণ করেন ‘দরিয়াবাজ’। সুনামগঞ্জে দরিয়াবাজ গ্রামটি আজও রয়েছে।
‘হাছন রাজা সমগ্র’ গ্রন্থ থেকে জানা যায়, বুনো হাতি শিকারের জন্য আসাম সরকারের অনুমতি নিয়ে বেশ কয়েকবার লাউড়ের পাহাড়ে হাতি খেদিয়ে প্রচুর অর্থ ব্যয় করেছেন। মাঝে মাঝে খেদায় ধরা বন্য হাতিগুলোকে পোষ মানাবার জন্য লক্ষ্মণশ্রীর উল্টো দিকে সুরমা নদীর অপর পারে ‘সুন্দরগড়’ নামক স্থানে রাখা হতো। জিবা, রাজরানী, হাছন প্যারী, সুরতজান প্রভৃতি বাহারি নামে ডাকতেন হাতিদের।
হাতির দোষগুণের বর্ণনায় এক পর্যায়ে হাছন লিখলেন, ‘শতাশতী হাতি, আমার পিতার ছিল/ পিলখানায় পড়িয়া, হাতি সব মৈল/ খুবসুরত হাতি ভিন্ন, খারাপ হাতির উপর/ কখনও না চড়িয়াছি আমি, শুন বেরাদর।’
দোয়েল পাখির প্রতিও হাছন রাজার আগ্রহ ছিল। তবে কোড়াপাখির প্রতি তাঁর দুর্বলতা ছিল বেশি। তিনি কখনও পাখি বধ করতেন না। দিনের পর দিন কোড়া শিকারের জন্য ভাওয়ালি নৌকায় থাকতে কুণ্ঠাবোধ করতেন না। অনেকে তাঁকে ভালোবেসে কোড়াপাখি উপহার দিত। এমন উপহারে তিনি খুব খুশি হতেন। উপহারদাতাকে নতুন ধুতি, চাদর, টাকা-পয়সা দিতেন। ভালোবেসে পাখিগুলোর নামও দিতেন।
‘মিউজিয়াম অব রাজাস’ সংগ্রহশালার সূত্রে হাছন রাজার পোষা ৮০টি কোড়াপাখির নাম জানা যায়। দাবা খেলারও শখ ছিল হাছনের। প্রভাতচন্দ্র গুপ্ত লিখেছেন, ‘ছুটির দিনে দাবা খেলতে আসতেন হাছন রাজা। আসার সময় সুরমা নদীর উজান বেয়ে এসে পৌঁছতেন সুনামগঞ্জ শহরের জাহাজঘাটে। সেখান থেকে বাকি পথটুকু আসতেন মানুষের কাঁধে চেপে।
এমন অভিনব কাণ্ডকারখানা জীবনে আর কখনও দেখিনি, শুধু পড়া ছিল সিন্দবাদ নাবিকের গল্পে। তাঁর সঙ্গে থাকত এক দঙ্গল সাঙ্গোপাঙ্গ ও খিদমতগার। কারও হাতে থাকত পিকদানি, কারও হাতে পানের ডিবে- অবিশ্রান্ত পান খেতেন হাছন রাজা। হাছন রাজা সাহেবের এই অলৌকিক অভিযান পর্ব একটি মজাদার চলচ্চিত্রের মতো আমাদের মনে যতই কৌতূহল জাগাক না কেন, তাঁর কোনো ভাবান্তর হতো না এতে। যারা তাঁকে কাঁধে চাপিয়ে বয়ে বেড়াত, তারা কাজটাকে অপমানকর মোটেই মনে করত না; বরং এতে গৌরবই বোধ করত।’