- লাইফস্টাইল
- সংক্রমণ ঊর্ধ্বমুখী থাকতে পারে আরও এক মাস
সংক্রমণ ঊর্ধ্বমুখী থাকতে পারে আরও এক মাস

প্রাণঘাতী করোনাভাইরাসের সংক্রমণ এবং মৃত্যু আরও এক মাস ঊর্ধ্বমুখী থাকবে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের করোনাভাইরাস ব্যবস্থাপনা কোর কমিটি ও জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা এমন পূর্বাভাসই দিয়েছেন। আগামী ফেব্রুয়ারি মাসের মাঝামাঝি অথবা তৃতীয় সপ্তাহ পর্যন্ত এ ধারা অব্যাহত থাকবে। এরপর সংক্রমণ ও মৃত্যু ধাপে ধাপে কমে আসতে শুরু করবে। তবে মাস্ক পরা, সামাজিক দূরত্ব ও স্বাস্থ্যবিধি উপেক্ষা করলে তা আরও প্রলম্বিত হতে পারে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে জাতীয় রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ডা. এ এস এম আলমগীর সমকালকে বলেন, করোনাভাইরাসের বৈশ্বিক সংক্রমণ পরিস্থিতি পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, শনাক্ত হওয়া করোনার নতুন কোনো ভ্যারিয়েন্ট (ধরন) চার থেকে ছয় সপ্তাহ পর্যন্ত মারাত্মক সংক্রমণ ছড়ায়। কিন্তু চার থেকে ছয় সপ্তাহ পর সংক্রমণ ও মৃত্যু কমে আসতে শুরু করে। এটি ভাইরাসের বৈশিষ্ট্য। সুতরাং এ থেকে ধারণা করা যায়, চলমান সংক্রমণ ফেব্রুয়ারি মাসের মাঝামাঝি অথবা তৃতীয় সপ্তাহ পর্যন্ত অব্যাহত থাকতে পারে। এ সময়ে সংক্রমণ ও মৃত্যু আরও বাড়বে।
ডা. আলমগীর আরও বলেন, আগের ধরনগুলোর তুলনায় ওমিক্রন অধিক সংক্রমণপ্রবণ। এটি দ্রুত ছড়িয়ে পড়ছে। বর্তমানে ঢাকায় জোরালো সামাজিক সংক্রমণ চলছে। আবার ঢাকার বাইরে ডেলটার আধিক্য চলছে। তবে কয়েক দিনের মধ্যে গ্রামেও ওমিক্রন ছড়িয়ে পড়বে। সুতরাং সংক্রমণ অনেক বেশি হবে। হয়তো সেটি ডেলটার ভ্যারিয়েন্ট সংক্রমণকেও ছাড়িয়ে যাবে।
ডেলটা ভ্যারিয়েন্টের সময় গত বছর শনাক্তের হার ৩২ শতাংশ উঠেছিল। ওমিক্রনে শনাক্তের হার গতকাল ৩২ শতাংশ ছাড়িয়েছে। এটি আগামী ফেব্রুয়ারি মাসের মাঝামাঝি অথবা তৃতীয় সপ্তাহ পর্যন্ত বাড়তে পারে। তখন শনাক্তের হার বাড়তে পারে।
সংক্রমণ বাড়ছে জ্যামিতিক হারে :ডিসেম্বরের তৃতীয় সপ্তাহ থেকে সংক্রমণ বাড়তে শুরু করে। গত বছরের ২০ ডিসেম্বর থেকে গতকাল সোমবার পর্যন্ত ৩৫ দিনে শনাক্তের হার ১ দশমিক ৩০ শতাংশ থেকে বেড়ে ৩২ শতাংশ ছাড়িয়েছে। গত বছরের ২১ সেপ্টেম্বর রোগী শনাক্তের হার ৫ শতাংশের নিচে নেমে এসেছিল। এর ১০৮ দিন পর গত ৭ জানুয়ারি শনাক্তের হার ৫ শতাংশের