এই লেখাটি লিখতে যখন কলম ধরেছি, তখন মিডিয়ার সর্বগ্রাসী রূপ সারাবিশ্বকে কবলিত করেছে। মিডিয়ার সঙ্গে সারাজীবন সম্পৃক্ত থেকেছি; মিডিয়া বিষয়ে প্রায় তিন দশক শিক্ষকতা করেছি এবং একটা সময়ে তার জাদুকরী শতধারূপকে প্রত্যক্ষ করেছি। 'জাদুকরী শতধারূপ' কথাটি আমার নয়; সমাজতাত্ত্বিক ড. দানিয়েল লার্নারের কথা। তাঁর যুক্তি ছিল, যে কোনো সমাজে চাহিদা ও চাহিদা পূরণের মধ্যে পার্থক্য থাকল ওই সমাজে অস্থিরতা সৃষ্টি হয় এবং এখানেই বড় হয়ে ওঠে মিডিয়ার ভূমিকা। পরিবার, গোষ্ঠী, পুলিশ, রাষ্ট্রযন্ত্র, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সঙ্গে মিডিয়াও পুরোপুরি 'নো' থেকে 'আধুনিক'-এর পথে চলতে থাকা সমাজের অধিবাসীদের 'উপযুক্ত' মানসিকতা, দৃষ্টিভঙ্গি নির্মাণে সাহায্য করে। ক্রমবর্ধমান শ্রোতা-দর্শক-পাঠকের চরিত্র পরিবর্তনে মিডিয়া সহজেই মোহগ্রস্ত করতে পারে। এটাই বা জাদুকরী শতধারূপ।
দুই
বঙ্গবন্ধুর সময় এই সর্বগ্রাসী এবং জাদুকরী শতধারূপ না থাকলেও প্রকৃতপক্ষে মিডিয়ার সঙ্গে তথ্যবিন্যাসের যোগসূত্র রচিত হয়েছিল দ্বিতীয় মহাযুদ্ধোত্তর র্পবে, যখন তৃতীয় বিশ্বের বেশ কিছু দেশ একে একে সাম্রাজ্যবাদী শাসন থেকে মুক্ত হতে থাকে। কিন্তু স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে রাজনৈতিক আত্মপ্রকাশই শেষ কথা নয়। সদ্য স্বাধীন রাষ্ট্রগুলোর অর্থনৈতিক স্বনির্ভরতাও একটা বিশাল বিষয় ছিল। যার ফলে শুরু হয়ে যায় উন্নয়নের দৌড়। উন্নত বিশ্ব ও উন্নয়নশীল দেশের যে টানাপোড়েন ও দরকষাকষি, যার মূলে রয়েছে উন্নয়নের লক্ষ্য পূরণের দৌড়; এই বিষয়টির প্রতি বঙ্গবন্ধু খুবই সচেতন ছিলেন। মিডিয়াকে তিনি খুবই গুরুত্ব দিতেন, কিন্তু মিডিয়ার প্রতি তিনি মোহগ্রস্ত ছিলেন না। বর্তমানে যেমন অনেক রাজনৈতিক নেতা, এমনকি শীর্ষ বুদ্ধিজীবীদের অনেকে মিডিয়ার প্রতি মুখিয়ে থাকেন। মিডিয়ার বিলম্বে তাদের অনুষ্ঠানের বিলম্ব ঘটানো হয়, এমন ন্যক্কারজনক দৃশ্যও দেখতে হয় মিডিয়া কর্মীদের।
আগেই উল্লেখ করেছি, মিডিয়ার পরিবর্তনে যুদ্ধোত্তর পর্বের রাষ্ট্র, সমাজ ও শ্রেণিবিন্যাসের ভূমিকা এবং সৌভাগ্যবশত বঙ্গবন্ধু এই পরিবর্তনের প্রেক্ষাপটে গড়ে ওঠা একজন ব্যক্তিত্ব, যার পূর্ণ এবং সম্ভাবনাময় বিকাশ ঘটেছিল মধ্য পঞ্চাশ থেকে। আর ষাট দশকের প্রারম্ভ থেকে ওই দশকজুড়েই তিনি হয়ে উঠেছিলেন বাঙালি জাতির একক অবিসংবাদিত নেতারূপে, যা ইতিহাস-বিধৃত। আমার সৌভাগ্য হয়েছিল কর্মসূত্রে সত্তরের নির্বাচনের প্রাকলগ্ন থেকে একাত্তরের ২৫ মার্চ এবং পরবর্তী সময়ে পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্ত হয়ে ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের পর থেকে আমৃত্যু তাকে কাছে থেকে দেখা ও সংবাদ-কভারেজের