ঢাকা বৃহস্পতিবার, ২২ মে ২০২৫

প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী

নেতাকর্মীর ত্যাগ, মানুষের ভালোবাসায় টিকে আছে বিএনপি

নেতাকর্মীর ত্যাগ, মানুষের ভালোবাসায় টিকে আছে বিএনপি

শামসুজ্জামান দুদু

শামসুজ্জামান দুদু

প্রকাশ: ৩১ আগস্ট ২০২৪ | ২৩:৫৫ | আপডেট: ০১ সেপ্টেম্বর ২০২৪ | ০৭:৩৩

বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল বিএনপির ৪৬তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী আজ। ইতিহাসের অনেক বাঁক বদলের ঘটনা রয়েছে এই সময়ের মধ্যে। অনেক চড়াই-উতরাইয়ের মধ্য দিয়ে, অনেক অপপ্রচার আর ষড়যন্ত্র মোকাবিলা করে, নেতাকর্মীর ত্যাগের বিনিময়ে এতটা বছর দেশের সাধারণ মানুষের ভালোবাসায় টিকে আছে দলটি। 

দেশে আরও অনেক পুরোনো দল আছে। তবে তারা বিএনপির মতো জনগণের আস্থা, ভালোবাসা অর্জন করে হৃদয়ে স্থান করতে পারেনি। বরং মানুষের ওপর অত্যাচার, নির্যাতনের কারণে এবং মানুষের প্রত্যাশাকে ভূলুণ্ঠিত করার কারণে অনেক দল আজ ধিকৃত। এর সর্বশেষ উদাহরণ আওয়ামী লীগ। অবৈধভাবে ক্ষমতায় থাকতে গিয়ে তারা আজ ইতিহাসের আঁস্তাকুড়ে। ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে দেশ ছেড়ে পালিয়ে যেতে হয়েছে আওয়ামী লীগপ্রধান শেখ হাসিনাকে। 

বিএনপি যখন গঠিত হয়েছিল তখন পরিস্থিতিটা ছিল একেবারেই ভিন্ন। ১৯৭৫ সালের জানুয়ারিতে দেশের সব রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধ করে চতুর্থ সংশোধনীর মাধ্যমে একটি জাতীয় দল গঠনের সিদ্ধান্ত হয় জাতীয় সংসদে। দেশের সব রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধ হয়ে যায় এবং বাকশাল নাম দিয়ে সেই জাতীয় দল গঠন করা হয়। এমনকি যুব সংগঠন, ছাত্র সংগঠন, শ্রমিক সংগঠন এগুলোও নিষিদ্ধ করে বাকশালে একীভূত করা হয়।

১৯৭১ সালে স্বাধীনতা অর্জনের পর বাংলাদেশ একটি স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে যাত্রা শুরু করে। আমরা একটি স্বাধীন ভূখণ্ড, মানচিত্র ও একটি পতাকা পেয়েছিলাম। দুঃখজনক হলেও সত্য, কার্যকর রাষ্ট্র বলতে যা বোঝায়, তা আমরা অর্জন করতে পারিনি।  দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি ও হানাহানি ছড়িয়ে পড়েছিল চারদিকে।

মূলত বিএনপির আমলেই একটি কার্যকর রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশ যাত্রা শুরু করে। দক্ষ প্রশাসনিক ব্যবস্থা গড়ে তোলার উদ্যোগ নেওয়া হয়। আমলাতন্ত্রকে মেধার ভিত্তিতে ঢেলে সাজানো শুরু হয়। সামরিক বাহিনীর পুনর্বিন্যাস করে এর ব্যাপ্তি বাড়ানো হয়। বিএনপির আমলে নারী পুলিশ নিয়োগ করা হয়। আনসার-ভিডিপি গড়ে তোলা হয় নতুন করে। 

