কলকাতা বইমেলায় প্রকাশকদের স্টল বরাদ্দ করে মেলা কর্তৃপক্ষ পাবলিশার্স অ্যান্ড বুকসেলার্স গিল্ড লটারির মাধ্যমে। এবারের কলকাতা বইমেলায় আরএসএসের শাখা সংগঠন বিশ্ব হিন্দু পরিষদ, যারা ঐতিহাসিক বাবরি মসজিদ ধ্বংসে সবচেয়ে সোচ্চার ভূমিকা পালন করেছিল; লটারির মাধ্যমে তাদের পাওয়া স্টল নম্বরটি হলো ৩৭০। আরএসএস এবং তার যাবতীয় শাখা সংগঠন আর রাজনৈতিক সংগঠন বিজেপি, ভারতীয় সংবিধানে জম্মু-কাশ্মীরের ভারতভুক্তির অন্যতম প্রধান শর্ত হিসেবে যে কাশ্মীরিয়াতের প্রতি সম্মান প্রদর্শনের ভাবনা থেকে ৩৭০ নম্বর ধারা ছিল, সেটিকে অবলুপ্তির জন্য সবচেয়ে বেশি সোচ্চার ছিল এবং তাদের দীর্ঘদিন ধরে বিভিন্ন রাজনৈতিক কর্মসূচি, নির্বাচনী ইশতেহারে এই ৩৭০ ধারা অবলুপ্তির কথা জোর দিয়ে বলা হতো। নরেন্দ্র মোদির দ্বিতীয় দফায় ক্ষমতাসীন হওয়ার পর নিছক সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোরে যে ৩৭০ ধারা অবলুপ্ত করা হয়েছে ভারতীয় সংবিধান থেকে, সেই সংখ্যাটি বিশ্ব হিন্দু পরিষদের স্টল নম্বর! মেলার আয়োজক গিল্ড নিশ্চয় এটিকে কাকতালীয় বলবে। ভাগ্যান্বেষণের ভেতর দিয়ে ভাগ্য নির্ধারণের অদ্ভুতুড়ে কাণ্ড কারখানার দোহাই পেড়ে একটা আত্মপক্ষ সমর্থনের চেষ্টা হতেই পারে। তবু বিশ্ব হিন্দু পরিষদের স্টল নম্বর ৩৭০ হওয়ার ভেতর দিয়ে কলকাতা বইমেলার বর্তমান অবস্থা কিন্তু দিনের আলোর মতো পরিস্কার হয়ে যাচ্ছে।

বস্তুত বাম জমানায় শুধু বামফ্রন্ট সরকারকে হেনস্তা করার উদ্দেশ্য নিয়েই পার্ক স্ট্রিটের প্রশস্ত এলাকায় সবুজ রক্ষার তাগিদে বইমেলা বন্ধের যে মামলা-মোকদ্দমা হয়েছিল, সেই মামলাতে যিনি মেলা স্থানান্তরের দাবিতে আদালতে লড়েছিলেন, সেই কল্যাণ বন্দ্যোপাধ্যায় এখন রাজ্যের শাসক তৃণমূল কংগ্রেসের একজন সাংসদ। আর যিনি এ মামলাটি করেছিলেন, সেই স্বঘোষিত পরিবেশবিদ সুভাষ দত্ত, রাজ্যজুড়ে পরিবেশের ষষ্ঠী পূজা হয়ে গেলেও, আর কখনও কিন্তু আদালতমুখো হন না।

