উদারনৈতিক বিশ্বব্যবস্থা ভাঙনের মুখে
আন্তর্জাতিক

.
দ্য ইকোনমিস্ট
প্রকাশ: ১৪ মে ২০২৪ | ২৩:০১ | আপডেট: ১৫ মে ২০২৪ | ০৮:৫৩
দেখে মনে হচ্ছে, বিশ্ব অর্থনীতি নাজুক পরিস্থিতি কাটিয়ে আবার স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসছে। এমনকি চীনের সঙ্গে বাণিজ্যিক যুদ্ধ সত্ত্বেও যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতি চাঙ্গা হয়ে উঠেছে। রাশিয়ার গ্যাস সরবরাহ বন্ধের ক্ষতি কাটিয়ে জার্মানির অর্থনীতি উঠে দাঁড়িয়েছে। মধ্যপ্রাচ্যে যুদ্ধের কারণে তেলের সংকট তৈরি হয়নি। মিসাইল বা ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপকারী হুতি বিদ্রোহীরা বৈশ্বিক পণ্য পরিবহনের সামান্য ক্ষতিও করতে পারেনি। মহামারির কবলে পড়ে বৈশ্বিক জিডিপিতে ব্যবসায়ের অবদান যতটুকু কমেছিল, তা আগের অবস্থায় ফিরে এসেছে এবং চলতি বছর এ খাতে ভালোই উন্নতি হবে বলে ভবিষ্যদ্বাণী করা হচ্ছে।
তবে একটু গভীরে তাকালে পরিস্থিতির ভঙ্গুরতা বোঝা যায়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর বছরের পর বছর যে ব্যবস্থা বিশ্ব অর্থনীতিকে চালিয়ে যাচ্ছে, তাতে ক্ষয় ধরেছে এবং বর্তমানে তা ধ্বংসের মুখোমুখি। উদ্বেগজনক এত বিষয় আছে, যেগুলো নৈরাজ্যের সূচনা ঘটাতে পারে। যেখানে গায়ের জোরই সঠিক এবং আবারও যুদ্ধই পরাশক্তির অবলম্বন হয়ে উঠেছে। এমনকি এটা যদি কখনও সংঘাতে না-ও গড়ায়, বিদ্যমান নিয়ম-নীতির বিপর্যয় অর্থনীতিতে দ্রুত ও ভয়াবহ প্রভাব ফেলতে পারে।
আমাদের বিভিন্ন প্রতিবেদনে যা স্পষ্ট; পুরোনো ব্যবস্থার ভাঙনের শব্দ সর্বত্র শোনা যায়। নব্বই দশকের তুলনায় বিভিন্ন দেশের ওপর নিষেধাজ্ঞা বা অবরোধ এখন চার গুণ জারি আছে। যেসব সংস্থা রাশিয়ার সেনাদের সমর্থন করে, তাদের ওপর সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্র ‘পরোক্ষ’ জরিমানা আরোপ করেছে। আর্থিক সমর্থন দিয়ে একটা যুদ্ধ চালানো হচ্ছে। একই সঙ্গে বিভিন্ন দেশ রাষ্ট্রীয় আনুকূল্যে পরিবেশসম্মত উৎপাদন ব্যবস্থা চালু করে চীন ও মার্কিন নীতি অনুসরণ করতে চায়। আমাদের এক বিশেষ প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, যদিও ডলার এখনও শক্তিশালী এবং উঠতি অর্থনীতিগুলো বেশ ঘাতসহ হয়ে উঠেছে, বৈশ্বিক পুঁজিপ্রবাহ কিন্তু ভাঙতে শুরু করেছে।