বিশেষ দায়িত্ম ্বপালনের। এ সময় লক্ষ্য করেছি, তিনি আবশ্যিক অর্থেই মিডিয়ার দায়িত্ব ও গুরুত্বকে উপলব্ধি করতেন। তার বিশ্বাস ছিল- প্রয়োজনীয় তথ্য বা সংবাদের বস্তুনিষ্ঠতার গুরুত্ব কিংবা জ্ঞান সঞ্চালনের মাধমে জনসাধারণের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধি করা, আচরণ ও দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন ও তাদের প্রকৃত উন্নয়নে শামিল করাই মিডিয়ার গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব।
তিন
সত্তরের নির্বাচনের প্রাক্কালে রাজনৈতিক দলগুলোর সভা-সমিতি, নির্বাচনী প্রচারসহ কিছু বিষয়ে তৎকালীন আইনি বৈধতা বা 'খবমধষ ঋৎধসবড়িৎশ'-এর অধীনে মিডিয়াকে সংবাদ প্রচারে এক ধরনের স্বাধীনতা দেওয়া হয়েছিল। আওয়ামী লীগ তখন দেশের বৃহত্তম রাজনৈতিক সংগঠনরূপে রেডিও-টিভির সংবাদ প্রচারে মুখ্য জায়গা করে নিয়েছিল। বলা বাহুল্য, বঙ্গবন্ধুর নিজের আপামর মানুষের কাছে জনপ্রিয়তাই এর কারণ ছিল। বঙ্গবন্ধু তখন নিয়মিত সংবাদ শুনতেন। নির্বাচন-প্রাককালীন তিনি যেখানেই যেতেন জনতার ঢল নামত রেল-স্টেশনে, ফেরিঘাটে, স্টিমার ঘাটে; মাঠে-ময়দানের জনসভায় তো বটেই। এসব খবর নিয়মিত রেডিও-টেলিভিশনে প্রচারিত এবং সংবাদপত্রেও প্রকাশিত হতো। বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে তার সহকর্মী, সাথী, সহযাত্রীরা বেতার ট্রানজিস্টর রাখতেন, নিয়মিত সংবাদ শুনতেন।
দেশে টেলিভিশনের প্রসার তখন উল্লেখযোগ্য আকারে হয়নি। সবেমাত্র 'টেলিভিশন প্রমোটাস কোম্পানি' নামে পরীক্ষামূলক টেলিভিশন করপোরেশনে পরিণত হয়েছে। রামপুরায় বর্তমান টেলিভিশন কেন্দ্রের উন্মুক্ত আঙিনায় একটি শক্তিশালী নতুন ট্রান্সমিটার স্থাপনের মাধ্যমে টিভির সম্প্রচার পরিধি ১২ মাইল থেকে ৫০ মাইল পর্যন্ত উন্নীত করা হয়েছে। তবে টেলিভিশন গ্রাহকযন্ত্রের অতিমূল্য এবং ঞবৎৎবংঃৎরধষ সম্প্রচারে দূরবর্তী স্থানগুলোয় সংকেত গ্রহণে নানা প্রতিকূলতার কারণে সাধারণ্যের কাছে বেতার সম্প্রচারই প্রাধান্য পেত। এ কথা অনস্বীকার্যভাবে সত্য যে, নিম্নবিত্ত থেকে মধ্যবিত্ত, সব মানুষের কাছে স্বল্পমূল্যের রেডিও ঞৎধহংরংঃড়ৎ ব্যাপক জনপ্রিয়তা পেয়েছিল। স্মর্তব্য, সত্তরের ঐতিহাসিক নির্বাচনের সময় ও নির্বাচনোত্তর ফলাফল প্রচারে সেদিনের ঢাকা টেলিভিশন অসামান্য সফলতা পেয়েছিল। লোকজন কোথাও বাড়িতে, কোথাও বড় হলরুমে এমনকি আত্মীয়স্বজনের বাড়িতে গিয়ে সারারাত জেগে টেলিভিশন অনুষ্ঠান ও সংবাদ প্রচার দেখেছিল। এখান থেকেই ঢাকা টেলিভিশন স্টেশনের জনপ্রিয়তা বেড়ে যায়।
চার
