জুলাই-অভ্যুত্থান
কেন সেদিন ফাইয়াজের বদলে আমার মৃত্যু হলো না

মানজুর-আল-মতিন
মানজুর-আল-মতিন
প্রকাশ: ১৫ আগস্ট ২০২৪ | ০২:০৮
১৬ জুলাই ২০২৪। একটা নাম, একটা ভয়াবহ দৃশ্য, একটা মৃত্যুর সামনে আমার গোটা অস্তিত্বই থমকে গেল। এভাবে কেউ আমাকে পাল্টে দিতে পারে– তা আগে ভাবিনি। আমি কিংবা আমার স্ত্রী, আমরা কেউই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সক্রিয় ছিলাম না অনেক দিন ধরেই। একটা টকশো উপস্থাপনার প্রয়োজনে, আর খানিকটা পুরোনো অভ্যাসের কারণে খবরের কাগজ পড়া হয়।
একই প্রয়োজনে টিভি কিংবা অনলাইন সংবাদমাধ্যমও নজর এড়ায় না। সেই আমি দেখলাম গুলির সামনে বুক চিতিয়ে দাঁড়ানো আবু সাঈকে। পড়লাম মৃত্যুর আগে তাঁর লিখে যাওয়া শেষ ফেসবুক স্ট্যাটাস। সেই শেষ বার্তা পড়ে হঠাৎ আমার পায়ের নিচ থেকে মাটি সরে গেল। বহু বছর নিদ্রিত আসহাবে কাহাফের ঘুম ভাঙল যেন। কে এই আবু সাঈদ! কোথায় পেল এমন করে আরেক ড. শামসুজ্জোহা হয়ে ওঠার শক্তি!
এর পর, অনেকটা বাধ্য হয়েই আবার ফেসবুকে আসা। নিউজ ফিডে বারবার ভেসে আসা কাজী নজরুলের বিদ্রোহী কবিতার চরণের (বল বীর, বল উন্নত মম শির। শির নেহারি আমারি, নত শির ঐ শিখর হিমাদ্রির!) সঙ্গে এই সময়ের বিদ্রোহী বীর সাঈদের শেষ মুহূর্তগুলোর ছবি! সত্যিই সাঈদের গৌরবদীপ্ত মূর্তির সামনে হিমালয় মাথা নত করতে বাধ্য!
সাঈদের ছবির পাশাপাশি ভেসে আসতে থাকল আরও নানা প্রতিবাদের ডাক। অবাক হয়ে দেখলাম আমার বিদ্যাপীঠ– যেখানে কাটিয়েছি জীবনের সেরা ১০টি বছর, পিছিয়ে নেই কারও চেয়ে। পরদিন, ১৭ জুলাই ঢাকা রেসিডেনসিয়াল মডেল কলেজের ছাত্ররা রাস্তায় নামবে। তাও আমার বাড়ির একেবারে কাছে। এর পর আর ঘরে বসে, মধ্যবিত্ত বাঙালির চিরন্তন বুলি ‘আমি কারও সাতে-পাঁচে থাকি না’ আওড়াবার সুযোগ থাকল না। ভোর রাত সাড়ে ৩টার দিকে যোগাযোগ করলাম স্কুলজীবনের অন্যতম গুরু এবং বড় ভাই আয়নুল হক রবিনের সঙ্গে। ‘ভাই আসছেন তো?’ ‘আসছি’। ব্যস, এতটুকুই যথেষ্ট। মনে বাজল, ‘বন্ধুর পথে চলিব আবার, বন্ধুরা এস ফিরে’। পরদিন সকালে যখন বাসা থেকে বের হচ্ছি, তখন আমার দু’পাশে দুই অভিন্ন-হৃদয় বন্ধু, জীবনসঙ্গী ডা. সারা আহমেদ সাবন্তী আর ড. স্নেহাদ্রী চক্রবর্ত্তী রিন্টু।
ধানমন্ডি ২৭-এর মোড়ে পৌঁছাতেই দেখা হলো রেসিডেনসিয়াল মডেল স্কুল ও কলেজের ছেলেদের সঙ্গে। তারা একা নয়, এসেছে ধানমন্ডি-মোহাম্মদপুরের সব স্কুল-কলেজ-মাদ্রাসার ছেলেমেয়ে। ইংরেজি মাধ্যমের ছেলেমেয়েও কম নয় সেখানে। সবার মুখে শান্তিপূর্ণ অবস্থানের ডাক। বন্ধু রিন্টু মেয়েদের বিপুল উপস্থিতি দেখে আপ্লুত। বহু বছরের পোড় খাওয়া রাজনৈতিক কর্মী সে। বলল, একটা আন্দোলনের সফলতা নির্ভর করে তাতে নারীদের অংশগ্রহণের ওপর। ভুল বলেনি মোটেই!
