- লাইফস্টাইল
- বইয়ের পাতায় প্রদীপ জ্বলে
বইয়ের পাতায় প্রদীপ জ্বলে

পাঠের অভ্যাস বাড়াতে ঘরে ঘরে বইয়ের কর্নার হতে পারে বেশ ভালো একটি উদ্যোগ। বইপড়া জীবন-যাপনের অনিবার্য অংশ হয়ে উঠলে জীবন সুন্দর হয়ে ওঠে। মুক্তিযুদ্ধ ও ইতিহাস সম্পর্কে জানতে মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে রচিত বই পড়তে পারেন। লিখেছেন অরণ্য সৌরভ
শব্দ জ্ঞান বৃদ্ধি করে, প্রবাদে তাই বলে। শব্দ যেখানে অর্থপূর্ণ বাক্যমঞ্জরিতে আবদ্ধ- সেটি বই, যা কাগজে বা অন্তর্জালে লিপিবদ্ধ থাকতে পারে। বই অগোচরেই অজানাকে শেখায়, জানায় নতুন কিছু। বই পড়া মানসিক স্বাস্থ্যের জন্য উপকারী। প্রকারান্তরে শারীরিক স্বাস্থ্যের জন্যও উপকারী। ভালো বই মানসিক স্বাস্থ্যের উন্নতি ঘটিয়ে আরও বেশি দিন বাঁচতে সহায়তা করে।
পাঠের অভ্যাস মেধা-মনন, স্মৃতিশক্তি, যোগাযোগে দক্ষতা বাড়ায়; সৃজনশীল, পরিশীলিত ও মানবীয় গুণে গুণান্বিত হয়ে গড়ে উঠতে ভূমিকা রাখে। নেদারল্যান্ডসের এক গবেষণায় দেখা গেছে, অন্য সবার চেয়ে বইপড়ুয়ারা গল্প ও কাল্পনিক চরিত্রের মাধ্যমে সহজেই 'ইমোশনালি ট্রান্সপোর্টেড' (আবেগ দ্বারা প্রভাবিত) হয়ে থাকেন, যা সহমর্মিতা বাড়ায়। অন্যের অবস্থা ও সুখ-দুঃখকে অনুধাবন করার ক্ষমতা বৃদ্ধি করে।
এত উপকারী হওয়া সত্ত্বেও বই পড়ার অভ্যাসে ভাটা পড়েছে, বিশেষ করে আমাদের দেশে। দিনকে দিন বইবিমুখ হচ্ছে শিশু থেকে বৃদ্ধ। বই পড়ার প্রতি এই উদাসীনতার নেতিবাচক প্রভাব ব্যক্তি, পরিবার এবং জাতীয় উন্নয়নে পড়ছে বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা।
কথাসাহিত্যিক ও মনোরোগ বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ড. মোহিত কামাল বলেন, 'ছেলেবেলায় আমরা ২-৩ মাইল হেঁটে পাবলিক লাইব্রেরিতে যেতাম। সে সময় চার আনা জমা দিয়ে রূপকথার বই পড়তাম। বড় হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে দেশ-বিদেশের বিভিন্ন বই খুঁজে পড়েছি। এভাবে আমাদের একটা প্রজন্ম বই নিয়ে বড় হয়েছে। কিন্তু এখন সে লক্ষণটা নেই। তাড়না বা মোটিভেশনাল ফোর্স, যেটা মানুষকে তার লক্ষ্যের দিকে টেনে নিয়ে যায়, সেখানে আজ বই নেই।'
তিনি বলেন, 'মোটিভেশনাল ফোর্সে উৎসাহ, আগ্রহ এবং চাহিদা- এই তিনটি অংশ রয়েছে। এ অংশগুলো আমাদের বইয়ের মধ্যে ঢুকিয়ে রেখেছে। তাই আমাদের প্রজন্ম বই পড়ে বড় হয়েছে। কিন্তু এখন বাচ্চাদের খাওয়াতে, শান্ত রাখতে, বিরক্ত করা থেকে রেহাই পাওয়াসহ বিভিন্ন কারণে আমরা শিশুদের হাতে স্মার্টফোন তুলে দিচ্ছি। এ থেকে বাচ্চাদের মোবাইলের প্রতি উৎসাহ, আগ্রহ, চাহিদা পেয়ে বসছে; যা মোটিভেশনাল ফোর্স থেকে দূরে ঠেলে দিচ্ছে। মোবাইল ফোনে আসক্তি জমে যাচ্ছে। এ ছাড়া নানা রকম গেমসে ঝুঁকে ঘণ্টার পর ঘণ্টা সময় নষ্ট করে বইয়ের প্রতি মনোযোগ হারিয়ে ফেলেছে। এখনকার প্রজন্মের বইবিমুখের একটি কারণ মোবাইল ফোন।
ডিজিটালাইজেশনের যুগেও বই পড়ার জন্য বাচ্চাদের উপযোগী বিভিন্ন অ্যাপ তৈরি হয়েছে এবং হচ্ছে। যেখানে বাচ্চারা হেসেখেলে মজার ছলে দেখতে, বলতে এবং শিখতে পারছে। বাচ্চাদের সেদিকে আগ্রহী করে তুলতে হবে, চাহিদা বাড়াতে হবে- বলেন মোহিত কামাল। তিনি মনে করেন, 'বই পড়ার অভ্যাস তৈরিতে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে হবে পরিবারকে। মা-বাবা যদি মোবাইলে, টিভি সিরিয়ালের সামনে বসে থাকেন তাহলে বই পড়ার অভ্যাসের চাহিদা, আগ্রহ এবং উৎসাহ বৃদ্ধি পাবে না। সে জন্য ঘরের ভেতরে বই পড়ার কালচার শুরু করতে হবে। পাড়া-মহল্লায় নয়, এখন ঘরে ঘরে গ্রন্থাগার গড়ে তুলতে হবে।'
