ঢাকা মঙ্গলবার, ২৯ এপ্রিল ২০২৫

রক্তকরবীর রাজার মতো নিঃসঙ্গ আইনি ভাষা

বাংলা ভাষা

রক্তকরবীর রাজার মতো নিঃসঙ্গ আইনি ভাষা

.

শেখ হাফিজুর রহমান

প্রকাশ: ১৮ ফেব্রুয়ারি ২০২৪ | ০২:০২

ধরুন আপনি নিরক্ষর বা পড়াশোনা বেশি জানেন না কিংবা বিএ, এমএ পাস করেছেন এবং মাঝারি গোছের বা বড়সড় চাকরিই করছেন। কোনো একটা খুনের মামলা বা অন্য কোনো মামলায় সংশ্লিষ্টতার কারণে আপনাকে আদালতে হাজিরা দিতে হয়, যদি জামিন পান। যদি জামিন না পান, তাহলে কেরানীগঞ্জ বা কাশিমপুরের কারাগার। তো আদালত যেদিন রায় ঘোষণা করলেন, সেদিন আপনি মনোযোগ দিয়ে রায় শুনলেন। রায় কিছুটা বুঝলেন, কিছুটা বুঝলেন না। তবে বাস্তবতা হচ্ছে, অধিকাংশ ক্ষেত্রে শিক্ষিত লোকেরাও রায় খুব একটা বোঝেন না। কেননা রায় ঘোষণা করা হয় ইংরেজিতে। ইংরেজি বুঝলেও আইনের পরিভাষা আপনার বোঝার কথা না।

যাই হোক, দশকের পর দশক এটিই ছিল ভারতীয় উপমহাদেশে আদালতের অবস্থা। বাংলাদেশও ব্যতিক্রম নয়। কিন্তু ১৯৮৭ সালে বাংলা ভাষা প্রচলন আইন পাস হওয়ার পরে আমরা এক ধাপ অগ্রসর হয়েছিলাম। এই অর্থে যে, আবেগ-অনুভূতি এবং সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা থাকার পরেও অফিস-আদালত ও ডাক্তারখানায় বাংলা চালুর ব্যাপারে সুনির্দিষ্ট বিধিমালা ছিল না। এ আইন পাসেরও অনেক দিন পর মুন্সেফ কোর্ট থেকে জেলা জজ আদালত পর্যন্ত বিচারিক স্তরের অধিকাংশ আদালতে বাংলায় রায় দেওয়া হচ্ছে। কিন্তু উচ্চ আদালত অর্থাৎ বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট ডিভিশন ও অ্যাপিলেট ডিভিশনে কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া রায় দেওয়া হয় ইংরেজিতে। বাংলায় রায় দেওয়া হলেও অনেক ক্ষেত্রে বিচারপ্রার্থীরা আইনের পরিভাষার কারণে রায়ের ভাষা পুরোপুরি বুঝতে পারেন না। রায় যথাযথভাবে বোঝার জন্য সাহায্য নিতে হয় আইনজীবীদের।

যেমন বিচারক চৌধুরী মুনীর উদ্দিন এক নিবন্ধে স্মৃতিচারণ করেছেন– “১৯৯৮ সাল, আমি তখন অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা জজ হিসেবে টাঙ্গাইল জেলায় কর্মরত ছিলাম। কোনো এক খুনের মামলার রায়ের ফাঁসির আদেশ দিই। সেই রায়টি উন্মুক্ত আদালতে ইংরেজিতে পড়ে শোনাই। তিনি (প্রবীণ আইনজীবী আলী সিদ্দিকি) তখন উক্ত আদালতে উপস্থিত থেকে আদালতের অনুমতি নিয়ে বলেছিলেন, ‘হুজুর আদালত-এ মামলার মক্কেলগণ বাঙালি, বিজ্ঞ আইনজীবীগণও বাঙালি এবং মাননীয় বিচারক আপনিও বাঙালি। তাই রায়টি যদি বাংলায় হতো, তাতে কারও কোনো আপত্তি থাকত না বা অসুবিধা হতো না। বরং মক্কেলগণের বুঝতে সুবিধা হতো হুজুর কেন ফাঁসি দিলেন। তারা বুঝল তাদের ফাঁসি হয়েছে। কেন হলো, তা তো তারা বুঝল না। এভাবে বাংলায় রায় লিখলে ভাষা আন্দোলন ও ভাষাশহীদদের এবং স্বাধীনতা আন্দোলন ও স্বাধীনতার শহীদদের প্রতি যথোপযুক্ত সম্মান প্রদর্শন করা হতো। আদালতের কাছে বাংলায় রায় চাওয়া আমাদের সাংবিধানিক অধিকার এবং এ অধিকার ভাষা আন্দোলন ও স্বাধীনতা যুদ্ধের চেতনার সম্পূরক। আমাদের এ চাওয়া বেশি চাওয়া নয়’।” সূত্র : ঢাকা ল’ রিপোর্ট (৫৮ ডিএলআর)।  

