আমরা যাদের সঙ্গে ওঠাবসা করি, চলাফেরা করি কিংবা সম্পর্ক রাখি, দেখা-সাক্ষাৎ হলে বা দূরালাপনীতে কথা বললে প্রশ্ন করি- কেমন আছ? এটা কখনও আন্তরিকতার সঙ্গে আবার কখনও নিতান্তই সৌজন্যের খাতিরে বলা হয়ে থাকে। কারণ কে কেমন আছে বা থাকল, তাতে আমাদের তেমন কোনো ক্ষতিবৃদ্ধি আছে, এমনটি আমরা অনেকেই মনে করি না। তারপরও আমরা জিজ্ঞেস করে থাকি- কেমন আছ ভাই? এটা একটা নির্দোষ প্রশ্ন। আমি কেমন আছি বা আপনি কেমন আছেন, তা জানতে চাওয়া মানে হলো আমি বা আপনি পরস্পরের ভালো-মন্দ থাকা নিয়ে কিছুটা হলেও ভাবিত। উত্তর যদি হয় ভালো; আমরা বলি- আলহামদুলিল্লাহ। আর যদি শুনি 'ভালো নেই', আমরা উদ্বেগ প্রকাশ করি। চেষ্টা করি তার ভালো না থাকার কারণ জানতে, ক্ষেত্রবিশেষে সমস্যা কাটিয়ে ওঠার উপায় উদ্ভাবনে। প্রিয়জনের ভালো থাকা আমাদের সবারই কাম্য। অবশ্য দু'চারজন যে এর ব্যতিক্রম নেই তা নয়। তারা মনে করে, কে কেমন থাকল তা নিয়ে আমার মাথাব্যথা থাকার দরকার কী? আমি কেমন আছি সেটাই বড় কথা। এ ধরনের ব্যক্তি লোকসমাজে স্বার্থপর হিসেবেই বিবেচিত। 'আপনারে লয়ে বিব্রত রহিতে আসে নাই কেহ অবনী 'পরে,/ সকলের তরে সকলে আমরা, প্রত্যেকে আমরা পরের তরে'- কবির এ উক্তি তাদের বেলায় প্রযোজ্য নয়। আর তারা বোধ করি কবির এ বাক্য কানেও নেয়নি কখনও।

যদি প্রশ্ন করা হয়, বর্তমানে আমাদের নিত্যসঙ্গী কে, যাকে ছাড়া আমরা এক কদমও হাঁটতে পারি না? কে কী জবাব দেবেন জানি না। তবে আমার মনে হয় 'রাজনীতি' নামের 'কায়াহীন মায়া'ই এখন আমাদের প্রাত্যহিক সঙ্গী। তাকে ছাড়া আমাদের একদিন, এমনকি এক মুহূর্তও চলে না। রাজনীতি আমাদের জীবনে এমনভাবে মিশে আছে যে, চলনে-বলনে, শয়নে-স্বপনে সে-ই এখন আমাদের অচ্ছেদ্য বন্ধু। দু'চারজন কোথাও একত্র হলেই, তা হোক শহর কিংবা গ্রামের চায়ের স্টলে কিংবা কোনো বিয়েবাড়ির প্যান্ডেলে, এ কথা-সে কথার পর সেখানে হুট করে ঢুকে পড়া বিষয়টির নাম রাজনীতি। কখনও কখনও তা পাসপোর্ট-ভিসা ছাড়াই দেশের সীমান্ত পেরিয়ে তা চলে যায় বহির্বিশ্বে। দেশ-বিদেশে কোথায় কী ঘটছে, কোন সরকার কী সিদ্ধান্ত নিচ্ছে, বিরোধী দল কী করছে, তা নিয়ে সরস-বিরস আলোচনা স্থান পায় সেসব আড্ডায়। রাজনীতির এই যে সর্বগামিতা, এটা ভালো কি মন্দ সে বিচারে না হয় নাইবা গেলাম। তবে এ থেকে এটা স্পষ্ট যে, আমরা অত্যন্ত রাজনীতিসচেতন। অনেকে আমাদের রাজনীতিমনস্ক জাতি হিসেবেও অভিহিত করে থাকেন। এটাকে নেতিবাচক দৃষ্টিতে দেখার পক্ষে নই। বরং দেশের সাধারণ জনগণের রাজনীতিসচেতন হওয়ার একটি ইতিবাচক দিক আছে। তারা যদি রাজনীতিসচেতন হন, তাহলে কোনো দল বা সরকারের ইচ্ছামাফিক কায়কারবার করার সুযোগটা কমে যায়। কিন্তু আমাদের দৈনন্দিন জীবনে 'ফেভিকল' আঠার মতো লেপ্টে থাকা রাজনীতির বর্তমান অবস্থা কেমন, সে প্রশ্ন কি আমরা কখনও করেছি? কখনও কি জিজ্ঞেস করেছি- রাজনীতি, তুমি কেমন আছ? যেহেতু রাজনীতি একটি অশরীরী অবয়ব, তাই এসব প্রশ্নের উত্তর তার পক্ষে দেওয়া সম্ভব নয়। প্রশ্নকর্তাকেই এর উত্তর খুঁজে নিতে হবে বিদ্যমান অবস্থা থেকে।