এখন আমাদের পাড়া-মহল্লায়, অলিগলিতে বড় মাঠ নেই, বিভিন্ন ধরনের ক্লাব ও সংগঠন নেই, সুস্থধারার নাটক, যাত্রা, গান-বাজনার অনুষ্ঠান নেই। কিন্তু এত কিছু নেই-এর মধ্যেও খুঁজে নিয়ে শেখার, জানার সুযোগ করে দিতে হবে। বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা, গান শোনা, বেড়াতে যাওয়াসহ যোগাযোগ বাড়াতে হবে। এমনটাই মনে করেন মনোরোগ বিশেষজ্ঞ এ কথাসাহিত্যিক।
একদিন পরই বিজয় দিবস। যে বিজয় বাঙালির আবেগ, অনুভূতি, অস্তিত্ব, পরিচয় ও চেতনার ধারক। দেশি-বিদেশি অনেক লেখক, সাংবাদিক, গবেষক, বুদ্ধিজীবী এবং মুক্তিযুদ্ধের সঙ্গে প্রত্যক্ষ-পরোক্ষভাবে জড়িত মানুষজন তাদের লেখনীর মাধ্যমে আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের প্রকৃত চিত্র ফুটিয়ে তুলেছেন। রচিত হয়েছে অসংখ্য মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক বই। মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক চলচ্চিত্র, ঘটনাপ্রবাহ জানতে পড়া যেতে পারে কিছু বই। যেমন- 'একাত্তরের চিঠি', হাসান হাফিজুর রহমান সম্পাদিত 'বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (১-১৫ খণ্ড )', এম আর আখতার মুকুলের 'আমি বিজয় দেখেছি', সেলিনা হোসেনের 'হাঙর নদী গ্রেনেড', আনোয়ার পাশার 'রাইফেল রোটি আওরাত', লে.জে.এ.এ.কে. নিয়াজীর 'দ্য বিট্রেয়াল অব ইস্ট পাকিস্তান', বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর 'মুক্তিযুদ্ধের সামরিক অভিযান (১-৭ খ )', শাহাদুজ্জামানের 'ক্রাচের কর্নেল', কর্নেল শাফায়াত জামিলের (অব.) 'একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ', 'রক্তাক্ত মধ্য আগস্ট' ও 'ষড়যন্ত্রময় নভেম্বর', মঈদুল হাসানের 'মূলধারা '৭১', যতীন সরকারের 'পাকিস্তানের জন্ম-মৃত্যু দর্শন', অ্যান্থনি ম্যাসকারেনহাসের 'দ্য রেইপ অব বাংলাদেশ', জাহানারা ইমামের 'একাত্তরের দিনগুলি', আফসান চৌধুরীর 'গ্রামের একাত্তর', আনিসুল হকের 'মা', হুমায়ূন আহমেদের 'জোছনা ও জননীর গল্প', সৈয়দ শামসুল হকের 'নিষিদ্ধ লোবান'সহ আরও অনেক বই।
লেখক ও গবেষক আফসান চৌধুরী বলেন, 'বাংলাদেশে এখনও এক মলাটে পরিপূর্ণ মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস লিপিবদ্ধ করা সম্ভব হয়নি। আর মুক্তিযুদ্ধের ওপর সামগ্রিক সে রকম গবেষণাভিত্তিক বই নেই বললেই চলে।'
মুক্তিযুদ্ধের গতানুগতিক ধারার বই তরুণ প্রজন্মরা তেমন গ্রহণ করছে না, মনে করেন আফসান চৌধুরী। তিনি বলেন, 'মুক্তিযুদ্ধের বিভিন্ন প্রেক্ষাপটের ওপর আলাদা আলাদা কিছু বই হয়েছে, সেগুলো যার যার প্রয়োজন ও চাহিদা মতো পড়তে পারে।'
বই পড়ার অভ্যাস বাড়াতে একটু ইতিবাচক মনোভাবই যথেষ্ট। উত্তর প্রজন্মে এ অভ্যাসকে পৌঁছে দিতে বই নিজে পড়ার পাশাপাশি সন্তানকে বই কিনে দিতে বইয়ের দোকান, গ্রন্থাগার ও বইমেলাতে নেওয়া যেতে পারে। সে জন্য নূ্যনতম একটি বাজেট রাখা ভালো। এ ছাড়া বিদ্যাপীঠে শ্রেণিভিত্তিক বই পড়া প্রতিযোগিতার আয়োজনসহ বার্ষিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতার পুরস্কার হিসেবে বই দেওয়ার ব্যবস্থা করা যেতে পারে। প্রতিদিন নিয়ম করে নির্দিষ্ট একটু সময় সন্তানের সঙ্গে বই পড়ে একে সংস্কৃতিতে পরিণত করা হলে সুফল আসবেই। া
মন্তব্য করুন