নাগরিক অধিকার
গ্রেপ্তার-রিমান্ড: আদালতের নির্দেশনা মানা হচ্ছে?
প্রতীকী ছবি
মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল গালিব
প্রকাশ: ০৩ সেপ্টেম্বর ২০২৪ | ০০:১০
বিনা পরোয়ানায় গ্রেপ্তার, পুলিশ হেফাজতে আটক রাখা, রিমান্ডের নামে অমানুষিক নির্যাতন সদ্য ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ে স্বাভাবিক বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছিল। প্রশ্ন উঠছে, অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সময়ে তা কতটা বন্ধ হয়েছে?
বাংলাদেশের সংবিধান অনুযায়ী প্রত্যেক নাগরিক আইনের আশ্রয় লাভের অধিকারী এবং আইনি বিধানের ব্যত্যয় ঘটিয়ে কোনো ব্যক্তির বিরুদ্ধে এমন কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করা যাবে না, যাতে তার জীবন, স্বাধীনতা, দেহ, সুনাম বা সম্পত্তির হানি ঘটে। সংবিধানের ৩৩ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী গ্রেপ্তারকৃত কোনো ব্যক্তিকে যথাসম্ভব শীঘ্র গ্রেপ্তারের কারণ না জানিয়ে প্রহরায় আটক রাখা যাবে না এবং গ্রেপ্তারকৃত ব্যক্তির মনোনীত আইনজীবীর সঙ্গে পরামর্শ ও আত্মপক্ষ সমর্থনের অধিকার থেকে বঞ্চিত করা যাবে না। পরিতাপের বিষয়, সংবিধান প্রদত্ত উল্লিখিত মৌলিক অধিকার এখনও প্রায়ই লঙ্ঘিত হচ্ছে।
ফৌজদারি কার্যবিধি, ১৮৯৮-এর ৫৪ ধারার বিধান অনুসারে, পুলিশ কর্মকর্তা ম্যাজিস্ট্রেটের আদেশ বা গ্রেপ্তারি পরোয়ানা ছাড়াই এমন কাউকে গ্রেপ্তার করতে পারেন, যিনি কোনো আমলযোগ্য অপরাধের সঙ্গে জড়িত বা তাঁর বিরুদ্ধে আমলযোগ্য অপরাধে জড়িত থাকার অভিযোগ করা হয়েছে বা বিশ্বাসযোগ্য তথ্য পাওয়া গেছে বা যুক্তিসংগত সন্দেহ রয়েছে। এ ছাড়া আরও আটটি কারণে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা ছাড়াই কাউকে গ্রেপ্তার করতে পারে পুলিশ।
এ ক্ষেত্রে মনে রাখতে হবে, আইন অনুযায়ী বিনা পরোয়ানায় গ্রেপ্তারকৃত ব্যক্তিকে ম্যাজিস্ট্রেটের বিশেষ আদেশ ছাড়া ২৪ ঘণ্টার বেশি আটক রাখার বিধান নেই। তবে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে তদন্ত শেষ না হলে ফৌজদারি কার্যবিধির ১৬৭ ধারার বিধানমতে যদি প্রাপ্ত অভিযোগ বা সংবাদ যথেষ্ট বিশ্বাসযোগ্য হয় তাহলে ম্যাজিস্ট্রেট তাঁর নিজ বিবেচনায় আসামিকে বিভিন্ন সময়ে হেফাজতে আটক রাখার ক্ষমতা প্রদান করবেন। সেটাও সর্বোচ্চ ১৫ দিনের বেশি হবে না।
অভিযুক্ত ব্যক্তিকে তদন্তের স্বার্থে ২৪ ঘণ্টার অতিরিক্ত পুলিশ হেফাজতে আটক রাখার বিষয়কে সাধারণভাবে ‘রিমান্ড’ বলা হয়। উল্লেখ্য, প্রচলিত আইনে রিমান্ড শব্দটির সংজ্ঞা দেওয়া হয়নি। ফৌজদারি কার্যবিধির ১৬৭ ধারায় বলা হয়েছে, গ্রেপ্তারের পরবর্তী ২৪ ঘণ্টার মধ্যে তদন্ত শেষ করতে না পারলে, গ্রেপ্তারকৃত ব্যক্তির বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগ যথাযথ ও বস্তুনিষ্ঠ বিবেচিত হলে মামলার তদন্ত কর্মকর্তা ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে গ্রেপ্তারকৃত ব্যক্তিকে ফেরত পাঠানোর আবেদন করতে পারেন। ম্যাজিস্ট্রেট সন্তুষ্ট হলেই রিমান্ড আবেদন মঞ্জুর করে পুলিশের কাছে আসামিকে ফেরত দিতে পারেন, তবে তা একসঙ্গে ১৫ দিনের বেশি হবে না। বাংলাদেশ লিগ্যাল এইড অ্যান্ড সার্ভিসেস ট্রাস্ট (ব্লাস্ট) বিনা পরোয়ানায় গ্রেপ্তার এবং গ্রেপ্তারকৃত ব্যক্তিকে রিমান্ডে নিয়ে নির্যাতনের বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে হাইকোর্টে একটি রিট মামলা করে। মামলার চূড়ান্ত শুনানি শেষে ১৫ দফা নির্দেশনাসহ রায় দেন আদালত।
