- লাইফস্টাইল
- ‘বিএনপির’ রূপনে পাল্টাচ্ছে ভোটের হিসাবনিকাশ
বরিশাল সিটি নির্বাচন
‘বিএনপির’ রূপনে পাল্টাচ্ছে ভোটের হিসাবনিকাশ

বরিশাল সিটি করপোরেশনের মেয়র নির্বাচনে স্বতন্ত্র প্রার্থী কামরুল আহসান রূপন সপ্তাহখানেক আগেও আলোচনায় ছিলেন না। কিন্তু ভোটের প্রচার শুরুর পর বিএনপির প্রয়াত মেয়র আহসান হাবিব কামালের এই ছেলে গুরুত্বপূর্ণ ফ্যাক্টর হয়ে উঠেছেন। বিএনপি বর্জন করলেও দলের কর্মী-সমর্থকদের ভোট পেতে নিজেকে জাতীয়তাবাদী শক্তির প্রার্থী হিসেবে তুলে ধরে মেয়র পদের লড়াইকে বহুমুখী করে তুলেছেন রূপন। তবে বরিশালের বিএনপি নেতারা তাঁর ঘোর বিরোধী। নৌকাকে হারাতে ধানের শীষের ভোট পাওয়ার আশায় থাকা চরমোনাইয়ের পীরের হাতপাখাও বিপাকে রূপনের টেবিল ঘড়ির কারণে। পরীক্ষায় পড়েছে নৌকাও।
বরিশাল শহরে নিজস্ব ভোট রয়েছে চরমোনাই পীরের নেতৃত্বাধীন ইসলামী আন্দোলনের। নির্বাচনে বিএনপি না থাকায় ধারণা ছিল, আওয়ামী লীগের নৌকার প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী হবে হাতপাখা। বিএনপির ভোট পেলে জয় নিশ্চিত– এ সমীকরণে নৌকাকে হারাতে কোমর বেঁধে মাঠে নামে চরমোনাইয়ের পীর পরিবার। কিন্তু বিএনপি অধ্যুষিত এলাকা হিসেবে পরিচিত বরিশাল শহরের ভোটে প্রয়াত বাবার ঘড়ি প্রতীক নিয়ে নির্বাচনে নেমে হিসাব জটিল করে দিয়েছেন সাবেক ছাত্রদল নেতা রূপন।
রূপনের বিরোধিতা করা বিএনপি নেতারা প্রকাশ্যে দাবি করছেন, দল নির্বাচন বর্জন করায় ধানের শীষের ভোটাররা কেন্দ্রেই যাবেন না। বরিশাল অঞ্চলের বিএনপির নিয়ন্ত্রক হিসেবে পরিচিত দলের যুগ্ম মহাসচিব মজিবর রহমান সরোয়ার সমকালকে বলেছেন, বর্তমান বা সাবেক যে নেতাই ভোটে যাবেন, বহিষ্কার হবেন। বিএনপি নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবিতে আন্দোলনে রয়েছে। যারা আন্দোলনে নেই, তারা বিএনপি সমর্থকদের ভোট পাবে না।
তবে বরিশাল বিএনপির একাধিক নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে সমকালকে বলেছেন, দলের অনেক নেতা কাউন্সিলর প্রার্থী হওয়ায় কর্মী-সমর্থকরা ভোটকেন্দ্রে যাবেন। বিকল্প না থাকায় তাঁরা রূপনকেই ভোট দিতে পারেন। কারণ, স্থানীয়ভাবে চরমোনাইয়ের সঙ্গে বিএনপির বিরোধ রয়েছে। আবার নৌকায় ভোট দেবেন না বিএনপির কর্মী-সমর্থকরা। জাতীয় পার্টির প্রার্থী ইকবাল হোসেন ভোটের মাঠে পিছিয়ে থাকায় লাঙ্গলে ভোট দিয়ে নৌকা ঠেকানো প্রায় অসম্ভব।
