
সিটি করপোরেশন নির্বাচনের তৎপরতা শুরু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বেশ কিছু বিষয় জনসমক্ষে চলে এসেছে। তার মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে প্রার্থীদের সম্পদের হিসাব। কোনো প্রার্থী মধ্যবিত্ত নয়, অর্থনৈতিক টানাপোড়েনের মধ্যে নেই, বিপুল সম্পদ তাদের জীবনের নিরাপত্তাকে নিশ্চিত করেছে। উপমহাদেশের রাজনীতিবিদদের অর্থসম্পদ একদা ছিল এ রকমই। তবে তারা পেশায় ছিলেন আইন ব্যবসায়ী, জমিদার ও উচ্চবিত্তের মানুষ। একেবারে কমিউনিস্ট আন্দোলনের নেতৃত্বেও ছিলেন জমিদার ও আইন ব্যবসায়ীরা। এর মধ্যে অবশ্য স্কুল, কলেজ শিক্ষক, ছোটখাটো সরকারি কর্মচারী এবং কৃষক-শ্রমিকের একটা অংশ যুক্ত হয়েছিল। কিন্তু নেতৃত্বে ধনাঢ্য ব্যক্তিরাই তাদের সম্পদ বিলিয়ে দিয়ে শ্রেণিচ্যুত হয়েছিলেন।
দেশ বিভাগের পর পূর্ব বাংলায় এই নেতৃত্বের পরিবর্তন হতে থাকে এবং পরিবর্তনের সূচনা হয়। লুঙ্গি-পাঞ্জাবি পরিহিত একেবারেই আমজনতার মানুষ মওলানা ভাসানী, নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান শামসুল হক এবং সচ্ছল, মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান শেখ মুজিবুর রহমান। ভাসানী-মুজিবের নেতৃত্বে আওয়ামী লীগে মধ্যবিত্ত ও নিম্নমধ্যবিত্তের মানুষ রাজনীতিতে এগিয়ে আসে। মওলানা ভাসানী ও শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে দূরত্ব সৃষ্টি হওয়ার পরও আওয়ামী লীগে এবং মওলানা ভাসানীর ন্যাপের কেন্দ্রীয় ও তৃণমূল পর্যায়ের নেতৃত্বে পোড়-খাওয়া বিত্তহীন মানুষের সমাবেশ ঘটে। এই সমাবেশের কারণেই একমাত্র মুসলিম লীগ ছাড়া সব ডান ও বাম দলের মধ্যবিত্ত নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়। বাম দলগুলো ক্রমশ শক্তি সঞ্চয় করে এবং ছাত্রদের মধ্যে বিপুল প্রভাব সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়। একদিকে ছাত্র ইউনিয়ন, অন্যদিকে ছাত্রলীগ ও আরও নানা ধরনের ছাত্র সংগঠনের নেতৃত্বে গেল মধ্যবিত্তদের প্রাধান্য। আদর্শের জায়গায় ভিন্নতা থাকলেও সব নেতাকর্মী গণমানুষের সমস্যা বুঝতে পারতেন, যার জন্য অনেক ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন করা সম্ভব হয়েছে। আইয়ুববিরোধী আন্দোলনে এবং ৬ দফা, ১১ দফা বাস্তবায়নে একটা দৃঢ় ঐক্য দেখা গেল। এসব নেতাকর্মীর হাত ধরেই ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান, সত্তরের নির্বাচন এবং মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে বাংলাদেশ একটি স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে দাঁড়িয়ে যায়।
