
১৯২০ সালের ১৭ মার্চ। সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর অবিস্মরণীয় জন্মদিন। তাঁর অসাধারণ নেতৃত্বে দীর্ঘ স্বাধীনতা সংগ্রাম ও মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত রক্তস্নাত এই পবিত্র স্বাধীন মাতৃভূমি। বাংলা নামক ধরিত্রীর জনপদে রোপিত হলো সম্ভাবনার নিরঞ্জন দ্যোতক। জন্মেই যেন রবিঠাকুরের 'শিশুতীর্থ' কবিতার পঙ্ক্তি ধ্বনিত হলো- 'কবি দিলে আপন বীণার তারে ঝংকার, গান উঠল আকাশে-/জয় হোক মানুষের, ওই নবজাতকের, ঐ চিরজীবিতের।' সকলে জানু পেতে বসল, রাজা এবং ভিক্ষু, সাধু এবং পাপী, জ্ঞানী এবং মূঢ়-উচ্চস্বরে ঘোষণা করলে :'জয় হোক মানুষের, ওই নবজাতকের, ওই চিরজীবিতের।'
বঙ্গবন্ধুর অত্যুজ্জ্বল সামাজিক-রাজনৈতিক অভিযাত্রায় (১৯৩৪-১৯৭৫) সপ্তম শ্রেণি থেকে প্রতিটি দিনক্ষণ জীবনপ্রবাহের এক একটি অধ্যায়ের নবতর সংস্করণ। বঙ্গবন্ধু শৈশবকাল থেকেই স্বদেশি আন্দোলনের প্রত্যক্ষদর্শী হয়ে নেতাজি সুভাষ বসুর আদর্শিক চেতনায় প্রক্ষিপ্ত হলেন। গৃহশিক্ষক কাজী আবদুল হামিদ, এমএসসির সান্নিধ্যে গরিব শিক্ষার্থীদের সহযোগিতাকল্পে 'মুসলিম সেবা সমিতি'র কর্মকাণ্ডে সম্পৃক্ত হলেন এবং অকপটে সহপাঠীদের নিয়ে মুষ্টি ভিক্ষার চাল সংগ্রহ করতেন। ফুটবল, ভলিবল, হকি খেলায় পারদর্শিতা প্রদর্শনে বঙ্গবন্ধু ছিলেন অকুতোভয় খেলোয়াড়। পাশাপাশি প্রিয় পিতার মতোই আনন্দবাজার, বসুমতী, আজাদ, মাসিক মোহাম্মদী ও সওগাত পত্রিকার নিয়মিত পাঠক ছিলেন। পরে ১৯৩৮ সালে গোপালগঞ্জে বাংলার প্রধানমন্ত্রী শেরে বাংলা ও শ্রমমন্ত্রী সোহরাওয়ার্দীর আগমনকে কেন্দ্র করে বঙ্গবন্ধু নির্ভীক রাজনীতিকের উপচীয়মান চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যে ঋদ্ধ হলেন। ব্রতী হলেন দেশমাতৃকার মুক্তির স্বপ্নে বিভোর আত্মত্যাগের মহান দৃষ্টান্ত স্থাপনে বৈদগ্ধ চারণ। মিঞা মুজিবুর রহমান রচিত 'জাতির জনকের নেতৃত্বে মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতা' গ্রন্থে ১৯৭০ সাল থেকে ২০ বছর বাংলাদেশে বসবাসকারী জেমস জে নোভাকের একটি উদ্ধৃতি প্রণিধানযোগ্য- 'শেখ মুজিব রাজনৈতিক পরিবেশে এক ধরনের তাৎক্ষণিকতা নিয়ে আসেন। সূক্ষ্ণ কূটচাল অথবা খাপছাড়া পদক্ষেপ নিয়ে তিনি জনগণকে ক্লান্ত করতেন না। সরকারি পদের প্রতি তাঁর কোনো মোহ ছিল না। তাঁর উত্থানের সময় থেকে স্বাধীনতা যুদ্ধ শুরুর দিনে তাঁকে গ্রেপ্তার করা পর্যন্ত সবাই জানত এবং বুঝত, তিনি স্বাধীনতার পক্ষেই কথা বলেছেন।'