ঘড়ি বা হাতপাখা– যে প্রতীকই বিএনপি সমর্থকদের ভোট একচেটিয়া পাবে, নৌকার বিরুদ্ধে তার জয়ের সম্ভাবনা তত বেশি বলে অভিমত বিএনপি নেতাদের। ভোট ভাগ হলে লাভ নৌকার। নৌকার মেয়র প্রার্থীর নির্বাচন পরিচালনার সঙ্গে যুক্ত আওয়ামী লীগ নেতারা বলছেন, রূপনের একটি ভোট বাড়লে, হাতপাখার একটি কমবে। তবে এতে বিপদ কমছে না। কারণ, আগে লড়াই নৌকা ও হাতপাখার মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল। ঘড়ি যোগ হওয়ায় অঙ্ক জটিল হয়েছে। বিএনপির সমর্থকরা একজোট হয়ে ঘড়িতে ভোট দিলে নৌকার জেতা কঠিন হবে।
তবে নৌকার মেয়র প্রার্থীর নির্বাচন পরিচালনা কমিটির সদস্য মীর আমিন উদ্দিন মোহন এমন আশঙ্কা নাচক করে দেন। তিনি সমকালকে বলেছেন, নগরে বিএনপির বড় ভোট ব্যাংক আছে। কিন্তু রূপনের বাবা ছিলেন আওয়ামী লীগের ‘গৃহপালিত’ মেয়র। রূপন বিএনপির কিছু ভোট পেলেও নৌকার ক্ষতি করতে পারবেন না।
আওয়ামী লীগ নেতারা এ দাবি করলেও বাস্তবে রূপনকে ক্ষমতাসীন দল প্রতিদ্বন্দ্বী ভাবছে। এর প্রমাণ তাঁর সমর্থকদের পুলিশ দিয়ে হয়রানির অভিযোগ। সেই তুলনায় নির্বিঘ্নে প্রচার চালাচ্ছে হাতপাখা।
আওয়ামী লীগের গৃহবিবাদও চরমে। মেয়র সেরনিয়াবাত সাদিক আবদুল্লাহকে বাদ দিয়ে ক্ষমতাসীন দল প্রার্থী করেছে তাঁর চাচা আবুল খায়ের আবদুল্লাহকে (খোকন সেরনিয়াবাত)। এখনও চাচা-ভাতিজার বিরোধ দৃশ্যমান। সাদিক আবদুল্লাহর অনুসারীরা নৌকাকে হারাতে চেষ্টা করছে বলে খোকনের নির্বাচন পরিচালনাকারীরা প্রকাশ্যেই বলছেন। তাই সাদিক অনুসারীরা ঘড়িতে ঝুঁকলে নৌকার বিপদ আরও বাড়বে।
ভোটের প্রচারে নিজেকে জাতীয়তাবাদী শক্তি ও মেয়র কামালের উত্তরসূরি হিসেবে তুলে ধরা রূপন আছেন ধানের শীষের নীরব ভোটারদের ভরসায়। তবে তাঁর পাশে বিএনপি নেতা তো দূরের কথা, চেনা পরিচিত কর্মীরাও নেই। তার পরও রূপনের দাবি, আগামী ১২ জুনের নির্বাচনে নীরব ভোটবিপ্লব হবে। বিএনপির কর্মী-সমর্থকরা একাট্টা হয়ে ঘড়িতে ভোট দেবেন।
বিএনপি ভোটে অংশ নিলে যাঁরা মেয়র পদে মনোনয়ন চাইতেন, সেই নেতারা ঘড়ির বিরুদ্ধে একাট্টা। দলে পদ না থাকলেও রূপনকে কারণ দর্শানোর নোটিশ দিয়েছে বিএনপি। রূপন সমকালকে বলেছেন, নির্বাচন থেকে সরবেন না। তাঁর দাবি, বিএনপির সমর্থকদের ৭০ ভাগ ভোট পাবেন। বিএনপি সমর্থকরা কোনো অবস্থাতেই নৌকায় ভোট দেবেন না।