আমরা যদি এসব প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে আমাদের রাজনীতির দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ করি, তাহলে এটা পরিস্কার হয়ে যাবে যে, রাজনীতি ভালো নেই। তার শরীরে বাসা বেঁধেছে নানা রোগ। সে এখন অনেকটাই স্থবিরতায় ভুগছে। তার হূৎপিণ্ড অনেকটাই অকেজো। সে এখন নিজে নিজে সাবলীলভাবে চলতেও পারে না। তাকে পথ চলতে হচ্ছে অপরের কাঁধে ভর দিয়ে। ফলে সেই ভর দেওয়া শক্তির ইচ্ছামাফিক তাকে পথ চলতে হচ্ছে। তার মাথাও এখন ঠিকমতো কাজ করে না। মনে হয় স্মৃতিশক্তি বিনাশী রোগ 'ডিমেনশিয়া'য় আক্রান্ত সে। তার গলার স্বরেও আর আগের মতো তেজ নেই। তাই গলা ফাটিয়ে চিৎকার করে নচিকেতার সুরে বলতেও পারছে না- 'আমাকে আমার মতো চলতে দাও।' একটু রাজনীতির ফিলহাল অবস্থার দিকে ফিরে তাকাই! কী দেখছি আমরা? এককালে যে রাজনীতি ছিল সৌন্দর্যমণ্ডিত, যার অবয়ব ছিল স্বর্ণোজ্জ্বল, যেখান থেকে বিচ্ছুরিত হতো ঝলমলে আলোকরশ্মি; যার আলোতে আকৃষ্ট হয়ে মানুষ তার পানে ছুটে যেত মোহগ্রস্তের মতো, সে অবস্থা এখন আর নেই। রোগ-ব্যাধির আক্রমণে তার শরীর আজ এমনই জরাগ্রস্ত যে, মানুষ এখন তার প্রতি আকর্ষণ বোধ করে না। বরং তার কাছ থেকে দূরে থাকতে চায়। এখন প্রশ্ন হলো, কীভাবে আমাদের রাজনীতি এমন রোগাক্রান্ত হলো? কাদের কারণে রাজনীতি আজ সাধারণ মানুষের কাছে পরিত্যাজ্য? নিঃসন্দেহে এর জন্য দায়ী তারা, যারা রাজনীতিকে নিয়ে নানা কিসিমের খেলা খেলে থাকেন। রাজনীতি আজ যে দিকহারা, এ জন্য দায়ী তো তারাই, যাদের হাতে রয়েছে রাজনীতি নামের অশ্বটির লাগাম।

পূর্বেই উল্লেখ করেছি, আমরা রাজনীতিমনস্ক জাতি। রাজনীতির প্রতি আমাদের রয়েছে দুর্নিবার এক আকর্ষণ। আর তাই ব্যক্তিগত জীবনের লাভালাভের কথা বিবেচনায় না এনে অনেকেই নিজেকে সম্পৃক্ত করেছেন রাজনীতিতে। তারা তাদের জীবনের সবচেয়ে মূল্যবান সময় ব্যয় করেছেন রাজনীতির মাঠে। কিন্তু জীবনের পড়ন্তবেলায় হিসাব কষতে গিয়ে দেখেছেন, 'রেওয়া মিল' হচ্ছে না। লোকসানের পাল্লা ভারী। অন্যদিকে একটি শ্রেণি রাজনীতিকে বাহন বানিয়ে পৌঁছে যাচ্ছে মঞ্জিলে মকসুদে। তারা বিত্ত-বৈভবে যেমন পর্বতসম, তেমনি ক্ষমতায়ও একেকজন মস্ত হস্তী। তারাই দখল করে আছেন রাজনীতির মাঠ। অথচ রাজনীতির প্রতি আমরা আকৃষ্ট ছিলাম বলেই একাত্তরে স্বাধীনতার জন্য প্রশ্নাতীত জাতীয় ঐক্য গড়ে উঠতে পেরেছিল। রাজনীতির প্রতি ভক্তি-শ্রদ্ধা এবং বিশ্বাস ছিল বলেই এ দেশের মানুষ বারবার তাদের আস্থা স্থাপন করেছে রাজনীতির মানুষের ওপর। কিন্তু আমাদের রাজনীতির মানুষেরা সে আস্থা ও বিশ্বাসের দাম দিতে পেরেছেন কতটুকু? কখনও ব্যক্তিস্বার্থে, কখনও কোটারি স্বার্থে, তারা জনস্বার্থকে করেছেন পদদলিত, পথের ধুলায় লুণ্ঠিত।

