রিসেপ তায়েপ এরদোয়ান তুরস্কের প্রেসিডেন্ট হিসেবে আবারও পাঁচ বছরের জন্য নির্বাচিত হয়েছেন। তিনি তাঁর মেয়াদ পূর্ণ করতে পারলে একটানা ২৬ বছর ক্ষমতায় থাকবেন। অর্থাৎ একুশ শতকে তুর্কি ইতিহাসের প্রায় পুরোটাতে থাকছেন তিনি। আশ্চর্যের বিষয় হলো, তুরস্কের অধিকাংশ মানুষ দেশটির অর্থনৈতিক দুরবস্থা, ব্যাপক মূল্যস্ফীতি সত্ত্বেও এরদোয়ানকে নির্বাচিত করেছে। তাই এরদোয়ান কীভাবে নির্বাচনে জয়লাভ করলেন; এবং আরও গুরুত্বপূর্ণ– দেশটির ভবিষ্যৎ কী হতে যাচ্ছে তা নিয়ে আলোচনা করা দরকার। 

তুরস্কের নির্বাচনটি অবাধ হয়েছে এই অর্থে যে, রাজনৈতিক দলগুলো তাদের প্রার্থীদের মনোনয়ন দিতে এবং তারা স্বাধীনভাবে প্রচারণা চালাতে পেরেছে। প্রতিটি ভোটকেন্দ্রে রাজনৈতিক দলগুলো এজেন্ট দিয়েছে এবং ভোটাররাও স্বাধীনভাবে ভোট দিতে পেরেছে।

তবে নির্বাচনটিকে সুষ্ঠু বলা যাবে না। নির্বাচনের সম্ভাব্য প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী ছিলেন একরাম ইমামোগলু। গত ডিসেম্বরে ‘তুর্কি কর্মকর্তাদের অপমান করা’র অভিযোগে তাঁকে দুই বছরেরও বেশি সময়ের জন্য কারাদণ্ডে দণ্ডিত করা হয়েছিল। ইমামোগলু ইস্তাম্বুলের জনপ্রিয় মেয়র ছিলেন, যিনি ২০১৯ সালে এরদোয়ানের দলকে পরাজিত করে মেয়র পদে জয়লাভ করেন। জরিপে দেখা গিয়েছিল, প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে তিনি এরদোয়ানের বিপরীতে সহজে জয়লাভ করতে পারতেন। কেউ কেউ বলছেন, আদালতের রায় ছিল রাজনৈতিকভাবে প্রভাবিত। ইমামোগলু না থাকায় বিরোধীরা কিলিচদারোগলুর নেতৃত্বে একত্রিত হয়েছিল, যিনি বলা চলে এরদোয়ানের মতো হাইপ্রোফাইল প্রার্থীর তুলনায় দুর্বল।

তুরস্কের সংবাদমাধ্যমের ওপর এরদোয়ানের প্রায় সর্বব্যাপী প্রভাব রয়েছে, যা প্রেসিডেন্টের প্রাসাদের মিডিয়া ও যোগাযোগ বিভাগের প্রধান ফাহরেদ্দিন আলতুনের মাধ্যমে তৈরি। তুর্কি সংবাদমাধ্যমগুলো হয় সরাসরি এরদোয়ানের আত্মীয়দের মালিকানাধীন, যেমন জনপ্রিয় সাবাহ সংবাদপত্রের মালিকানায় রয়েছেন সাদাত আলবায়রাক, অথবা আলতুন দ্বারা নিযুক্ত ও নিরীক্ষিত ব্যবস্থাপনা সম্পাদকদের মাধ্যমে নিয়ন্ত্রিত। কিছু স্বাধীন ইন্টারনেটভিত্তিক খবরের সাইট যেমন টি-টোয়েন্টিফোর টিকে থাকার জন্য স্ব-আরোপিত সেন্সরশিপ অনুশীলন করে।

সংবাদমাধ্যমের ওপর ব্যাপক নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে এরদোয়ান এবং তাঁর সমর্থকরা টেলিভিশনে তাঁকে নিয়ে বেশি সময় দেওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করেছে। বিমানবন্দর, সড়ক ও সেতু নির্মাণের মাধ্যমে তুরস্ককে এগিয়ে নেওয়ায় টেলিভিশনে এরদোয়ানকে একজন বিশ্বনেতা হিসেবে দেখানো হয়। তিনি টিভিতে কয়েক ডজন সাংবাদিকের সামনে সাক্ষাৎকার দেন, কিন্তু সব প্রশ্ন আগেই প্রস্তুত করা এবং এরদোয়ান সেভাবেই তার উত্তর দেন।