রূপনের এই আত্মবিশ্বাসের কারণ বরিশালের ভোটের পরিসংখ্যান। ২০১৮ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের সেরনিয়াবাত সাদিক আবদুল্লাহ জয়ী হলেও সেবার ব্যাপক কারচুপির অভিযোগ ওঠে। এর আগে অনুষ্ঠিত তিন নির্বাচনেই আওয়ামী লীগ সমর্থিত প্রার্থীর চেয়ে বেশি ভোট পায় বিএনপি। ২০১৩ সালের নির্বাচনে বিএনপির প্রার্থী রূপনের বাবা আহসান হাবিব কামাল ৮৩ হাজার ৭৫১ ভোট পেয়ে জয়ী হন। বিপরীতে বরিশালে ব্যাপক উন্নয়ন করা আওয়ামী লীগের শওকত হোসেন হিরন পেয়েছিলেন ৬৬ হাজার ৭৪১ ভোট। এত উন্নয়নের পরও ১৭ হাজার ভোটে হিরনের হেরে যাওয়া ছিল সারাদেশে আলোচিত।
২০০৩ সালে মজিবর রহমান সরোয়ার আওয়ামী লীগ সমর্থিত এনায়েত পীর খানকে ১১ হাজার ভোটে হারান। ওই নির্বাচনে বিএনপির দুই বিদ্রোহী প্রার্থী আহসান হাবিব কামাল ২৬ হাজার এবং এবায়দুল হক চাঁন ২৪ হাজারের বেশি ভোট পান। ২০০৮ সালের নির্বাচনেও কামাল ও চাঁন প্রার্থী হলে বিএনপির ভোট ভাগ হয়। ৪৬ হাজার ৭৯৬ ভোট পেয়ে মেয়র হন শওকত হোসেন হিরন। বিএনপির আরেক নেতা শরফুদ্দিন সান্টু পেয়েছিলেন ৪৬ হাজার ২৮৯ ভোট। কামাল ও চাঁন মিলে পেয়েছিলেন ৪৬ হাজার ৪২ ভোট।
বিএনপির কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য আবু নাসের রহমতউল্লাহর দাবি, বরিশালে ধানের শীষের ভোট নৌকার দ্বিগুণ। তিনি সমকালকে বলেন, কাউন্সিলর প্রার্থীদের জন্য বিএনপির যাঁরা ভোট দিতে যাবেন, তাঁদের বড় অংশের ভোট পেতে পারেন রূপন। বাকি ভোট পাবে হাতপাখা ও লাঙ্গল।
মহানগর বিএনপির সাবেক যুগ্ম সম্পাদক আকবর হোসেন সমকালকে বলেন, কামাল ১৯৭৭ সাল থেকে পর্যায়ক্রমে পৌরসভার কমিশনার ও চেয়ারম্যান, সিটির ভারপ্রাপ্ত মেয়র ও মেয়র হয়েছিলেন। বরিশাল শহরে তাঁর অনুসারী-ভক্ত আছেন। তাঁদের ভোট রূপন পেতে পারেন। আকবরের মতে, এতে ভোটের হিসাব বদলে যেতে পারে।
তবে বিএনপি নেতারা ঘড়ির বিপক্ষে। রূপন সমকালকে বলেছেন, বিভাগীয় পর্যায়ের এক বিএনপি নেত্রী এবং মহানগরের নেতারা ঘড়িকে হারাতে কলকাঠি নাড়ছেন। ওই নেত্রীর শ্বশুরবাড়ির লোকজন নৌকার প্রচার চালাচ্ছেন। মহানগরের নেতারা হাতপাখার কাছ থেকে টাকা নিয়েছেন।
তবে ইসলামী আন্দোলনের মিডিয়া সেলের সদস্য কে এম শরীয়ত উল্লাহ বলেছেন, ভোট উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া যায় না। রূপনের সঙ্গে বিএনপির কেউ নেই।
মন্তব্য করুন