বইমেলাকে কেন্দ্র করে দলীয় রাজনীতির এই যে নগ্নতা, এমনটা বোধ হয় বিশ্বের কোনো বইমেলাতেই দেখতে পাওয়া যায় না। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী কলকাতা বইমেলার প্রধান থিম 'বাংলাদেশ' হওয়াকালীন মেলা উদ্বোধনে এসেছিলেন। তাঁর সেই সফরসঙ্গী ছিলেন কবি শামসুর রাহমান। মেলা উদ্বোধন কিন্তু শেখ হাসিনা করেননি। করেছিলেন কবি শামসুর রাহমান। আর এখন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার পর মেলার উদ্বোধন, মেলার তারিখ- সবকিছু নির্ধারিত হয় মমতা দেবীর মেজাজ-মর্জি অনুযায়ী। বলা বাহুল্য, কবি-সাহিত্যিক-বুদ্ধিজীবীরা উদ্বোধক থাকেন না; থাকেন মমতা স্বয়ং। চলতি বছর অবশ্য বিতর্কের বদলে বিস্তর হাসাহাসি হওয়ার পর মমতা নিজে মেলার উদ্বোধন করেননি; পাশে থেকেছেন। উদ্বোধকের পাশে।
সারস্বত চর্চার সার্বিক আঙ্গিক ভারতবর্ষে সর্বত্র যে দমবন্ধ করা অবস্থায় রয়েছে, ভারতের কেন্দ্র এবং পশ্চিমবঙ্গের শাসকদের শাসনের আস্টম্ফালনের একটি জান্তব প্রতিমূর্তি হিসেবে, সেই কবন্ধ সময়েরই পরিচয় দিয়ে চলেছে কলকাতা বইমেলা। জন্মলগ্ন থেকে এমনটা তো ছিল না কলকাতা বইমেলা। বামপন্থি সরকারের সঙ্গে নীতিগত প্রশ্নে, আদর্শগত অবস্থানে সম্পূর্ণ বিপরীত মেরুতে থাকা মানুষজন, রাজ্যের সেই সময়ের তথ্য ও সংস্কৃতিমন্ত্রী বা পরবর্তীকালে মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের সঙ্গে একযোগে বইমেলাতে নানা ধরনের আনুষ্ঠানিকতায় থেকেছেন। তারা যেসব ক্ষেত্রে, সবসময় রাজ্য সরকারের সুরে সেই সময় সুর মেলাতেন; তেমনটা ভেবে নেওয়ার কোনো কারণ নেই।

সিঙ্গুর-নন্দীগ্রাম কাণ্ড ঘিরে তৎকালীন বামফ্রন্ট সরকারকে অভিযুক্ত করে, তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের উপস্থিতিতে, অতীন বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতো প্রথিতযশা সাহিত্যিক রাজ্য সরকারের সমালোচনা করতে পেরেছিলেন বইমেলার মঞ্চ থেকে মুক্তকণ্ঠে। বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য কিন্তু তার সরকারের সেই সমালোচনার উত্তরে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে অতীন বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রতি বিন্দুমাত্র অসম্মানজনক, অমর্যাদাকর, অসূয়াপ্রসূত আচরণ একটিবারের জন্যও করেননি। এমনটা কিন্তু আজকের পশ্চিমবঙ্গে স্বপ্নেও কল্পনা করা যায় না। অচলায়তনের বিরুদ্ধে সচল সমাজের প্রতিবাদ-প্রতিরোধের সংকল্প ধ্বনিত-প্রতিধ্বনিত হওয়ার যে মুক্তমঞ্চ হিসেবে জন্মলগ্ন থেকে কলকাতা বইমেলা নিজের পরিচয় রেখে এসেছে, সেই পরিচয়টি এখন শাসক-পরিবৃত একটি দমবন্ধকর অবস্থায় সার্বিকভাবে মুখ থুবড়ে পড়ে রয়েছে। মেলা কর্তৃপক্ষ অতীতেও শাসকের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা বজায় রাখত প্রশাসনিক নানা সুযোগ-সুবিধার তাগিদে। কিন্তু সেই ঘনিষ্ঠতার ভেতর শাসকের রাজনৈতিক পদক্ষেপকে সমর্থন করার ভয়াবহ, বিপজ্জনক প্রবণতা এবং একটা লোভনীয় খাবার দেখলে যে রকম জিভ দিয়ে জল পড়ে, তেমন প্রবণতা কিন্তু ছিল না।