সারাদেশে কৃষির উন্নয়নে ব্যাপক কর্মসূচি হাতে নেওয়া হয়েছিল বিএনপির প্রথম আমলে। খাল খনন ও সেচ ব্যবস্থায় আমূল পরিবর্তন করা হয়। খাল খনন, কাজের বিনিময়ে খাদ্য কর্মসূচির মতো বিভিন্ন কর্মসূচিতে ব্যাপকভাবে সাধারণ মানুষের সম্পৃক্ততা সৃষ্টি করা হয়। ব্রিটিশ ও পাকিস্তানিদের দ্বারা শাসিত ও শোষিত মানুষ এই প্রথম রাষ্ট্রকে কাছ থেকে নিজের মতো করে দেখতে পেল এবং এর সুফল ভোগ করতে শুরু করল। বিএনপির হাত ধরে অর্থনৈতিক ও প্রশাসনিক সংস্কারের কারণে নতুন নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি হতে শুরু করে। কৃষিভিত্তিক অর্থনীতির পাশাপাশি বিএনপির আমলে প্রবাসী আয় ও পোশাক রপ্তানির আয় থেকে নতুন এক মধ্যবিত্ত শহুরে নাগরিক শ্রেণির বিকাশ ঘটতে শুরু করে এবং রাজনীতি, অর্থনীতি, সংস্কৃতিতে এই নতুন মধ্যবিত্ত শ্রেণির নেতৃত্বের উত্থান লক্ষ্য করা যায়।

জিয়াউর রহমান ১৯৮১ সালের ৩০ মে পর্যন্ত অনেক যুগান্তকারী কাজ করেছিলেন। তার একটা হলো বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল গঠন। এই দলের গঠনটা এক দিনে হয়নি। প্রথমে জাগো দল বলে একটি সংগঠন গড়ে উঠেছিল। বিচারপতি সায়েম ছিলেন তার আহ্বায়ক। বিভিন্ন দলের অনেক নেতাকর্মী এবং সাধারণ মানুষ যারা কখনও রাজনীতিতে সম্পৃক্ত ছিলেন না তারা এতে যোগ দেন। সেই জাগো দল এবং ভাসানী ন্যাপ, ইউনাইটেড পিপলস পার্টি, বাংলাদেশ কংগ্রেস, বাংলাদেশ লেবার পার্টি এ রকম বেশ কয়েকটি দলের সমন্বয়ে গঠিত হয় জাতীয়তাবাদী গণতান্ত্রিক ফ্রন্ট। সেই ফ্রন্টের প্রার্থী হিসেবে জিয়াউর রহমান রাষ্ট্রপতি নির্বাচন করেছিলেন। ওই সময়ে তিনি রাষ্ট্রপতি থাকলেও সেভাবে তিনি থাকতে চাননি। তিনি জনগণের সমর্থন নিয়ে রাষ্ট্রপতি হতে চেয়েছিলেন। এর আগেই তিনি আরেকটা কাজ করেছিলেন। ১৯ দফা কর্মসূচি প্রণয়ন করেন। ১৯৭৮ সালের ১ সেপ্টেম্বর বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) গঠন করেন। সেই বিএনপি নানা চড়াই-উতরাই পেরিয়ে আজকের অবস্থায় এসেছে। 

জিয়াউর রহমান বাংলাদেশিদের সুস্পষ্ট একটা পরিচয় দেন। বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদ। তিনি বিচার ব্যবস্থার স্বাধীনতা, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা ফিরিয়ে দেন। সংবাদপত্রের স্বাধীনতা ফিরিয়ে দেন। পূর্বের বাকশালের একদলীয় শাসনব্যবস্থার পরিবর্তে বিএনপি বহুদলীয় রাজনৈতিক ব্যবস্থা ফিরিয়ে আনে। 

