ঢাকা মঙ্গলবার, ১৮ ফেব্রুয়ারি ২০২৫

আমার একাত্তর, আমাদের একাত্তর

আমার একাত্তর, আমাদের একাত্তর

রাশেদ খান মেনন

প্রকাশ: ২৫ মার্চ ২০২০ | ১৪:১৮

পঁচিশে মার্চ একাত্তরের সেই কালরাতেই ঘুমন্ত ঢাকা মহানগরীর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়েছিল পাকিস্তান সেনাবাহিনী। শুরু করেছিল অপারেশন সার্চলাইট। অবশ্য মহানগরীর সব মানুষ ঘুমিয়ে ছিল না। ছাত্র-যুবকর্মীরা, পাড়ার নেতারা মহানগরের বিভিন্ন রাস্তায় ব্যারিকেড তৈরি করছিল, যাতে সেনাবাহিনীর ট্যাঙ্ক-গাড়ি এগোতে না পারে। কারণ বিকেল থেকে রটে গিয়েছিল, ওই রাতেই সেনাবাহিনী 'ক্র্যাকডাউন করবে'। সে সময়ের আওয়ামী লীগের নেতাকর্মী যারা ৩২ নম্বরে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে ছিলেন, বিভিন্ন শলাপরামর্শ, আলাপ-আলোচনা করছিলেন, তাদের বিভিন্ন লেখার বর্ণনায় জানা যায়- বঙ্গবন্ধুর কাছে ও ৩২ নম্বরে সেনাবাহিনীর সামরিক প্রস্তুতির খবর আসছিল। বঙ্গবন্ধু শান্ত থেকেই সবাইকে নির্দেশ দিচ্ছিলেন। বিশেষ করে আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগের নেতৃস্থানীয় যারা ছিলেন, তাদের বলছিলেন নিরাপদ জায়গায় সরে গিয়ে প্রতিরোধের প্রস্তুতি নিতে। তাজউদ্দীন আহমদ, ড. কামাল হোসেন, আমীর-উল ইসলামদেরও তিনি নির্দেশ দেন প্রতিরোধের জন্য কী করতে হবে। মুক্তিযুদ্ধের সূচনা কী করে করতে হবে। ভারতে কোথায় কার সঙ্গে যোগাযোগ করতে হবে। পরে জানা যায়- ইতোমধ্যে তিনি স্বাধীনতার ঘোষণা ওয়্যারলেসে পাঠাবার ব্যবস্থা করেছেন। ৩২ নম্বরে এক আবেগঘন পরিস্থিতি সৃষ্টি হলেও বঙ্গবন্ধু সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন, তিনি আত্মগোপনে যাবেন না। তাহলে তার খোঁজে সেনাবাহিনী আরও উন্মত্ত আচরণ করবে। পুরো ঢাকা মহানগরসহ দেশকে জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে দেবে।

৩২ নম্বরের এ খবর সাধারণ মানুষের জানার মধ্যে ছিল না। মুজিব-ইয়াহিয়া আলোচনা, বিভিন্ন জায়গায় সেনাবাহিনীর সঙ্গে সাধারণ মানুষের সংঘর্ষ- এসব বিষয়ে যে উত্তেজনা ছিল তাদের মধ্যে। স্বাভাবিকভাবেই অনেকেই নিদ্রায় চলে গিয়েছিলেন অথবা নিদ্রায় যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। নেতাকর্মীরা সচেতন-সজাগ থাকলেও সাধারণ নাগরিকরা পরের দিন কী হয় সেটি জানার জন্য অপেক্ষা করছিলেন। কিন্তু ইতোমধ্যে ঘড়ির কাঁটা রাত ১২টা ছোঁয়ার আগেই ঘৃণ্য আক্রমণ শুরু হয়।

আমার জন্যও ২৫ মার্চের সারাদিন বিশেষ উত্তেজনাপূর্ণ ছিল। ওই দিন বিকেলে কমিউনিস্ট বিপ্লবীদের পূর্ব বাংলা সমন্বয় কমিটির সিদ্ধান্ত অনুসারে পূর্ব বাংলা শ্রমিক ফেডারেশন ও পূর্ব বাংলা বিপ্লবী ছাত্র ইউনিয়নের যৌথ উদ্যোগে পল্টন ময়দানে জনসভা ডাকা হয়েছিল। আমার সেই জনসভায় বক্তৃতা দেওয়ার কথা ছিল।