আরও একটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা ঘটেছিল বাঙালি জাতির জীবনে। নির্বাচনের পূর্বে ১৯৭০ সালের ১২ নভেম্বর বাংলাদেশের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলীয় উপকূলে স্মরণকালের প্রলয়ংকরী ঘূর্ণিঝড়ে ১০ লাখ মানুষ প্রাণ হারিয়েছিল। গবাদি পশু, শস্য, সহায়-সম্পদ হারিয়ে কোটি কোটি মানুষ নিঃস্ব হয়েছিল। বেতার ও সংবাদপত্রে এই খবর প্রথমে আসে বিক্ষিপ্তভাবে। কেননা, উপদ্রুত এসব এলাকায় মানুষের পক্ষে যাওয়া অগম্য হয়ে উঠেছিল। তবে ঢাকা টেলিভিশনের চিত্রগ্রাহকরা জীবনপণ করে অনেক স্থানে পৌঁছেছিলেন। আমার মনে পড়ে, বাদল মির্জা নামে একজন সিনিয়র ও সাহসী ক্যামেরাম্যান ৭ দিন পর যখন উপদ্রুত এলাকা থেকে ফিরে আসেন; আমরা তার শারীরিক অবস্থা দেখে চিন্তিত হয়ে পড়েছিলাম। সেইদিন রাতে টেলিভিশনে তার গৃহীত সংবাদচিত্র প্রচার হলে সারাদেশে তোলপাড় ওঠে। বিদেশি সাংবাদিকরা বিমূঢ় হয়ে পড়ে; শঙ্কিত হয়ে পড়ে পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী।
কারণ বঙ্গবন্ধুর কাছে খবর ছিল, সেই প্রলয়ংকরী ঘূর্ণিঝড়ের আভাস নাকি দিয়েছিলেন ওয়াশিংটনভিত্তিক ওহঃবষংধঃ নামক একটি উপগ্রহের কর্মকর্তারা। কিন্তু পাকিস্তানের সামরিক জান্তা শাসকগোষ্ঠী তা আমলে নেয়নি। তারা এই পূর্বাভাস আমলে নিলে প্রাণ-সম্পদের ক্ষতি অনেকটা কম হতো। বঙ্গবন্ধু পূর্ববাংলার মানুষের প্রতি তাদের এই অবহেলা ও উপেক্ষায় গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেন। সারাদেশের মানুষ তখন ক্ষোভে ফেটে পড়েছে। বঙ্গবন্ধু জনগণের সহায়তা ও সাহায্য নিয়ে বিভিন্ন উপদ্রুত এলাকায় যান এবং নিঃস্ব মানুষের পাশে দাঁড়ান ও সাহস জোগান। তার সামনে তখন দুটি চ্যালেঞ্জ-একটি নির্ধারিত দিনে নির্বাচন অনুষ্ঠান, অন্যটি ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাসে নিঃস্ব মানুষের পাশে থেকে তাদের সেবা ও দেশের আপামর মানুষকে নির্বাচনের সপক্ষে তৈরি করা। এর একটি প্রধান কারণ ছিল মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী জাতির এই প্রাকৃতিক দুর্যোগে নির্বাচন না করার ডাক দিয়ে বঙ্গবন্ধুকে নির্বাচন না করার আহ্বান জানিয়েছিলেন। কিন্তুবঙ্গবন্ধু তার প্রজ্ঞা দিয়ে বুঝেছিলেন, নির্বাচনে না গেলে পাকিস্তানের স্বৈরশাসকরা নতুন ফন্দি করে তাদের শাসনকে আরও কায়েমি ও দৃঢ় করার চেষ্টা করবে। তিনি বরং মওলানা সাহেবকে উল্লিখিত বার্তা দিয়ে বোঝাতে চাইলেন এবং নির্ধারিত তারিখেই নির্বাচনে যাওয়ার দৃঢ় ইচ্ছা প্রকাশ করেন। বঙ্গবন্ধু তখন এই বিষয়টি অনুধাবন করে উপদ্রুত এলাকা ছাড়াও বিভিন্ন সমাবেশে নির্বাচনে যাওয়ার গুরুত্ব আরোপ করে বক্তব্য রাখা শুরু করেন। মিডিয়াও ওই সময়ে বঙ্গবন্ধুর এই ইচ্ছার কথা গুরুত্বের সঙ্গে প্রচার ও প্রকাশ করে।
পাঁচ
