সমকালীন প্রসঙ্গ
শিক্ষার্থী আন্দোলনে শিক্ষকদের ভূমিকা

কাজী এ এস এম নুরুল হুদা
কাজী এ এস এম নুরুল হুদা
প্রকাশ: ০৩ আগস্ট ২০২৪ | ২১:৪৪ | আপডেট: ০৩ আগস্ট ২০২৪ | ২১:৪৫
বর্তমান বাংলাদেশে আলোচনার কেন্দ্রে শিক্ষার্থী তথা তরুণরা, যারা কিনা ন্যায়বিচার এবং সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কারের নামে বৈষম্যের বিরুদ্ধে লড়ছে। এ কারণে তাদের আন্দোলন আজ কোটা সংস্কারের পরিধি ছাড়িয়ে রাষ্ট্রের আরও বৃহৎ পরিসরে সম্ভবত প্রবেশ করেছে। আন্দোলনের এই ঢেউ দেশের আর্থসামাজিক-রাজনৈতিক মানচিত্রের একটি গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্তকে তুলে ধরে, যা শিক্ষকদের তাদের শ্রেণিকক্ষের সীমানার বাইরে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকার প্রতি আলোকপাত করে। ঐতিহাসিকভাবে জ্ঞান ও দিকনির্দেশনার বাতিঘর হিসেবে পরিচিত শিক্ষকদের এখন শিক্ষাগত দায়িত্বের সঙ্গে ভারসাম্য বজায় রেখে তাদের নৈতিক দায়িত্ব পালনের জন্য এ আন্দোলনকে সমর্থন করার আহ্বান জানানো হয়েছে। এ প্রেক্ষাপটে চলমান কোটা সংস্কার আন্দোলনে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের সাম্প্রতিক সম্পৃক্ততা তাদের ছাত্রদের ভবিষ্যৎ গঠনে এবং আরও বড় করে দেখলে জাতির ওপরে যে গভীর প্রভাব ফেলতে পারে, তা তুলে ধরে।
শিক্ষক মাত্রই একজন সমাজকর্মী, যার বিচরণ থাকে শ্রেণিকক্ষ এবং শ্রেণিকক্ষের বাইরে যে বৃহৎ জনপরিসর তাতে। কারণ, সমাজকর্মী হিসেবে তিনি সমাজ পরিবর্তনের জন্য একজন অত্যাবশ্যকীয় উপাদান। এ পরিবর্তনের উদ্দেশ্যেই ইতিহাসের নানা সময়ে আমরা দেখি, শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের নানা আন্দোলনে জড়াতে। এ রকম ক্রিটিক্যাল সময়ে শিক্ষার্থীদের প্রতি শিক্ষকদের দায়িত্ব কী– এমন প্রশ্ন প্রায়ই আমাদের সামনে এসে হাজির হয়। গত কয়েক সপ্তাহের বাংলাদেশ তার থেকে ব্যতিক্রম কিছু নয়।
সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কারকে কেন্দ্র করে শুরু হওয়া চলমান শিক্ষার্থী আন্দোলনে দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক শিক্ষক নানাভাবে সমর্থন জানাচ্ছেন। সমর্থন জানাতে নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের আয়োজিত এমন এক সমাবেশের কারণ সম্পর্কে সাংবাদিকদের উদ্দেশে স্থাপত্য বিভাগের অধ্যাপক ডক্টর সাইফুল আলম বলেন, ‘শিক্ষকদের দায়িত্ব শুধু শিক্ষার্থীদের চাকরির জন্য প্রস্তুত করার মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়; এটি তাদের মধ্যে ঠিক থেকে বেঠিকের ভেদ বিচার করার মধ্যেও নিহিত। আর শিক্ষার্থীরা যা দাবি করেছে, তা ন্যায্য। তাই তাদের পক্ষে দাঁড়ানো অপরিহার্য।’