ইতোপূর্বে ১৯৭০-এর ২২ ফেব্রুয়ারি ঢাকার পল্টন ময়দানে একুশে ফেব্রুয়ারি শহীদ দিবস উপলক্ষে পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়ন আয়োজিত ছাত্র জনসভায় 'স্বাধীন জনগণতান্ত্রিক পূর্ব বাংলা'র দাবি জানানো ও তার ১১ দফা কর্মসূচি তুলে ধরে বক্তৃতা দেওয়ার জন্য ইয়াহিয়ার সামরিক আদালত আমার অনুপস্থিতিতেই সাত বছর সশ্রম কারাদণ্ড ও সম্পত্তির ৬০ ভাগ বাজেয়াপ্তের আদেশ দিয়েছিলেন। সভার আরেক বক্তা তৎকালীন শ্রমিক নেতা কাজী জাফর আহমদেরও আমার মতো সাত বছর ও সভার সভাপতি পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়নের (মেনন গ্রুপ) তৎকালীন সভাপতি মোস্তফা জামাল হায়দার ও সাধারণ সম্পাদক মাহবুব উল্লাহর এক বছর করে সশ্রম কারাদণ্ড হয়েছিল। সমন্বয় কমিটির সিদ্ধান্ত অনুসারে আমি আত্মগোপনে চলে যাই এবং দক্ষিণাঞ্চলের বরিশাল, পিরোজপুর, বাগেরহাটে গ্রামাঞ্চলে কৃষক ও খুলনার আটরা শিল্পাঞ্চলে শ্রমিকদের স্বাধীনতার জন্য সশস্ত্র সংগ্রামের লক্ষ্যে কাজ করতে থাকি। ইতোমধ্যে ঢাকার নরসিংদীর শিবপুরে আব্দুল মান্নান ভূঁইয়ার নেতৃত্বে শিবপুর শহীদ আসাদ কলেজের বিজ্ঞানের শিক্ষকরা কীভাবে 'মলোটভ ককটেল' বানাতে হয়, তার শিক্ষা দিতে থাকেন। শিবপুর কার্যত তখন কমিউনিস্ট বিপ্লবীদের পূর্ববাংলা সমন্বয় কমিটির অঘোষিত হেডকোয়ার্টার।

১ মার্চ ইয়াহিয়া জাতীয় পরিষদ স্থগিত করলে অসহযোগ আন্দোলনের যে কর্মসূচি দেন, তাতে ৭ মার্চের পর থেকে বাংলাদেশের প্রশাসন তার নেতৃত্বে চলে যায়। দেশের পুলিশ-গোয়েন্দা সবই তখন স্বাধীনতার পক্ষে। সুতরাং সামরিক আদালতের সাজা থাকলেও আমরা অনেকটা আধা-আত্মগোপন অবস্থায় সাংগঠনিক কাজ করতাম। আমি জহির রায়হানের গাড়িতে ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশনের সামনে থেকে বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণ শুনি।

কমিউনিস্ট বিপ্লবীদের পূর্ব বাংলা সমন্বয় কমিটি সামগ্রিক অবস্থা বিবেচনা করে মধ্য মার্চেই এই সিদ্ধান্তে উপনীত হয় যে, আর আপস-মীমাংসার সম্ভাবনা নেই। পূর্ব বাংলা বিপ্লবী ছাত্র ইউনিয়ন কর্মীদের নিয়ে ইতোমধ্যে ছোট ছোট গেরিলা স্কোয়াড তৈরি করা হয়েছে। বিভিন্ন জায়গা থেকে অস্ত্র সংগ্রহ ও মলোটভ ককটেল বানানোর জন্য গন্ধক সংগ্রহ করা হচ্ছে। ফয়েজ ভাইয়ের 'স্বরাজ' পত্রিকা সামরিক শাসনের মধ্যেই 'মলোটভ ককটেল' বানানোর সচিত্র নির্দেশনাও প্রকাশ করছে। পূর্ব বাংলা বিপ্লবী ছাত্র ইউনিয়ন লাল হরফে লিফলেট বিলি করছে।

বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ 'স্বাধীনতা'র শপথ নিয়ে মিছিল করে ৩২ নম্বরে যাচ্ছে বঙ্গবন্ধুর নির্দেশ শোনার জন্য। ইতোমধ্যে অবশ্য ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ ২ মার্চ সবুজের মধ্যে লাল বৃত্তে বাংলাদেশের হলুদ মানচিত্র সংবলিত স্বাধীনতার পতাকা উত্তোলন করেছে, ৩ মার্চ স্বাধীনতার ইশতেহার ঘোষণা করেছে, জয় বাংলা বাহিনী গঠন করেছে, ৩২ নম্বরে বাংলাদেশের স্বাধীনতার পতাকা তুলে দিয়েছে। এসব ঘটনার মধ্যে একমাত্র ব্যতিক্রম ছিল মতিয়া গ্রুপ ছাত্র ইউনিয়নের মিছিলের স্লোগান ও ব্যানার। এ রকম একটি ব্যানার ছিল- 'মেশিনগানের সামনে মোরা গাইব জুঁই ফুলেরই গান।' আর যখন মিছিল প্রকম্পিত 'বীর বাঙালি অস্ত্র ধর বাংলাদেশ স্বাধীন কর', 'শ্রমিক-কৃষক অস্ত্র ধর, পূর্ব বাংলা স্বাধীন কর' স্লোগানে, তখন তাদের মিছিলের স্লোগান ছিল- 'পূর্ব-পশ্চিম এক আওয়াজ, কায়েম কর গণরাজ।' অবশ্য তাদের ছেলেমেয়েরা ডামি রাইফেল নিয়ে মিছিল করছিল।

যা হোক, ২৫ মার্চ বিকেলে পল্টনে জনসভায় দুই লাখের মতো মানুষ জমা হয়েছিল। আমরা আবেগদীপ্ত কণ্ঠে উদাত্ত আহ্বান জানালাম- 'বঙ্গবন্ধু আপনি এখনই স্বাধীনতা ঘোষণা করুন।' জনসভা চলাকালে হঠাৎ দেখলাম বিপুলসংখ্যক বিদেশি সাংবাদিক এসে ভিড় করেছেন। পরে শুনেছি, তাদের কাছে খবর ছিল পাকিস্তান সেনাবাহিনী এই জনসভা থেকেই তাদের আক্রমণ শুরু করবে। পাকিস্তান সেনাবাহিনী যদি এই জনসভাকে আক্রমণ করত, তবে তারা এর দায় 'নকশালপন্থি' বিচ্ছিন্নতাবাদীদের ওপর চাপিয়ে দিতে পারত। আমরা ছিলাম 'সফট বেলি', যেখান দিয়ে সহজে এই আক্রমণ শুরু করা যেত। ওই জনসভা চলাকালে ন্যাপের সাধারণ সম্পাদক মশিউর রহমান যাদু মিঞা দ্রুত জনসভা শেষ করে দিয়ে আমাদের চলে যাওয়ার জন্য বার্তা পাঠান। যাদু মিঞার সঙ্গে ভুট্টোর ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ ছিল। তাই তিনি সম্ভবত আগেভাগেই ২৫ মার্চের ক্র্যাকডাউন সম্পর্কে জানতে পেরেছিলেন।

জনসভা শেষ করে পল্টন থেকে আমি, রনো ও জাফর ভাই হাঁটতে হাঁটতে মধুর ক্যান্টিনে আসি। এতদিন পর মধুদা আমাদের দেখে খুবই উচ্ছ্বসিত হয়ে ওঠেন। তিনি নিজে অর্ডার দিয়ে আমাদের জন্য টোস্ট ও ডাবল ডিমের ওমলেট খাওয়ালেন। অনেক গল্প হলো মধুদার সঙ্গে। মধুদা ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আমাদের রক্ষক। পকেটে পয়সা না থাকলেও মধুদার বাকির খাতার বদৌলতে সকালের নাশতা, সারাদিনের চা-নাশতা- সবই আমাদের জন্য খোলা থাকত। কিন্তু পঁচিশের সেই সন্ধ্যায়ও ভাবিনি আর কিছু পরে পাকিস্তান সেনাবাহিনী সব প্রতিরোধ গুঁড়িয়ে দিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইকবাল হল ও জগন্নাথ হল এলাকা যখন আক্রমণ করবে, তখন মধুদা হবেন তার প্রথম শহীদদের একজন।

