ফারুক আহমেদ। গ্রামের বাড়ি কিশোরগঞ্জের ভৈরবে। কৈশোরে বন্ধুদের সঙ্গে একবার কক্সবাজার ঘুরতে যান। তারপর সেখানে বাদাম বিক্রি শুরু করেন। পরে ঢাকায় এসে এ কাজ শুরু করেন। জীবনের বেশিরভাগ সময় পার করে দিয়েছেন ফুটপাতে বাদাম বিক্রি করে। তাঁর সঙ্গে কথা বলে লিখেছেন ফরিদুল ইসলাম নির্জন

বাদাম বিক্রির কথা মাথায় এলো কীভাবে?

এলাকায় ঘুরে বেড়াতাম। সংসারে অভাব ছিল। স্কুলে যেতেও ভালো লাগত না। পরিবারের জন্য কিছু করব- এসব মাথার ভেতর ছিল না। ঘুরতে ঘুরতে জীবন পার করে দিতে চেয়েছিলাম। অভাবের পরিবারে ঘুরে বেড়ালে তো সংসার চলবে না। হঠাৎ করে বন্ধুদের সঙ্গে একবার কক্সবাজার ঘুরতে যাই। সেই ছোটবেলার কাহিনি। টাকাও ছিল না তেমন, কিন্তু ঘোরার শখ ছিল। সেখানে দেখলাম অনেকেই ফেরি করে বাদাম বিক্রি করছেন। তাঁদের কাছ থেকে বাদাম কিনলাম। আর কথা বলতে শুরু করলাম। কীভাবে বাদাম বিক্রি করেন, কত দাম, লাভ কেমন, কোন মার্কেট থেকে বাদাম আনেন- এসব জানলাম। বাদাম বিক্রির পুঁজিও কম লাগে। আমার কাছে ফেরার জন্য কিছু টাকা ছিল, আরেক বন্ধুর কাছ থেকে কিছু টাকা নিলাম। পরে সাহস করে বাদাম বিক্রি শুরু করে দিলাম। প্রথম দিন ভালোই বিক্রি হলো। পরের দিনও ভালো বিক্রি হলো। বাদাম বিক্রি করা আমার কাছে তেমন কঠিন মনে হলো না। এটি সহজ হওয়াতে কাজটা করতে থাকি। সেই থেকে বাদাম বিক্রি শুরু। জীবনে আর থামতে পারিনি।

ঢাকায় এলেন কীভাবে?

কক্সবাজারে বন্ধুদের সঙ্গে বাদাম বিক্রি শুরু করলেও কয়েক দিন পর অনেকেই চলে আসে। কিন্তু আমরা তিনজন থাকি। সেখানে চার বছরের মতো বাদাম বিক্রি করি। ভালোই চলছিল। সেখানকার এক বন্ধু ঢাকায় বাদাম বিক্রি শুরু করে। সে জানায়, ঢাকায় লাভ বেশি। কক্সবাজারে বাড়ি থেকে যাতায়াত দূরে হওয়ায় ভাবলাম ঢাকাতেই বাদাম বিক্রি শুরু করব। তখন ঢাকায় চলে আসি। তেজগাঁওয়ে বাদাম বিক্রি শুরু করি। সত্যিকার অর্থে এখানে লাভ বেশি হওয়াতে আর ফিরে যাইনি।

তখনকার সময় আর বর্তমান সময়ের মধ্যে কি কোনো পার্থক্য খুঁজে পান?

হ্যাঁ, বেশ কিছু পার্থক্য রয়েছে। আগে লাভ বেশি হতো। এখন লাভ কম। দ্বিগুণের চেয়েও বেশি দামে বাদাম কিনতে হয়, কিন্তু বিক্রি করার ক্ষেত্রে সে পরিমাণ কম দেওয়া যায় না। আপনাকে বাদাম কম দিলে বলবেন, এত কম বাদাম এই টাকায়! অনেকেই রাগ করে রেখেও যান। এখনকার জীবন অনেক কষ্টের মনে হয়। সংসার চালাতে হিমশিম খেতে হয়।

আপনার পরিবারের কে কে আছেন?

পরিবারে তিন সন্তান। ঢাকায় থাকলে সংসারের খরচ বেশি। এখন সবকিছুর দাম বেশি। তাই সংসার চালাতে হিমশিম খেতে হয়। অন্য কোনো ব্যবসা করতে তো পুঁজি লাগে। তাই সবাইকে গ্রামে রেখে এসেছি। আমি ঢাকায় থাকি। সময়-সুযোগ বুঝে বাড়ি যাই।

আপনি কোথা থেকে বাদাম কেনেন? বিক্রি করেন কোন এলাকায়?

কারওয়ান বাজার থেকে সংগ্রহ করি। কখনও কখনও পুরান ঢাকায় যাই। এই তেজগাঁওয়ে বিক্রি করেই জীবন পার করলাম। বাদাম বিক্রির প্রতি একটা মায়া জন্মেছে। এই মায়া থেকে বের হতে পারিনি। ঘর-সংসার, ছেলে-মেয়ে সব এই বাদাম বিক্রির আয় থেকেই হয়েছে। জীবনের শেষ পর্যন্ত এখানেই বাদাম বিক্রি করে যেতে চাই।

বাদাম বিক্রি নিয়ে মনে রাখার মতো ঘটনা বলুন।

কত ধরনের ঘটনা জীবনে ঘটেছে। তবে একটা মজার ঘটনা বলি, যা মনে হলে এখনও হাসি পায়। আমি নতুন বিয়ে করেছি। রাতে ঘুমের ভেতর স্বপ্ন দেখি, বাদাম বিক্রি করছি। জোরে জোরে বলছি, 'এই বাদাম নেবেন, এই বাদাম নেবেন।' আমার বউয়ের হাসতে হাসতে অবস্থা খারাপ। আমাকে যখন ডাক দেয় তখন দেখি- আমি রুমের ভেতর, ফুটপাতে না।

সব শেষে যা বলতে চান?

জীবনের শেষের দিকে এসে একটি কথা বলতে চাই, কোনো কাজকে ছোট করে দেখা উচিত না। পরিবারকে সবার টাকা জোগান দেওয়া উচিত। শুধু পরিবার থেকে টাকা নেব না, তাদের দেবও- এমন প্রতিজ্ঞা করা উচিত। যে কোনো কাজকে সহজ করে দেখলেই সহজ হয়ে যায়। এই সহজের মধ্য দিয়ে টাকা আয় করা যায়। আপনাদের সঙ্গে কথা বলে পুরোনো দিনের বাদাম বিক্রির কথা মনে পড়ল। চোখের সামনে সব ভাসছে। আপনাদের ধন্যবাদ, সেই দিনের কথা মনে করে দেওয়ার জন্য।