যেসব প্রতিষ্ঠান পুরোনো ব্যবস্থাকে রক্ষা করছিল, সেগুলো ইতোমধ্যে অকেজো অথবা দ্রুত বিশ্বাসযোগ্যতা হারাচ্ছে। আগামী বছর বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার ৩০ বছর হবে। তবে আমেরিকার অবহেলার কারণে আরও পাঁচ বছরের বেশি প্রতিষ্ঠানটিকে স্থবির হয়ে থাকতে হবে। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) পরিচয় সংকটে অকার্যকর হয়ে পড়েছে। পরিবেশসম্মত প্রকল্প বনাম আর্থিক স্থিতিশীলতা নিশ্চিতকরণের মধ্যে হাবুডুবু খাচ্ছে এটি। জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদ নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়েছে। আন্তর্জাতিক বিচার আদালত (আইসিজে) ক্রমশ যুদ্ধরত দলগুলোর হাতিয়ারে পরিণত হচ্ছে। গত মাসে আমেরিকান রাজনীতিবিদ ও সিনেটে রিপাবলিকান নেতা মিচ ম্যাককোনেল নিষেধাজ্ঞার কথা বলে আন্তর্জাতিক ফৌজদারি আদালতকে (আইসিসি) হুমকি দিয়েছিলেন। যদি ইসরায়েলি নেতাদের আটকাদেশ জারি করা হয়, তাহলে প্রতিষ্ঠানটির বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হবে বলে তিনি হুমকি দিয়েছিলেন। অথচ ইসরায়েল আন্তর্জাতিক বিচার আদালতে গণহত্যার অভিযোগে অভিযুক্ত। দক্ষিণ আফ্রিকা তাদের বিরুদ্ধে এ অভিযোগ করেছিল।
এ পর্যন্ত ভাঙন ও ক্ষয় বৈশ্বিক অর্থনীতির ওপর অদৃশ্য এক কর (স্টিলথ ট্যাক্স) আরোপ করেছে। এটা উপলব্ধি করা যায়, যদি আমরা সঠিক জায়গায় নজর দিতে পারি। দুর্ভাগ্যবশত হলেও ইতিহাসের পাঠ ধরে বলা যায়, আরও গভীর ও অধিকতর বিশৃঙ্খল দুর্যোগ ঘটা সম্ভব, যা হঠাৎ একবার শুরু হলে ক্রমাগত আঘাত হানতে থাকবে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ বিশ্বায়নের সোনালি অধ্যায়ের পুরোপুরি অবসান ঘটিয়েছিল, যা অনেকে তখন চিরকাল থাকবে বলে অনুমান করেছিল। ত্রিশের দশকের শুরুতে অর্থনৈতিক মন্দা ও স্টোট-হাওলি ট্যারিফকে কেন্দ্র করে আমেরিকার রপ্তানি মাত্র দুই বছরে ৪০ শতাংশ কমে গিয়েছিল। ১৯৭১ সালের আগস্টে রিচার্ড নিক্সন অপ্রত্যাশিতভাবে ডলারের স্বর্ণে রূপান্তরযোগ্যতা বাতিল করেন। এর মাত্র ১৯ মাস পর নির্ধারিত বিনিময় হারের ব্রেটন উডস পদ্ধতি ভেঙে পড়েছিল।
আজ একই ধরনের ভাঙন টের পাওয়া যাচ্ছে। হোয়াইট হাউসে জিরো-সাম বিশ্বদৃষ্টি নিয়ে ডোনাল্ড ট্রাম্প ফিরে এলে প্রতিষ্ঠান ও নিয়মকানুনের অবনতি চলতেই থাকবে। চীনের সস্তা রপ্তানির দ্বিতীয় ধাপ এ পরিস্থিতি আরও বাড়িয়ে তুলবে। তাইওয়ান নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র ও চীন অথবা পাশ্চাত্য ও রাশিয়ার মধ্যকার প্রকাশ্য যুদ্ধ বড় ধরনের ধ্বংসযজ্ঞের কারণ হতে পারে।