আমরা জানি, ১ মার্চ ১৯৭১ সালে ইয়াহিয়া খান কর্তৃক জাতীয় পরিষদের অধিবেশন স্থগিতের ঘোষণা বঙ্গবন্ধু দুপুরে দলের কার্যালয়ে বসে বেতারেই শুনেছিলেন। দলীয় কার্যালয়ের রেডিও ট্রানজিস্টর ঘিরে তাজউদ্দীন আহমদসহ অনেক সিনিয়র নেতা তার সঙ্গে ছিলেন। আমার অফিস তখনকার ডিআইটি ভবনে (রাউজক) ছিল এবং ওই দিন বেলা ৩টায় আওয়ামী লীগ পার্লামেন্টারি পার্টির একটি সভা কভার করার দায়িত্ব ছিল। সভাস্থল পূর্বাণী হোটেল হওয়ায় এবং পর্যাপ্ত সময় থাকায় আমি সকাল থেকে আমার দপ্তরের কাছে ঢাকা স্টেডিয়ামে একটি আন্তর্জাতিক ক্রিকেট খেলা দেখছিলাম। দুপুর ১টায় বেতার সংবাদে জাতীয় পরিষদের অধিবেশন স্থগিতের ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গে স্টেডিয়ামের ফেস্টুন-ব্যানার ছিঁড়ে ফেলে দলে দলে লোকজন রাস্তায় নেমে আসে। খেলা তাৎক্ষণিক পরিত্যক্ত হয়। প্রতিবাদমুখর মানুষের ঢল নামে সড়কে সড়কে। আমি পূর্বাণী হোটেলে গিয়ে দেখি, আমার আগেই একজন সিনিয়র কলিগ এজেডএম হায়দার উপস্থিত। তিনি আবার বঙ্গবন্ধুর ঘনিষ্ঠ ছিলেন এবং তার কাছে গিয়ে কিছু নির্দেশ নিলেন। সেই দিন থেকে মিডিয়া বঙ্গবন্ধুর সরাসরি ও প্রত্যক্ষ নির্দেশে চলা শুরু করল। হায়দার ভাই এর পরপরই লাহোর টিভিতে বদলি হয়ে যান। ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণের কভারেজ আমাকে একাই করতে হয়েছিল। টেলিভিশন সংবাদে সেই দিন বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ভাষণ গুরুত্বের সঙ্গে প্রচার করা হয়েছিল এবং তা করতে পেরে একজন তরুণতম সনিষ্ঠ সংবাদকর্মীরূপে অন্যান্যের সঙ্গে আমিও গর্বিত। প্রযুক্তির দিক থেকে টেলিভিশন এতটা পিছিয়ে ছিল যে, এখন আমার মনে হয়, সেই সময় আমরা টেলিভিশন-ইতিহাসের প্রস্তর যুগে বাস করতাম। আমাদের দুর্ভাগ্য, শুধু একটি ক্যামেরার সাহায্যে ম্যাগনোস্ট্রাইপ ১৬ মম ফিল্মে ভাষণের অংশবিশেষ ধারণ করা গিয়েছিল। তবে একটি জার্মান  UHER টেপ রেকর্ডারে পুরো ভাষণের শব্দ ধারণ করতে পেরেছিলাম। সেদিন টেলিভিশনের বহির্দৃশ্য সম্প্রচার প্রযুক্তি থাকলে পুরো ভাষণচিত্র ও ধ্বনিসহ প্রচার করা যেত। বেতার পুরো ভাষণ রেকর্ড করলেও ওই দিন নিষেধাজ্ঞা আরোপের কারণে প্রচার করতে পারেনি। বেতারের কর্মীরা পরের দিন কর্মবিরতির হুমকি দিয়ে কর্মবিরতিতে গেলে কর্তৃপক্ষ ৮ মার্চ পুরো ভাষণ প্রচারের অনুমতি দেয়। বেতারে এই ভাষণ প্রচারের ফলে সারা জাতি স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষায় উদ্বুদ্ধ হয়ে ওঠে। পরের ঘটনা অনেকেই জানেন না এবং তা হলো ২৫ মার্চ পর্যন্ত প্রতিদিন টেলিভিশনে রাত ৯টার সংবাদ প্রচারের পর ৩২ নম্বরে যেতাম বঙ্গবন্ধুর নির্দেশনা নিতে। যেমন আগামীকাল কী করতে হবে কিংবা বঙ্গবন্ধুর নিজস্ব কর্মসূচি ইত্যাদি বিষয়ে তার নির্দেশনা নিয়ে বেশ রাতে বাড়ি ফিরতাম। এই বিষয়ে আমি আগেই অন্যত্র লিখেছি। এমনকি বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে আমার একটি নিবেদিত কবিতাও সমকালে প্রকাশিত হয়েছে।
