মানুষ গৃহবন্দি, কিন্তু তার ভাবনার অপমৃত্যু ঘটেনি। ঘটবেও না কোনোদিন। কারণ ভাবনার মৃত্যু নেই। আর ভাবনারাই তো এ বিশ্বকে গড়েছে; জ্ঞান-বিজ্ঞানের উত্থান ও প্রসার ঘটিয়েছে। সেই ভাবনা থেকেই মানুষ উদ্বিগ্নচিত্তে আজ প্রশ্ন তুলছে-

মেডিসিনের দেশ সুইজারল্যান্ড অসহায়; প্রযুক্তির দেশ জার্মানি নিরুপায়; মানবতার দেশ ইতালি কাঁদছে; ক্ষমতার দেশ আমেরিকা দিশেহারা। বস্তুত চীনে ডিসেম্বরে শুরু হয়ে জানুয়ারি, ফেব্রুয়ারি ও মার্চে করোনাভাইরাস দৃশ্যত বিশ্বভ্রমণে বেরিয়ে দেশে দেশে যে মৃত্যুর মিছিল সংগঠিত করেছে, তার ভয়াবহতা ও মানুষের অসহায়তা বোঝাতেই সুইজারল্যান্ড, জার্মানি, ইতালি ও আমেরিকার প্রসঙ্গ তোলা হয়েছে। গোটা পৃথিবীর সংবাদমাধ্যম ঘণ্টায় ঘণ্টায় আক্রান্ত ও মৃত্যুর যে তালিকা প্রকাশ করে চলেছে, তা থেকেই মানুষের মনে ওই চারটি দেশ সম্পর্কে নানা প্রশ্ন মানুষের ভাবনায় স্থান পেয়েছে।

চীনে যখন ঘটল; লাখের মতো মানুষ আক্রান্ত হলো, কিন্তু কয়েক দিনের মধ্যে হাজারতিনেক মানুষের মৃত্যুর পর তারা যে দ্রুততায় রোগটিকে বিদায় দিল; তেমন বা তার চাইতে দ্রুততার সঙ্গে ইতালি, ফ্রান্স, জার্মানি, ইংল্যান্ড ও আমেরিকা কেন পারল না- তা ভেবে সত্যিই কূল-কিনারা পাচ্ছেন না সারা পৃথিবীর চিন্তাশীল ঘরে বসে থাকা কোটি কোটি মানুষ। ওই উন্নত দেশগুলোর স্বাস্থ্য ব্যবস্থা কি এতই দুর্বল? তাদের স্বাস্থ্য বিজ্ঞানীরাও এতটা পেছনে পড়ে আছেন যে, করোনার হাত থেকে মানুষকে বাঁচানোর কোনো ওষুধ আজও তারা আবিস্কার করতে পারছেন না? বিস্মিত হতে হয়, কয়েক হাজার মানুষের মৃত্যু এবং লক্ষাধিক মানুষের সংক্রমণের পর সংবাদ সম্মেলন করে যখন ডোনাল্ড ট্রাম্প বলেন, আমেরিকায় আরও এক থেকে দুই লাখ লোক এপ্রিলে মারা যেতে পারেন।\হঅপরদিকে খোদ ব্রিটেনের খবর। ইংল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী ও স্বাস্থ্যমন্ত্রী করোনায় আক্রান্ত। আফ্রিকার (সম্ভবত) একটি দেশের স্বাস্থ্যমন্ত্রী দেশবাসীকে করোনা আক্রমণের হাত থেকে রক্ষা করতে না পেরে আত্মহত্যা করেছেন। বহু গৌরবের অধিকারী, ফুটবলে পৃথিবীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ দেশ এবং অসংখ্য গৌরবের অধিকারী উন্নত দেশ ইতালি যখন মৃত্যুপুরিতে পরিণত হয়; ফ্রান্স-জার্মানির মতো জ্ঞান-বিজ্ঞান-সভ্যতায় শীর্ষস্থানে অধিষ্ঠিত ইউরোপীয় দেশে যখন প্রতিদিন শত শত মানুষ আক্রান্ত হন, মৃত্যুবরণ করেন; তখন মানুষ আতঙ্কিত না হওয়ার কোন কারণ খুঁজে পাওয়া দুরূহ।

