ক্যান্সারের বিরুদ্ধে লড়াই, এক নির্মম লড়াই, যেখানে ঘাপটি মেরে থাকে রাজ্যের ভয়। সেই ভয় চির প্রস্থানের। এ মৃত্যুভয় জয় করতে পারলেই রোগের সঙ্গে লড়াই অনেক সহজ হয়ে যায়। অক্টোবর স্তন ক্যান্সার সচেতনতার মাস। এবারের মূল প্রতিপাদ্য- 'স্তন ক্যান্সারবিষয়ক সচেতনতা তৈরি ও প্রতিকার নিশ্চিত করা'। লিখেছেন ডা. অদিতি পাল চৌধুরী

পড়ন্ত বিকেল, ৫টার কাঁটা ছুঁইছুঁই। প্রতিদিনের হাসপাতালের ডিউটি শেষে বাসায় ফেরার প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম। এমন সময় চেম্বারে হন্তদন্ত হয়ে ঢুকলেন এক কম বয়সী দম্পতি। ফাইলের দিকে তাকিয়ে বুঝলাম মেয়েটিই রোগী, বয়স ২০ বছর। এরপর শুরু হলো রোগীর ইতিহাস নেওয়ার পালা। জানা গেল, রোগের উপসর্গের শুরু বাম স্তনের একটি ছোট চাকা দিয়ে; যা ধীরে ধীরে বাড়ছিল আকারে। রোগীর দাদির স্তন ক্যান্সারের ইতিহাস থাকায় তিনি ছুটে যান ডাক্তারের কাছে। ডাক্তারের পরামর্শে চাকাটি অপসারণ করা হয়। এর মধ্যে হিস্টোপ্যাথলজি রিপোর্ট পেতে কেটে যায় আরও দুই মাস। রিপোর্টে দেখা যায়, স্তন ক্যান্সার খুব প্রাথমিক ধাপে রয়েছে, যাকে আমরা ইন সিটু ক্যান্সার বলি।

রোগীর অবস্থা বিবেচনায় তাঁকে দ্রুত একটি ব্রেস্ট এমআরআই করানো হয় এবং একটি টিউমার বোর্ড গঠন করে দ্রুত সার্জারি করার পরামর্শ দেওয়া হয়। একটি পূর্ণাঙ্গ অপারেশনের পর রোগীর এ ক্ষেত্রে আর কোনো চিকিৎসার প্রয়োজন নাও হতে পারে অথবা রেডিওথেরাপি নিলেই তিনি আরোগ্য লাভ করতে পারেন। রোগী এখন অপেক্ষা করছেন দ্রুত আরোগ্যলাভের।

পরদিন সকালেই কথা হচ্ছিল আরেক রোগীর স্বামীর সঙ্গে, যাঁর ক্যান্সার সারা শরীরে ছড়িয়ে গেছে শুরুতেই প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণের অভাবে। রোগীর স্বামী খুব আফসোস করছিলেন, কেন প্রাথমিক পর্যায়ে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে পারেননি।

বিশ্বে নন-ইনফেকশাস ডিজিজ বা ছোঁয়াচে নয়, এমন রোগে যাঁদের মৃত্যু হয়, সেসব রোগের মধ্যে ক্যান্সার দ্বিতীয় স্থানে। প্রতি আট নারীর মধ্যে একজন তাঁদের জীবনকালে কখনও না কখনও স্তন ক্যান্সারে আক্রান্ত হন। স্তন ক্যান্সার এখন আর পঞ্চাশ বা চল্লিশোর্ধ্ব নারীর রোগ নয়। ইউরোপিয়ান সোসাইটি অব মেডিকেল অনকোলজির তথ্য অনুসারে, এশিয়ার দেশগুলোয় নারীরা ইউরোপীয় বা মার্কিন নারীদের তুলনায় কম বয়সে ক্যান্সারে আক্রান্ত হন।

বাংলাদেশে প্রতিনিয়তই বাড়ছে স্তন ক্যান্সারে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা। নারী-পুরুষ মিলে তা ৮ দশমিক ৩ শতাংশ। আন্তর্জাতিক সংস্থা ইন্টারন্যাশনাল এজেন্সি ফর রিসার্চ অন ক্যান্সারের (আইএআরসি) হিসাবে, বাংলাদেশে প্রতি বছর ১৩ হাজারেরও বেশি নারী নতুন করে স্তন ক্যান্সারে আক্রান্ত হন। মারা যান ৬ হাজার ৭৮৩ জন। নারী ক্যান্সার রোগীর মধ্যে ১৯ শতাংশ ভোগেন স্তন ক্যান্সারে। বিশ্বব্যাপী অক্টোবর মাসকে 'স্তন ক্যান্সার সচেতনতা মাস' হিসেবে পালন করা হয়, যা 'পিংক অক্টোবর' হিসেবেও পরিচিত। এবারের পিংক অক্টোবরের মূল প্রতিপাদ্য- 'স্তন ক্যান্সারবিষয়ক সচেতনতা তৈরি ও প্রতিকার নিশ্চিত করা'।