বেশি হয়। এরপর শনাক্তের হার আরও নিচে নামে। কিন্তু ১৮ দিন ধরে শনাক্তের হার ৫ শতাংশের বেশি আছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, শনাক্তের হার নূ্যনতম ১৪ দিন ধরে ৫ শতাংশের ওপরে থাকলে সেটি মহামারি হিসেবে বিবেচ্য হবে। সে হিসেবে দেশে এখন করোনা পরিস্থিতির মহামারি চলছে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের প্রতি সপ্তাহের রোগতাত্ত্বিক পর্যালোচনা যাচাই করলে বিষয়টি আরও স্পষ্ট হবে। গত ২০ ডিসেম্বর স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের ৫০তম সপ্তাহের রোগতাত্ত্বিক পর্যালোচনা বলছে, আগের সপ্তাহের তুলনায় শনাক্ত ৬ দশমিক ৬ শতাংশ হ্রাস পেয়েছিল। একই সঙ্গে মৃত্যুও ২৫ দশমিক ৯ শতাংশ হ্রাস পায়। এর বিপরীতে নমুনা পরীক্ষা ৫ দশমিক ৩ শতাংশ এবং সুস্থতা ২৪ দশমিক ৩ শতাংশ বৃদ্ধি পায়। পরবর্তী সপ্তাহ থেকেই চিত্র পাল্টাতে থাকে। ২৭ ডিসেম্বর ৫১তম সপ্তাহের রোগতাত্ত্বিক পর্যালোচনায় দেখা যায়, আগের সপ্তাহের তুলনায় শনাক্ত এক লাফে ২৩ দশমিক ৪ শতাংশ বৃদ্ধি পায়। পরবর্তী সপ্তাহে শনাক্তের সঙ্গে মৃত্যুও বেড়ে যায়। ৩ জানুয়ারি ৫২তম রোগতাত্ত্বিক পর্যালোচনায় দেখা যায়, আগের সপ্তাহের তুলনায় রোগী শনাক্ত বৃদ্ধি পায় ৪৮ দশমিক ১ শতাংশ। একই সঙ্গে মৃত্যুও বৃদ্ধি পায় ৪১ দশমিক ৭ শতাংশ। এর বিপরীতে শনাক্ত ৪ দশমিক ৬ শতাংশ এবং সুস্থতা ১৪ দশমিক ৮ শতাংশ বৃদ্ধি পায়। ১০ জানুয়ারি ৫৩তম সপ্তাহের রোগতাত্ত্বিক পর্যালোচনায় দেখা যায়, আগের সপ্তাহের তুলনায় শনাক্তের হার বেড়েছে ১২৫ দশমিক ১ শতাংশ। একই সঙ্গে মৃত্যু বেড়েছে ৪৭ দশমিক ১ শতাংশ। এর বিপরীতে সুস্থতা কমেছে ৩৬ দশমিক ৭ শতাংশ। ১৭ জানুয়ারির রোগতাত্ত্বিক পর্যালোচনায় দেখা যায়, আগের সপ্তাহের তুলনায় শনাক্তের হার ২৩১ দশমিক ৯ শতাংশ বৃদ্ধি পায়। একই সঙ্গে মৃত্যুও বাড়ে ৬৮ শতাংশ। সর্বশেষ গতকাল সোমবারের রোগতাত্ত্বিক পর্যালোচনায় দেখা যায়, শনাক্তের হার বেড়েছে ১৮০ দশমিক ৮০ শতাংশ। একই সঙ্গে মৃত্যুও বেড়েছে ৮৮ দশমিক ১ শতাংশ। এ চিত্র থেকে বলা যায়, সংক্রমণ জ্যামিতিক হারে বাড়ছে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের আট সদস্যের জনস্বাস্থ্যবিদ সমন্বয়ে গঠিত কমিটি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইনস্টিটিউট এবং কানাডিয়ান জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ দল সমন্বিতভাবে