আমাদের চরম পরিতাপের বিষয়, সেই পরিবেশ পশ্চিমবঙ্গ তথা ভারতের সারস্বত সমাজের কোনো ক্ষেত্রেই প্রায় আর এখন অবশিষ্ট নেই। বইমেলাও তার থেকে ব্যতিক্রম কিছু নয়। মুক্তবুদ্ধি চর্চার একটা খোলা জমি হিসেবে আমরা পৃথিবীর প্রায় প্রতিটি দেশে বইমেলাকে ব্যবহূত হতে দেখি। যেমনটা আমরা আমাদের এই কলকাতা শহরের বইমেলাকে ঘিরে দীর্ঘদিন ধরে দেখে আসছিলাম, তেমনটা কিন্তু এখন আর কোনো অবস্থাতেই দেখতে পাই না। প্রতিবাদ হলে, প্রতিরোধের সংকল্প দৃঢ় হলে; প্রতিবাদে সুদৃঢ়, প্রতিরোধী সংকল্পে অটল মানুষের ওপর বইমেলার মুক্তমঞ্চ থেকে কীভাবে রাষ্ট্রযন্ত্র তার নখদন্ত বের করে, তার সার্বিক চিত্র অনুভব, এখন আমরা এপার বাংলার মানুষেরা প্রায় প্রত্যেকেই ভুক্তভোগী হয়ে পড়েছি।

প্রতিবাদীর গায়ে রাষ্ট্রবিরোধী তকমা লাগিয়ে, গোটা রাষ্ট্রযন্ত্রকে প্রতিবাদের বিরুদ্ধে, প্রতিবাদীর বিরুদ্ধে লেলিয়ে দেওয়ার একটি ক্ষেত্র হিসেবে শাসক আজ যে বইমেলাকেও নিস্তার দিচ্ছে না; কলকাতা বইমেলার গত কয়েক বছরের বিভিন্ন ঘটনা বিচার-বিশ্নেষণ করলে তা আমাদের কাছে পরিস্কার হয়ে যায়। বস্তুত বিদ্যাচর্চার সামগ্রিক পরিমণ্ডলই এখন শাসকের অঙ্গুলি হেলনে পরিচালিত। মুক্তবুদ্ধির চর্চা আজ ভারতে ভয়ংকরভাবে শাসনযন্ত্র দ্বারা নিয়ন্ত্রণের কদর্য প্রয়াসে ক্লিন্ন, তার পাশাপাশি মেলাজুড়েই এখন সাম্প্র্রদায়িক, মৌলবাদী শিবিরের সশব্দ, দাম্ভিক পদচারণা।

একটা সময় ছিল যখন রাষ্ট্রীয় স্তরে হিন্দু সাম্প্রদায়িক মৌলবাদী শিবির রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করে গোটা দেশে আজ যেমন সাম্প্রদায়িক মেরুকরণের লক্ষ্যে যেসব উদ্যোগ নিয়েছে; তেমনটাই নিত। সেই চেষ্টা থেকে বইমেলাগুলোও বাদ যেত না। কিন্তু সেই উদ্যোগ সেই সময়ে কলকাতার বুকে কিন্তু প্রতিহত হতো রাজ্যের শাসকদের দ্বারা। কারণ তখন রাজ্যে কোনো অবস্থাতেই সাম্প্রদায়িক শিবিরের কোনো রকম বন্ধুত্বপূর্ণ মানসিকতাসম্পন্ন রাজনৈতিক শক্তি সরকার পরিচালনা করত না।

পোখরান বিস্টেম্ফারণ থেকে শুরু করে গুজরাট গণহত্যা, অপরপক্ষে বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনার প্রতি সমর্থন জ্ঞাপন কিংবা কুখ্যাত যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবি- সবকিছু ক্ষোভ, দাবিই উচ্চকণ্ঠে একবুক সাহসে দানা বেঁধে উচ্চারিত হতো বইমেলাতে। রাজ্যের শাসক কোনো অবস্থাতেই মেলা কর্তৃপক্ষকে এসব প্রতিবাদ-প্রতিরোধ ঘিরে এতটুকু প্রভাবিত করত না।
দিন যে বদলেছে- তা আজ কলকাতা বইমেলায় পা দিলেই হাড়ে হাড়ে টের পাওয়া যায়। সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ, বহুত্ববাদী চেতনায় সমৃদ্ধ ভারতবর্ষের প্রতি সম্মতি জ্ঞাপন, মধ্যকালীন ভারতের সমন্বয়ী চেতনার প্রতি আস্থা স্থাপন আজ কলকাতা বইমেলায় কার্যত একটি দুঃসাধ্য বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। মেলা কর্তৃপক্ষের নিয়ন্ত্রণাধীন মঞ্চ থেকে কোনো অবস্থাতেই বহুত্ববাদী ভারতবর্ষের চিন্তা-চেতনার প্রতি সম্মতি জ্ঞাপন করে রাজনৈতিক হিন্দুদের ধর্মান্ধ সাম্প্রদায়িকতা বা প্রতিযোগিতামূলক সাম্প্রদায়িক ও ভাষাভিত্তিক সাম্প্রদায়িকদের অপকর্মের বিরুদ্ধে কোনো কর্মসূচি পালন করতে পারা কার্যত এক দুঃসাধ্য বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে এখন।