২০১৭ সালের ১ ফেব্রুয়ারি তৎকালীন প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা আশাবাদ ব্যক্ত করে বলেছিলেন, বাংলাদেশের সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগও বাংলায় রায় দেবে। তিনি বলেছিলেন, আইনের ধারাগুলো ইংরেজিতে হওয়ায় এবং বাংলা ভাষায় লেখা আইনের বই না থাকায় সর্বোচ্চ আদালতে বাংলা ভাষায় রায় দেওয়ার ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতা দেখা দেয়। আমার অভিমত হচ্ছে, বাংলায় রায় লেখার বিষয়ে অনুপুঙ্খ আলোচনা প্রয়োজন। শুধু আবেগের অনুবর্তী হয়ে বাংলায় রায় লেখার কথা বলা বা দু’চারটি রায় বাংলায় লিখে চমক তৈরি করা কাম্য নয়। নিঃসন্দেহে বাংলায় রায় লেখাটা কঠিন। সব বিচারক কর্তৃক বাংলায় রায় দেওয়ার বিষয়টি অনেক পূর্বশর্ত পূরণের ওপর নির্ভর করে।  

বাংলাদেশের আইন ও বিচার ব্যবস্থার বাস্তবতা হচ্ছে, দেওয়ানি ও ফৌজদারি আইন এবং কার্যবিধিসহ অধিকাংশ মূল আইন প্রণীত হয়েছিল ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসকদের দ্বারা তাদের মাতৃভাষা ইংরেজিতে। ভিনদেশের ওই ইংরেজ শাসকরা আদালতের যে বিন্যাস সাজিয়ে দিয়েছিলেন, এখনও তা বহাল। বাংলাদেশের আইন ও বিচার ব্যবস্থা ব্রিটেনে বিকশিত ‘কমন ল’ সিস্টেমের অন্তর্ভুক্ত হওয়ায় বাংলাদেশের আইন শিক্ষা ও বিচার ব্যবস্থায় মূলত ইংলিশ আইনের নীতিমালা, ম্যাক্সিম ও মামলা পড়ানো হয় এবং অনুসরণ করা হয়।

বাংলাদেশে যেসব শিক্ষার্থী এখন বিভিন্ন পাবলিক ও প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে আইন বিষয়ে সম্মানসহ স্নাতক ডিগ্রি নিতে আসেন, মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ে আইনবিষয়ক কোনো কোর্স না থাকায় প্রথম দু’এক বছর আইনের নীতিমালা, আইনের ভাষা, পরিভাষা ও বিষয়বস্তু বোঝার জন্য তাদের রীতিমতো যুদ্ধ করতে হয়। এর কারণ বিষয়বস্তু সম্পর্কে পূর্বজ্ঞান না থাকা। দ্বিতীয় কারণ ভাষা। বিচারপতি এস কে সিনহা যেমন বলেছেন, আইনের প্রায় সব প্রামাণিক ও নির্ভরযোগ্য গ্রন্থই ইংরেজিতে। অনেক গুরুত্বপূর্ণ আইনের মূল বয়ান ইংরেজিতে, ল রিপোর্টগুলো ইংরেজিতে, রয়েছে পরিভাষার সমস্যা। অনেক আইনের মূল বয়ানের কোনো কোনো ধারায় অর্ধপৃষ্ঠা বা এক পৃষ্ঠাজুড়ে একটি বাক্যে আইনের ভাষ্য বর্ণিত হয়েছে, যা অত্যন্ত জটিল, দুর্বোধ্য ও ক্লান্তিকর।

আমার অভিজ্ঞতায় দেখেছি স্বল্পসংখ্যক আইনের শিক্ষার্থী, যারা অত্যন্ত মেধাবী বা আইন বিষয়ে যাদের পারিবারিক ঐতিহ্য রয়েছে এবং যারা পরবর্তী সময়ে আইনের শিক্ষক, গবেষক, বিচারক ও আইনজীবী হিসেবে দক্ষতার পরিচয় দেন, তারাই ভাষার দেয়াল ভেদ করে আইনের ভাষা ও নীতিমালার সৌন্দর্যে অবগাহন করতে পারেন, বিচিত্র সব মামলার ভান্ডার থেকে তুলে আনতে পারেন মণি-মুক্তা। আমার প্রশ্ন হচ্ছে, স্বল্পসংখ্যক মেধাবীর জন্য আইনকে কেন ‘রক্তকরবীর রাজা’র মতো বিচ্ছিন্ন করে ফেলতে হবে সর্বসাধারণের কাছ থেকে?             

