
সব প্রজাতির মাছের পাশাপাশি চাষের মাছেরও দাম বেড়েছে। খাবার হোটেল মালিকরা বাজারের সঙ্গে সমন্বয়ের নামে মাছের দাম বাড়িয়েছেন পিসপ্রতি ২০-৩০ টাকা। মাছের আড়তদার আর হোটেল ব্যবসায়ীরা লাভবান হলেও খরচের বাড়তি চাপ বহন করতে হচ্ছে ভোক্তাদের। বাজারে দাম বাড়লেও জেলেরা সুবিধা পাচ্ছেন সামান্যই। তাঁরা মাছঘাটের ইজারাদার থেকে ঋণ (দাদন) নিয়ে নৌকা ও জাল ক্রয় করেন। ফলে দাদন দেওয়া ইজারাদারের ঘাটে মাছ বিক্রি করতে বাধ্য থাকেন। বাজারদর নিয়ন্ত্রণে হাত থাকে না এসব জেলের।
রাজধানীর কারওয়ান বাজার, যাত্রাবাড়ীর কুতুবখালী ও সোয়ারীঘাটের আড়তদাররা মাছের বাজারের দাম নিয়ন্ত্রণ করেন। ডিজেলের দাম বাড়ার পর মুদি থেকে শুরু করে সব ধরনের পণ্যের দাম কমবেশি বেড়েছে। অথচ বেশিরভাগ পণ্যের ক্ষেত্রেই জ্বালানির প্রভাব সামান্য। যেমন- মাছ ধরার নৌকা বা ট্রলারে ডিজেল লাগে। আবার শিকার করা মাছ পরিবহনে নৌযান বা ট্রাকে ডিজেল লাগে। দক্ষিণাঞ্চল থেকে ঢাকায় লঞ্চে এক ঝুড়ি মাছ পরিবহনে ভাড়া বেড়েছে ২২ শতাংশ। অথচ বাজারে মাছের দাম বেড়েছে কেজিতে ৬০-৮০ টাকা।
মাসখানেক আগে চাষের পাঙাশ ও তেলাপিয়া কেনা যেত প্রতি কেজি ১৫০-১৭০ টাকায়। এখন তা ২০০-২১০ টাকা। ১৬০-১৮০ টাকা কেজির চাষের কই এখন ২০০-২৩০ টাকা। এসব মাছের জন্য বাজার থেকে খাবার কিনতে হলেও শিকারে ডিজেল দরকার হয় না। তার পরও মাসের ব্যবধানে দামে অসামঞ্জস্য লক্ষ্য করা যাচ্ছে। দাম বাড়ার জন্য খুচরা ব্যবসায়ীরা পাইকারি ব্যবসায়ীদের (আড়তদার) দুষছেন। আর পাইকারি ব্যবসায়ীরা জ্বালানি তেলের দাম বাড়ার পাশাপাশি অন্যান্য পণ্যের দাম বৃদ্ধিকে অজুহাত হিসেবে সামনে আনছেন। তবে ব্যবসায়ীরা স্বীকার করেছেন, বাজারে সব পণ্যের দাম বাড়ায় তাঁদের জীবনধারণ কঠিন হয়ে পড়েছে। ফলে দাম বাড়িয়ে টিকে থাকতে হচ্ছে। হঠাৎ করে ডিম ও ব্রয়লারের বাজারে উত্তাপ ছড়াল। বাণিজ্যমন্ত্রীর ডিম আমদানির ঘোষণা আর সরকারের হুঁশিয়ারির পর ডিম ও ব্রয়লারের দাম অনেকটা নিয়ন্ত্রণে রয়েছে।
মাছ আমদানির অনুমতির ঘোষণা দেওয়ার দরকার নেই। কারণ আমরা জানি, বাংলাদেশ মাছে স্বয়ংসম্পূর্ণ। ইলিশ উৎপাদনে আমাদেশ দেশ বিশ্বে শীর্ষ অবস্থানে রয়েছে। বিশ্বে স্বাদু পানির মাছের ১১ শতাংশ এ দেশে উৎপাদিত হয়, যার মোট পরিমাণ প্রায় ১৩ লাখ টন। চিংড়িকে বলা হয় হোয়াইট গোল্ড। চাষের মাছেও সাফল্য দেখা যাচ্ছে। তার পরও নানা অজুহাতে মাছের দাম বাড়ানোর নেপথ্যে সিন্ডিকেটের কারসাজি রয়েছে কিনা, তা খতিয়ে দেখা দরকার।
নদী, অসংখ্য খালবিল, হাওর-বাঁওড়, ডোবা-নালার এ দেশে পাওয়া যায় নানা রং ও স্বাদের মাছ। আকার-আকৃতিতেও এরা যেমন বিচিত্র, নামগুলোও তেমনি নান্দনিক। একসময় গোলা ভরা ধান ছিল, চাহিদামতো মাছের সরবরাহ ছিল। তাই মাছে-ভাতে বাঙালি নদীমাতৃক বাংলাদেশের চিরাচরিত প্রবাদ। এখন আর সেই গোলাভরা ধান নেই। প্রতিনিয়ত চালের দাম বাড়ছে; বাড়ার তালিকায় যুক্ত হচ্ছে মাছ। ভেতো বাঙালির মাছের বাজার দিন দিন নিম্ন আয়ের ভোক্তাদের নাগালের বাইরে চলে যাচ্ছে।
দেশে নদীদূষণ ও দখল মাছ উৎপাদনে নেতিবাচক প্রভাব সৃষ্টি করছে। আগে প্রবহমান খালে নানা প্রজাতির মাছ পাওয়া যেত। কিন্তু দখলদারদের কারণে দিন দিন মরা খালের সংখ্যা বাড়ছে। আবাসন আর বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান তৈরির অজুহাতে ভরাট হচ্ছে পুকুরসহ অন্যান্য জলাশয়। চরাঞ্চলে বর্ষাকালে ফসলের মাঠের অভ্যন্তরে থাকা জলাশয়ে হরেক রকমের মাছ পাওয়া যেত। কিন্তু জমিতে অতিমাত্রায় কীটনাশক ও রাসায়নিক ব্যবহারের ফলে এসব জলাশয়ে সেভাবে মাছ উৎপাদিত হয় না। অনেক স্থানে আবার এসব জলাশয় ভরাট করে চাষাবাদ করা হচ্ছে। এ ছাড়া আকস্মিক বন্যায় বদ্ধ জলাশয়ের মাছ যেমন বিলীন হয়ে যাচ্ছে, পাশাপাশি অনাবৃষ্টি ও পানির অভাবে অনেক স্থানে মাছ উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে। প্রকৃতির ওপর কারও হাত নেই। তবে মানবসৃষ্ট সংকট দূর করে মাছ উৎপাদন বাড়ানোর পাশাপাশি বাজারে ভারসাম্য নিশ্চিত করতে হবে।
মিজান শাজাহান: সাংবাদিক
mizanshajahan@gmail.com
মন্তব্য করুন