এরদোয়ানের প্রতিদ্বন্দ্বী কিলিচদারোগলুর বিরুদ্ধে আলতুন মর্যাদাহানিকর প্রচারণা চালিয়েছেন বলে অভিযোগ। বিরোধী নেতা টিভিতে কম সময় পেয়েছিলেন। আলতুন শুধু প্রচলিত টিভি চ্যানেল এবং প্রিন্ট মিডিয়া নয়; সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমও নিয়ন্ত্রণ করে। যার প্রভাব স্পষ্ট। উল্লখযোগ্যসংখ্যক ভোটার এসব প্রচারণায় বিভ্রান্তিতে পড়ে এবং তারা ভেবেছে, কিলিচদারোগলু নির্বাচিত হলে তুরস্কের পরণতি আরও খারাপ হবে।

তুরস্কে যে পরিস্থিতি চলছে তাতে সেখানে সরকার পরিবর্তন জরুরি ছিল। সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সংকট আরও তীব্র হচ্ছে। এরদোয়ান ২০২৩ সালের মধ্যে তুরস্ককে পুনর্জীবিত করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন এবং এই বছরই তুরস্কের প্রজাতন্ত্রের একশ বছর পালিত হচ্ছে। এই সময়ের মধ্যে তুরস্ক বিশ্বের ১০টি শীর্ষ অর্থনীতির দেশের তালিকায় প্রবেশ করার কথা। কিন্তু বিশ্বে ১৯তম অর্থনীতির দেশটি বর্তমানে অর্থনৈতিক দিক থেকে শীর্ষ ২০-এও নেই। দেশটির অর্থনীতি গত তিন বছরে ভয়াবহ মন্দার সম্মুখীন। তুর্কি মুদ্রা লিরার মূল্য হ্রাস পেয়েছে, যা একটি ডলারভিত্তিক অর্থনীতির দিকে পরিচালিত করেছে।

তবে ডলার উপার্জন সহজ নয়। তুরস্কের কেন্দ্রীয় ব্যাংক নির্বাচনের জন্য গত কয়েক মাসে রিজার্ভ খালি করে অর্থনীতিকে ভাসমান রেখেছে। বর্তমানে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রতি মাসের ঘাটতি ৮ থেকে ১০ বিলিয়ন ডলার। গত সপ্তাহে তুরস্কের রিজার্ভ এমন পর্যায়ে নেমে গেছে, যেমনটি ২০০২ সালের পর আর ঘটেনি। সে জন্য এরদোয়ানকে অর্থের খোঁজ করতে হবে। স্বাভাবিকভাবেই তাঁকে উচ্চ সুদে বিদেশি ঋণ নিতে হবে। তেলসমৃদ্ধ মুসলিম দেশগুলো যাতে তুরস্ককে কিছু তহবিল দেয়, সে জন্য তিনি তাদের আকৃষ্ট করতে কূটনৈতিক প্রচেষ্টা শুরু করবেন। এই প্রচেষ্টা কতটা সফল হবে এবং তাদের সম্ভাব্য স্বল্পমেয়াদি লাভের কারণে তুরস্ক অর্থনৈতিক মন্দার মধ্যে পড়বে কিনা, তা নিয়ে অনিশ্চয়তা রয়েই গেছে।

বৈদেশিক নীতির দিক থেকে এরদোয়ান ন্যাটো, ইউরোপীয় ইউনিয়ন এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে মুক্ত থেকে স্বাধীন একটি আঞ্চলিক শক্তি হওয়ার চেষ্টা চালিয়ে যাবেন। তিনি রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের সঙ্গে তুরস্কের সম্পর্ক জোরদার করতে চেষ্টা করবেন, যা তুরস্কের পশ্চিমা মিত্রদের জন্য উদ্বেগের কারণ।

তুরস্কের সংবিধান অনুসারে এটাই হবে এরদোয়ানের শেষ শাসনকাল। ৬৯ বছর বয়সী প্রেসিডেন্টের শারীরিক অনেক জটিলতা রয়েছে। সামনের দিনগুলোতে তাঁর স্বাস্থ্যের সংকট আরও বাড়তে পারে। পরিস্থিতির অবনতি হলে প্রেসিডেন্টের দায়িত্বভার বিশ্বস্ত কাউকে দিতে হবে। কিংবা তাঁর জাস্টিস অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট পার্টির (একেপি) সম্ভাব্য নেতারা এরদোয়ানের মেয়াদ শেষ হওয়ার আগেই তাঁকে ক্ষমতাচ্যুত করার জন্য একটি দলীয় অভ্যুত্থান করার সিদ্ধান্ত নিতে পারেন, যাতে তাঁরা ২০২৮ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের আগে জনসমর্থন অর্জন করতে পারেন। যদিও নির্বাচন-পরবর্তী তুরস্কে আপাতত কিছুটা রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা বিরাজ করবে, তবে অদূর ভবিষ্যতে দেশটি অর্থনৈতিক, সামাজিক এবং রাজনৈতিক অস্থিরতার মধ্যে থাকতে পারে।

মেহমেদ ওজালপ: অস্ট্রেলিয়ার চার্লস স্টুয়ার্ট ইউনিভার্সিটির শিক্ষক, এশিয়া টাইমস থেকে ঈষৎ সংক্ষেপিত ভাষান্তর মাহফুজুর রহমান মানিক