২৫ মার্চের কালরাতে বঙ্গবন্ধুকে গ্রেপ্তার ও পাকিস্তানে নিয়ে কারারুদ্ধ করলে তার নির্দেশে ২৫ মার্চ পর্যন্ত গৃহীত সংবাদচিত্র ও বুলেটিন পাকিস্তানি জান্তা জব্দ করে নিয়ে যায়। তার বিরুদ্ধে তথাকথিত দেশদ্রোহের সাক্ষ্য দেওয়ার জন্য ঢাকা টেলিভিশনের সেই সময়কার জেনারেল ম্যানেজার আমিরুজ্জামান খান ও কেন্দ্রীয় তথা প্যারালাল ব্যাংক চালানোর জন্য তৎকালীন বেসরকারি খাতের দুটি বাঙালি মালিকানাধীন ব্যাংক ইস্টার্ন ব্যাংকিং করপোরেশনের ব্যবস্থাপনা পরিচালক জনাব হামিদুল্লাহ ও ইস্টার্ন মার্কেন্টাইল ব্যাংক লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক হাফিজুল ইসলামকে পাকিস্তানে নিয়ে যায়। জনাব হামিদুল্লাহর স্ত্রী মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তান হানাদার বাহিনীর গুলিতে মারা যান। তিনি পরবর্তীকালে বঙ্গবন্ধুর ইচ্ছায় বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রথম গভর্নর হয়েছিলেন। তবে এরা কেউ বঙ্গবন্ধুর বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দেননি। তারা বলেছিলেন, দেশের জনগণ যে নির্দেশনায় চলছিল, রাষ্ট্রযন্ত্রকে সচল রাখার জন্য তারাও জনগণের ইচ্ছার সঙ্গে চলছিলেন।
এখানে উল্লেখ্য, পাকিস্তান আর্মি ২৫ মার্চ পর্যন্ত ফিল্ম ও বুলেটিন জব্দ করলেও মুনীর আলম মির্জা (বাদল) এবং আমার কাছে অনেক Exposed negative film রয়ে গিয়েছিল, যা আমরা যত্নের সঙ্গে গোপনে সংরক্ষণ করেছিলাম। বাদল একটি ১৬ এমএম রোলেক্স ক্যামেরা নিয়ে সীমান্ত অতিক্রম করে ভারতে গিয়ে মুক্তিযুদ্ধের অনেক মূল্যবান চিত্র ধারণ করে। দেশ স্বাধীন হলে আমাদের লুকানো সেইসব দুর্মূল্য ছবি এবং বাদলের যুদ্ধদিনের চিত্রগুলো নিয়ে আমরা যৌথ প্রচেষ্টায় 'সংগ্রাম, উজ্জীবন, স্বাধীনতা' নামে একটি প্রামাণ্য চিত্র নির্মাণ করি। ভিডিকন চেনের (Vidicon chain) সাহায্যে ২ ইঞ্চি কোয়ার্টজ টেপে ধারণ করে অতঃপর চিত্রের সঙ্গে ধারাবর্ণনা সংযোগ করে অনেকটা কষ্টকর পদ্ধতিতে এই প্রামাণ্য চিত্রটি নির্মিত হয়, যা অতি পুরোনো পদ্ধতি ও বারবার টিভি সম্প্রচার পদ্ধতি বা Format পরিবর্তনের কারণে সংরক্ষণ করা যায়নি।
ছয়
বঙ্গবন্ধু ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি স্বদেশে ফিরে এলে টিভি সংবাদের কনিষ্ঠতম সদস্য হিসেবে আমিই তার দৈনন্দিন কর্মসূচি অনুসরণ করতাম ও পালন করতাম সংবাদ কভারেজের দায়িত্ব। বঙ্গবন্ধু তখন রাষ্ট্রের কর্ণধার এবং তার প্রেস উইংয়ের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করা ছিল নিত্যকর্ম। সৌভাগ্যবশত সেখানে ছিলেন সহকারী প্রেস সচিব হিসেবে ঢাকা বিশ্ব্ববিদ্যালয়ের বহুদিনের বন্ধুবৎসল লোক আমিনুল হক বাদশা আর অগ্রজ অভিভাবকসম তোয়াব খান। সুতরাং বঙ্গবন্ধুর সংবাদ কভারেজে কখনও কোনো অসুবিধা হয়নি। কোনোদিন শুনিনি, তার কোনো সংবাদ নিয়ে মিডিয়ার প্রতি রুষ্ট হয়েছেন কিংবা তার অনুযোগের কথাও শুনিনি। ১৯৭৪ সালের সর্বনাশা বন্যায় তার সঙ্গে হেলিকপ্টারে একাধিক স্থানে যেতে হয়েছে একই দিনে।