আবার দক্ষিণ আমেরিকার ছোট্ট সমাজতান্ত্রিক দেশ কিউবা যখন করোনা আক্রমণ থেকে প্রায় মুক্ত থাকে; দশকের পর দশক ধরে আমেরিকার আরোপকৃত অবরোধের মতো চরম প্রতিকূলতাকে পরাজিত করে করোনার ওষুধ (স্বল্পমূল্যে) আবিস্কার করে; অসংখ্য চিকিৎসক-নার্স গড়ে তুলে বিপুল সংখ্যায় ইতালি ও অন্যান্য দেশে পাঠায়, তখন একদিকে যেমন বিস্ময়-বিমূঢ় হয়ে পড়তে হয়; তেমন তাদের এই সাফল্যে বিপুল আশাবাদেরও সৃষ্টি হয়।\হতবে বহু ক্ষেত্রে, বিশেষ করে স্বাস্থ্যবিজ্ঞান, স্বাস্থ্য-ব্যবস্থা, চিকিৎসার সুযোগহীনতা এবং উপযুক্ত শিক্ষা, বিশেষ করে বিজ্ঞানভিত্তিক শিক্ষার নিদারুণ অভাবের দেশ বাংলাদেশকে নিয়ে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা মানুষের মনে কম নেই। 'লকডাউন' আনুষ্ঠানিকভাবে ঘোষণা করা না হলেও দেশব্যাপী সামরিক বাহিনীকে যখন নামানো হয় রাস্তাঘাটে চলাচলে শৃঙ্খলা রক্ষা করতে অথবা সামাজিক দূরত্ব নিশ্চিত করতে, তখন আমাদের অ-বিজ্ঞানমনস্কতা উলঙ্গভাবে ধরা পড়ে। স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়, অফিস-আদালত, বাজার-বিপণি, গণপরিবহন পর্যন্ত বন্ধ থাকা অবস্থায়, বারংবার টেলিভিশন ও পত্রপত্রিকায় সবাইকে সতর্ক করে দেওয়া সত্ত্বেও রাস্তাঘাটে জটলা আমাদের অসচেতনাকেই নগ্নভাবে প্রকাশ করছে মাত্র। ফলে, বিপদের আশঙ্কা কমছে না; বাড়ছে বরং। সবার অন্তর থেকে বোঝা দরকার, নিয়ম-বিধি না মেনে বাইরে ঘোরাফেরা করলে করোনা সংক্রমণের আশঙ্কা প্রবল। আর তা যদি হয়, তাহলে গোটা সংসার, প্রতিবেশীসহ বহু লোকের বিপদ ঘটে যেতে পারে।\হআসলে মনে হয়, অনেকে এই বিষয়কে হালকাভাবে নিচ্ছে এই ভেবে- বাংলাদেশে সরকারি প্রচারণা অনুযায়ীই করোনা সংক্রমণ নামমাত্র। তাই কঠোরভাবে ওই নিয়মগুলো প্রয়োগ, তাদের মতে যুক্তিহীন। সে কারণেই হয়তো নিয়ম মানার তেমন প্রয়োজন অনুভব করছে না আমাদের তরুণরা। প্রকৃত পরিস্থিতি ঢাকায় বসে বোঝা যাবে না; যেতে হবে গ্রাম-গ্রামান্তরে। সেখানে সরকারি নিষেধাজ্ঞা, সামাজিক দূরত্ব রক্ষা এবম্বিধ কথাবার্তার প্রয়োগ চোখেই পড়ে না প্রায়। হাটবাজার, দোকানপাট মোটামুটি স্বাভাবিকভাবেই চলছে। উপজেলা পর্যায়ের সরকারি কর্মকর্তারাও পেরে উঠছেন না বহু ক্ষেত্রেই। কারণ নিজ নিজ এলাকার নির্বাচিত নানা স্তরের জনপ্রতিনিধির একটি বড় অংশই ব্যবসাবাণিজ্যে নিয়োজিত এবং তারা তাদের ব্যবসা যথারীতি চালিয়ে যেতে সচেষ্ট। স্বীয় স্বার্থ বিসর্জন দিয়ে দেশ ও জাতির স্বার্থ, এমনকি নিজ এলাকার ভোটারদের স্বার্থ রক্ষায় এগিয়ে আসতে তাদের অনেকেই রাজি নন।\হএ কথা ঠিক, বহু লোকই নিজেদের গৃহবন্দি করে রেখেছেন। কিন্তু তা কতদিন সম্ভব হবে? হাটবাজার তো দৈনন্দিন ব্যাপার ছিল। এখনকার পরিস্থিতিতে তা দৈনন্দিন না হয়ে সাপ্তাহিক ব্যাপার তো হবেই। অর্থাৎ সপ্তাহে অন্তত একবার তো বাজারে যেতেই হবে এবং সেখানে অজস্র মানুষের সঙ্গে গা ঘেঁষাঘেঁষি এড়িয়ে চলা অসম্ভব। তাই বাজারের সংখ্যা বাড়ানো হলে এ সমস্যার অনেকটা সমাধান হতে পারে। অন্তত সাময়িকভাবে।\হসর্বাধিক সংকটে পড়েছেন গরিব মানুষ, বেকার মানুষ। রিকশাচালক, ভ্যানচালকের সংখ্যা বিপুল। তাদের তো না বেরিয়ে উপায় নেই। পেটের দায়েই বেরোতে হয়। আবার বের হয়েও খুব একটা লাভ হচ্ছে না। তাদের বাড়িতে খাবার পৌঁছাতে হবে। সরকার ও নানা সামাজিক সংগঠন যেভাবে গরিব মানুষদের মধ্যে খাবার পৌঁছাচ্ছে, তাও ঝুঁকিপূর্ণ। কারণ তারা ক্যামেরাম্যান সঙ্গে নেন এবং বহুসংখ্যক মানুষকে একত্রে জমা করে বিলি করতে পছন্দ করেন। ঝুঁকির দিকটা এতে অবহেলিত হচ্ছে। ঝুঁকিও বাড়ছে। ফলে বিপদাশঙ্কা। গরিব মানুষদের বিনামূল্যে খাবার যেমন দিতে হবে, তেমনি তা হতে হবে ঝুঁকিমুক্ত। তাই পুলিশ বা প্রয়োজনে সেনাবাহিনীর সহায়তা নিয়ে যতটা সম্ভব বাড়ি বাড়ি পৌঁছে দেওয়াই সর্বাধিক নিরাপদ পদ্ধতি।