সমস্যাটা হলো, পুরো পাকিস্তান আমলে রাষ্ট্রটি পরিচালিত হতো ধনাঢ্য, সামন্তবাদী, সামরিক-বেসামরিক আমলাদের হাতে। ধানমন্ডি, গুলশান, উত্তরাসহ সব সরকারি আবাসিক প্রকল্পের সুবিধাভোগী হলেন তারাই। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর প্রথম দিকে মধ্যবিত্ত, নিম্নমধ্যবিত্তদের নিয়ে চিন্তাভাবনা শুরু হলেও রাজনীতিকদের একটা অংশ ক্রমেই দুর্নীতিগ্রস্ত হয়ে পড়ে। ফলে সম্পদের সুষম বণ্টন বাধাগ্রস্ত হয়। মধ্য আগস্টের হত্যাকাণ্ডের পর আবারও রাষ্ট্র সামরিক ও বেসামরিক আমলাদের হাতে চলে যায় এবং পাকিস্তানের সেই শাসনব্যবস্থা ও সম্পদের সুষম বণ্টনের কথা একেবারেই স্বপ্ন হয়ে ওঠে। সম্পদের নিয়ন্ত্রণ চলে যায় মুষ্টিমেয় কিছু লোকের হাতে। এভাবে সুদীর্ঘ ১৫ বছর ধরে এই ব্যবস্থা চালু থাকায় পরবর্তীকালে গণতান্ত্রিক সরকার এলেও অবস্থার কোনো পরিবর্তন হয় না। সামরিক শাসনের সময় গড়ে ওঠা রাজনৈতিক দলগুলো প্রাধান্য বিস্তার করতে থাকে। রাষ্ট্রটি পরিচালিত হয় ধনী লোকদের স্বার্থ রক্ষার জন্য। নতুন-পুরোনো সরকারি আবাসিক এলাকায় আবারও ধনাঢ্য ব্যক্তি, রাজনীতিক, আমলাদের জন্য নতুন বন্দোবস্তের ব্যবস্থা হয়। আশির দশকের মাঝামাঝি থেকে উন্নয়নের জন্য প্রচুর বিদেশি বিনিয়োগ আসতে থাকে কিছুটা সরকারের কাছে এবং একটা সিংহ ভাগ বিভিন্ন এনজিওর কাছে। এরশাদ সরকার এ সময় বাধ্য হয়ে এনজিও ফোরাম গঠন করেন। উদ্দেশ্য হচ্ছে এনজিওদের তহবিল নিয়ন্ত্রণ করা। তাতে খুব একটা শৃঙ্খলা আসে না। কারণ এই তহবিলটা আসে ইউরোপ ও আমেরিকা থেকে। আবার কিছু আসে মধ্যপ্রাচ্যের দেশ থেকে। মধ্যপ্রাচ্যের দেশ থেকে যে তহবিলটি আসে, তা মাদ্রাসা শিক্ষা; কিছু ইসলামের কল্যাণমূলক কাজে এলেও সেগুলো পরবর্তীকালে সাম্প্রদায়িকতার প্রসার ও মৌলবাদ-উগ্রবাদ প্রচারে ব্যবহূত হয়। জবাবদিহিমূলক ব্যবস্থা না থাকায় বিপুল সংখ্যক অর্থ কালো টাকায় রূপান্তরিত হয়ে অনেকের কাছে সঞ্চিত হতে থাকে। এই অর্থ রাজনীতিবিদদের হাতে গিয়ে একটা নিয়ামক শক্তি হিসেবে দাঁড়ায়।
ব্যক্তিগত ত্যাগ-তিতিক্ষা, সততা ও আদর্শের পরিবর্তে টাকা দিয়েই সবকিছু করার একটা মানসিকতা রাজনৈতিক নেতাদের মধ্যে কাজ করতে থাকে। এতে কাজও হয় এবং তৃণমূল পর্যায়ে কর্মীদর হাতেও বেশ কিছু টাকা-পয়সা পৌঁছে যায়। বিভিন্ন পর্যায়ের নির্বাচনে বিত্তশালী মানুষরা নেমে পড়ে। এর মধ্য থেকেই গ্রাম, ইউনিয়ন, উপজেলা ও জেলা পর্যায়ে বেশ কিছু সার্বক্ষণিক নেতাকর্মীর উত্থান ঘটে। দ্রুত তারা মোটরসাইকেল, গাড়ি, দোকানপাট, মার্কেট, ফ্ল্যাটসহ নানা স্থানে সরকারি জায়গাজমির মালিক হয়ে যায়। বিভিন্ন হত্যাকাণ্ডে বা দুর্বৃত্তায়নে পত্রপত্রিকায় এসব লোকের ওপর প্রতিবেদন ছাপা হতে থাকে। পরিস্থিতি এমন দাঁড়িয়েছে যে, সংসদে কোনো মধ্যবিত্তের জায়গাই হচ্ছে না। শুধু সংসদ নয়, মেয়র বা কাউন্সিলর নির্বাচনেও একই চিত্র দেখা দেয়। সংসদে এখন ব্যবসায়ীদের সংখ্যা সর্বোচ্চ। সমস্যা আরও গভীরতর চেহারা পায়, যখন গণপ্রতিনিধরা নিজ এলাকায় না থেকে তাদের ব্যবসায়িক স্বার্থে রাজধানীতে বসবাস শুরু করে। ঢাকা শহরে তাদের একাধিক ফ্ল্যাট-বাড়ি ও কয়েকটি দামি গাড়ির তারা মালিক। সন্তানদের একটা সময় পর্যন্ত ঢাকায় রেখে তারপর বিদেশে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। এই একাধিক গাড়ি এবং বিত্তবান লোকের রাজধানীতে থাকার ফলে একটা প্রবল যানজটের সৃষ্টি হচ্ছে। এসব বিত্তবান ব্যবসায়ী ও রাজনীতিকরা এলাকার উন্নয়ন, জাতীয় সমস্যা এসবের তোয়াক্কা না করে ব্যবসায় সৎ ও অসৎ পথে বিত্তের পাহাড় গড়ে তুলছে। বিত্ত গড়ার একটা প্রধান মাধ্যম হচ্ছে রাজনীতি। ক্ষমতায় না থাকলে অর্থ উপার্জনটাও বন্ধ হয়ে যায়। তাই ক্ষমতায় যাওয়াটা খুব প্রয়োজন হয়ে পড়ে।
