- মুক্তমঞ্চ
- করোনাকালে অনলাইন শিক্ষা কার্যক্রম
করোনাকালে অনলাইন শিক্ষা কার্যক্রম

অনলাইনে শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনা বিশ্বব্যাপী একটি অতি জনপ্রিয় ব্যবস্থাপনা। উন্নত দেশগুলোতে অনেক আগে থেকেই এ কার্যক্রম পরিচালিত হয়ে আসছে এবং শিক্ষার্থীদের মধ্যে ব্যাপক আগ্রহ ও উৎসাহ লক্ষ্য করা যায়। অনলাইনের কল্যাণে এক দেশে বসে অন্য দেশের নামিদামি বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লাসরুমে সংযুক্ত হওয়া, লেকচার শোনা, পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করা, সর্বোপরি ডিগ্রি অর্জন তেমন আর নতুন কিছু নয়। বর্তমান বিশ্বের এই সংকটময় মুহূর্তে সারা পৃথিবী লকডাউন অবস্থায় আছে এবং এ অবস্থা দীর্ঘায়িত হতে পারে বলে মনে করা হচ্ছে। সবাইকে যার যার ঘরে থাকতে বলা হচ্ছে এবং বই-গল্প পড়া, ধর্ম-কর্ম পালন করা, টেলিভিশন দেখা, হালকা ব্যায়াম করা, স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা ইত্যাদি কার্যক্রম করে সময় কাটাতে বলা হচ্ছে।
প্রাণঘাতী করোনার এই মরণ ছোবল আমাদের মাতৃভূমি বাংলাদেশের ওপর দিয়েও বয়ে যাচ্ছে। তাই বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও সরকারি-বেসরকারি অফিস-আদালত এবং প্রায় সব ধরনের ব্যবসা-বাণিজ্য আপাতত বন্ধ। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান অর্থাৎ স্কুল-কলেজ, মাদ্রাসা ও বিশ্ববিদ্যালয়গুলো বন্ধ আছে এবং ধারণা করা হচ্ছে, এই বন্ধ দীর্ঘায়িত হতে পারে। এমনকি এই বন্ধ ঈদুল ফিতর পর্যন্ত থাকতে পারে। শিক্ষার্থীরাও যার যার বাড়িতে, শহরে কিংবা গ্রামে অবস্থান করছে। এমতাবস্থায় শিক্ষা কার্যক্রমে মারাত্মক ক্ষতির সম্মুখীন হওয়ার আশঙ্কা থাকে। এবং এই আশঙ্কা থেকেই সরকার ও শিক্ষা মন্ত্রণালয় প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ে অনলাইনে ক্লাস পরিচালনা শুরু করেছে। শিক্ষাবান্ধব প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা ও অনুপ্রেরণায় এবং শিক্ষামন্ত্রীর সরাসরি তত্ত্বাবধানে 'আমার ঘরে আমার স্কুল' প্রোগ্রামের আওতায় সংসদ টেলিভিশনের মাধ্যমে এই অনলাইন ক্লাস সরাসরি পরিচালিত হচ্ছে, যা দেশব্যাপী সব মহলের প্রশংসা কুড়িয়েছে।
এ অবস্থায় বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে অনলাইনে ক্লাস পরিচালনা করার জন্য প্রজ্ঞাপন জারি করেছে এবং অনলাইনে শিক্ষাদানের পাশাপাশি করোনার বিস্তার রোধে প্রয়োজনীয় জনসচেতনমূলক কার্যক্রম যেমন হ্যান্ড স্যানিটাইজার তৈরির সহজ পদ্ধতি, ব্যক্তিগত ও পারিবারিক নিরাপত্তায় কীভাবে কার্যকর ভূমিকা রাখা যায় সে ব্যাপারে আলোচনা আহ্বান জানিয়েছে। এ লক্ষ্যে বাংলাদেশ গবেষণা ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের (BDRen) ডাটা সেন্টারে স্থাপিত 'Zoom Application' টি ব্যবহার করতে বলা হয়েছে। ইতোমধ্যে এই সফটওয়্যারটির লিংক এবং ব্যবহারবিধি সব পাবলিক ও প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রেরণ করা হয়েছে। আগ্রহী শিক্ষকদের অনেকেই ইতোমধ্যে এই সফটওয়্যারটি তাদের কম্পিউটারে সংযোজন করেছেন এবং অনেকেই সম্পূর্ণ ব্যক্তিগত উদ্যোগে অনলাইনে ক্লাস নেওয়া শুরু করেছেন। উল্লেখ্য, প্রায় সবক'টি প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় অনলাইনে শতভাগ ক্লাস পরিচালনা করে আসছে এই মহামারী করোনা শুরু হওয়ার পরপরই। অর্থাৎ সরকার ঘোষিত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধের পরপরই। সে ক্ষেত্রে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের 'Zoom Application'-এর অধীনে Zoom Class Room ব্যবহার করে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো অনলাইনে তাদের শিক্ষা কার্যক্রম চালু করলে শিক্ষার্থীরা খুবই উপকৃত হবে।