খাদ্যাভ্যাস
প্রতিদিনের খাদ্যতালিকায় রাখুন মটরশুঁটি, পেঁয়াজপাতা, মিষ্টি আলু, শাকসবজি, তাজা ফল, শস্যের মতো আঁশযুক্ত খাবার, সয়াবিন ও অন্য সয়া পণ্য, গ্রিন টি। গরু বা ছাগলের দুধ ও দুগ্ধজাত খাবার, বাদাম, মাশরুম ও সামুদ্রিক মাছ খেতে পারেন। ফ্রেঞ্চ ফ্রাই, চিপস, দীর্ঘ সময় ধরে ভাজা খাবার, প্যাকেটজাত ভুট্টা, মাইক্রোওয়েভে তৈরি খই বা পপকর্ন, রেড মিট, কৃত্রিম চিনি এড়িয়ে চলা ভালো।

প্রতিরোধে করণীয়
প্রতিটি নারীর ৩৫ বছর বয়সের পর স্তন ক্যান্সার স্ট্ক্রিনিংয়ের আওতায় আসা বিশেষ প্রয়োজন। যাঁদের পারিবারিক ইতিহাস আছে তাঁদের ক্ষেত্রে তা ২০-২৫ বছরেই শুরু করা উচিত। স্ট্ক্রিনিংয়ের জন্য ম্যামোগ্রাম একটি গোল্ড স্ট্যান্ডার্ড টুল বিবেচনা করা হলেও ৩৫ বা তার নিচের বয়সী নারীর ক্ষেত্রে তা আলট্রাসনোগ্রাম দিয়ে করাটাই ভালো। যাঁদের পারিবারিক ইতিহাস আছে তাঁদের স্ট্ক্রিনিংয়ে এমআরআই ব্যবহার করা হয়। তবে বছরে সাধারণত একবারই কোনো ইমেজিং পদ্ধতি দিয়ে স্ট্ক্রিনিংটি করা হয়।

বাকিটা সময় সেলফ ব্রেস্ট এক্সামিনেশনের জন্য উদ্বুদ্ধ করা হয় নারীদের। কীভাবে এটি করতে হবে তার অনেক ভিডিও এখন পাওয়া যায় ইউটিউব বা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে। নিজে স্তন পরীক্ষা করার সময় কোনো গোটা অনুভব করলে, স্তনে কোনো দাগ দেখা দিলে, স্তন লাল হয়ে গেলে, উষ্ণ অনুভব করলে, স্তন বা এর চারপাশে ফুসকুড়ি হলে, স্তনে ব্যথা হলে, স্তনের চামড়া কুঁচকে গেলে, স্তনবৃন্ত ভেতরের দিকে ঢুকে গেলে, স্তনবৃন্ত থেকে কোনো তরল নিঃসৃত হলে, অর্থাৎ স্তন বা স্তনবৃন্তের যে কোনো পরিবর্তন গুরুত্বসহকারে নিন। আপনজনের সঙ্গে কথা বলুন। দ্রুত চিকিৎসকের শরণাপন্ন হোন।

চিকিৎসা পদ্ধতি
প্রতিরোধের শত চেষ্টা ব্যর্থ হয়ে যে কারও স্তন ক্যান্সার হতে পারে। এ জন্য ভেঙে না পড়ে দ্রুত সঠিক চিকিৎসায় যুক্ত হতে হবে। বাংলাদেশে ক্যান্সারের সুচিকিৎসা রয়েছে। তবে এ চিকিৎসা অন্য রোগের মতো নয়। এক বিশাল পরিসরে এর যাত্রা।

স্তন ক্যান্সারের চিকিৎসা একটি মাল্টি-ডিসিপ্লিনারি অ্যাপ্রোচ, অর্থাৎ এই চিকিৎসার জন্য সার্জারি বিশেষজ্ঞ, মেডিকেল ও রেডিয়েশন অনকোলজি বিশেষজ্ঞের প্রয়োজন। স্তন ক্যান্সারের চিকিৎসা ব্যবস্থার মধ্যে উল্লেখযোগ্য- ১. সার্জারি, ২. রেডিওথেরাপি, ৩. কেমোথেরাপি, ৪. হরমোন থেরাপি, ৫. টার্গেটেড থেরাপি, ৬. ইমিউনোথেরাপি। মনে রাখা প্রয়োজন, সব ধরনের চিকিৎসা ব্যবস্থা একজন রোগীর দরকার হয় না। এটি নির্ভর করবে রোগের বিস্তৃতি, টিউমারের চরিত্র বা ধরনের ওপর।

চিকিৎসা পদ্ধতি দীর্ঘমেয়াদি হলেও দ্রুত রোগ শনাক্ত হলে অধিকাংশ ক্ষেত্রে এর সম্পূর্ণ নিরাময় সম্ভব। তাই ক্যান্সার শনাক্ত হলে ভেঙে পড়ার কোনো কারণ নেই। বরং শনাক্তের সঙ্গে সঙ্গে অভিজ্ঞ বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নিয়ে দ্রুত চিকিৎসা নেওয়া উচিত। স্তন ক্যান্সারের সব ধরনের চিকিৎসা ব্যবস্থা এখন বাংলাদেশেই রয়েছে। তাই ঘাবড়ে না গিয়ে সঠিক চিকিৎসা ও সচেতনতার ওপর জোর দিতে হবে।

লেখক :জুনিয়র কনসালট্যান্ট, রেডিয়েশন অনকোলজি
আহছানিয়া মিশন ক্যান্সার অ্যান্ড জেনারেল হাসপাতাল