বিরল বাদ্যযন্ত্রের মেলা
রাজধানীর আলিয়ঁস ফ্রঁসেজ গ্যালারিতে ‘নিরাময়ের ঐকতান’ শীর্ষক ব্যতিক্রমী বাদ্যযন্ত্রের প্রদর্শনীটি হয় ২৫ থেকে ২৯ নভেম্বর পর্যন্ত- ছবি:: ফয়সাল সিদ্দিক কাব্য
দ্রোহী তারা
প্রকাশ: ৩০ নভেম্বর ২০২৪ | ০০:০৪ | আপডেট: ০১ ডিসেম্বর ২০২৪ | ১১:৪০
নিজের জনাচারেক বন্ধু নিয়ে একটি ব্যান্ড তৈরির কথা ভাবছিলেন রাইয়ান। সদ্য কলেজ থেকে বেরোনো রাইয়ান ও তাঁর বন্ধুরা নিজেদের ব্যান্ডে প্রাধান্য দিচ্ছেন পশ্চিমা সংস্কৃতির বাদ্যযন্ত্র এবং বর্তমান সময়ের বিভিন্ন সংগীতবিষয়ক সফটওয়্যারকে। ইউটিউব ঘেঁটে এগুলোর বিষয়ে যতটা পারছেন জেনে বাদ্যযন্ত্রগুলো আয়ত্ত করার চেষ্টায় ব্যস্ত ইদানীংকালে। কিন্তু গত ২৫ নভেম্বর রাজধানীর আলিয়ঁস ফ্রঁসেজ দ্য ঢাকায় এক ব্যতিক্রমী বাদ্যযন্ত্রের প্রদর্শনীতে গিয়ে বিগত পাঁচ মাসের ধ্যানে ছেদ পড়ে রাইয়ানের। তিনি আমাদের দেশজ বাদ্যযন্ত্র এবং তার শ্রুতিমধুর সুরের মোহে পড়ে যান।
পুরো প্রদর্শনীতে নাকাড়া, বিভিন্ন রকম একতারা, দোতারা, বিশেষত বিষহরীর পুঁথি দেখে বিস্ময় প্রকাশ করে রাইয়ান বলেন, ‘খুব সাধারণ দেখতে এই ইন্সট্রুমেন্টগুলোকে আমি আমার ব্যান্ডে ব্যবহার করব। আমার চিন্তায় অনেক বড় ছাপ ফেলেছে এ প্রদর্শনী। এগুলো দেখতে কত সাধারণ, কিন্তু কী সুন্দর সুর! এগুলো সম্পর্কে খুব বেশি কিছু জানতাম না। আজ সরাসরি দেখার পাশাপাশি তৈরি করার স্টেপগুলোও দেখলাম। আর জীবনের প্রথম এই পুঁথি দেখলাম। এটি ভাষায় প্রকাশ করার মতো বিষয় না আমার পক্ষে।’ শুধু রাইয়ান নন, এ ব্যতিক্রমী তারযন্ত্রের প্রদর্শনী আগত সব দর্শক, সুরপ্রেমী ও দেশজ শিল্প রক্ষায় কাজ করা মানুষদের যথেষ্ট আকৃষ্ট করেছে।
১৯৯৪ সালে গাইবান্ধা জেলার গোবিন্দগঞ্জ উপজেলার ফুলপুকুরিয়া গ্রামে জন্মেছেন মোহাম্মদ জাকির হোসেন। যে বয়সে তরুণরা স্রোতে গা ভাসিয়ে চলতে পছন্দ করে, যখন যেটা আলোচনা-সমালোচনার তুঙ্গে থাকে, তাতে নিজেকে ভাসিয়ে দিতে পছন্দ করে– সে বয়সে মোহাম্মদ জাকির হোসেন বাংলাদেশের শিকড়ের অনুসন্ধানে হাতড়ে বেরিয়েছেন। শৈশব থেকেই তাঁর গানের প্রতি অনুরাগ। জাকির ২০১৬ সাল থেকে শিক্ষা পরিমণ্ডলের বাইরে গিয়ে সুরের সন্ধানে দেশ ও বিদেশের নানা প্রান্তে ছুটে গেছেন। সঙ্গ নিয়েছেন বাউল, বয়াতি, ফকির, বিশিষ্ট সংগীতজ্ঞদের। তিনি গুরুরূপে সান্নিধ্য পেয়েছেন নদীয়ার মনসুর ফকির, পার্বতী বাউল, লক্ষ্মণ বাউল ও বীরভূমের কানাই দাশ বাউলের মতো বিশিষ্টজনকে। যাদের সঙ্গ পেয়ে জাকিরের অনুসন্ধিৎসু মন খুঁজতে শিখেছে বাউল, মারফতি গানের মর্মবাণী এবং সুর ও কথার অন্তর্নিহিত ধ্বনি।