এ ধরনের অসংখ্য ঘটনায় ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ অনেকের কল্পনাকেও ছাড়িয়ে যাবে। বৈষম্যের কারণ হিসেবে বিশ্বায়ন, বৈশ্বিক অর্থনৈতিক সংকট ও জলবায়ু উপেক্ষাকে অবিরাম সমালোচনা করা ফ্যাশনে দাঁড়িয়েছে। কিন্তু নব্বইয়ের দশক ও ২০০০ সাল থেকে প্রথম দশকের অর্জন হলো উদার পুঁজিবাদের চূড়ান্ত পর্বে পৌঁছে যাওয়া, যা ইতিহাসে অতুলনীয়। বিশ্ব অর্থনীতির শরিকানা হওয়ায় চীনের লাখ লাখ মানুষ দারিদ্র্যের কবল থেকে মুক্তি পেয়েছিল। ১৯৯০ সালে শিশুমৃত্যুহার যা ছিল, তা বর্তমান বিশ্বে অর্ধেকের নিচে নেমে এসেছে। যুদ্ধ-পরবর্তী সময়ে বিভিন্ন দেশের সংঘাতের কারণে বিশ্ব জনসংখ্যার মৃত্যুহার একেবারেই কমে গিয়েছিল, যা ২০০৫ সালে ছিল ০.০০০২ শতাংশ। ১৯৭২ সালে এ হার দাঁড়িয়েছিল ৪০ গুণের বেশি। সাম্প্রতিক গবেষণায় দেখা যাচ্ছে, আজকের নেতারা ‘ওয়াশিংটন কনসেনসাস’-এর যুগের প্রতিস্থাপন করার স্বপ্ন দেখছেন। এক সময় দরিদ্র দেশগুলো এটা দিয়েই সমৃদ্ধি দেখেছিল এবং উন্নত বিশ্বের সঙ্গে তাদের ব্যবধান কমিয়ে আনতে শুরু করেছিল।
এই ব্যবস্থার ভাঙন অগ্রগতি মন্থর করে দেওয়া কিংবা উল্টো দিকে ছুড়ে ফেলার হুমকি দেয়। একবার ভেঙে গেলে নতুন নিয়মে প্রতিস্থাপিত হওয়ার সম্ভাবনা নেই। বরং বৈশ্বিক সম্পর্কগুলো তাদের নৈরাজ্যের স্বাভাবিক পরিস্থিতিতে নেমে আসবে, যা হবে দস্যুতা ও সহিংসতার পক্ষে। পারস্পরিক সহযোগিতার জন্য আস্থা ও প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো ছাড়া একুশ শতকের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করা দেশগুলোর জন্য আরও বেশি কঠিনতর হয়ে উঠবে। সেটা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তায় অস্ত্র প্রতিযোগিতা থেকে শুরু করে মহাকাশে সহযোগিতা করা পর্যন্ত। সমমনা দেশগুলো জোট বেঁধে সমস্যা মোকাবিলা করবে। সেটা কাজ করতে পারে, কিন্তু ইউরোপের কার্বন বর্ডার ট্যারিফ অথবা আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের সঙ্গে চীনের দ্বন্দ্বজনিত কারণে তা প্রায়ই আরও বেশি সংঘাত ও অসন্তোষ সৃষ্টি করবে। সহযোগিতার মানে যখন শক্তিশালী অস্ত্র সরবরাহ করা, তখন দেশগুলোর মধ্যে শান্তি বজায় রাখার যুক্তি দুর্বল হয়ে পড়ে।
উদারনৈতিক ব্যবস্থা বাকি বিশ্বের জন্য বহু উপকার বয়ে এসেছিল। ইতোমধ্যে বিশ্বের অসংখ্য গরিব মানুষ কভিড-১৯ মহামারির কারণে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের রাষ্ট্রীয় ঋণ পরিশোধ না করতে পেরে ভোগান্তির মধ্যে পড়েছে। ভারত ও ইন্দোনেশিয়ার মতো মধ্যম আয়ের দেশগুলো ধনী হতে গিয়ে পুরোনো ব্যবস্থার ভাঙনে যেসব সুবিধার সৃষ্টি হয়েছে, সেগুলো কাজে লাগাচ্ছে। শেষ পর্যন্ত দেশগুলোর অবস্থা বৈশ্বিক অর্থনীতির অন্তর্ভুক্তিকরণ ও অনুমানযোগ্যতার (প্রেডিক্টেবল) ওপরেই নির্ভর করছে।
- দ্য ইকোনমিস্ট থেকে ভাষান্তর ইফতেখারুল ইসলাম