একদা একজন সৎ রাজনীতিকের অঙ্গুলি হেলনে দুর্বৃত্তরা এলাকা ছেড়ে পালাত। অনেক সৎ রাজনীতিক দুর্বৃত্তদের হাতে নিহতও হয়েছে। কিন্তু এখন রাজনীতিকদের পাশে যে বাহিনী নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকে, তারা সশস্ত্র; যারা প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করার জন্য প্রচুর ক্ষমতা রাখেন। দেশে এখন যে পরিমাণ উন্নয়ন কার্যক্রম হচ্ছে এবং নানাবিধ জনকল্যাণমূলক কাজের পরিধি বাড়ছে, তাতে সত্যি সোনার বাংলা গড়া সম্ভব, যদি চাটার দল সবকিছু চেটেপুটে না খেয়ে ফেলে। এই চাটার দলকে বঙ্গবন্ধু ১৯৭৪ সালে চিহ্নিত করেছিলেন। চাটার দলকে যদি নিশ্চিহ্ন করা যেত, তাহলে দেশের চেহারাই অন্যরকম হয়ে যেত। আমাদের শিল্প-সাহিত্য খুবই উঁচুমানের। কিন্তু আমাদের সংস্কৃতি খুবই অনুন্নত। শিক্ষা এমন একটা নিচু স্তরে নেমে গেছে যে, প্রাথমিকের শিক্ষক থেকে শুরু করে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য পর্যন্ত বারবারই নিম্নরুচির পরিচয় দিয়ে আসছে। তাদের নৈতিকতা, জীবনাচরণ সবই প্রবলভাবে প্রশ্নবিদ্ধ। এসব ঘটনা থেকে ছাত্ররাও প্রভাবিত হয়ে পড়ছে। সরকারি কর্মচারীরা তো বটেই। নিয়োগ বাণিজ্য, মনোনয়ন বাণিজ্য এমন একটা জায়গায় পৌঁছেছে, যেখানে কোনো যোগ্য ব্যক্তির সুযোগ থাকছে না। গণতন্ত্র ও মানবাধিকার এই পরিস্থিতিতে অসহায় হয়ে পড়ছে। যেখানে সবকিছুর নিয়ামক অথর্, সেখানে পেশিশক্তিও অত্যন্ত প্রভাবশালী হয়ে ওঠে। এই অবস্থা থেকে মুক্তির উপায় অবশ্যই খুঁজতে হবে। এত সম্ভাবনাময় উর্বর ও নানাক্ষেত্রে তারুণ্যের যে ইতিবাচক কাজ, এসবই ভেসে যাবে। এখানে যা কিছু বলা হলো, তা শুধু সর্বজনবিদিত নয়, নাগরিকরা প্রতিমুহূর্তে এসবের ভুক্তভোগী।
অসাধু ব্যবসায়ীরা মানুষের নিত্যদিনের জীবনযাপনের সংকট হয়ে দাঁড়াচ্ছে। সরকারের সদিচ্ছা থাকলেও পেঁয়াজের দাম ও মশা- এ দুটির কোনোটাই নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না। অর্থাৎ পরোক্ষভাবে সরকারের একটা প্রভাবশালী অংশের সঙ্গে তারা যুক্ত। গত কয়েকদিন ধরেই পেঁয়াজ দুইশ' টাকা কেজিতে উঠেছে এবং তার সহযোগী সব পণ্যের দাম বেড়ে গেছে। মন্ত্রীদের মধ্যে অনেক বড় বড় ব্যবসায়ীও আছেন। তারা জনগণকে রক্ষা না করে ওইসব ব্যবসায়ীর পক্ষ নিচ্ছেন কেন, এর জবাব জানা নেই। দেশের বিপুল সংখ্যক মানুষ নিঃসন্দেহে এই অবস্থার পরিবর্তন চায়। এই সংস্কৃতি পরিবর্তনের জন্য যার যার জায়গা থেকে আরও বেশি তৎপর হওয়া উচিত। নৈতিকতা, মূল্যবোধ এসবের নতুন ব্যাখ্যা দেওয়া প্রয়োজন। তা না হলে আমরা সুড়ঙ্গের মধ্যে আলো দেখার চেয়ে সুড়ঙ্গের গভীর অন্ধকারের দিকে ধাবিত হবো।
সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব
মন্তব্য করুন