দীর্ঘ পাঁচ বছর ভারতে কাটিয়ে ২০২২ সালে দেশে ফিরে আবুল কাসেম বয়াতিকে নিজ গুরু হিসেবে পান জাকির। এ বছর আকবর আলী মণ্ডলের কাছে জাকির লুকিয়ে থাকা এক গুপ্তধনের মতো সন্ধান পান মধ্যযুগের কবি জগজ্জীবন গোঁসাইর বিষহরী পুঁথির। ৭৫ বছর বয়সী আকবর আলী মণ্ডল এখনও সুরেলা কণ্ঠে পুঁথি পাঠ করেন। বর্তমানে তাঁর কাছেই জাকির পুঁথির সুর শিখছেন।
এ ছাড়াও ১৯৪৭ সালে বঙ্গভঙ্গের আগে দ্বিজেন কবিরাজের তৈরি ও ব্যবহৃত একটি সেতার পেয়েছেন জাকির হোসেন। যেটি পরবর্তীকালে একই পরিবারের একজন কৃষক ও সংগীত অনুরাগী দুরিয়ধন বর্মণের উত্তরাধিকারসূত্রে পেয়েছিলেন। ২০২০ সালে সেই সেতার একটা স্টোররুমে পাওয়া যায়; যা দীর্ঘ এক দশকেরও বেশি সময় ধরে পরিত্যক্ত ছিল। জাকির হোসেন সেতারটির হারানো রূপ ও সুর ফিরিয়ে এনে সেটি ব্যবহার করে সুমধুর সুর তুলে চলেছেন।
জাকির হোসেন ২০১৮ সালে ‘অবকল্প’ প্রতিষ্ঠা করেন। এ প্রতিষ্ঠানের উদ্দেশ্য– বাংলা সংগীতবিষয়ক গবেষণার পাশাপাশি সংগীতে ব্যবহৃত বাদ্যযন্ত্রগুলো নিয়ে নিবিড় নিরীক্ষা ও নতুনভাবে যন্ত্রগুলো সংস্করণ ও সংরক্ষণ করা। প্রচলিত যন্ত্র তৈরির প্রক্রিয়ার সঙ্গে তাঁর গবেষণা যুক্ত হয়ে বাদ্যযন্ত্রগুলো যে অভিনব রূপ লাভ করেছে তা-ই দর্শকদের সামনে তুলে এনে পরিচিত করার প্রয়াস এই প্রদর্শনীতে করছে অবকল্প।
নিজের দীর্ঘদিনের কাজ ও প্রদর্শনী নিয়ে জাকির হোসেন বলেন, ‘‘এই প্রদর্শনী নিয়ে মানুষের কাছ থেকে এতটা সাড়া পাব, তা আশা করিনি। এটি খুবই বিশেষ একটি বিষয়, আমি জানতাম। দেশজ বাদ্যযন্ত্রের এ বিষয়টি যদি মানুষ বুঝতে পারে যে, কতটা জরুরি বাংলার ঐতিহ্যের জায়গাটা ধরে রাখা, তাহলে অবশ্যই আধুনিকতার পাশাপাশি নিজ শিকড়কে ভুলবে না; বরং ধরে রাখবে যত্ন করে। নিজ শিকড়ের সঙ্গে যতটা সংযুক্ত থাকা যাবে, মানুষ নিজেকে ঠিক ততটাই চিনতে ও বুঝতে পারবে। আমি আশা রাখি, এটি যারা বুঝতে পারবে না, তারা কাল, পরশু বা কোনো এক সময় অবশ্যই বুঝতে পারবে। এই আশা রেখেই আমি কাজ করে চলছি। এ ছাড়াও আমি বাউল ও আধ্যাত্মিক গান নিয়ে এ প্রজন্মের তরুণের ওপর ছোট্ট একটা জরিপ করেছিলাম। সেখানে দেখেছি, এমন ভঙ্গিতে ‘বাউল’ বলেছে যে, এটি আবার কী! তারা জানেও না, আসলে এটি আমাদের কত বড় সম্পদ। খুব ছোট করে হলেও সবার মাঝে বাদ্যযন্ত্রগুলোর পরিচয় ও ইতিহাস তুলে ধরার প্রয়াস এই প্রদর্শনী আমার কাছে। আমি চাই আধুনিকতা থাকবে অবশ্যই। সেই সঙ্গে নিরীক্ষণমূলক কাজের জায়গাও থাকবে। মূলত এ প্রদর্শনী আমার কাজের প্রথম প্রতিফলন। আরও বাদ্যযন্ত্র নিয়ে সামনে কাজের পরিকল্পনা রয়েছে। যখন এক টুকরো কাঠ থেকে একটা বাদ্যযন্ত্র বেরোচ্ছে, যেটি শুধু একটি সাজিয়ে রাখার জিনিস নয়; এসব বিষয়ে ভালো লাগা অন্যরকম আমার কাছে।’’