রাজনীতির প্রতি আমাদের দেশের সাধারণ মানুষের অনীহার বিষয়টি প্রকটভাবে স্পষ্ট হয়েছে গত কয়েকটি নির্বাচনে ভোটার উপস্থিতির নিম্নহার থেকে। যে দেশের মানুষ ভোট দেওয়ার জন্য উন্মুখ হয়ে থেকেছে সবসময়, নিজের ভোটটি নিজে দেওয়ার জন্য শত শত মাইল পথ পাড়ি দিয়ে হাজির হয়েছে ভোটকেন্দ্রে, সেই মানুষগুলোই আজ 'ঘর হতে শুধু দুই পা ফেলিয়া' ভোটকেন্দ্রের মুখদর্শন করার ইচ্ছা অনুভব করে না। কেন এই বিমুখতা? কেন এই নিস্পৃহতা? বলা নিষ্প্রয়োজন, একদিনে এ পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়নি। এর জন্য কোনো ব্যক্তি, গোষ্ঠী বা দল এককভাবে দায়ী নয়। এ জন্য দায়ী রাজনীতির চালক-বাহকরা। রাজনীতিকে দেশ ও জনগণের সেবার ব্রত হিসেবে না নিয়ে ব্যক্তিগত ভাগ্য পরিবর্তনের হাতিয়ার হিসেবে তাদের অনেকেই এ জন্য দায়ী। এ দেশের মানুষ দেখেছে, কীভাবে রাষ্ট্রীয় সম্পদ লুণ্ঠন করে বিদেশে পাচার করা হয়েছে। তারা দেখেছে, রাজনীতিকে বর্ম বানিয়ে এক শ্রেণির মানুষ কীভাবে ফুলেফেঁপে পাটখড়ি থেকে বটগাছ হয়েছে। সমাজে যত অপকর্ম সংঘটিত হয়, তার বেশিরভাগের হোতারাই কোনোভাবে রাজনীতির ছাতার নিচের মানুষ। টেন্ডারবাজি, দখল কিংবা ক্যাসিনোর মতো জঘন্য জুয়া, সবকিছুর পেছনের মানুষগুলো সবাই রাজনীতির আবরণে আবৃত।

গত ২২ ফেব্রুয়ারি শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে গ্রেপ্তার হলো যে নারী, সেও তার সব অপকর্ম নির্বিঘ্নে চালানোর জন্য রাজনৈতিক পরিচয়কে ব্যবহার করেছে। এমন চরিত্রের একজন নারীও রাজনীতির জার্সি গায়ে চড়িয়েছিলেন। এ লজ্জা কার? রাজনীতির নাকি রাজনীতির মানুষদের? প্রশ্নটা সঙ্গত কারণেই সামনে এসে দাঁড়ায়- কারা এদেরকে পৃষ্ঠপোষকতা দেন? নির্দি্বধায় বলা যায়, তারা রাজনীতিরই মানুষ। শুধু এই একটি ঘটনা নয়। এমন বহু ঘটনাই আছে। টেন্ডার মোগল জি কে শামীম, ক্যাসিনো সম্রাট খালেদ কিংবা সন্ত্রাসী বাহিনীর গডফাদার ইসমাইল হোসেন সম্রাট, এরা সবাই নিজেদের অপকর্মগুলো করেছে রাজনীতির মুখোশে মুখ ঢেকে। আর এভাবেই দুর্বৃত্তায়িত হয়েছে আমাদের রাজনীতি। আর তা থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে সাধারণ মানুষ। শুনতে খারাপ শোনা গেলেও বলতে দ্বিধা নেই যে, সাধারণ মানুষ এখন রাজনীতিকদের অনেককেই আগের মতো শ্রদ্ধার চোখে দেখে না। বরং তারা আমাদের রাজনীতির পূর্বপুরুষদের সঙ্গে আজকের রাজনীতিকদের অনেকের ছবি মেলাতে গিয়ে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই হতাশ হচ্ছেন। এ কথা অস্বীকার করার জো নেই যে, রাজনীতিকে আমরা নিজ নিজ প্রয়োজনে ব্যবহার করলেও কখনও তার স্বাস্থ্যের খোঁজ নিইনি। উদ্যোগ নেওয়া হয়নি তার নিরাময়ের। এ থেকে পরিত্রাণের পথ খুঁজতে হবে রাজনীতিকদেরই। স্থবিরতার বৃত্তমুক্ত করতে হবে রাজনীতিকে।

সাংবাদিক ও রাজনৈতিক বিশ্নেষক