শিক্ষার অন্যতম উদ্দেশ্য শিক্ষার্থীদের সত্যের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেওয়া বা আরেকটু উদারভাবে বললে, সত্য অনুসন্ধান কীভাবে করতে হয়, তার প্রশিক্ষণ দেওয়া। মোদ্দাকথা, শিক্ষার সঙ্গে সত্যের নিবিড় সম্পর্ক আছে। যে শিক্ষা শিক্ষার্থীদের মিথ্যার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেয়, তাকে প্রকৃত অর্থে শিক্ষা বলা যায় না। এ জন্যই প্রাচীন গ্রিসে আমরা দেখি সক্রেটিসকে সোফিস্টদের সমালোচনা করতে। সোফিস্টরা তরুণদের এমন শিক্ষা দিতেন, যে শিক্ষা কাজে লাগিয়ে যেমন করেই হোক, বিতর্কে জিতে যাওয়া যায়। অন্যদিকে সক্রেটিস তরুণদের প্রশ্ন করতে উৎসাহিত করতেন। ন্যায়ের কথা বলতেন। এককথায়, সক্রেটিসের শিক্ষার মূল উদ্দেশ্য ছিল মানুষের মধ্যে নীতিবোধ জাগ্রত করা। ভালো-মন্দের ভেদাভেদের এ শিক্ষা, বিদ্যায়তনিক পরিসরে, একজন শিক্ষক শুধু শ্রেণিকক্ষেই শেখাবেন না। জীবনাচারের মাধ্যমেও তা শিক্ষার্থীদের শেখাতে পারেন। কারণ একজন শিক্ষক তার শিক্ষার্থীদের কাছে শুধু এমন একজন মানুষ না, যিনি কিনা তাকে তার ভবিষ্যৎ কর্মজীবনের জন্য প্রস্তুত করবেন। তিনি তার চেয়েও বেশি কিছু। শিক্ষক দিকনির্দেশনা এবং কর্মের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের কাছে হয়ে উঠতে পারেন একজন অনুকরণীয় ব্যক্তিত্ব।
তাই যে শিক্ষক নিজে শিক্ষার্থীদের ন্যায়-অন্যায় বোধের কথা বলেন, কিন্তু তাদের ন্যায্য দাবির পক্ষে দাঁড়ান না, তিনি একজন অনুকরণীয় ব্যক্তিত্ব হতে পারেন না। একজন অনুকরণীয় ব্যক্তিত্ব মাত্রই এমন কেউ, যাঁর উচ্চারণ এবং কাজের উচ্চতার মধ্যে সংগতি থাকবে। অনেক শিক্ষক শ্রেণিকক্ষে পান থেকে চুন খসলেই অন্যায় করেছে বলে শিক্ষার্থীর ওপর তেলেবেগুনে জ্বলে ওঠেন। তিনিই আবার শিক্ষার্থীরা যখন কোনো ন্যায্য দাবি তোলে এবং তার কারণে নিপীড়নের শিকার হয়, তখন চুপ থাকেন। এ ধরনের শিক্ষক শিক্ষার্থীদের জন্য অনুকরণীয় ব্যক্তিত্ব হয়ে উঠতে পারেন না। সে শিক্ষকই বরং শিক্ষার্থীদের কাছে অনুকরণীয় হয়ে ওঠেন, যিনি কোটা সংস্কার আন্দোলনের মতো ন্যায়সংগত শিক্ষার্থী আন্দোলনের সময় তাদের কাছে একই সঙ্গে হয়ে উঠতে পারেন একজন দায়িত্ববান পিতা, দিকনির্দেশনা প্রদানকারী গুরু এবং সমর্থন প্রদানকারী বন্ধু।
শিক্ষক শিক্ষার্থীর কাছে এমন সময়ে হয়ে উঠতে পারেন বুদ্ধিবৃত্তিক ও নৈতিক দিকনির্দেশনার এক অসীম আধার। তিনি শিক্ষার্থীদের এমন আন্দোলনের বৃহত্তর সামাজিক-রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট, ঐতিহাসিক নজির এবং তাদের কর্মের প্রভাব বুঝতে সাহায্য করতে পারেন। অতীতের বিভিন্ন ঐতিহাসিক আন্দোলন থেকে প্রাপ্ত শিক্ষা কীভাবে বর্তমান আন্দোলনে কাজে লাগতে পারে, সে বিষয়টি শিক্ষার্থীদের শিক্ষা দেওয়ার মাধ্যমে শিক্ষকরা শিক্ষার্থীদের আন্দোলনকে বর্তমান পরিকাঠামোর সঙ্গে প্রাসঙ্গিক করতে সাহায্য করতে পারেন। এতে আন্দোলনের লক্ষ্য অর্জনের জন্য কার্যকর এবং নৈতিক উপায় সম্পর্কে শিক্ষার্থীরা কিছু মূল্যবান দিকনির্দেশনাও পেতে পারে। এটি আন্দোলন পরিচালনায় তাদের বোঝাপড়ার দিক এবং কৌশলগতভাবে সমৃদ্ধ করতে পারে।
আন্দোলনের সময় শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করাও শিক্ষকদের অন্যতম দায়িত্ব। এ নিরাপত্তা শারীরিক বা মানসিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রিক হতে পারে। আবার শাসকের নিপীড়নের হাত থেকে মুক্ত থাকা যায় কীভাবে, সে-বিষয়কও হতে পারে। তাই আন্দোলনের জন্য নিরাপদ পরিবেশ তৈরি করতে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী, এমনকি স্বাস্থ্যসেবায় জড়িত লোকজনের সঙ্গেও যোগাযোগের দায়িত্ব শিক্ষকদের ওপর বর্তায়। যে কোনো আন্দোলনই শিক্ষার্থীদের ওপর প্রচুর মানসিক চাপ সৃষ্টি করতে পারে। তাই এ সময় সহায়ক পরিবেশ তৈরির মাধ্যমে শিক্ষকদের উচিত শিক্ষার্থীদের মানসিক সমর্থন প্রদান করা, কথা শোনা এবং প্রয়োজনে কাউন্সেলিং পরিষেবা নিশ্চিত করা।
