- লাইফস্টাইল
- সরকারি নিবন্ধনে হবে মরণোত্তর দেহদান
সরকারি নিবন্ধনে হবে মরণোত্তর দেহদান

দেশে মরণোত্তর দেহদানের অগ্রদূত সারাহ ইসলাম। তাঁর দেখানো পথে এবার সরকারিভাবে শুরু হতে যাচ্ছে এ প্রক্রিয়া। আগামীকাল সোমবার থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে মরণোত্তর দেহদানে অঙ্গীকারকারীদের নিবন্ধনের আওতায় আনা হচ্ছে। যাঁরা নিবন্ধন করবেন, তাঁদের দেওয়া হবে বিশেষ ডোনার কার্ড। এ লক্ষ্যে জাতীয় ক্যাডাভেরিক ট্রান্সপ্লান্ট কমিটির সার্বিক তত্ত্বাবধানে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে (বিএসএমএমইউ) একটি সেল গঠন করা হয়েছে।
চিকিৎসকরা বলছেন, 'মস্তিস্ক মৃত (ব্রেইন ডেড)' ব্যক্তির দেহ থেকে ১২ ধরনের অঙ্গ সংগ্রহ করে প্রতিস্থাপন সম্ভব। দেশে ১৯৮২ সালে জীবিত দাতার কাছ থেকে কিডনি প্রতিস্থাপন শুরু হয়। 'ব্রেইন ডেড' রোগীর কিডনি নেওয়ার ব্যাপারে আইনি সীমাবদ্ধতা ছিল। ২০১৮ সালে আত্মীয়দের সম্মতিতে 'ব্রেইন ডেড' রোগীর অঙ্গ সংগ্রহের অনুমতি দিয়ে অঙ্গদান আইন সংশোধন করা হয়। এরপর ১৮ জানুয়ারি প্রথম সারাহ ইসলামের মাধ্যমে দেশে মরণোত্তর কিডনি প্রতিস্থাপন শুরু হয়।
তবে এখনও এ প্রক্রিয়া অনুসরণে নানা প্রতিবন্ধকতা রয়ে গেছে। দেশে মরণোত্তর প্রতিস্থাপনের সক্ষমতাও কম। কেন্দ্রীয় সংরক্ষণাগার ও ডাটাবেজও নেই। ৩৭টি সরকারি মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল থাকলেও মাত্র পুরোনো আটটি মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে এ মরণোত্তর দেহ সংরক্ষণের সুযোগ রয়েছে। অঙ্গ প্রতিস্থাপন প্রয়োজন এমন রোগীর ২ থেকে ৩ শতাংশকে এ প্রক্রিয়ায় আনা সম্ভব হচ্ছে।
সংশ্নিষ্টরা বলছেন, এই প্রক্রিয়াকে গতিশীল করতে সরকারি উদ্যোগের পাশাপাশি ধর্মীয় ও সামাজিক কুসংস্কার দূর করা প্রয়োজন। মানুষের মধ্যে ব্যাপক সচেতনতা বাড়াতে হবে। একই সঙ্গে বাড়াতে হবে দেশে নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্র (আইসিইউ) সুবিধা।
বিদ্যমান আইন ও ইসলাম ধর্মে মরণোত্তর অঙ্গদানে বাধা নেই। মুসলিম বিশ্বের অন্যতম সংস্থা ওআইসি এবং বিশিষ্ট ইসলামিক ওলামারাও মরণোত্তর কিডনিসহ অন্য অঙ্গদানকে স্বীকৃতি দিয়েছেন।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, 'মৃত্যুঞ্জয়' নামে একটি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন ২০১৪ সাল থেকে মরণোত্তর দেহদান নিয়ে কাজ শুরু করে। ২০১৪ সালের ডিসেম্বরে এক অনুষ্ঠানেই ২২ জন মরণোত্তর দেহদানের অঙ্গীকার করেছিলেন। ওই সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত আবৃত্তিকার সাগর লোহানী বলেন, 'এ পর্যন্ত ১০০ জনের কাছ থেকে আমরা অঙ্গীকার পেয়েছি। আমাদের কাজ হলো তাঁদের এই অঙ্গীকার অনুযায়ী মৃত্যুর পর মরদেহ হাসপাতালে দানের ব্যবস্থা করা। আমরা এরই মধ্যে কয়েকটি মরদেহ হাসপাতালে দিয়েছি।' মরণোত্তর দেহ সবচেয়ে বেশি সংরক্ষিত আছে বিএসএমএমইউতে; এ সংখ্যা ২৫।
এদিকে ২০০০ সাল থেকে এ পর্যন্ত ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের অ্যানাটমি বিভাগ নিজ উদ্যোগে অন্তত ১০০ জনের কাছ থেকে মরণোত্তর দেহদানের অঙ্গীকার করেন। তবে এখন পর্যন্ত কারও মরণোত্তর অঙ্গ প্রতিস্থাপন সম্ভব হয়নি। তবে দেহ চার-পাঁচ বছরের বেশি সংরক্ষণ করা যায় না।