উল্লেখ্য, জুম অ্যাপ্লিকেশনটির অনলাইন ক্লাস, অনলাইন কনফারেন্সসহ নানাবিদ প্রোগ্রাম বিশ্বব্যাপী খুবই সমাদৃত ও জনপ্রিয়। ইন্টারনেট কানেকশন থাকলে এটি ব্যবহার করা খুবই সহজ এবং ৪০-৪৫ মিনিটের একটি ক্লাসে ১০০ জন শিক্ষার্থীর জন্য এটি একটি ফ্রি প্যাকেজ। অর্থাৎ কোনো খরচ নেই। গুগল কোম্পানি বিশ্বব্যাপী এই সুযোগটি সবার জন্য উন্মুক্ত করে রেখেছে। তবে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের দেওয়া অ্যাপ্লিকেশনটি প্রাইভেট ও পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য আনলিমিটেড টাইম এবং ৩০০ জন শিক্ষার্থীর জন্য ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। এটি একটি খুবই চমৎকার প্রোগ্রাম। অনেকটা শ্রেণিকক্ষে ক্লাস নেওয়ার মতোই বরং অনেক সুযোগ-সুবিধা আছে, যেগুলো সরাসরি ক্লাসে থাকে না। এই প্ল্যাটফর্মে ছাত্র-শিক্ষক সবাই সবাইকে দেখছে, শুনছে, প্রশ্ন করছে এবং উত্তর দিতে পারছে। প্রয়োজনে চ্যাট বপে যে কোনো কমেন্ট, সাজেশন ও প্রশ্ন লিপিবদ্ধ করে রাখতে পারে। আলোচনা-পর্যালোচনা, কমেন্ট ইত্যাদি অটোমেটিক্যালি রেকর্ড ও ভিডিও করার ব্যবস্থা আছে। এ সিস্টেমে অটোমেটিক্যালি একটি ওয়েব লিংক তৈরি করা যায়, যা ব্যবহার করে শিক্ষার্থীরা আলোচনাটি যখন ইচ্ছা শুনতে ও দেখতে পাবে। ফলে যেসব শিক্ষার্থী নির্দিষ্ট সময়ে এই অনলাইন ক্লাসে সংযুক্ত হতে পারেনি; পরবর্তী সময়ে এই লিংক ব্যবহার করে তারা পুরো ক্লাসটি শুনতে পাবে ও উপকৃত হবে।
এখানে আছে হোয়াইট বোর্ড, যেখানে শিক্ষক 'সরাসরি ক্লাস'-এর মতোই লিখতে, ড্রয়িং করতে পারেন, বোঝাতে পারেন, মুছতে পারেন ইত্যাদি। পরে আবার কখন, কোন দিন, কোন সময়, রাতে কিংবা দিনে, সন্ধ্যা বা বিকেলে অর্থাৎ ২৪ ঘণ্টাই ক্লাসের সিডিউল করার ব্যবস্থা আছে। শুধু দরকার একটি ইন্টারনেট কানেকশন এবং একটি ডেস্কটপ কিংবা ল্যাপটপ অথবা স্মার্ট মোবাইল ফোন। আধুনিক এই প্ল্যাটফর্মটি ব্যবহার করতে তেমন কোনো কারিগরি দক্ষতার প্রয়োজন নেই। যাদের সামান্য কম্পিউটার পরিচালনা এবং ইন্টারনেট ব্যবহারের অভ্যাস আছে, তাদের এই প্ল্যাটফর্মে নিজেকে সম্পৃক্ত করতে আধা ঘণ্টা থেকে এক ঘণ্টা সময় ব্যয় করতে হবে। আর আমাদের অভিজ্ঞতায় আমরা দেখেছি, শিক্ষার্থীরা অনেকেই এই প্ল্যাটফর্মের সঙ্গে পরিচিত অনেক আগ থেকেই। তবে এখানে ছাত্র শিক্ষকের কাছাকাছি বা সংস্পর্শে আসতে পারে না। পারে না শিক্ষক ছাত্রকে সরাসরি কন্ট্রোল করতে। শিক্ষার্থী এ ধরনের ভার্চুয়াল ক্লাসে সংযুক্ত হয় ঠিকই, কিন্তু সে কি কম্পিউটার কিংবা ল্যাপটপের সামনে বসে আছে, নাকি বিছানায় শুয়ে আছে, শিক্ষক তা নিয়ন্ত্রণ করতে পারেন না। আবার শিক্ষক যেসব আলোচনা করেন তা যে শুধু শিক্ষার্থীই শুনছে; তা কিন্তু নয়।
বাংলাদেশে আমাদের আছে রমজান, শীত-গ্রীষ্ম, নির্বাচনের ছুটি, পরিবহন ধর্মঘট এবং অঘোষিত আন্দোলন। শিক্ষার্থীরা তখন যার যার ঘরে অবস্থান করে থাকে। এসব কারণে বছরে প্রায় চার মাস অর্থাৎ এক-তৃতীয়াংশ সময় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকে। এই সময়ে শিক্ষার্থীদের 'সরাসরি ক্লাস'-এর বিকল্প হিসেবে অনলাইন ক্লাসের মাধ্যমে পাঠদান করা যেতে পারে। সে ক্ষেত্রে 'Zoom Class Room'-এর মতো প্ল্যাটফর্মের বিকল্প নেই। সর্বোপরি এ রকম একটি সহজ ও সহজলভ্য আধুনিক ডিজিটাল পদ্ধতিতে আমরা নিজেদের খাপ খাইয়ে নেওয়ার এখনই উত্তম সময়।
অধ্যাপক ও পরিচালক, ইনস্টিটিউট অব ইনফরমেশন টেকনোলজি, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
মন্তব্য করুন