প্রায়ই মনে হয়, বাংলাদেশে আইনের ভাষা দিয়ে সাধারণ মানুষ ও বিচারপ্রার্থীদের মধ্যে এক দুর্ভেদ্য ও দুর্বোধ্য দেয়াল রচনা করা হয়েছে। ওই দেয়াল ভেদ করে শেষ অব্দি আইনের ভাষার সৌন্দর্য, বিষয়বস্তুর যথার্থতা, সংজ্ঞার বিমূর্তায়ন বুঝতে সমর্থ হন গুটি কতক মেধাবী ও প্রশিক্ষিত বিচারক, আইনজীবী, শিক্ষক ও গবেষক। বাংলাদেশের আইন হয়ে গেছে ‘রক্তকরবীর রাজা’র মতো অভিজাত ও নিঃসঙ্গ। আইন ভিনদেশি ভাষা দিয়ে, ভাষার চারদিকে জটিল ও দুর্বোধ্যতার দেয়াল তুলে দিয়ে নিজেই হয়ে পড়েছে অবরুদ্ধ।

আইনের ভাষাকে প্রাঞ্জল ও ব্রাত্যজনের বোধগম্য করার উদ্যোগ সর্বপ্রথম গ্রহণ করেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। জাতির পিতার হত্যাকাণ্ডের ১২ বছর পর বাংলা ভাষা সর্বত্র প্রচলনের জন্য আইন প্রণয়ন করেও সর্বত্র বাংলা ভাষা চালু করা যায়নি। তবে আইন-আদালতের জগতে অগ্রগতি হচ্ছে শম্বুকগতিতে। আর ডাক্তারি পাঠ ও গবেষণা, প্রকৌশল, ওষুধ-প্রযুক্তি, পদার্থবিদ্যা, রসায়ন, গণিত, ব্যবসায় প্রশাসন ও অণুজীববিদ্যার উচ্চতর পড়াশোনা কতটা বাংলায় করা যাচ্ছে? বর্তমান অবস্থায় এসব বিশেষায়িত বিষয়ের মানসম্পন্ন ও প্রামাণিক পড়াশোনা ইংরেজি ছাড়া কি সম্ভব? এসব বিশেষায়িত বিষয় বাংলায় পড়তে ও পড়াতে হলে রাষ্ট্রীয় ও বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে এবং বাংলা একাডেমির মতো প্রতিষ্ঠানকে উল্লিখিত বিষয়গুলোর প্রামাণিক সব গ্রন্থ ও জার্নালের বাংলা অনুবাদের ব্যবস্থা করতে হবে।      

একইভাবে বাংলাকে আইন শিক্ষার মাধ্যম করতে হলে মামলার রায় লিখতে হবে বাংলায়, আইনের নির্ভরযোগ্য গ্রন্থ, দেশি-বিদেশি জার্নাল ও ল রিপোর্টগুলোকে বাংলায় অনুবাদ করতে হবে। প্রণীত আইন ও জজ সাহেবদের লেখা রায় যেন বিচারপ্রার্থীরা বুঝতে পারেন, সে ব্যবস্থাটি করতে হবে। কাজটি সহজ নয়। তবে যথাযথ উদ্যোগ নিলে সম্ভব। যে গতিতে আইন শিক্ষা ও অফিস-আদালতে বাংলা প্রচলনের কাজ চলছে, তাতে আরও অনেক দিন অপেক্ষা করতে হবে, আমাদের প্রত্যাশার ঘোড়াও শ্লথগতিতেই চলতে থাকবে। তবে সদিচ্ছা থাকলে এবং যথাযথ উদ্যোগ নেওয়া গেলে সবকিছুই সম্ভব।                                        

শেখ হাফিজুর রহমান কার্জন: অধ্যাপক আইন বিভাগ; পরিচালক, সেন্টার ফর জেনোসাইড স্টাডিজ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

আরও পড়ুন

×