অথচ আজ থেকে ১০ বছর আগে কলকাতা বইমেলায় হিন্দু-মুসলমান উভয় সম্প্রদায়ের মৌলবাদী, সাম্প্রদায়িক শিবিরের এ রকম স্থুলতা প্রকাশ্যে দেখতে পাওয়া কোনো অবস্থাতেই সম্ভব ছিল না। আজ দেশ-বিদেশের জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চার পাশাপাশি উভয় ধর্মের ধর্মান্ধ, সাম্প্রদায়িক, মৌলবাদী শিবিরগুলোর অন্ধকারকে আবাহনকারী বক্তব্য প্রচারের উদ্দেশ্যে প্রকাশ্যে পসরা সাজিয়ে বসে থাকতে আমরা দেখি; তেমনটা অতীতে ছিল না।

পশ্চিমবঙ্গের সারস্বত চর্চা এবং সংস্কৃতি চর্চার সার্বিক অঙ্গন যে এখন শাসক দ্বারা সর্বতোভাবে নিয়ন্ত্রিত; কলকাতা বইমেলা দেখলেই তা আমাদের কাছে এখন দিনের আলোর মতো পরিস্কার হয়ে যায়। চিন্তা-চেতনা জগতের এই দৈন্য কিন্তু গত ১০ বছর আগেও এপার বাংলায় দেখতে পাওয়া যেত না। প্রতিবাদ করলে কিন্তু রাষ্ট্রযন্ত্র নানাভাবে প্রতিবাদীর গায়ে শোষণের উলকি দেগে দেওয়ার স্পর্ধা দেখাত না। আর আজ সাহিত্য-সংস্কৃতি জগতের কার্যত একটা বড় অংশ যেভাবে শাসকের সঙ্গে নিজেদের সব ধরনের মিতালি পাতিয়ে, নিজেদের মেরুদণ্ডটা বিক্রি করে বসে আছে; তার জান্তব চিত্র আমরা যেমন সারস্বত মণ্ডলের সর্বক্ষেত্রে দেখতে পাচ্ছি, তেমনিই কলকাতা বইমেলার ক্ষেত্রেও দেখতে পাচ্ছি। রাষ্ট্রীয় শক্তির কাছে বুদ্ধিজীবী সমাজের আপস না করার যে সুমহান উত্তরাধিকার দেশ-কালের সীমা অতিক্রম করে বাঙালি সমাজের ছিল; আজ পশ্চিমবঙ্গের একাংশের শাসক তোষামোদকারী, কিছু লোকের করে-কম্মে খাওয়ার তাগিদে সেই উত্তরাধিকারের প্রশ্নটিই এখন একদম জাদুঘরে ঠাঁই নিয়েছে।

তবু তারই ভেতর শাহিনবাগ জাগছে। তারই ভেতর জাগছে দলীয় রাজনীতির অর্গলে আবদ্ধ না থেকে ছাত্র-যুবসমাজের রাজনীতি থেকে সমাজনীতি, সাহিত্য থেকে অর্থনীতি, কবিতা থেকে মিছিল- সবকিছু কুক্ষিগত করে সাম্প্র্রদায়িকতার কোটরে নির্বাসিত করার কদর্য প্রবণতার বিরুদ্ধে এক প্রতিবাদী সত্তা। কলকাতা বইমেলা সীমাবদ্ধতার ভেতরেও তার সার্থকতার নয়াদিগন্তের আভাস দিচ্ছে।

ভারতীয় গবেষক