করোনাভাইরাস দীর্ঘস্থায়ী হলে এবং অন্য দেশগুলোয় ছড়িয়ে পড়লে বিশ্ব অর্থনীতিতে কী প্রভাব পড়তে পারে, তার উদ্বেগজনক চিত্র তুলে ধরেছে বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় অর্থনৈতিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান অক্সফোর্ড ইকোনমিকস। এই প্রতিষ্ঠান বলছে, করোনাভাইরাসের কারণে চলতি বছরের প্রথম প্রান্তিকে চীনের প্রবৃদ্ধি দুই শতাংশ কমে যেতে পারে। অথচ করোনাভাইরাসের আবির্ভাবের আগে এই প্রবৃদ্ধি ছিল ছয় শতাংশ। চীনের প্রবৃদ্ধির হার কমে গেলে স্বাভাবিকভাবেই বৈশ্বিক জিডিপিতেও এর প্রভাব পড়বে। তাদের পূর্বাভাসে বলা হয়, করোনাভাইরাস এশিয়ার বাইরে ছড়িয়ে পড়লে বিশ্ব অর্থনীতির ক্ষতি হবে এক লাখ ১০ হাজার কোটি (এক দশমিক এক ট্রিলিয়ন) ডলারের, যা বিশ্বের মোট অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির এক দশমিক তিন শতাংশ। এশিয়ায় এই ভাইরাসের কারণে অর্থনীতির সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হবে বলে এডিবি ঘোষণা দিয়েছে। করোনাভাইরাসের কারণে জাপানের অর্থনীতিতে মন্দার আশঙ্কা করা হচ্ছে। বড় ধরনের প্রভাব পড়তে পারে ইতালি, দক্ষিণ কোরিয়া ও জার্মানির অর্থনীতিতেও। মালয়েশিয়া ও সিঙ্গাপুরের অর্থনীতিতে প্রভাব অনিবার্য বলে দেশগুলো জানিয়েছে। চীনের বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভের অন্তর্ভুক্ত দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোও করোনার ধাক্কা এড়াতে পারবে না। প্রভাব পড়বে এসব দেশের কর্মসংস্থান ও অর্থনীতিতে। চীনের বড় বাণিজ্যিক অংশীদার ব্রাজিলে মন্দা দেখা দিতে পারে। যুক্তরাষ্ট্রে এরই মধ্যে করোনার আক্রমণ শুরু হয়ে গেছে। মার্কিন প্রেসিডেন্ট বিশেষ তহবিল বরাদ্দের ঘোষণা দিয়েছেন। যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স কোথায় নেই করোনার প্রভাব। বাংলাদেশ, তুরস্ক, মেক্সিকোসহ অনেক দেশের পোশাক কারখানাগুলোও ভীষণভাবে চীনের কাঁচামালের ওপর নির্ভরশীল। চীন শুধু সারাবিশ্বে পণ্য সরবরাহই করে না; চীনের ১৪০ কোটি মানুষ এখন ইলেকট্রনিক গ্যাজেট, ফ্যাশনেবল পোশাক আর বিদেশ ভ্রমণেও প্রচুর অর্থ ব্যয় করে থাকে। চীন বিশ্বের সবচেয়ে বড় বাজার। আমেরিকার বহুজাতিক বিনিয়োগ ব্যাংক মরগ্যান স্টানলির এশিয়া বিভাগের সাবেক চেয়ারম্যান স্টিফেন রোচ বলেছেন, করোনাভাইরাসের কারণে বিশ্ব অর্থনীতিতে মন্দা দেখা দিতে পারে। বিমান সংস্থাগুলোর সামনে 'কঠিন বছর'। আন্তর্জাতিক বিমান পরিবহন সমিতি (আইএটিএ) জানিয়েছে, এশিয়া-প্যাসিফিক অঞ্চলে করোনাভাইরাসের কারণে এবার দুই হাজার ৯৩০ কোটি ডলার ক্ষতি হবে। এবার বিমান সংস্থাগুলোর যাত্রী ১৩ শতাংশ কমে যাবে বলে সংস্থাটি জানিয়েছে। আক্রান্ত দেশগুলো নিজেদের সংকুচিত করে ফেলেছে। ফলে কমে গেছে আকাশ, স্থল ও জলপথের যোগাযোগ।
বাংলাদেশ বিশ্বের বাইরে নয়। বাংলাদেশের অর্থনীতিতে করোনাভাইরাসের প্রভাব ইতোমধ্যে পড়তে শুরু করেছে। করোনা আতঙ্কে দেশের শেয়ারবাজারে স্মরণকালের বড় ধস নেমেছে। করোনার প্রভাবে দেশের পোশাক শিল্পের ওপর বড় প্রভাব পড়তে যাচ্ছে বলে মনে করা হচ্ছে। যদিও সাম্প্রতিক সময়ে পোশাক রপ্তানি আয় এমনিতেই পড়তির দিকে। পোশাক রপ্তানির অন্যতম প্রধান বাজার হচ্ছে ইউরোপ, যুক্তরাষ্ট্র। করোনাভাইরাসের কারণে সেখানকার বাজারে এরই মধ্যে প্রভাব পড়তে শুরু করেছে। ইতালিতে মানুষ ঘর থেকেই বের হতে পারছে না। যেখানে ১৪৩ কোটি ডলারের পোশাক রপ্তানি করেছে বাংলাদেশ গত বছর। ধীরে ধীরে একই পরিস্থিতি তৈরি হচ্ছে গোটা ইউরোপে, এমনকি যুক্তরাষ্ট্রেও।