বাংলাদেশে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ও মৃত্যুর পূর্বাভাস নিয়ে কাজ করে আসছে। এই কমিটির সদস্য জনস্বাস্থ্যবিদ ড. আবু জামিল ফয়সাল সমকাল বলেন, করোনাভাইরাসের নতুন করে সংক্রমণ শুরুর পর তারা বিষয়টি নিয়ে কাজ করেছেন। কিন্তু এখনও সেটি প্রস্তুত হয়নি। কয়েক দিনের মধ্যেই এ-সংক্রান্ত একটি পূর্বাভাস তৈরি করা হবে। তবে করোনাভাইরাসের কয়েকটি ঢেউ পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, একেকটি ভ্যারিয়েন্ট সংক্রমণ শুরুর এক সপ্তাহের মধ্যে ছড়াতে শুরু করে। দ্বিতীয় সপ্তাহে গিয়ে আরও বিস্তার ঘটে। তৃতীয় ও চতুর্থ সপ্তাহে ভয়াবহ পরিস্থিতি ধারণ করে। এটি পঞ্চম ও ষষ্ঠ সপ্তাহ পর্যন্ত অব্যাহত থাকতে পারে। তবে অধিকাংশ ক্ষেত্রে দেখা যায়, ভ্যারিয়েন্টগুলো চার থেকে ছয় সপ্তাহ পর্যন্ত ঊর্ধ্বমুখী অবস্থায় থাকে। এরপর ধাপে ধাপে সংক্রমণ কমে আসতে থাকে। এ অবস্থায় বলা যায়, চলমান সংক্রমণ দুই সপ্তাহ ধরে চলছে। আগামী ফেব্রুয়ারি মাসের মাঝামাঝি এটি পঞ্চম সপ্তাহ অতিক্রম করবে। সুতরাং ফেব্রুয়ারির মাঝামাঝি পর্যন্ত উচ্চ সংক্রমণ চলবে। এরপর তা কমে আসতে শুরু করবে।
হাসপাতাল প্রস্তুত রাখার তাগিদ বিশেষজ্ঞদের :বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য ও ভাইরোলজিস্ট অধ্যাপক ডা. নজরুল ইসলাম সমকালকে বলেন, ওমিক্রনের উচ্চ সংক্রমণ শুরু হয়েছে। জ্যামিতিক হারে সংক্রমণ বাড়ায় হাসপাতালে রোগী ভর্তির ভিড়ও বাড়ছে। ওমিক্রনের পাশাপাশি ডেলটা ধরনও সংক্রমণ ছড়াচ্ছে। সুতরাং রোগী বাড়বে। তাই দ্রুততার সঙ্গে হাসপাতালের সাধারণ ও আইসিইউ শয্যা বাড়াতে হবে। একই সঙ্গে অক্সিজেনের পর্যাপ্ত সরবরাহ নিশ্চিত করতে হবে। পাশাপাশি জনসাধারণকে সরকার আরোপিত স্বাস্থ্যবিধিও মেনে চলতে হবে। অন্যথায় পরিস্থিতি ভয়াবহ আকার ধারণ করবে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখার সাবেক পরিচালক অধ্যাপক ডা. বে-নজির আহমেদ সমকালকে বলেন, আগামী এক থেকে দেড় মাস রোগীর চাপ থাকবে। প্রতিবেশী ভারতে মারাত্মকভাবে ছড়িয়ে পড়া ওমিক্রন পরিস্থিতি বিশ্নেষণ করে দেখা যায়, সেখানে ৫ থেকে ১০ শতাংশের মতো রোগীর হাসপাতালে ভর্তির প্রয়োজন পড়ছে। দেশে দৈনিক ২০ হাজার মানুষ সংক্রমিত হলে ১০ শতাংশ করে দুই হাজার মানুষের হাসপাতালে ভর্তির প্রয়োজন পড়বে। এভাবে এক মাস ধরে সংক্রমণ চললে রোগী ভর্তির শয্যা মিলবে না। সুতরাং হাসপাতালগুলোকে প্রস্তুত রাখতে হবে।
মন্তব্য করুন