খানিক বাদে বাঁশ আর রামদা হাতে এই শিশুদের উচিত শিক্ষা দিতে ছুটে এলো আওয়ামী লীগ, যুবলীগ আর ছাত্রলীগের কর্মীরা। নিরস্ত্র, শান্তিপূর্ণ আন্দোলনের কণ্ঠ রোধ করার পুরোনো হাতিয়ার ব্যবহৃত হলো। আগেও ব্যবহার হয়েছে বারবার। কিন্তু এবার যে ভিন্ন ইতিহাস লিখবে জেন, জি!
মোবাইল ইন্টারনেট বন্ধ। তাই বাসায় ফিরে কিছু ছবি আপলোড করে আবার বেরিয়ে পড়লাম রাস্তায়। ততক্ষণে পুরো ধানমন্ডি ২৭ নম্বর ছাত্র-জনতার দখলে। মিরপুর রোডের দিক থেকে ছুটে আসছে টিয়ার গ্যাসের শেল। এক ছাত্রের সঙ্গে এসেছেন তার মা আর বোন। সে মাকে বলছে, ‘অনেক তো থাকলে, এবার বাড়ি যাও!’ মা নিরুত্তর। তিনি তাঁর কাজে ব্যস্ত। ওড়না ছিঁড়ে বানাচ্ছেন কাঁদানে গ্যাস মোকাবিলার ব্রহ্মাস্ত্র! যে লড়াইয়ে সন্তানের পাশে মা-বাবাও এসে দাঁড়ান, সে লড়াইয়ে হার নেই! আজ দ্বার থেকে দ্বারে আশ্রয় ভিক্ষা করে বেড়ানো শেখ হাসিনা যদি ১৭ জুলাই তারিখেও এ কথা উপলব্ধি করতেন, তাহলে হয়তো আজকের বিজয়ে এত প্রাণ হারানোর হাহাকার মিশে থাকত না।
দুপুরের পর টিয়ার গ্যাসের শেলের তীব্রতা বাড়ল। সে ধোঁয়া ফুঁড়ে বেরিয়ে এলো খুনে দস্যুর দল। দুপুর রোদে তাদের হাতে ঝলমল করছে খুন পিয়াসী মারণাস্ত্র! এর মধ্যে রবিন ভাইও যোগ দিয়েছেন আমাদের সঙ্গে। আমি আমার ক্যামেরায় ছবি তুলে চলেছি। পেছনে ছাত্রছাত্রীরা খবরের কাগজে আগুন দিয়ে, মুখে টুথপেস্ট মেখে টিয়ার গ্যাসের অসহ্য যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পাওয়ার চেষ্টায় ব্যস্ত। আমরা গুলি থেকে বাঁচতে পিছিয়ে এসেছি ধানমন্ডি ২৮-এর গলিতে। আর একটু এগোলেই নজরুলের স্মৃতিবিজড়িত কবি ভবন। গলায় চ্যানেলের আইডি ছিল, হাতে বেশ বড়সড় ডিএসএলআর ক্যামেরা। সবাই বলছিল, ‘ভাই, আমাদের দিকে গুলি করছে! সরাসরি গুলি করছে! আপনি যাবেন না! ছবি তুলুন!’ আমি পালাতে পারিনি। হয়তো পা বলছিল, পালাও, গুলি আসছে! কিন্তু হাত আর চোখ ক্যামেরা থেকে সরেনি। সে অবস্থাতেই হাঁটু গেড়ে আমার দিকে একজন গুলি করল। পেছনে রবিন ভাইয়ের চিৎকার, ‘তোকে দেখে ফেলেছে! সর! সরে যা!’