শিক্ষকরা আন্দোলনকারী শিক্ষার্থী ও প্রশাসনের মধ্যে মধ্যস্থতাকারী হিসেবেও ভূমিকা রাখতে পারেন। মধ্যস্থতাকারী হিসেবে এ দুই পক্ষের মধ্যে সংলাপ আয়োজন করতে পারেন। একই সঙ্গে এ সংলাপে যাতে শিক্ষার্থীদের বক্তব্য শোনা এবং বিবেচনা করা হয়, সেদিকেও খেয়াল রাখতে পারেন। কারণ কণ্ঠহীনতা ও অবজ্ঞা আরও আন্দোলনের কারণ হতে পারে।
শিক্ষকরা আন্দোলনে জড়িত শিক্ষার্থীদের আইনি অধিকার এবং নৈতিক দায়িত্ব সম্পর্কে প্রয়োজনীয় জ্ঞান দিতে পারেন। তারা শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভ পরিচালনার ক্ষেত্রে যতটা সম্ভব আইন মেনে চলার প্রয়োজনীয়তা এবং নির্দিষ্ট কিছু কর্মের সম্ভাব্য পরিণতি সম্পর্কে শিক্ষিত করতে পারেন। এটি আন্দোলন যেন আইনি সীমার মধ্যে থাকে, তার সম্ভাবনা বাড়াবে।
শিক্ষার্থীদের আন্দোলনে সমর্থন দেওয়ার ক্ষেত্রে শিক্ষকদের বিভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গিকে সম্মান করে নিরপেক্ষতা এবং কঠোর পেশাদার নৈতিকতা বজায় রাখতে হবে। নিশ্চিত করতে হবে যে আন্দোলনের জন্য তাদের সমর্থন বিদ্যায়তনিক দায়িত্বে হস্তক্ষেপ করবে না বা ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গির শিক্ষার্থীদের প্রতি বৈষম্য তৈরি করবে না।
আন্দোলনকে এগিয়ে নিতে যেমন তারুণ্যের আবেগ দরকার, তেমনি আন্দোলনে সফলতার জন্য দরকার যুক্তির সঙ্গে আবেগের ভারসাম্য। এ ক্ষেত্রে শিক্ষকরা তাদের শিক্ষার্থীদের জন্য আদর্শ হিসেবে কাজ করতে পারেন। নিজেরা বিভিন্ন সামাজিক কর্মকাণ্ডে দায়িত্বশীল ও নৈতিকতার সঙ্গে জড়িয়ে শিক্ষার্থীদের সামনে যুক্তির সঙ্গে আবেগের ভারসাম্য বজায় রাখার উদাহরণ তৈরি করতে পারেন। এতে শিক্ষার্থীরাও তাদের আন্দোলনে সচেতন এবং চিন্তাশীল ক্রিয়া দ্বারা চালিত হওয়ার উৎসাহ পায়।
পরিশেষে শিক্ষার্থী আন্দোলনের সময় শিক্ষকদের কর্তব্য সমর্থন, নির্দেশনা এবং দায়িত্বের একটি সুষম মিশ্রণ প্রদান করা। এটি শিক্ষার্থীদের মধ্যে আন্দোলনের জন্য দরকারি গঠনমূলক এবং নৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি গড়ে তোলার পাশাপাশি তাদের নিরাপত্তা এবং মঙ্গলও নিশ্চিত করবে। শিক্ষকদের সম্পৃক্ততা আন্দোলনের কার্যকারিতা এবং ফলাফলকে উল্লেখযোগ্যভাবে প্রভাবিত করতে পারে। ফলে আন্দোলনে জড়িত সবার জন্য এটি একটি অর্থবহ এবং রূপান্তরমূলক অভিজ্ঞতায় পরিণত হতে পারে। এভাবেই সমাজকর্মী হিসেবে তাদের দায়িত্ব পালনের মধ্য দিয়ে শিক্ষকরা নিজেদের অন্য স্তরে নিয়ে যেতে পারেন। হয়ে উঠতে পারেন সমাজের সব স্তরের মানুষের জন্য আলোকবর্তিকা।
ড. কাজী এ এস এম নুরুল হুদা: সহযোগী অধ্যাপক, দর্শন বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
huda@du.ac.bd
- বিষয় :
- সমকালীন প্রসঙ্গ