- মুক্তমঞ্চ
- আদালত ও কারাগারের সতর্কতা
আদালত ও কারাগারের সতর্কতা

১৮ মার্চ করোনায় মৃত্যুর খাতা খুলেছে বাংলাদেশ। সমগ্র বিশ্ব করোনার প্রভাবে একে অপরের কাছ থেকে আজ বিচ্ছিন্ন। আমাদের দেশেও যোগাযোগের ক্ষেত্রে সে প্রভাব পরিলক্ষিত। সদাশয় সরকার পরিস্থিতি অনুধাবনে ৩১ মার্চ পর্যন্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ রেখেছে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ করার উদ্দেশ্য ছিল ব্যক্তি ও প্রাতিষ্ঠানিক পর্যায়ে বিপদ এড়াতে সংগনিরোধ করা। যাতে করে এই সংক্রামক ব্যাধিটি অন্যদের থেকে সংক্রমিত হতে না পারে। কিন্তু পরিস্থিতি তার উল্টো। বন্ধের সুযোগে পরিবার-পরিজন কক্সবাজার সমুদ্রসৈকতসহ দেশের বিভিন্ন পর্যটনকেন্দ্রে ভিড় জমাচ্ছেন।
ভারতের সুপ্রিম কোর্টে জরুরি বিষয় ছাড়া অন্য কোনো কাজই হচ্ছে না। ১৮ মার্চ কার্যতালিকায় থাকার পরও করোনার প্রভাবে ফেলানী হত্যার ন্যায্যবিচার প্রার্থনার তরে আনীত রিটের পূর্বনির্ধারিত শুনানি হয়নি। শুধু তাই নয়, কার্যতালিকা থেকেও সেটি বাদ গেছে। ভারত করোনাকে মহাদুর্যোগ হিসেবে দেখছে। জনসংখ্যার যে ঘনত্ব তাতে এ রোগ বিস্তারের সবচেয়ে বড় উর্বর ভূমি হবে বাংলাদেশ। এটি প্রতিরোধ করার মতো সক্ষমতা উন্নত রাষ্ট্রেরই নেই। সম্ভাব্য পরিস্থিতি কত ভয়াবহ হতে পারে, তা কি আমরা উপলব্ধি করতে পারছি?
এই রোগের সম্ভাব্য আক্রমণ থেকে বাঁচতে গমনাগমনে আত্মনিয়ন্ত্রণ, জনবিচ্ছিন্ন ও পরিস্কার-পরিছন্ন থাকাই মূল কাজ। আর এই কাজগুলো উচ্চবিত্ত ও মধ্যবিত্তরা সহজে করতে পারলেও অর্থনৈতিকভাবে প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর জন্য দুরূহ। কারণ তাদের প্যাডেল চালিয়েই পেট চালাতে হয়। ফলে করোনার মহামারিতে দুর্ভোগে পড়বেন গরিব মানুষ। তারা গ্রাম ও শহরে রোগ ও অভাবে পতিত হবেন।
আমরা যদি উত্তরাঞ্চলের দিকে তাকাই তবে দেখব, তাদের অধিকাংশই শ্রমজীবী ও অর্থনৈতিকভাবে প্রান্তিক। তাদের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ দেশের বিভিন্ন জেলায় শ্রম বিকোতে যান। এর মধ্যে ঢাকা-চট্টগ্রামসহ বড় শহরগুলোতে এদের অবস্থান বেশি। এদের উল্লেখযোগ্য সংখ্যা বস্তিবাসী। করোনার প্রভাবে যদি সবকিছু বন্ধ হয়ে যায়, তবে এদের পেটে খাদ্য যাবে না। এরা কর্মহীন হয়ে পড়বেন। আমাদের সরকার দেশের দরিদ্র জনগোষ্ঠীর জন্য কাজের মন্দার সময়ে কাজের ব্যবস্থা করে থাকে, খাদ্যের ব্যবস্থাও করে। টিআর-কাবিখার মতো কর্মসূচি চালু করে। কম দামে চাল ও আটা দিয়ে থাকে। যেহেতু করোনার কারণে নানামুখী ছুটিছাটায় রাজধানীসহ নানা শহরের মানুষ কর্মহীন হয়ে পড়বেন, তাদের বেঁচে থাকার জন্য আপদকালীন সহযোগিতা দিতে হবে রাষ্ট্রকে। ঢাকা শহরের মজুর, গার্মেন্টের স্বল্প বেতনের চাকুরে ও রিকশাওয়ালাদেরও মানবিক সহযোগিতার আওতায় আনতে হবে, গ্রামের গরিবদের জন্যও মানবিক সুবিধা সৃজন করতে হবে।
