‘ঘুরে দৌড় দিলে চোখটা হয়তো বেঁচে যেত’
উন্নত চিকিৎসার অভাবে নষ্ট হওয়ার পথে নাউমের চোখ
ইমতিয়াজ আহমেদ
প্রকাশ: ১৩ ডিসেম্বর ২০২৪ | ২৩:১৯
‘রংপুরের আবু সাঈদ ভাইকে পুলিশ গুলি করে হত্যার পরও যখন তৎকালীন সরকার ঢাকায় আন্দোলনে নৃশংসভাবে পেটায়, এসব দেখে আর ঘরে বসে থাকতে পারছিলাম না। আমরা কয়েকজন বন্ধু মিলে সিদ্ধান্ত নিই ফুলবাড়িয়ায় আন্দোলনে নামার। আন্দোলনকারীর সংখ্যা দিনে দিনে বাড়তে থাকল। ওই সময় সরকারের পেটুয়া বাহিনী আর পুলিশের কড়া নজর থাকে আমিসহ আমাদের কয়েকজনের ওপর। যত দিন যায় বিভিন্ন জায়গা থেকে গুলিতে হতাহত হওয়ার খবর কানে আসতে থাকে আমাদের। আমরা মনোবল হারাই না– আন্দোলন চালিয়ে যাই। বাড়ি থেকে আব্বা-আম্মা নিষেধ করলেও আমি শুনিনি। আন্দোলনে যোগ দিতাম নিয়মিত– নেতৃত্ব দিতাম। এখনও আয়নার মতো চকচক করছে সেই ভয়ংকর স্মৃতির দিনগুলো। ৪ আগস্ট ছাত্র, বিভিন্ন রাজনৈতিক দলসহ সব শ্রেণিপেশার মানুষের প্রতিবাদ-প্রতিরোধে উত্তাল তখন দেশ। সেদিন বাড়ি থেকে বের হয়ে ফুলবাড়িয়া এসে প্রাইভেট পড়ি। প্রাইভেট শেষে হাসিনা সরকারের দলীয় লোকজন এবং পুলিশ বাহিনী আমাদের ওপর চড়াও হয়, ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া চলে কয়েক ঘণ্টা। পরে ময়মনসিংহ পুলিশ লাইন্স থেকে আরও রিজার্ভ পুলিশ আনা হয় ছাত্রদের আন্দোলন দমাতে। এরপর শুরু হয় আন্দোলনকারীদের ওপর গুলি। আমরা একদল ছাত্র স্লোগান দিতে দিতে সামনে এগোতে থাকি, কয়েকজন পুলিশ আমাদের আসতে দেখেই ওত পেতে থাকে। আমি ছিলাম সবার সামনে। এমন সময় পুলিশ বন্দুক নিয়ে বেরিয়ে এলো। পেছন থেকে বন্ধুরা দৌড় দেয়, কিন্তু আমি অবাক হয়ে সেই পুলিশের দিকে তাকিয়ে ছিলাম। মনে মনে ভেবেছিলাম, কী আর করবে, মারবে না হয় ধরে নিয়ে জেলে দেবে। কিন্তু না, এমন কিছু ভাবতে ভাবতেই ধুম করে গুলি করে দিল পুলিশ। পরে আমার বুকে-পেছনে গুলি চালাল। আমি কিছুই বুঝতে পারছি না। আমার ডান চোখ দিয়ে রক্ত বের হচ্ছে; প্রচণ্ড ব্যথা হচ্ছে। এরপর হাসপাতালে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলাম; কিন্তু কেউ আমাকে তাঁর রিকশা বা সিএনজিতে তুলছিলেন না। একজন দয়া করে আমাকে রিকশায় করে স্থানীয় উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিয়ে যান। সেখানে আমাকে দেখে ডাক্তাররা চিকিৎসা না করে ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠিয়ে দেন। ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে প্রথমে আমাকে চিকিৎসা দেওয়া হয়নি। পরে একটা ইনজেকশন আর চোখের রক্ত পড়াটা বন্ধ করে দেওয়া হয়। এরপর দ্বিগুণ টাকা খরচ করে অ্যাম্বুলেন্স দিয়ে ঢাকায় চিকিৎসার জন্য সিএমএইচে ভর্তি হই। অপারেশন হয় চোখের। পরের দিন ৫ আগস্ট হাসপাতালের বেডে শুয়ে থাকাবস্থায় কানে আসে বিজয়ের ধ্বনি। চারপাশে বিজয় উল্লাস– আমার বুক থেকে যেন আকাশের মতো বিশাল একটা পাথর নেমে গেল...।’