দেশে তখন খাদ্যাভাস ও অনটন যা বাংলাদেশের স্বাধীনতাবিরোধী বৃহৎ শক্তি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের চাপিয়ে দেওয়া ষড়যন্ত্র ও পিএল ৪৮০-এর জাহাজ ফিরিয়ে নিয়ে এক ধরনের কৃত্রিম সংকটও বটে! বঙ্গবন্ধু এই সব চালবাজি ও ষড়যন্ত্র বুঝতে পেরেও নিশ্চুপ ছিলেন জাতির বৃহত্তর স্বার্থে। আমরা সারাদিন হেলিকপ্টারে ঘুরে বিকেলে অফিসে ফিরে ক্ষুন্নিবৃত্তি করতাম কারণ বঙ্গবন্ধু যেসব এলাকা ঘুরে বন্যা পরিস্থিতি দেখতেন, সেই সব এলাকার জেলা প্রশাসন থেকে স্থানীয় পর্যায়ের নেতাদের বলে দেওয়া হয়েছিল যেন কোনোরকম খাওয়াদাওয়ার ব্যবস্থা না করে।
অথচ ১৯৭২ সালে বঙ্গবন্ধু কুমিল্লায় বাংলাদেশ মিলিটারি একাডেমির প্রথম ব্যাচের গ্র্যাজুয়েশন-প্যারেড অনুষ্ঠানে যাচ্ছিলেন; আমরা চিত্রগ্রাহক ও রিপোর্টারের প্রায় ১৪-১৫ জনের একটা দল একটি মাইক্রোবাসে তাঁর সফরসঙ্গী ছিলাম। আমরা সকাল ৮টার দিকে রওনা দিয়েছিলাম কুমিল্লায় নির্ধারিত সকাল ১১টার অনুষ্ঠানে। কিন্তু পথে পথে জনতার সংবর্ধনার জবাব দিতে যাত্রাবিরতি করতে করতে দাউদকান্দি ফেরি পার হতে বঙ্গবন্ধুর দুপুর ১২টা পার হয়ে গেল। আমার মনে আছে, দাউদকান্দির এপারে তখনকার ঢাকার ডিসি সৈয়দ রেজাউল হায়াৎ তার এলাকার প্রটোকল শেষে বঙ্গবন্ধু ও আমাদের বিদায় দিলেন। বঙ্গবন্ধু এ সময় আমাদের মাইক্রোবাসের কাছে এসে খোঁজখবর নিলেন আমাদের নেতৃত্বদানকারী বাসসের সিনিয়র সাংবাদিক গিয়াস কামাল চৌধুরীর কাছে। গিয়াস ভাই কিছু একটা বলার আগেই পাশে দাঁড়ানো তোয়াব ভাইকে বললেন, 'তোয়াব, এদের সবার মুখ শুকিয়ে গেছে ক্ষিধায়। কিছু খেতে দাও।' আমাদের গন্তব্যে পৌঁছানোর ব্যাপারে যে বেশ বিলম্ব হবে তা ঢাকার মেধাবী জেলা প্রশাসক আগেই আন্দাজ করে কিছু খাবার প্যাকেট তোয়াব ভাইয়ের হাতে ধরিয়ে দিয়েছিলেন। বঙ্গবন্ধুর নির্দেশ পেয়ে তোয়াব ভাই সেই সব খাবারের প্যাকেট আমাদের দিয়ে দিলেন। বঙ্গবন্ধু তাঁর সাথী-সঙ্গীসহ তাঁর সঙ্গে নিয়োজিত সরকারি লোকজনদের এমনি করে সদা-দেখভাল করতেন।
সাত