সন্ধ্যায় লালবাগে আমার শ্বশুরবাড়ি গেলাম প্রায় এক বছর বাদে। আত্মগোপন অবস্থায় আমার কন্যাসন্তান হয়েছে। ধানমন্ডিতে ডা. ওয়াদুদের ক্লিনিকে রাতের বেলা দেয়াল টপকে আমি নবজাতকের মুখ দেখেছিলাম। তারপর সাত মাসে আর দেখিনি। ওকে দেখার ইচ্ছা থেকেই লালবাগের বাসায় গেলাম। সকালবেলা শিবপুর থেকে ঢাকা আসতে জিপ বারবার ঠেলতে হওয়ায় বড় পরিশ্রান্ত ছিলাম। প্রয়াত সাদেক হোসেন খোকা একটি পুরোনো জিপ নিয়ে গিয়েছিল শিবপুর থেকে আমাকে আনতে। বারবার রাস্তায় বন্ধ হয়ে যাওয়ায় নেমে ঠেলতে হচ্ছিল স্টার্ট নেওয়ার জন্য। তাই যখন শ্বশুরবাড়ি পৌঁছলাম, তখন শরীর অবসাদে ভেঙে আসছিল। সাত মাসের মেয়ে সুবর্ণার সঙ্গে খেলা করতে গিয়ে কখন ঘুমিয়ে পড়েছিলাম জানি না। এর আগে অবশ্য আমার স্নেহশীল শাশুড়ি আমাকে রাতের খাবার খাইয়ে দিয়েছেন। বহুদিন পর হয়তো পেটভরে খাওয়াটাও ঘুমিয়ে পড়ার কারণ ছিল। রাত ১০টা-১১টার দিকে ঘুমের মধ্যেই পাড়ায় ব্যারিকেড দেওয়ার আওয়াজ ও হৈ-হট্টগোল শুনছিলাম। এর মধ্যেই আমার শ্বশুর রাত ১২টার দিকে এসে ঘুম থেকে আমাকে ধাক্কা দিয়ে জাগান এবং বলেন, আক্রমণ শুরু হয়েছে। তার সঙ্গে লালবাগের বাসার ছাদে গেলাম। লালবাগ থেকে পিলখানা ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় খুব দূরে নয়। ছাদে উঠে আমরা দু'দিক থেকে ভারী আগ্নেয়াস্ত্রের বিকট সব আওয়াজ শুনতে পাচ্ছিলাম। আর আকাশে ছোড়া ফ্লায়ার বোমায় আকাশ পরিস্কার দেখা যাচ্ছে, আর তার পরপরই গুলির আওয়াজ। অর্থাৎ লক্ষ্য নির্দিষ্ট করে তারা আক্রমণ চালাচ্ছে। বুঝলাম প্রতিরোধ ছাড়া বাঙালির আর পথ নেই।

শ্বশুর-শাশুড়ি ও স্ত্রী সবাই আমার নিরাপত্তা নিয়ে উৎকণ্ঠিত হয়ে পড়ল। আমাকে পাশের বাসায় রান্নাঘরের পেছনে একটি ছোট ঘরে পাঠিয়ে দিল। সঙ্গে পাঠাল আমার পার্টি-সংশ্নিষ্ট সব বইপত্র, খাতা-কাগজপত্র। ওই ঘরে খড়ের গাঁদায় নির্ঘুম বসে রইলাম। আমার শ্যালক (যে পরবর্তী সময়ে মুক্তিযুদ্ধে শহীদ) হিল্লোল। সে বাসায় আসেনি। পরদিন সকালে সে ইকবাল হল থেকে ড্রেন ধরে ক্রল করে বাসায় এলে তার কাছে বিবরণ শুনলাম- কী প্রচণ্ডতায় সেনাবাহিনী ইকবাল হল আক্রমণ করেছে। তারা মনে করেছিল ইকবাল হলই প্রতিরোধের কেন্দ্র। আর তাই এটি গুঁড়িয়ে দিতে হবে।

২৭ মার্চ সকাল নাগাদ কিছুক্ষণের জন্য কারফিউ উঠলে কাঁধের ঝোলায় একপ্রস্থ লুঙ্গি-গেঞ্জি নিয়ে এক কাপড়ে বেরিয়ে পড়লাম। আগেই ঠিক ছিল শিবপুরে মিলিত হবো সবাই। জহির রায়হানের ভক্সল গাড়ির ব্যাকডালায় আমাদের সংগ্রহ করা কিছু অস্ত্র তুলে রনো ও অন্যদের সঙ্গে চলে গেলাম নরসিংদীর শিবপুরে। ডেমরা পেরোতেই রাস্তার দু'ধারে মানুষ। সকলকে পানি দিচ্ছে, খাওয়া দিচ্ছে। প্রত্যেক বাড়িতে সগর্বে উড়ছে বাংলাদেশের পতাকা। শিবপুর থেকে শুরু হলো আমার মুক্তিযুদ্ধ। 

বাংলাদেশের ওয়ার্কাস পার্টির সভাপতি

আরও পড়ুন

×