- লাইফস্টাইল
- মসলা গবেষণার দুরবস্থা
মসলা গবেষণার দুরবস্থা
উৎপাদন বৃদ্ধি করিয়া আমদানি হ্রাসকল্পে ১৯৯৬ সালে বগুড়ায় স্থাপিত দেশের একমাত্র মসলা গবেষণা কেন্দ্রটির কার্যক্রম সম্পর্কে সংশ্লিষ্ট নীতিনির্ধারকদের ভাবনা-চিন্তার সময় আসিয়াছে বলিয়া আমরা মনে করি। অন্তত শুক্রবার প্রকাশিত সমকালের এ-সংক্রান্ত প্রতিবেদনটি ইহাই প্রতীয়মান। গবেষণা কেন্দ্রটির সরবরাহকৃত তথ্য উদ্ধৃত করিয়া প্রতিবেদনে বলা হইয়াছে, ২০০০ সাল হইতে গবেষণার মাধ্যমে উৎপাদন শুরুর পর প্রতিষ্ঠানটি অদ্যাবধি ১৫৬টি মসলা ফসলের প্রযুক্তি ও ৫১টি জাত উদ্ভাবন করিয়াছে। কিন্তু কৃষকরা এই জাতগুলির মধ্যে বিশেষত পেঁয়াজ, রসুন ও হলুদ চাষে উৎসাহ প্রদর্শন করিলেও আদা চাষে তেমন আগ্রহ দেখাইতেছে না। এমনকি এলাচ, জিরা, ও দারচিনি চাষ হইতেছে না বলিলেই চলে। এমতাবস্থায় বিশেষত শেষোক্ত চারটি মসলার আমদানি ক্রমান্বয়ে বৃদ্ধি পাইতেছে। ফলস্বরূপ দেশ হইতে বাহির হইয়া যাইতেছে কষ্টার্জিত মহামূল্যবান বৈদেশিক মুদ্রা।
মসলা গবেষণা কেন্দ্রের তথ্যানুযায়ী– পেঁয়াজ, রসুন ও আদা ব্যতীত দেশে বৎসরে মসলার মোট চাহিদা ৫৮ লক্ষ ৫০ সহস্র টন। তন্মধ্যে আমদানি হয় প্রায় ৪৫ লক্ষ টন। প্রায় সাড়ে ১৩ লক্ষ টন ঘাটতি পূরণের পন্থা সম্পর্কে প্রতিষ্ঠানটি কিছু না বলিলেও, ইহা এক প্রকার ওপেন সিক্রেট যে, এই চাহিদার প্রায় পুরোটাই আসে বিশেষত পার্শ্ববর্তী ভারত হইতে চোরাচালানের মাধ্যমে। কারণ এ সকল মসলার চাষ দেশে অত্যন্ত সীমিত পরিসরে হয় বলিয়া সকলেই জানে। ইহাও অত্যুক্তি হইবে না, পেঁয়াজের চাষ দেশে ইদানীং বৃদ্ধি পাইলেও বাৎসরিক চাহিদার একটা উল্লেখযোগ্য অংশ আমদানি করিতে হয়। নতুবা অতি প্রয়োজনীয় মসলাটির বাজার বল্গাহীন হইয়া যায়, যেমনটা ইদানীং পরিলক্ষিত হইতেছে। উৎপাদন আশানুরূপ না হইবার কারণে রসুন ও আদার অধিকাংশ চাহিদাও পূরণ হয় আমদানির মাধ্যমে। অভিজ্ঞতা বলে, অন্যান্য খাদ্যপণ্যের তুলনায় বিশ্বপরিসরে অধিকতর অস্থির হইল মসলার বাজার; যাহার প্রভাব স্বাভাবিকভাবেই অভ্যন্তরীণ বাজারে পড়ে। বিশেষত ঈদসহ বিভিন্ন অনুষ্ঠান ঘিরিয়া দেশে যখন পণ্যসমূহের চাহিদা বৃদ্ধি পায়। বিষয়টা বুঝিবার জন্য কোনো গবেষণার প্রয়োজন নাই, বর্তমান মসলার অভ্যন্তরীণ বাজারের দিকে দৃষ্টিপাত করিলেই চলিবে। আসন্ন ঈদুল আজহা সামনে রাখিয়া ইতোমধ্যে প্রতি কেজি পেঁয়াজের মূল্য ৭০-৮০ টাকায় উঠিয়াছে; ২৫০-৩০০ টাকার নিম্নে আদা-রসুন মিলিতেছে না; জিরার কেজি ৫০০ টাকা স্পর্শ করিয়াছে।
মনে রাখিতে হইবে, বাঙালির রসনাবিলাসে মসলা অপরিহার্য উপাদান। বিশেষজ্ঞরাও পরিমিত পরিমাণ মসলা মানবদেহের সুস্থতার জন্য জরুরি বলিয়া মনে করেন। তাঁহাদের মতে, দৈনিক একজন পূর্ণ বয়স্ক মানুষের মরিচ, পেঁয়াজ, রসুন, আদা ও হলুদ– এ প্রধান পাঁচটি মসলা অন্তত ৩৮ গ্রাম খাওয়া প্রয়োজন। কিন্তু দেশে দৈনিক মাথাপিছু মাত্র ৮ গ্রাম মসলার চাহিদা পূরণ হয়। এমতাবস্থায় মসলার উৎপাদন বৃদ্ধির কোনো বিকল্প নাই, বিশেষত পূর্বে যেমনটা বলা হইয়াছে– মসলার বিশ্ববাজারের প্রায় চিরস্থায়ী অস্থিরতার পরিপ্রেক্ষিতে। আর এখানেই স্বল্প সময়ে অধিক উৎপাদনের লক্ষ্যে মসলা গবেষণার গুরুত্ব স্পষ্ট হইয়া যায়। কিন্তু বগুড়ার মসলা গবেষণা কেন্দ্র উদ্ভাবিত আদা চাষে সময় লাগে প্রায় ১০ মাস। উহাদের উদ্ভাবিত জিরা, দারচিনি, এলাচসহ অনেক মসলার জাত দেশের অধিকাংশ অঞ্চলের মাটি ও আবহাওয়ার উপযোগী নহে। জলবায়ু পরিবর্তনও মসলা চাষে বড় প্রতিবন্ধক বলিয়া বিশেষজ্ঞগণ মনে করেন।
মসলা গবেষণা কেন্দ্রের মুখ্য বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা বলিয়াছেন, গবেষণা কেন্দ্রে বিশাল পরিসরে গবেষণা পরিচালনার জন্য বিজ্ঞানীর সংখ্যা অপ্রতুল। দক্ষতা বাড়াইতে ফেলোশিপ ও উচ্চতর প্রশিক্ষণের ব্যবস্থাও নাই; বিষয়টা নিঃসন্দেহে হতাশাজনক। তবে পরিস্থিতি যে রূপ ধারণ করিয়াছে, উহাতে কোনো টোটকা মসলা গবেষণা ও চাষে কাঙ্ক্ষিত উন্নতি ঘটাইতে পারিবে বলিয়া মনে হয় না। এ জন্য সরকারকে অবিলম্বে উপযুক্ত বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ লইয়া গবেষণা কেন্দ্রটিকে ঢালিয়া সাজাইতে হইবে; তৎসহিত পর্যাপ্ত সহযোগিতা ও নজরদারি নিশ্চিতকরণ জরুরি।
মন্তব্য করুন