বাংলাদেশ সদ্য-স্বাধীন একটি যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ। চারদিকে হাহাকার স্বজনহারাদের। কোটি কোটি মানুষ ঘরবাড়িবিহীন নিঃস্ব। ট্রেন ও সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থা সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন। দেশকে সার্বিক অর্থে গড়ে তোলার ব্রত নিয়েছে বঙ্গবন্ধুর সরকার। এই সময়ে টেলিভিশন চালু রাখা অনেকে হাতি পোষা মনে করতেন। বঙ্গবন্ধু-সরকারের অনেকে, বিশেষ করে অর্থমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ বঙ্গবন্ধুকে পরামর্শ দিয়েছিলেন কিছুকাল টেলিভিশন বন্ধ রাখার জন্য। তাঁর একটা যুক্তি ছিল, টেলিভিশন সাধারণ মানুষের কাছে পৌঁছায় না। প্রচার পরিধিও কম। অন্যদিকে বেতার আপামর মানুষের কাছে পৌঁছে যাচ্ছে। একজন পান-বিড়ির দোকানি থেকে ঘরের গৃহিণী সবার কাছে বেতার পৌঁছে যাচ্ছে, বিশেষ করে মুক্তিযুদ্ধের সময় স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের জনপ্রিয়তা এই ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল। কিন্তু বঙ্গবন্ধু এই পরামর্শে রাজি হননি। তিনি বুঝে ছিলেন হাজারো শব্দের কথকতা থেকে একটি দৃশ্যের মূল্য কত বেশি বাস্তব, কত বেশি যৌক্তিক। তার নির্বাচনী প্রচার শুধু নয়; সত্তরের প্রলয়ঙ্করী জলোচ্ছ্বাস ও ঘূর্ণিঝড়ে অসংখ্য প্রাণ ও প্রভূত-সম্পদের টিভি সংবাদ চিত্র দেখে সেদিন মানুষ কেঁদেছিল। বিশ্ববাসী সাহায্যের হাত প্রসারিত করেছিল। পাকিস্তানি সামরিক জান্তা ভীতসন্ত্রস্ত হয়েছিল। সর্বোপরি বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধে পাকিস্তান হানাদার বাহিনীর নারকীয় বর্বরতার সংবাদ-চিত্র ও যুদ্ধের প্রামাণ্য চিত্র একদিকে যেমন জাতিকে উদ্দীপ্ত করেছে, অন্যদিকে বিশ্ববাসী সত্যের চাক্ষুষ উপলব্ধি থেকে আমাদের মুক্তিযুদ্ধের প্রতি সমর্থন দিয়েছিল। ভাবতে অবাক লাগে, বঙ্গবন্ধু সেই সত্তর দশকের প্রারম্ভেই বুঝেছিলেন শ্রুতি ও দৃশ্যের সমন্বয়ে গড়ে ওঠা টেলিভিশন মিডিয়ার জগতে কত বিপ্লব সাধন করতে পারে। তিনি অনেকের পরামর্শ উপেক্ষা করে বরং ১৯৭২ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর টেলিভিশনকে সরকারিভাবে অধিগ্রহণ করেন। শুধু তাই নয়, তিনি নাটোরে দেশের প্রথম টেলিভিশন উপকেন্দ্র স্থাপনের নির্দেশ দেন এবং ১৯৭৪ সালেই তা বাস্তবায়িত হয়ে টেলিভিশন সম্প্রচার দেশের উত্তরাঞ্চলে সম্প্রসারিত হয়। পরবর্তীতে প্রশাসন বিকেন্দ্রীকরণে তাঁর প্রজ্ঞায় নাটোরে দিঘাপাতিয়ার বিখ্যাত জমিদার বাড়িতে উত্তরা দ্বিতীয় গণভবন প্রতিষ্ঠিত হয়, যা বাংলাদেশের দ্বিতীয় রাজধানী হিসেবে চিহ্নিত হয়েছিল। বঙ্গবন্ধুর সময়েই ১৯৭৪ সালে 'বেতবুনিয়া ভূ-উপকেন্দ্রের' মাধ্যমে দেশে জনগণ প্রথম সরাসরি টেলি-সম্প্রচার উপভোগ করে।
আট