\হলক্ষণীয়, উন্নততর দেশগুলোর অবস্থাই সর্বাধিক বেহাল। অপর পক্ষে এখন পর্যন্ত দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলো তুলনামূলক ভালো অবস্থায়। এখন বাংলাদেশসহ দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলো যদি অধিকতর সচেতন হয়ে উপযুক্ত ব্যবস্থাদি গ্রহণ করতে পারে, তবে হয়তো এসব দেশ অনেক কম ক্ষতির সম্মুখীন হতে পারবে। কিন্তু বিশ্ব স্থাস্থ্য সংস্থা সরাসরি অভিযোগ এনেছে, 'বাংলাদেশের মানুষ অসচেতন। তাই সেখানে ২০ লাখ মানুষের প্রাণহানি ঘটতে পারে।' মানুষ যে অসচেতন- আমরা নিজেরাই স্বীকার করি এবং সে কারণেই মানুষকে অযথা রাস্তায় না বেরিয়ে ঘরে থাকতে বাধ্য করার চেষ্টা করছি। প্রয়োজনে নিয়ম ভঙ্গকারীদের জেল-জরিমানার মতো শাস্তিও দিচ্ছি। তাই বিশ্বব্যাংক, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ও বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ বাড়াবাড়িভাবে মানা ও মানানোর ব্যবস্থা করতে হবে।\হএ অঞ্চলে ধর্মীয় অন্ধত্ব একটি মারাত্মক সমস্যা ও সংকট সৃষ্টি করেছে। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে বলা যায়, নববর্ষের সাংস্কৃতিক সমাবেশ, বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকীর যাবতীয় সমাবেশ, রাজনৈতিক সমাবেশ বন্ধ করাতে কোনো সমস্যা না হলেও মসজিদগুলোতে জুমা আর নামাজ বন্ধ করায় প্রশ্ন উঠছে। গোটা বিশ্বের এই দুর্যোগপূর্ণ পরিস্থিতিতে সৌদি আরব এ বছরের জন্য মুসলিমদের সর্ববৃহৎ আন্তর্জাতিক ধর্মীয় অনুষ্ঠান পবিত্র হজ পর্যন্ত বন্ধ করতে চলেছে। এ থেকেও আমাদের শিক্ষা নেওয়া কর্তব্য।\হসরকার অবলিম্বে সব জেলায় করোনা টেস্ট ও চিকিৎসার ব্যবস্থা করুক। পৌরসভা এবং ইউনিয়ন পরিষদগুলোয় পরিচ্ছন্নতা অভিযান পরিচালনায় সর্বত্র জীবাণুনাশক ওষুধ কেন্দ্র করার করার ব্যবস্থা করুক। আসুন, পারিবারিক থেকে সব পর্যায়ে আমরা স্বপ্রণোদিত হয়ে গৃহবন্দি থেকে নিজেরা বাঁচি, প্রতিবেশী ও দেশবাসীকে বাঁচাই। মানুষই শ্রেষ্ঠ জীব। সেই শ্রেষ্ঠত্বের সার্বিক পরীক্ষা দেওয়ার চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করতে হবে। মাস্ক, হ্যান্ডওয়াশ, হ্যান্ড স্যানিটাইজার বাড়ি বাড়ি সুলভ মূল্যে পৌঁছানোও জরুরি।

এবার কবি শঙ্খ ঘোষের একটি কবিতা দিয়ে নিবন্ধটির সমাপ্তি টানি- আমাদের দেখা হোক মহামারী শেষে/আমাদের দেখা হোক জিতে ফিরে এসে/আমাদের দেখা হোক জীবাণু-ঘুমালে/আমাদের দেখা হোক সবুজ সকালে/আমাদের দেখা হোক কান্নার ওপারে/আমাদের দেখা হোক সুখের শহরে/আমাদের দেখা হোক হাতের তালুতে/আমাদের দেখা হোক ভোরের আলোতে/আমাদের দেখা হোক বিজ্ঞান জিতলে/আমাদের দেখা হোক মৃত্যু হেরে গেলে/আমাদের দেখা হোক আগের মত করে/আমাদের দেখা হোক সুস্থ শহরে।\হসেই সাক্ষাৎ, সেই হ্যান্ডশেক, সেই আলিঙ্গন, সেই নৈকট্য, সেই সমাবেশ, সেই হাটবাজার, স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে মুখরিত পদচারণার দিনগুলে সবার জন্য ফিরে আসুক।

জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক

raneshmaitra@gmail.com