সে যাত্রায় গুলি আমার গায়ে লাগেনি। পরে খবর পেলাম, সেই দিনই এই ধানমন্ডি ২৭ নম্বর রাস্তাতে বুকে-মাথায় গুলি নিয়ে শহীদ হয়েছে আমার স্কুলের ছোট ভাই ফারহান ফাইয়াজ! মনে হলো, জীবনে ৪০টি বসন্ত দেখেছি। স্ত্রী-সন্তান, আত্মীয়-পরিজন, পোষা প্রাণী, সবার ভালোবাসায় প্রতিদিন সিক্ত হয়েছি! ফারহান তো ‘ফোটার আগেই ঝরা মুকুল!’ কেন আমি বেঁচে থাকলাম, কেন ফারহান চলে গেল– সে প্রশ্নের উত্তর পাইনি। শুধু একটা কথা মনে হয়েছে, পুরোনো আমার, ভীরু আমার, কারও সাতে-পাঁচে না থাকা আমার যেন সেদিনই মৃত্যু হয়েছে। ১৭ জুলাই ২০২৪-এর পর আমার বেঁচে থাকা ফারহানের রক্তের বিনিময়ে, সাঈদের রক্তের বিনিময়ে, মুগ্ধের রক্তের বিনিময়ে, কিংবা বাবার কোলে চিরনিদ্রায় ঢলে পড়া ছোট্ট রিয়া গোপের রক্তের বিনিময়ে। আমাদের আজকের বেঁচে থাকা অজস্র শহীদের রক্তের বিনিময়ে!
শেখ হাসিনা পালিয়েছেন। তাঁর দোসররা একে একে ধরা পড়ছে। ধ্বংসস্তূপ থেকে বাংলাদেশ আবারও ঘুরে দাঁড়াবে। এই খুনের, এই গণহত্যার, এই সীমাহীন নিপীড়নের বিচার এ দেশের মাটিতেই হবে। শুধু ফিরে আসবে না সাঈদ, ফারহান, মুগ্ধ কিংবা রিয়া! আমরা যারা বেঁচে আছি, তাদের মনে রাখতে হবে, আমাদের শরীরে বহমান রক্ত শুধু আমাদের নয়! আমাদের প্রতিটি রক্তবিন্দুতে ঋণ আছে জুলাই অভ্যুত্থানে শত শত শহীদের।
জানি না ডা. জাফরুল্লাহ ভাইয়ের মতো বলতে পারব কিনা, ‘শেখ মুজিব কি আমাকে বলেছিল, জাফরুল্লাহ যুদ্ধে যাও, তুমি বেঁচে ফিরবা? আমরা তো মরতেই গিয়েছিলাম। এটা আমাদের বোনাস জীবন। এখন আর ভয় কীসের?’ হয়তো আবারও আমাদের মধ্যে ‘আমি কারও সাতে-পাঁচে থাকি না’ ভাবটা ফিরে আসতে চাইবে। তখন যেন আমাদের সাঈদের কথা মনে পড়ে। যেন মনে পড়ে আমাদের নীরবতা, আমাদের সহ্য করে নেওয়া, আমাদের ভীরুতার কারণেই সাঈদদের জীবন দিতে হয়েছে। ভীরুর জীবন নয়, আমরা যেন একেকজন ড. শামসুজ্জোহা, একেকজন আবু সাঈদ, একেকজন ফারহান ফাইয়াজ হয়ে উঠতে পারি। তবেই আমরা মাথা উঁচু করে বলতে পারব, শহীদের রক্ত বৃথা যেতে দেব না। তবেই রাষ্ট্র মেরামতের যে বিপুল কর্মযজ্ঞ আমাদের তরুণরা কাঁধে তুলে নিয়েছে, তার অংশীদার হওয়ার হক জন্মাবে আমাদের।
মানজুর-আল-মতিন: সাংবাদিক ও আইনজীবী