ময়মনসিংহ নগরীর হরিকিশোর রায় রোডের এক বিল্ডিংয়ের ছাদের রেলিং ধরে শেষ গোধূলি ছড়িয়ে অস্ত যাওয়া লাল সূর্যটাকে সাক্ষী রেখে রোদচশমা পরা এ কিশোর একটানে কথাগুলো বলে গেল। কিছুক্ষণ পর তার চোখ জলে ছলছল; কান্নায় বারবার গলা চেপে আসছে ছেলেটার। তবুও সে বলল, ‘জানেন আমি আমার ডান চোখে কিছুই দেখি না, এটা মানতে পারি না আমি। আমি যদি সবার মতো পুলিশ দেখে দৌড়ে পালাতাম, তাহলে হয়তো গুলিটা আমার চোখে লাগত না। ডাক্তার বলেছেন, ৩ মাস পর আমার অপারেশন লাগবে, বিদেশে চিকিৎসা করানোর কথা বলেছেন। কিন্তু কীভাবে যাব, সেই সামর্থ্য তো আমার পরিবারের নেই...।’
এই সাহসী ছেলেটার নাম মো. আরিশ আহমেদ নাউম। নবম শ্রেণির ছাত্র, পড়ে ময়মনসিংহের ফুলবাড়িয়া শহীদ স্মৃতি স্কুল অ্যান্ড কলেজে। ৪ আগস্ট পুলিশের এলোপাতাড়ি গুলিতে ডান চোখ আক্রান্ত হয় নাউমের। এখন সে ওই চোখে কিছুই দেখে না। উন্নত চিকিৎসার জন্য এখন পর্যন্ত সরকারের পক্ষ থেকে কোনো সহযোগিতা পায়নি নাউম। নাউমের গ্রামের বাড়ি ফুলবাড়িয়া উপজেলার কুশমাইল গ্রামে। বাবা পেশায় একজন চাল বিক্রেতা। তাঁর পক্ষে ছেলের চিকিৎসা করা একরকম অসম্ভব। জমানো যা ছিল, ছেলের চিকিৎসার পেছনে ব্যয় করেছেন। বর্তমানে ঢাকার সিএমএইচ হাসপাতালে তার চিকিৎসা চলছে। তবে সে থাকে ময়মনসিংহের হরিকিশোর রায় রোডে মামার বাসায়। সেখানকার ডাক্তাররা বলেছেন, বিদেশে নিয়ে উন্নত চিকিৎসা করলে চোখ ভালো হওয়ার সম্ভাবনা আছে বলে আশায় বুক বেঁধে আছে নাউম।
নাউম জানায়, ‘বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে যারা আহত আছেন তাদের পরিপূর্ণ চিকিৎসা হচ্ছে না। আগে এ জুলাই গণঅভ্যুত্থানে যারা আহত হয়েছেন বা নিহত হয়েছেন সবার আগে প্রয়োজন তাদের পাশে দাঁড়ানো, তাদের পুনর্বাসন করা, তাদের উন্নত সুচিকিৎসার ব্যবস্থা করা। কিন্তু আমি সেই সুচিকিৎসা পাচ্ছি না। ৫ আগস্ট আমার মনে দুই ধরনের অনুভূতি হচ্ছিল– প্রথম আমার যে কী আনন্দ লাগছিল তা ভাষায় প্রকাশ করতে পারব না। কষ্ট একটাই– এই আনন্দে শামিল আমি হতে পারিনি। আমি
আবার চোখে দেখতে চাই। জুলাই গণঅভ্যুত্থানের একজন ক্ষুদ্র আহত সৈনিক হিসেবে এটুকু কি আমি চাইতে পারি না আমার দেশের কাছে?’ v
- বিষয় :
- গুলিবিদ্ধ