বর্তমানে বাংলাদেশ মহাকাশে উপগ্রহ উৎক্ষেপণ করেছে যার মাধ্যমে আমাদের মিডিয়ার সম্প্রচারকে নিজস্ব ট্রান্সপোন্ডার ব্যবহার করে বহুধা পল্লবিত করছে। বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নযাত্রা বাস্তবায়নে তার সুযোগ্য কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হাত ধরেই দেশে এসেছে 'বঙ্গবন্ধু উপগ্রহ' যা ১৬ কোটি মানুষেরই মহাকাশে যেন গর্বিত পদক্ষেপ! আমি 'বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নযাত্রা' কথাটা এই জন্যই বলেছি কেননা, তিনি জীবদ্দশায় ইন্টালসেটের (Intelsa) কথা জেনেছিলেন। জেনেছিলেন চন্দ্র পৃষ্ঠে মানুষের পদ-পাতের কথা এবং তার সময়েই শোনা গিয়েছিল মার্শাল ম্যাকলুহানের বিখ্যাত উক্তি 'Global village' তথ্য আজকের বিশ্বায়ন এখন তথ্য মহা-সরণিতে যোগ দিয়ে বাংলাদেশের মানুষের যে সফল-যাত্রা সূচিত হয়েছে তা অবশ্য বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নযাত্রার ফলশ্রুতিরই নামান্তর। মিডিয়া তথা তথ্য আদান-প্রদান যে বহুধা-পল্লবিত হবে তা তিনিই তাঁর স্বল্পায়ু জীবনে উপলব্ধি করেছিলেন।
একজন প্রাক্তন প্রবীণ সম্প্রচার সাংবাদিক, শিক্ষক ও পেশাজীবী হিসেবে এখানে একটি বিষয় অবশ্য আমাকে অবতারণা করতে হচ্ছে। বিষয়টি হচ্ছে, পৃথিবীর মহাকালজুড়ে বিভিন্ন উন্নত ও উন্নয়নশীল দেশের উপগ্রহ ইতোপূর্বে উৎক্ষেপণ করা হয়েছে। মহাকালজুড়ে এই উৎক্ষেপণের স্থানগুলো হচ্ছে- প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চল (POR), আটলান্টিক মহাসাগরীয় অঞ্চল (AOR) এবং ভারত মহাসাগর অঞ্চল (IOR)। আমাদের 'বঙ্গবন্ধু উপগ্রহ' যা মূলত Broadcast satellite তা ভারত মহাসাগরীয় অঞ্চলেই অবস্থিত। এই অঞ্চলে পূর্বদিকে ইন্দোনেশিয়া PALAPA এবং পশ্চিমে ASIASET-সহ ভারতীয় ও অন্যান্য দেশের একাধিক উপগ্রহ থাকায় 'বঙ্গবন্ধু উপগ্রহ'-এর স্থান কক্ষপথে এমন একটি স্থানে নির্ধারিত হয়েছে ((90. Degree) ) যাতে করে তার প্রচার পরিধি অর্থাৎ, Foot-Print পূর্বে অস্ট্রেলিয়ার একাংশ এবং পশ্চিমে ভারতীয় উপমহাদেশের শেষে ইরানের কিছু অংশ এসেছে আওতায়। এর অর্থ হচ্ছে, মধ্যপ্রাচ্যের বিশাল প্রবাসী বাঙালি ছাড়াও যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্র কিংবা কানাডার প্রবাসী বাঙালিরা প্রচার পরিধির আওতার বাইরে। অবিলম্বে Double Hoop বা অন্য একটি Satellite-এর সাহায্য নিয়ে এই অবস্থা থেকে উত্তরণ সম্ভব যা বিশ্বের অন্যান্য দেশও করে থাকে। বিটিভির অতীতে অনেক সময় বাইরে থেকে বিশেষ করে নিউইয়র্ক, ওয়াশিংটন থেকে অতিগুরুত্বপূর্ণ স্যাটেলাইট-ফিড গ্রহণের জন্য Double Hoop ব্যবহার করতে হতো। হয়তো সামনে ভবিষ্যতে এমনও দিন আসবে, বাংলাদেশ দ্বিতীয় সাবমেরিন কেবল ও অতি-প্রযুক্তির অপটিক-ফাইবার ব্যবহার করে স্থলপথে কিংবা সমুদ্রতলদেশ দিয়ে ওই সব বিশাল অঞ্চলে টিভি-সংকেত পৌঁছে দিতে পারবে। মিডিয়ায় বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নযাত্রায় উত্তরোত্তর সাফল্য কামনাই হোক আমাদের লক্ষ্য।
লেখক
কবি, প্রাবন্ধিক