১৯৫৫ থেকে ১৯৭১ পর্যন্ত প্রতিটি সাল বাংলার স্বাধীনতার ইতিহাসে অচ্ছেদ্য অধ্যায়ের সাক্ষ্য বহন করে। রাজনৈতিক সংগ্রাম, 'মুসলিম' শব্দ প্রত্যাহার করে শুধু 'আওয়ামী লীগ' নামকরণ, কোয়ালিশন সরকারের শিল্প-বাণিজ্য-শ্রম-দুর্নীতি দমন ও ভিলেজ-এইড দপ্তরের মন্ত্রিত্ব গ্রহণ এবং দলীয় সিদ্ধান্ত অনুসারে দলকে সুসংগঠিত করার লক্ষ্যে মন্ত্রিসভা থেকে পদত্যাগ, দীর্ঘ সময় কারাবরণ, 'স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী পরিষদ' গঠন, সর্বদলীয় সংগ্রাম পরিষদ গঠন, সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা প্রতিরোধ কমিটি গঠন, ঐতিহাসিক ছয় দফা উপস্থাপন, আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা ও কারামুক্তি, 'বঙ্গবন্ধু' উপাধিতে ভূষিত, নির্বাচনে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন, ৭ মার্চের ভাষণ ও স্বাধীনতা ঘোষণা, বঙ্গবন্ধুকে রাষ্ট্রপতি করে বিপ্লবী সরকার গঠন, নয় মাসের মহান মুক্তিযুদ্ধে ৩০ লাখ শহীদ ও দুই লাখ জননী-জায়া-কন্যার সর্বোচ্চ ত্যাগের বিনিময়ে ১৬ ডিসেম্বর বিজয় অর্জনের মাধ্যমে স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠায় বঙ্গবন্ধুর আজীবনের লালিত স্বপ্নের সফল বাস্তবায়ন স্বাধীনতা অর্জনের একটি যুগান্তকারী পর্বের পরিসমাপ্তি ঘটে। শুরু হয় অর্থনৈতিক মুক্তির অর্থবহ স্বাধীনতা সংগ্রামের দ্বিতীয় পর্ব। বঙ্গবন্ধুর জীবন-সমাজ-রাষ্ট্র-শিক্ষা-উন্নয়ন দর্শনের ন্যায়ালয় ছিল বাংলার মাটি-মানুষের ন্যায্য সুদৃঢ়তা। হৃদয় নিঙড়ানো বাঙালি জাতিসত্তাই ছিল এর নয়নাভিরাম ভিত্তি। ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি স্বীয় নেতৃত্বে সদ্য স্বাধীন দেশের মাটিতে পদার্পণ করেই ঐতিহাসিক রেসকোর্স ময়দানে অগণিত বাঙালির অশ্রুসিক্ত জনসমাবেশে নতুন করে উচ্চারণ করলেন :'আমি বাঙালি, আমি মানুষ, আমি মুসলমান, একবার মরে দুইবার মরে না। আমি বলেছিলাম, আমার মৃত্যু এসে থাকে যদি, আমি হাসতে হাসতে যাব। তোমাদের কাছে ক্ষমা চাইব না এবং যাবার সময় বলে যাব, জয় বাংলা, স্বাধীন বাংলা, বাংলা আমার ভাষা, বাংলার মাটি আমার স্থান। আজ আমি বাংলাদেশে ফিরে এসেছি। আমার ভাইদের কাছে, আমার মা'দের কাছে।
আমার বোনদের কাছে। বাংলা আমার স্বাধীন। বাংলার মানুষ আজ আমার স্বাধীন।' আধুনিক চীনের জনক 'সান ইয়াত সেন' যেমন রাষ্ট্র ও জনকল্যাণে জাতীয়তা, গণতন্ত্র ও সমাজতন্ত্রের ত্রয়নীতি ধারণ করে দেশকে অনন্য উচ্চতায় নিয়ে যাওয়ার পরিকল্পনা গ্রহণ করেছিলেন, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের পর থেকেই বাঙালি জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতার চার স্তম্ভ্ভকে প্রতিষ্ঠিত করার নিরবচ্ছিন্ন ও নিরলস কর্মযজ্ঞে নিজেকে নিবেদন করলেন। বঙ্গবন্ধুর প্রিয় ব্যক্তিত্বের অন্যতম ছিলেন বিশ্বনন্দিত প্রজ্ঞাবান জ্ঞানতাপস বার্ট্রান্ড রাসেল। ১৯১৮ সালে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের শেষ পর্যায়ে ইংল্যান্ডের মিত্র আমেরিকার বিরুদ্ধে একটি প্রবন্ধ প্রকাশের অপরাধে তিনি ছয় মাস কারারুদ্ধ হন। মানবতাবাদী বার্ট্রান্ড রাসেল 'দ্য অটোবায়োগ্রাফি' গ্রন্থের ভূমিকায় যে তিনটি শক্তিমান অনুভূতি তাঁর জীবনকে পরিচালিত করত, যেমন :প্রেমের জন্য প্রবল আকাঙ্ক্ষা, জ্ঞানের সীমাহীন অনুসন্ধিৎসা এবং আর্তমানবতার অসহনীয় মর্মবেদনা; তেমনি বঙ্গবন্ধুর মনোগত প্রচণ্ড তাড়না ক্ষুধামুক্ত, দারিদ্র্যমুক্ত, অসাম্প্রদায়িক, শোষণমুক্ত মানবিক সমাজ প্রতিষ্ঠার মনীষিত দর্শন। বঙ্গবন্ধুই প্রকৃত অর্থে স্বাধীন বাঙালি জাতি-রাষ্ট্রের শ্রেষ্ঠ রেনেসাঁ বা নবজাগরণ-মানস।
ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে সংস্কৃতির অবগাহনে বঙ্গবন্ধু অকৃত্রিম ধারণ করেছেন রবিঠাকুর, নজরুল, জসিম উদ্দীনসহ শিল্পী-সাহিত্যিক-কবি-সংস্কৃতি কর্মীদের। নির্মাণ করেছেন নতুন এক কাব্যিক-শৈল্পিক কৌশল এবং বাঙালির মনস্তত্ত্ব উপলব্ধির উদ্দীপ্ত বোধ। বঙ্গবন্ধু যথার্থই আবিস্কার করেছেন গান-কবিতা ব্যতিরেকে কোনো আস্থা বা বিশ্বাস দীর্ঘস্থায়ী হতে পারে না। পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী রবিঠাকুরের গান ও সাহিত্যকে নিষিদ্ধ করে প্রতিটি বাঙালি পরিবারেই তাঁকে স্থাপিত করেছে।
'৭২-এর ১০ জানুয়ারি ঐতিহাসিক সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে জনতার মহাসমুদ্রে দাঁড়িয়ে বঙ্গবন্ধু যুদ্ধাপরাধীদের বিচারে স্বীয় অঙ্গীকারের কথা ব্যক্ত করে বলেছিলেন, 'গত পঁচিশে মার্চ থেকে এ পর্যন্ত দীর্ঘ নয় মাসে বর্বর পাকিস্তান সেনাবাহিনী এ দেশের প্রায় সব বুদ্ধিজীবীকে হত্যা করেছে। হাজার হাজার মা-বোনের সল্ফ্ভ্রম নষ্ট করেছে। বিশ্বকে মানব ইতিহাসের জঘন্যতম কুকীর্তির তদন্ত অবশ্যই করতে হবে। একটি নিরপেক্ষ আন্তর্জাতিক ট্রাইব্যুনাল গঠন করে এসব কুকীর্তির বিচার করতে হবে।' মহান নেতা বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকী উদযাপনে পুরো জাতি অপরিসীম আবেগতাড়িত এবং বিভিন্ন সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক, সামাজিক কর্মকাণ্ড ১৭ মার্চ ২০২০ থেকে বছরব্যাপী সুচারুরূপে সম্পন্ন করার লক্ষ্যে অভূতপূর্ব সাড়া-জাগানিয়া কর্মসূচি প্রণয়ন করেছে। বিশেষ করে আগামী দিনের পথপ্রদর্শক বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলা প্রতিষ্ঠার অমিত সম্ভাবনাময় তরুণ প্রজন্ম, স্বাধীনতাকে অর্থবহ করে বঙ্গবন্ধুর মুক্তির সংগ্রাম সার্থকতার সহযাত্রী অগণিত নতুন প্রজন্মের শিশু-কিশোরের হৃদয়ে 'চেতনায় মুক্তিযুদ্ধ-প্রেরণায় বঙ্গবন্ধু', 'জয় বাংলা' জয়ধ্বনি, সভ্যতার সূচক সচকিত সত্য, সুন্দর, কল্যাণ, আনন্দধারাকে অপরাজিত করার মনীষায় ১০ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তন দিবসকে মুজিববর্ষ পালনের দিনক্ষণ ঘোষণা এক অবিনাশী প্রেরণার ব্যঞ্জনা জুগিয়েছে। নিঃসন্দেহে তা যৌক্তিক এবং অখণ্ড বিবেকপ্রসূত। শুভ হোক নন্দিত মুজিববর্ষ।
লেখক: শিক্ষাবিদ; সাবেক উপাচার্য, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়
মন্তব্য করুন