একই সঙ্গে কারাগার ও আদালতে ব্যবস্থা নেওয়া উচিত। ১৮ মার্চ ২০২০-এর পরিসংখ্যান মতে, দেশে ৪০ হাজার ৬৬৪ বন্দি ধারণের স্থলে ৮৮ হাজার ১৬৬ জন বন্দি আছে। কুড়িগ্রাম জেলখানায় ১৬৭ জন ধারণক্ষমতার স্থলে বন্দি আছে ৭৪৮ জন। খুলনায় আছে ৬৭৮ জনের স্থলে ১৬২০ জন। ব্রিটিশরা যখন জেলকোড তৈরি করে, তখন একজন বন্দির জন্য ৩৬ বর্গফুট জায়গাকে মাথায় নিয়েছিল। এখন একজনের জন্য দশ বর্গফুট জায়গাও নেই। বর্তমান এই বন্দিঘনত্ব করোনার ঝুঁকিতে ফেলতে পারে। জেলখানার ভার কমানোর জন্য ছোট ছোট দণ্ডযোগ্য অপরাধের মামলার বন্দিদের জামিন বা মুক্তির বিষয়ে রাষ্ট্র ভাবতে পারে আর আদালতের তো বিবেচনার এখতিয়ার রয়েছেই। বর্তমানে করোনাভাইরাসের কারণে বিপুলসংখ্যক বন্দি নিয়ে আমাদের শক্তভাবে ভাবার প্রয়োজন আছে। যারা নবাগত বন্দি তাদের শারীরিক পরীক্ষায় বাধ্য করা। বিশেষত যাদের জ্বর-কাশির মতো উপসর্গ থাকবে, তাদের কোয়ারেন্টাইনে থাকার ব্যবস্থা করা জরুরি। তাদের জন্য আইসোলেশন ওয়ার্ড প্রস্তুত করা।
করোনাভাইরাসে আক্রান্ত কাউকেই জেলখানায় না নেওয়া। এ ধরনের কেউ বন্দি হয়ে গেলে তাকে কেন্দ্র করে অন্য বন্দিদের মধ্যে উত্তেজনাও তৈরি হতে পারে। বিশেষত রাষ্ট্রবিরোধী নানা অপরাধে সাজাপ্রাপ্ত অনেক বন্দি আছে, যাদের অনেক অনুসারীও আছে, যারা আতঙ্ক তৈরি করে জেলখানায় বৈরী পরিবেশ সৃষ্টির চেষ্টা নেবে। আবার গুরুতর অপরাধের কারণে আটক অনেকে করোনার সুযোগে জেলখানা থেকে আইনের ফাঁকে যাতে বেরিয়ে আসতে না পারে, সে বিষয়টিও প্রসিকিউশনকে বিবেচনায় নিতে হবে। আদালতপাড়ায় মানুষের ভিড় ও যন্ত্রণার কথা অনেক পুরোনো।
এই মুহূর্তে সুপ্রিম কোর্ট দুই সপ্তাহের জন্য অবকাশে আছেন। দিনকয়েক বাদে আবার খুললে জনসমাগম বৃদ্ধি পাবে। ঢাকা জজকোর্টে শুধু আইনজীবীই রয়েছেন ২০-২৫ হাজার। মোহরার সংখ্যা লক্ষাধিক। আদালতগুলোতে প্রতিদিন লাখ লাখ মানুষ আইনের বাধ্যবাধকতার কারণে আসতে বাধ্য হন। তারিখের দিন আদালতে না এলে মামলা খারিজ হয়, আসামির জামিন অনেক ক্ষেত্রে বাতিল হয়, নিষেধাজ্ঞার শুনানি থাকে, সাক্ষীর সমন ও ওয়ারেন্ট থাকে। এ ধরনের বেশ কিছু বিষয় আছে, যার জন্য একজন আইনের সাহায্যপ্রার্থী মানুষকে আদালতে আসতে বাধ্য হতে হয়। এ ক্ষেত্রে যুক্তিসঙ্গত মনে করলে আদালতের সহযোগিতায় মামলার লম্বা দিনান্তর হতে পারে। এই দিনান্তর জনচাপ কমাতে সাহায্য করবে অথবা আদালত এক মাসের ভ্যাকেশনে যেতে পারেন কিংবা ডিসেম্বরের সিভিল ভ্যাকেশন এগিয়ে এনে এখন তা কার্যকর হতে পারে। তবে এ ক্ষেত্রে আইনজীবী ও আদালতের ইতিবাচক মনোভাব থাকতে হবে।
সাবেক রাকসু নেতা, আইনজীবী ও মুক্তিযুদ্ধ গবেষক
মন্তব্য করুন