ঢাকা মঙ্গলবার, ১৮ ফেব্রুয়ারি ২০২৫

চলনবিলে ‘তরল মুক্তা’ মধু

চলনবিলে ‘তরল মুক্তা’ মধু

কুন্দইল গ্রামের কাটাগাঙের পারে ২৫০টির মতো মৌ বাক্স নিয়ে আস্তানা গেড়েছেন মৌচাষি সুবল চন্দ্র দাস

এম আতিকুল ইসলাম বুলবুল

প্রকাশ: ১০ জানুয়ারি ২০২৫ | ২৩:১৯ | আপডেট: ১১ জানুয়ারি ২০২৫ | ১৯:৩৮

চলনবিলের মধ্যস্থল সিরাজগঞ্জ জেলার তাড়াশ উপজেলার সগুনা ইউনিয়নের কুন্দইল গ্রামের কাটাগাঙের পারে ২৫০টির মতো মৌ বাক্স নিয়ে আস্তানা গেড়েছেন প্রায় তিন দশকেরও বেশি মধু সংগ্রহের অভিজ্ঞতা আছে এমন একজন মৌচাষি সুবল চন্দ্র দাস। নাটোর জেলার গুরুদাসপুর উপজেলার বিয়াঘাট ইউনিয়নের হামলাইকুল গ্রামের বাসিন্দা তিনি। বয়স ৫৫। অভিজ্ঞ এ মৌচাষি জানান, আগে যে পরিমাণ মধু সংগ্রহ করতে পারেন, এখন এর পরিমাণ অনেক বেড়েছে। সবকিছুর দাম বেশি, খরচ অনেক বেড়েছে।

চলনবিল অঞ্চলে সত্তর দশক থেকে ২০০৪ সাল পর্যন্ত মোটামুটি সিরাজগঞ্জের তাড়াশ, রায়গঞ্জ, উল্লাপাড়া, শাহজাদপুর; পাবনার ভাঙ্গুড়া, ফরিদপুর, চাটমোহর; নাটোরের গুরুদাসপুর, সিংড়া ও নওগাঁ জেলার আত্রাই উপজেলার নিম্নাঞ্চল বা নিচু উর্বর জমিগুলো প্রায় চার থেকে পাঁচ মাস পানিতে তলিয়ে থাকত। এ জন্য জমি সরিষা চাষের উপযোগী ছিল না। এ কারণে সে সময় বেশি জমিতে রবিশস্য সরিষার আবাদও হতো না। সর্বশেষ ২০০৪ সালে চলনবিল অঞ্চলে বড় বন্যা হয়। তখন থেকে আশ্বিন বা কার্তিক মাসেই বিল থেকে পানি নেমে যাওয়ায় চলনবিলের হাজার হাজার হেক্টর জমিতে সরিষার আবাদ শুরু হয় ব্যাপক পরিসরে। তখন এক ধরনের বিপ্লব ঘটে যায়। উৎপাদন হতে থাকে লাখ লাখ টন সরিষা। এর পাশাপাশি এখানকার সরিষার হলুদ ফুল থেকে আসতে থাকে শত শত টন মধু; যা এখন চলনবিলের ‘তরল মুক্তা’। যাতে করে সুবল দাস, তোজাম্মেল হক, মোশারফ হোসেনসহ কয়েকশ মৌচাষি যেমন স্বাবলম্বী হতে পারেন, তেমনি প্রচুর পরিমাণ বিশুদ্ধ মধুও পাওয়া সম্ভব হচ্ছে।

তাড়াশ উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা আবদুল্লাহ আল মামুন চলনবিলের কৃষি বিভাগের সমন্বিত তথ্য থেকে জানিয়েছেন, সরিষা ফুলকেন্দ্রিক মধু আহরণ বা সংগ্রহে অনেকটা আশাজাগানিয়া বাণিজ্যিক ভাব বিরাজ করছে এখন। সেই সঙ্গে সুন্দরবনের পর মধু সংগ্রহের বড় একটি ক্ষেত্র সৃষ্টি হয়েছে চলনবিলাঞ্চলে সরিষার ফুল থেকেও। আবার মধু সংগ্রহের মাধ্যমে মৌচাষিদের ভাগ্য দুই দশকে বড় পরিসরেই সুপ্রসন্ন হওয়ায় এখন বাণিজ্যিকভাবে মৌচাষিদের মধু সংগ্রহ করে আয় রোজগারেরও সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে।

রোজগারের আশায় চলমান সরিষার এ মৌসুমে তাড়াশের ২০ জন, গুরুদাসপুরের ৫০ জন, সিংড়ার ১৮ জন ও চলনবিলের আরও কয়েকটি উপজেলার প্রায় শতাধিক মৌচাষির সঙ্গে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের সাতক্ষীরা, বাগেরহাট, খুলনা, যশোর, কুষ্টিয়াসহ ওই অঞ্চলের আরও দুই শতাধিক মৌচাষি বিভিন্ন ফসলি মাঠে মধু সংগ্রহে অবস্থান করছেন। দৃশ্যত এখন সরিষার মৌসুমে চলনবিলের ফসলি মাঠ যেন অবারিত দিগন্ত। হলুদ আভায় ছবির মতো সেজেছে জনপদ। সেখানে মৌচাষিরা আস্তানা গেড়ে মৌ বাক্স বিছিয়ে দুই-আড়াই মাসে মধু সংগ্রহের মাধ্যমে রোজগারে শামিল হয়েছেন। 