জিয়াউর রহমানের হাত ধরেই দেশে গার্মেন্ট শিল্পের প্রতিষ্ঠা হয়। তিনিই প্রথম মধ্যপ্রাচ্যে সাড়ে আট হাজার জনশক্তি রপ্তানি করেন; যা আজ প্রায় সোয়া কোটিতে পরিণত হয়েছে। এই জনশক্তি দিয়ে আজ দেশে ১৮ বিলিয়ন এবং গার্মেন্ট শিল্প দিয়ে ৪০ বিলিয়ন বৈদেশিক মুদ্রা আয় করা হচ্ছে। গার্মেন্ট শিল্পের মাধ্যমে দেশের দরিদ্র ৭০ ভাগ নারীর কর্মসংস্থান হয়েছে। জিয়া গ্রামে শিল্পের মাধ্যমে উন্নয়নে পল্লী বিদ্যুতায়নের প্রথম উদ্যোগ নিয়েছেন। বঙ্গোপসাগরের মাছ রপ্তানি শুরু করেন। গিনিতে চাল রপ্তানি করেছেন। চিনি রপ্তানি করেছেন। জিয়া শুধু কৃষক ও শ্রমিকদের উন্নয়নে উৎপাদনের রাজনীতি করেছেন। যুব ও নারী শক্তিকে সমৃদ্ধ করেছেন। যুব ও নারী মন্ত্রণালয় গঠন করেছেন। 

জিয়াউর রহমানই প্রথম উন্নয়নের, উৎপাদনের রাজনীতি শুরু করেন। এই মন্ত্র দিয়েই তিনি বিএনপি গঠন করেন। যা কিছুই উৎপাদনের পক্ষে সেটাকেই তিনি গ্রহণ করলেন। বাংলাদেশের এতদিনে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্নজন কাজ করেছেন, উন্নয়ন করেছেন। তাদের সঠিকভাবে মূল্যায়ন করতে হবে। সম্মান জানাতে হবে। 

জিয়াউর রহমান মারা যাওয়ার পর অনেকেই মনে করেছিল বিএনপি ধসে যাবে। কিন্তু ধসেনি। তার অনুপস্থিতিতে দেশনেত্রী খালেদা জিয়া দায়িত্ব নিয়েছেন। আপসহীনভাবে স্বৈরাচার সরকারকে হটানোর জন্য দীর্ঘ ৯ বছর আন্দোলন-সংগ্রাম করেছেন। জনপ্রিয়তার শীর্ষে থাকা এ রকম নেত্রী বাংলাদেশে আর নেই। তাঁকে মাদার অব ডেমোক্রেসি উপাধি দেওয়া হয়েছে। বিএনপির তিনবারের শাসনামলে সামাজিক নিরাপত্তাবেষ্টনীর পরিধি বৃদ্ধি করা হয়েছিল কাজের বিনিময়ে খাদ্য কর্মসূচি, বিনা মূল্যে বাধ্যতামূলক প্রাথমিক শিক্ষা, অর্থের বিনিময়ে শিক্ষা, অবৈতনিক নারী শিক্ষাসহ নানাবিধ কর্মসূচির মাধ্যমে। অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে কেন্দ্রীভূত কাঠামোকে বাদ দিয়ে বেসরকারি খাতের বিকাশকে উৎসাহিত করেছিল। তবে রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণ বজায় রেখেছিল। চুরি, দুর্নীতি, পাচার রোধ করে নৈতিক অর্থনীতি কায়েম করার চেষ্টা করেছিল। শাসনব্যবস্থাকে গ্রাম সরকারের মাধ্যমে প্রান্তিক পর্যায়ে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা ছিল।

দেশের জন্য বিএনপির এ অবস্থানের কারণে পুরো জিয়া পরিবার আর দলের নেতাকর্মীর ওপর বিগত দিনে অকথ্য নির্যাতন করা হয়েছে। হত্যা-গুমের পাশাপাশি মামলা-হামলা করে নিঃশেষ 
করে দেওয়ার সব আয়োজনই  করেছিল আওয়ামী লীগ। তবে জনগণের সমর্থন থাকলে কোনো দলকে বিলুপ্ত করা সম্ভব নয়। 

বিএনপিকেও বিলুপ্ত করা সম্ভব না, আটকে রাখা যাবে না। জনগণের সমর্থন নিয়েই বিএনপি টিকে থাকবে। বিএনপির নেতৃত্বের নতুন সূর্য আগামী দিনের অহংকার, আগামীর রাষ্ট্রনায়ক জনাব তারেক রহমানের হাত ধরে নতুন বাংলাদেশ গঠনের লক্ষ্যে এগিয়ে চলেছে বিএনপি।

শামসুজ্জামান দুদু: বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান

আরও পড়ুন

×