বাংলাদেশের পোশাক রপ্তানির ৬২ শতাংশ আসে ইউরোপ থেকে আর ১৮ শতাংশই যুক্তরাষ্ট্র থেকে। তৈরি পোশাক শিল্পের উদ্যোক্তারা বলছেন, তারা এরই মধ্যে চাহিদা কমে যাওয়ার আঁচ পেতে শুরু করেছেন। বিজিএমইএর সভাপতি রুবানা হক বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্রের খুচরা বাজারে শতকরা তিন দশমিক এক ভাগ বিক্রি এরই মধ্যে কমে গেছে, কমে যেতে শুরু করেছে ক্রেতাদের কার্যাদেশও। আমাদের রপ্তানি বাজারগুলোয় যদি করোনা ব্যাপক আকারে ছড়িয়ে পড়ে, তাহলে পোশাকের চাহিদা অনেক কমে যাবে। ফলে পোশাক শিল্পের সমস্যা হতে পারে। আবার একইভাবে অনেকে এতে সম্ভাবনাও দেখছেন। করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবের কারণে চীন থেকে পণ্য আমদানি বন্ধ বা কমিয়ে দিয়েছে অনেক আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান। এর ফলে পোশাক খাতে বাংলাদেশের সুবিধা পাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। হংকংভিত্তিক একটি প্রতিষ্ঠানের প্রতিবেদনেও এমন তথ্য উঠে এসেছে। ২০০টি আন্তর্জাতিক ক্রেতা কোম্পানির ওপর তারা এ জরিপটি চালিয়েছে। এই প্রতিষ্ঠানগুলো বলছে, তারা চীনের বদলে এখন অন্য দেশ থেকে পণ্য সংগ্রহের দিকে ঝুঁকছে। যার মধ্যে ভিয়েতনাম, ভারতের সঙ্গে রয়েছে বাংলাদেশও।

বাংলাদেশের অর্থনীতির আরেকটি চালিকাশক্তি হচ্ছে রেমিট্যান্স। চলতি অর্থবছরের প্রথম আট মাসে এক হাজার ৪২ কোটি ডলার দেশে পাঠিয়েছেন প্রবাসীরা, যা আগের বছরের একই সময়ের চেয়ে ১০ শতাংশ বেশি। করোনার কারণে এই গতি ধরে রাখা এখন কঠিন হয়ে যেতে পারে বাংলাদেশের জন্য। যেসব দেশ করোনাভাইরাসে আক্রান্ত, সেখানে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড এরই মধ্যে অনেক কমে গেছে। সেখানে বসবাসরত বাংলাদেশি শ্রমিকরা আয় করতে না পারলে দেশে পরিবারের কাছে আগের মতো টাকা পাঠাতে পারবেন না। তাই স্বভাবতই রেমিট্যান্স কমতে থাকবে। এর প্রভাব পড়বে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভে। করোনার প্রভাবে বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের দামে ২০০৮ সালের পর সবচেয়ে বড় পতন হয়েছে। জ্বালানি তেলের দাম পড়তে থাকলে বড় ধরনের লোকসানে পড়তে পারে মধ্যপ্রাচ্যের জ্বালানি তেলনির্ভর অর্থনীতির দেশগুলো। বাংলাদেশের প্রবাসী আয়ের বড় অংশটিই কিন্তু আসে এ অঞ্চল থেকে। দেশে টাকা পাঠাতে না পারলে, দেশের মানুষের ক্রয়ক্ষমতা কমে যাবে; যার প্রভাব পড়বে দেশীয় বাজারে। পোশাক ও রেমিট্যান্সে ধাক্কা লাগলে অনেক লোক চাকরি হারাতে পারেন। অনেক প্রবাসী কাজ না থাকলে দেশে ফিরতে বাধ্য হতে পারেন- এতে দেশের বেকার সমস্যা আরও বাড়তে পারে। করোনাভাইরাস বিশ্ব অর্থনীতিকে কোন দিকে নিয়ে যায়, তাই এখন দেখার বিষয়। আমরা আশাবাদী মানুষ। নিশ্চয়ই এরই মধ্যে মানুষ এর প্রতিষেধক বের করে ফেলবে এবং শিগগিরই এটা থেকে আমাদের মুক্তি ঘটবে- এমনটাই আমাদের প্রত্যাশা।
অর্থনীতি বিশ্নেষক
anwarfaruq@yahoo.com