চলনবিলের লালুয়া মাঝিরা গ্রামে আসা মৌচাষি আনোয়ার হোসেন জানান, চলনবিল এলাকায় ২৫০ থেকে ২৮০টি মৌবাক্স আছে এমন মৌচাষিরা সরিষার এ মৌসুমের দুই-আড়াই মাসে প্রায় ৫০ জার মধু সংগ্রহ করবেন। ১১০ থেকে ১২৫ মণের মতো; যার প্রায় ৩০ থেকে ৩৫ শতাংশ মধু এরই মধ্যে সংগ্রহও করে ফেলেছেন। এ মধুর চলমান পাইকারি বাজার দর ৪০০ টাকা প্রতি কেজি। তাতে একজন মৌচাষি এ মৌসুমে সরিষার ফুল থেকে কমপক্ষে ১৮ থেকে ২০ লাখ টাকার মধু সংগ্রহ করতে পারবেন। সম্মিলিতভাবে যে পরিমাণ মধু সংগ্রহ করবেন মৌচাষিরা, এর পরিমাণ ও দাম অনেক। 

বর্তমান বাজারে প্রক্রিয়াজাতকরণের পর বোতলজাত ১ কেজি মধুর দাম প্রায় ৮০০ থেকে ৮৫০ টাকা। আবার এ মৌসুমের পর যখন মৌচাষিরা মধু সংগ্রহ করতে পারবেন না, তখন ২৫০ থেকে ২৮০টি মৌ বাক্স রয়েছে– এসব মৌচাষিকে মধু সংগ্রহের মৌসুম নয় এমন সময়ে ৫৫ থেকে ৬০ বস্তা চিনি কিনে খাওয়াতে হবে মৌ বাক্সে থাকা মৌমাছিকে; যার দামও সাড়ে তিন থেকে চার লাখ টাকার মতো। এ ছাড়া পরিবহন খরচ আছে। আছে মৌচাষির খাবারসহ প্রতিদিনের খরচ। তবে চলনবিল অঞ্চলের কোথাও মধু প্রক্রিয়াজাতকরণ মেশিন ও মৌচাষিদের প্রক্রিয়াজাতের প্রশিক্ষণ নেই এমনটিই জানান উল্লাপাড়ার উধুনিয়া এলাকার মৌচাষি মোক্তার হোসেন। এ দুটি জিনিস থাকলে এ অঞ্চলসহ চলনবিল এলাকায় মধু সংগ্রহে আসা সব মৌচাষির লাভের হিসাবটাও বদলে যেতে পারত। 

মধুর নানা গুণ নিয়ে সিরাজগঞ্জ মুনসুর আলী মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালের ভারপ্রাপ্ত পরিচালক ডা. আনোয়ার হোসেন বলেন, ‘কাঁচা বা প্রক্রিয়াজাতকরণ মধুর মধ্যে উপাদানগত পার্থক্য রয়েছে। বলতে গেলে মৌমাছির তৈরি মৌচাকে যে মধু থাকে, তা কাঁচা মধু। এ মধু পাতলা সুতি বা নাইলন কাপড়ের ছাঁকনিতে ছেঁকে তা থেকে মোম বা মৃত মৌমাছি আলাদা করা হয়। বাজারে বোতলজাত ও প্রক্রিয়াজাত করা মধু পাস্তুরিত বা ফিল্টার করা হয়। এতে পাস্তুরাইজেশন পদ্ধতিতে বেশি তাপে ছত্রাক ধ্বংস করা হয়। তাতে ওই মধুর স্বাদ বেশিদিন অক্ষুণ্ন থাকে। তারপর ফিল্টারাইজেশন পদ্ধতিতে বাণিজ্যিকভাবে উৎপাদিত কিছু মধুতে আরও উন্নত পদ্ধতি প্রয়োগ করায় স্বাস্থ্যকর পরাগরেণু, অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট নষ্ট হয়। বরং কাঁচা মধুতে বিভিন্ন ধরনের পুষ্টি উপাদান অক্ষুণ্ন থাকে। সাধারণত মধুতে ২২ ধরনের অ্যামিনো এসিড, ৩১টি ভিন্ন ধরনের খনিজ এবং অনেক ধরনের ভিটামিন ও পাচকরস মেলে। কাঁচা মধু রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ানোর পাশাপাশি হৃদরোগ, ক্যান্সার, ইনফ্লামেশনের মতো রোগের ঝুঁকি কমায়। অথচ বাণিজ্যিক মধুতে প্রক্রিয়াজাতকরণের কারণে এসব পুষ্টি উপাদান নষ্ট হয়; যা অনেকের অজানা। তাই অনেকেই হাতের কাছে কাঁচা বিশুদ্ধ মধু কেনেন না।’

আবার কৃষিবিজ্ঞান বলছে, এ পৃথিবীতে প্রায় ৮৭ শতাংশ ফসলই কীটপতঙ্গের দ্বারা পরাগায়ন হয়ে থাকে। আবার এর মধ্যে ৮০ শতাংশ ফসলের পরাগায়নে মৌমাছির অবদান থাকে। পরাগায়নের মধ্য দিয়ে ধাপে ধাপে ফুল থেকে ফল হয়; যা দিয়ে উদ্ভিদের বংশবিস্তার ঘটে। যদি এভাবে উদ্ভিদ তার বংশবিস্তার করতে না পারে তাহলে আমাদের প্রিয় বসুধার অস্তিত্বই বিপন্ন হয়ে পড়বে।

আরও পড়ুন

×