আলিয়ঁস ফ্রঁসেজের ‘নিরাময়ের ঐকতান’ নামে এই ব্যতিক্রমী প্রদর্শনীতে মেঝেতে পরিপাটি করে সাজানো বিভিন্ন ধরনের একতারা। আবার অন্য কোণে রয়েছে দোতারা। প্রদর্শনীতে আকর্ষণীয় বিষয় হলো– একটি একতারা বা দোতারা তৈরির পুরো প্রক্রিয়াটি পাশাপাশি ধাপে সাজানো রয়েছে; যেন দর্শকেরা সহজেই বাদ্যযন্ত্র তৈরির প্রক্রিয়াটি জানতে পারে।
বাংলাদেশে বছর বিশেক আগেও বিয়েতে আনন্দ আয়োজনে ব্যবহৃত বাদ্যযন্ত্র সানাই স্থান পেয়েছে এ প্রদর্শনীতে। অন্যান্য বাদ্যযন্ত্রের মধ্যে নাকাড়া, নাল, খোল, ঢোল এগুলো কোন কাঠ থেকে কোন বাদ্যযন্ত্র তৈরি হয়, সেই কাঠগুলোও তুলে ধরা হয়েছে।
প্রদর্শনীর কিউরেটর লুসি তৃপ্তি গমেজ বলেন, ‘এই বাদ্যযন্ত্রগুলো নিয়ে শ্রেণিবিভেদও করা হয়ে থাকে অনেক সময়। আমরা সেই জায়গা থেকে বেরোতে চাই। একটি শিশু গিটার বাজাতে চাইলে বাবা-মা যেভাবে উৎসাহিত করেন, শিশুটি যদি একতারা বা দোতারা বাজাতে চায়, তাকে ঠিক একইভাবে উৎসাহিত করা উচিত। আমরা এই জায়গাটা ধরতে চাই আমাদের এই প্রদর্শনীর মধ্য দিয়ে। এই প্রদর্শনীতে যে বাদ্যযন্ত্রগুলো আছে, অর্থনৈতিক মানদণ্ডে সেখানে ৭০-৮০ হাজার টাকার বাদ্যযন্ত্রও আছে। কিন্তু অনেকে না বুঝে বলতে পারে, একটি দোতারার এত দাম কীভাবে হয়? ইতিহাস ও সংস্কৃতির স্পর্শে এর দাম মাপকাঠির ঊর্ধ্বে। এগুলো খুঁজে বের করে সংরক্ষণ, এ প্রজন্ম ও পরবর্তী প্রজন্মের কাছে পৌঁছে দেওয়া আমাদের দায়িত্ব।’
প্রবীণ শিল্পী বয়াতি আবুল কাশেম অবকল্প উডল্যাবে তৈরি বাদ্যযন্ত্রের গুণগত মান নিরীক্ষণ করে থাকেন। জাকিরের উদ্দেশ্য এ বাদ্যযন্ত্র প্রদর্শনীর মাধ্যমে আমাদের দেশীয় বাদ্যযন্ত্র তৈরির এই শিল্পমাধ্যমকে দেশে ও আন্তর্জাতিক অঙ্গনে পৌঁছানো। তারই একটি ছোট্ট প্রয়াস এই প্রদর্শনী। ২৯ নভেম্বর পর্যন্ত চলা পাঁচ দিনের প্রদর্শনীতে নিরীক্ষামূলক দেশীয় তারযন্ত্রের প্রদর্শনী, সেমিনার, কর্মশালা, পালা ও বিচ্ছেদ গান, বিষহরীর পুঁথি প্রদর্শন, চিত্রাঙ্কন, লোকনৃত্য, কালজয়ী লোকসংগীতশিল্পীদের প্রতি শ্রদ্ধাঞ্জলি, বাদ্যযন্ত্র নির্মাণবিষয়ক প্রামাণ্যচিত্র প্রদর্শনী, গানের দল পরবাসী ও পেনোয়ার মৌলিক গান পরিবেশন এবং মুক্ত আলোচনার আয়োজন করা হয়। প্রদর্শনীটি উদ্বোধন করেন বাউল শফি মণ্ডল।