সারাহতে সাড়া: বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র মো. মারুফউল হাসান মুন্না। তিনি মরণোত্তর চক্ষুদান করবেন বলে ৫ ফেব্রুয়ারি সন্ধানী জাতীয় চক্ষুদান সমিতিতে নিবন্ধন করেন। মনিরুজ্জামান বাবু, উম্মে জোহরা বুশরা, জিসান তাহবুরসহ দুই সপ্তাহে প্রায় ১০ জন মরণোত্তর দেহদানের অঙ্গীকার করেন। ২০২২ সালে পুরো বছরেও এমন সাড়া মেলেনি। অঙ্গীকার করা এমন একাধিক ব্যক্তির অভিমত, মৃত্যুর পর তাঁদের দেহ বা অঙ্গ কোনো কাজে আসবে না; বরং দান করে দিলে কারও না কারও উপকারে আসবে। কেউ চোখের আলো ফিরে পাবে, কেউ বা ডায়ালাইসিস থেকে আজীবন মুক্তি পাবে। মানবিক চিন্তা থেকে এই সিদ্ধান্ত নেওয়া। ১৮ জানুয়ারি 'মস্তিস্ক মৃত' সারাহ ইসলামের দুটি কিডনি ও দুটি কর্নিয়া চারজনের শরীরে প্রতিস্থাপনের ঘটনা মানুষের মাঝে ভালো সাড়া ফেলেছে। মরণোত্তর দেহদানের ব্যাপারে এখন অনেকেই আগ্রহ দেখাচ্ছেন।
বিএসএমএমইউ অ্যানাটমি বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক অধ্যাপক লায়লা আনজুমান বানু সমকালকে বলেন, ২০০৩ সাল থেকে এ পর্যন্ত ৬০ জন মরণোত্তর দেহদানের অঙ্গীকার করেছেন। যাঁরা মরণোত্তর দেহদানের অঙ্গীকার করছেন, তাঁরা বয়সে তরুণ। মরণোত্তর দেহদানে মানুষের আগে খুব একটা আগ্রহ ছিল না। তবে এখন সমাজের মানুষের দৃষ্টিভঙ্গি বদলেছে। আজকাল তরুণরা বেশি আগ্রহ দেখাচ্ছে।
সাম্প্রতিক সময়ে বীর মুক্তিযোদ্ধা স্থপতি মোবাশ্বের হোসেন, আবৃত্তিকার হাসান আরিফ ও রাজশাহীর বাসিন্দা জামিলা বুপাশা মরণোত্তর দেহদানের অঙ্গীকার করে গেছেন। এখন তাঁদের দেহ রয়েছে বিএসএমএমইউতে।
বেশি হচ্ছে কর্নিয়া প্রতিস্থাপন: মরণোত্তর চক্ষুদান নিয়ে কাজ করে সন্ধানী জাতীয় চক্ষুদান সমিতি। সংগঠনটি ১৯৮৪ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়। শ্রীলঙ্কার চিকিৎসক হার্টসন সিলভা প্রথম দেশে কর্নিয়া প্রতিস্থাপন করেন। তিনি নিজ দেশ থেকে একটি কর্নিয়া এনে জাতীয় সন্ধানী চক্ষু হাসপাতালে টুনটুনি নামের এক শিশুর চোখে প্রথম প্রতিস্থাপন করেন। প্রতিষ্ঠার পর সন্ধানী চক্ষু হাসপাতালে ৩৯ হাজার ৫৬৯টি কর্নিয়া দানে প্রতিশ্রুতি পাওয়া গেছে। এর মধ্যে ৮ হাজার কর্নিয়া প্রতিস্থাপন করা হয়েছে।
সন্ধানী জাতীয় চক্ষুদান সমিতির সাবেক ভাইস প্রেসিডেন্ট অধ্যাপক জয়নাল আবেদিন সমকালকে বলেন, সারাহ ইসলামের মরণোত্তর দেহদানের পর মানুষের মনোভাবের পরিবর্তন এসেছে। অনেকেই মরণোত্তর দেহদানের জন্য অঙ্গীকার করছেন। আবার যাঁরা অঙ্গীকার করেন, তাঁদের মৃত্যুর পর সবার মরদেহ পাওয়া যায় না। কারণ, তাঁদের ছেলেমেয়েরা হয়তো চান না। আমাদের মৃত্যুর খবর না জানালে তো আমরা জানব না। আর আমরা মরদেহ সংগ্রহ করি না। আমাদের কাছে পৌঁছে দিতে হয়।
এ ব্যাপারে বিএসএমএমইউর চক্ষুবিজ্ঞান বিভাগের ডা. রাজশ্রী দাশ সমকালকে বলেন, দেশে সবচেয়ে বেশি কর্নিয়া প্রতিস্থাপন করা হয়। শুধু কর্নিয়া দেশের বাইরে থেকে নিয়ে এসে প্রতিস্থাপন সম্ভব। শ্রীলঙ্কা, নেপাল, যুক্তরাষ্ট্র থেকে বিভিন্ন সময় ব্যক্তি উদ্যোগে কর্নিয়া আনা হয়। এ প্রক্রিয়া অনেক ব্যয়বহুল। যুক্তরাষ্ট্র থেকে কর্নিয়া আনলে যাতায়াতে খরচ হয় ৭০০ থেকে ৮০০ মার্কিন ডলার। নেপাল থেকে আনলে প্রয়োজন হয় ৩০০ থেকে ৪০০ ডলার।
কাল সোমবার সকালে মরণোত্তর দেহদানে অঙ্গীকার অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি থাকবেন তথ্যমন্ত্রী হাছান মাহমুদ। ওই অনুষ্ঠানে বিএসএমএমইউর উপাচার্য অধ্যাপক ডা. মো. শারফুদ্দিন, ইউরোলজি বিভাগের অধ্যাপক ডা. হাবিবুর রহমান দুলাল, সারাহ ইসলামের মা শবনম সুলতানা, অঙ্গ প্রতিস্থাপনকারী অস্ত্রোপচার টিমের সব সদস্যের মরণোত্তর দেহদানে অঙ্গীকার করার কথা রয়েছে।
মন্তব্য করুন