
বাংলাদেশের সামগ্রিক উন্নয়নের চিত্রটি জিডিপি, মাথাপিছু আয়ের মতো সামষ্টিক অর্থনৈতিক সূচকে দৃশ্যমান এবং সংক্রামক রোগের প্রাদুর্ভাব হ্রাসেও উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি দেখা যায়। কিন্তু অসংক্রামক রোগে মৃত্যুহার ভয়াবহ আকারে বাড়ছে। বিশেষত হৃদরোগ, উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিস, ক্যান্সারের মতো প্রাণঘাতী রোগে আক্রান্ত হচ্ছে কোটি মানুষ।
করোনাভাইরাস সংকট মোকাবিলা করেও বিগত অর্থবছরে উল্লেখযোগ্য হারে প্রবৃদ্ধি অর্জনে বাংলাদেশ সারাবিশ্বে প্রশংসিত হয়েছে। জনগণ উন্নয়নের সুফল ভোগ করছে, তবে কার্যকর উদ্যোগের অভাবে তাদের স্বাস্থ্য সুরক্ষা হুমকির মুখে। এই স্বাস্থ্যঝুঁকির প্রধান কারণ তামাক ও তামাকজাত পণ্যের যথেচ্ছ ব্যবহার। বিশ্বে সর্বোচ্চ তামাক ব্যবহারকারী দেশগুলোর তালিকায় বাংলাদেশ আছে প্রথম ১০টির মধ্যে। তামাক ব্যবহারে জনগণ অসংক্রামক রোগে আক্রান্ত হচ্ছে এবং এর ফলে তাদের চিকিৎসা বাবদ বিপুল পরিমাণ অর্থ সরকারকে ব্যয় করতে হচ্ছে। নাগরিকদের নিজেদের পকেট থেকেও টাকা খরচ হচ্ছে। ফলে তামাক ব্যবহারের ব্যাপকতায় আমাদের অর্থনৈতিক ক্ষতিও হচ্ছে বিপুল পরিমাণ।
দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশে তামাক ব্যবহারের হার সবচেয়ে বেশি (৩৫.৩%, গ্যাটস ২০১৭)। তামাক ব্যবহারজনিত রোগে বাংলাদেশে প্রতি বছর প্রায় ১ লাখ ৬১ হাজার মানুষ মৃত্যুবরণ করে। ২০১৭-১৮ অর্থবছরে তামাক ব্যবহারের অর্থনৈতিক ক্ষতির (চিকিৎসা ব্যয় এবং উৎপাদনশীলতা হারানো) পরিমাণ ছিল ৩০ হাজার ৫৬০ কোটি টাকা।
তামাক ব্যবহার নিরুৎসাহিত করার জন্য কর বৃদ্ধির মাধ্যমে তামাকপণ্যের মূল্যবৃদ্ধি একটি আন্তর্জাতিকভাবে অনুসৃত পদ্ধতি। কিন্তু বাংলাদেশের বর্তমান তামাক কর কাঠামো তামাক ব্যবহার কমাতে কার্যকর প্রভাব রাখতে পারছে না। কার্যকরভাবে করারোপের অভাবে বাংলাদেশে তামাকপণ্য অত্যন্ত সস্তা এবং সহজলভ্য হয়ে যাচ্ছে। সিগারেটের চারটি স্তর থাকার ফলে সিগারেট ব্যবহারকারী তা ছেড়ে দেওয়ার পরিবর্তে তুলনামূলক কম দামি সিগারেট বেছে নেওয়ার সুযোগ পাচ্ছে।
এ অবস্থায় প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা বাস্তবায়ন এবং তামাকের নেতিবাচক প্রভাব থেকে জনস্বাস্থ্য সুরক্ষার নিমিত্তে আসন্ন ২০২৩-২৪ অর্থবছরের বাজেটে তামাকবিরোধী সংগঠন, অর্থনীতিবিদ, জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ এবং সুশীল সমাজের পক্ষ থেকে তামাক কর ও মূল্যবৃদ্ধির জন্য সুনির্দিষ্ট প্রস্তাবনা করা হয়।
সব সিগারেট ব্র্যান্ডে অভিন্ন করভারসহ (সম্পূরক শুল্ক চূড়ান্ত খুচরা মূল্যের ৬৫%) মূল্যস্তরভিত্তিক সুনির্দিষ্ট এক্সাইজ (সম্পূরক) শুল্ক প্রচলন করা অর্থাৎ নিম্নস্তরে প্রতি ১০ শলাকা সিগারেটের খুচরা মূল্য ৫৫ টাকা নির্ধারণ করে ৩৫ দশমিক ৭৫ টাকা সুনির্দিষ্ট সম্পূরক শুল্ক আরোপ; মধ্যম স্তরে প্রতি ১০ শলাকা সিগারেটের খুচরা মূল্য ৭০ টাকা নির্ধারণ করে ৪৫ দশমিক ৫০ টাকা সুনির্দিষ্ট সম্পূরক শুল্ক আরোপ; উচ্চস্তরে প্রতি ১০ শলাকা সিগারেটের খুচরা মূল্য ১২০ টাকা নির্ধারণ করে ৭৮ টাকা সুনির্দিষ্ট সম্পূরক শুল্ক আরোপ এবং প্রিমিয়াম স্তরে প্রতি ১০ শলাকা সিগারেটের খুচরা মূল্য ১৫০ টাকা নির্ধারণ করে ৯৭ দশমিক ৫০ টাকা সুনির্দিষ্ট সম্পূরক শুল্ক আরোপ করা।
জর্দা এবং গুলের কর, মূল্যবৃদ্ধিসহ সুনির্দিষ্ট এক্সাইজ শুল্ক (সম্পূরক শুল্ক চূড়ান্ত খুচরা মূল্যের ৬০%) প্রচলন করা, অর্থাৎ প্রতি ১০ গ্রাম জর্দার খুচরা মূল্য ৪৫ টাকা নির্ধারণ করে ২৭ টাকা সুনির্দিষ্ট সম্পূরক শুল্ক আরোপ এবং প্রতি ১০ গ্রাম গুলের খুচরা মূল্য ২৫ টাকা নির্ধারণ করে ১৫ টাকা সুনির্দিষ্ট সম্পূরক শুল্ক আরোপ করা।
২০২৩-২৪ অর্থবছরের বাজেটে তামাকপণ্যে করারোপে উল্লিখিত প্রস্তাবগুলো বাস্তবায়ন করা হলে শুধু সিগারেট খাত থেকেই প্রায় ৪২ হাজার ৩০০ কোটি টাকা রাজস্ব আয় হবে, যা আগের বছরের তুলনায় প্রায় ৩০ শতাংশ বেশি। এ ছাড়া প্রায় ১৪ লাখ প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ ধূমপান থেকে বিরত থাকতে উৎসাহিত হবে; ১০ লাখ তরুণ ধূমপান শুরু করতে নিরুৎসাহিত হবে এবং দীর্ঘমেয়াদে প্রায় ১০ লাখ জনগোষ্ঠীর তামাক ব্যবহারজনিত অকালমৃত্যু রোধ করা সম্ভব হবে। এটি সুস্পষ্টভাবে সরকার ও জনগণ উভয়ের জন্যই লাভজনক। সর্বোপরি এটি ২০৪০ সালের মধ্যে তামাকমুক্ত বাংলাদেশ গড়ার ক্ষেত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ হবে বলে বিশ্বাস করি।
ডা. মো. শাহ আলম: বিভাগীয় প্রধান, অর্থোপেডিকস, ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল
মন্তব্য করুন