নির্দেশনাগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য– বিশেষ ক্ষমতা আইনে ডিটেনশন দেওয়ার জন্য বিনা পরোয়ানায় গ্রেপ্তার করতে পারবে না; গ্রেপ্তারের সময় পুলিশ কর্মকর্তাকে পরিচয় দিতে হবে। থানায় আনার পর সংশ্লিষ্ট পুলিশ কর্মকর্তাকে দ্রুত গ্রেপ্তারের কারণগুলো কেস ডায়েরিতে লিখতে হবে। যদি গ্রেপ্তারের সময় গ্রেপ্তারকৃত ব্যক্তির শরীরে কোনো আঘাতের চিহ্ন থাকে, তার কারণ লিখতে এবং চিকিৎসার জন্য হাসপাতালে নিতে হবে। থানায় আনার তিন ঘণ্টার মধ্যে গ্রেপ্তারের কারণ জানাতে হবে। বাসস্থান বা কর্মস্থলের বাইরে থেকে গ্রেপ্তার করা হলে এক ঘণ্টার মধ্যে আত্মীয়স্বজনকে টেলিফোন বা বিশেষ বার্তাবাহকের মাধ্যমে বিষয়টি জানাতে হবে। গ্রেপ্তারকৃত ব্যক্তির পছন্দমতো আইনজীবী বা নিকটাত্মীয়ের সঙ্গে পরামর্শ করতে বা দেখা করতে দিতে হবে। গ্রেপ্তারকৃত ব্যক্তিকে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে তদন্ত প্রতিবেদনসহ ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে হাজির করতে হবে।
এ ছাড়া যদি গ্রেপ্তারকৃত ব্যক্তির বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগ বা তথ্যের যথার্থতা সুদৃঢ় না হয়, তাহলে ম্যাজিস্ট্রেট বিনা পরোয়ানায় গ্রেপ্তারকারী পুলিশ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশ দেবেন। অভিযুক্ত ব্যক্তিকে হেফাজতে নির্যাতনের প্রমাণ পাওয়া গেলে ম্যাজিস্ট্রেট আটককৃত ব্যক্তির অভিযোগের দরখাস্ত ছাড়াই সংশ্লিষ্ট পুলিশ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশ দেবেন। পুলিশ হেফাজত বা জেলখানায় আটক ব্যক্তির মৃত্যু হলে সংশ্লিষ্ট থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা বা তদন্ত কর্মকর্তা বা জেলার সেই খবর ম্যাজিস্ট্রেটকে জানাবেন।
সাইফুজ্জামান বনাম রাষ্ট্র ও অন্যান্য মামলায় হাইকোর্ট গ্রেপ্তার ও রিমান্ড সম্পর্কে আরও কিছু নির্দেশনা দিয়েছেন, যার মধ্যে রয়েছে পুলিশ কর্মকর্তা কোনো ব্যক্তিকে গ্রেপ্তারের পর তাৎক্ষণিকভাবে গ্রেপ্তারের একটি মেমো তৈরি করা; নিকটাত্মীয়কে দ্রুত সম্ভব গ্রেপ্তারের সময়, স্থান এবং বর্তমানে কোথায় আছে তা জানানো; গ্রেপ্তারের কারণ, তথ্য প্রদানকারী বা অভিযোগকারীর পরিচয়, গ্রেপ্তারকৃত ব্যক্তির অবস্থান লিপিবদ্ধকরণ; রিমান্ড শেষে ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে হাজির করা; গ্রেপ্তারকৃত ব্যক্তিকে আটক রাখার অত্যাবশ্যকীয় শর্ত তার বিরুদ্ধে মামলা রুজু থাকা।
উচ্চ আদালতের নির্দেশনা থাকার পরও বিনা পরোয়ানায় গ্রেপ্তারের ঘটনা এখনও কিন্তু ঘটছে। কৌশল হিসেবে অন্য কোনো আইন বা চলমান মামলায় গ্রেপ্তার দেখানো হচ্ছে। দেশে রাজনৈতিক পট পবিবর্তনের পর প্রত্যাশা ছিল– সংবিধান, প্রচলিত আইন ও আদালতের নির্দেশনা অনুসারে প্রৃকত অপরাধীকে আইনের আশ্রয়ে নিয়ে উপযুক্ত বিচার করা হবে। সেই প্রত্যাশা পূরণে বর্তমান সরকার ও পুলিশ প্রশাসন কি আন্তরিক হবে না?
মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল গালিব: অ্যাডভোকেট, জেলা ও দায়রা জজ আদালত, ঢাকা
ghalib.advocate@gmail.com
- বিষয় :
- অধিকার