মায়ের সুস্থতা শিশুর বিকাশের পূর্বশর্ত
প্রতীকী ছবি
নুসরাত জাহান ও সাকিলা ইয়াসমিন
প্রকাশ: ২০ নভেম্বর ২০২৪ | ০০:১৬
আজ বিশ্ব শিশু দিবস। এ বিষয়ে আলোচ্য– শিশুর বিকাশে মা কতটা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। আমরা জানি, মা ও শিশুর সম্পর্ক পৃথিবীর সবচেয়ে মধুর ও অমূল্য। মাতৃগর্ভে থাকতেই এ সম্পর্কের পথচলা শুরু। এখানে একজন মাকে নানা রকম শারীরিক ও মানসিক পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে যেতে হয়। শিশু জন্ম দেওয়ার পর থেকে মায়েরা সাধারণত দিনরাত তার সেবা-যত্নে ব্যস্ত হয়ে পড়েন। নিজের দিকে ফিরে তাকানোর সময় তেমন হয়ে ওঠে না।
শিশুর বিকাশে মায়ের মানসিক স্বাস্থ্যের ভূমিকা
মায়েদের শারীরিক ও মানসিক সুস্থতা শিশুর শারীরিক গঠন ও বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। মায়ের মানসিক চাপ, উদ্বেগ ও বিষণ্নতা শিশুর প্রাক-জন্মকালীন যত্ন ও পুষ্টিকে প্রভাবিত করে শিশুর বিকাশে বাধা সৃষ্টি করতে পারে।
গর্ভে থাকাকালীন মায়ের মানসিক চাপ কিংবা উদ্বেগের ফলে কর্টিসোলের পরিমাণ বেড়ে যেতে পারে, যা ভ্রূণের বিকাশকে প্রভাবিত করতে পারে। বিশেষ করে শিশুর শারীরিক কাঠামো গঠন এবং হাড়ের বিকাশে নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে। মা মানসিকভাবে সুস্থ না থাকলে শিশুকে বুকের দুধ খাওয়ানোর বেলায়ও অসুবিধা হতে পারে। পর্যাপ্ত পরিমাণে বুকের দুধ না পাওয়ার কারণে শিশুর পুষ্টি ব্যাহত হয়।
গবেষণায় দেখা যায়, গর্ভে থাকাকালীন মা যদি মানসিক চাপ, বিষণ্নতা, উদ্বেগ ইত্যাদির মধ্য দিয়ে যান, সে ক্ষেত্রে শিশুর মস্তিষ্কের বিকাশ বাধাগ্রস্ত হয়। শিশুর মস্তিষ্কের আকার ছোট হওয়ার ফলে যে কোনো কাজ বুঝতে, কথা বলতে, সে অনুযায়ী সাড়া দিতে, লেখাপড়া করতে কিংবা কোনো দক্ষতা অর্জনে দেরি হয়।
শিশুর সামাজিক ও ভাষাগত বিকাশের ক্ষেত্রে
পরিবার ও সমাজে থাকতে গেলে নানা ধরনের মানুষের সঙ্গে মিলেমিশে চলতে হয়। সামাজিক আচার-ব্যবহার, নিয়ম-নীতি পরিবার থেকেই শিশু সবার আগে শেখে। এ ক্ষেত্রে মা ও পরিবারের কাছের মানুষ কখন কী ধরনের আচরণ করেন, কীভাবে কথা বলেন– এগুলো শিশু প্রতিনিয়ত দেখে অনুকরণ এবং পরে সে অনুযায়ী আচরণ করে থাকে।
ছোটবেলা থেকে সামাজিক বিকাশ সঠিকভাবে হলে পরে তা শিশুর শিক্ষা, পেশা, ব্যক্তি ও পারিবারিক জীবনে সুস্থ, সুন্দরভাবে চলমান থাকার সম্ভাবনা থাকে।
শিশুর ভাষাগত ও বুদ্ধির বিকাশের ক্ষেত্রে
গর্ভে থাকার সময়েই শিশু মা ও মায়ের আশপাশে থাকা মানুষদের শব্দ শুনতে পায়। পরে সেসব শব্দ শুনলে শিশু সাড়া দিয়ে থাকে। শিশুরা জন্মের পরপর কথা বলতে না পারলেও মা ও আশপাশের মানুষ ও চারদিকের শব্দ শুনতে পায়। এই শব্দগুলো শিশুদের মস্তিষ্কে জমা হয় এবং পরে যখন তারা একটু একটু করে কথা বলতে শেখে, সেই শব্দগুলো ব্যবহার করে কথা বলতে থাকে। শিশুকে তার বয়স অনুযায়ী ছড়া-গল্প বললে ও তার সঙ্গে খেলা করলে খুব তাড়াতাড়ি সে তা শিখে ফেলতে পারে।
শিশুর সঙ্গে যখন মা আনন্দ নিয়ে কথা বলেন; গল্প, ছড়া ও গান করেন, শিশু তাতে খুব আগ্রহী হয়। মাকে সে অনুকরণ করে ও তাতে সাড়া দেয়। ফলে মায়ের সঙ্গে তার নিবিড় সম্পর্ক গড়ে ওঠে। শিশু মায়ের কাছ থেকে প্রচুর শব্দ শেখে, যা তার ভাষা বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। মা যখন শিশুর সঙ্গে কথা বলেন কিংবা খেলেন, তখন শিশু নানা বিষয়ে আগ্রহী হয়ে তাতে সাড়া দেওয়ার চেষ্টা করে।
শিশুর আবেগ-অনুভূতি ও আচরণের বিকাশ
শিশু যেহেতু বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই তার আবেগ-অনুভূতি সরাসরি প্রকাশ করে, কাজেই তাদের আবেগ-অনুভূতি বুঝে সে অনুযায়ী সাড়া দিতে হয়। শিশুরা যেহেতু অনেক কথা গুছিয়ে বলতে পারে না; অনেক রকম শব্দ করে; বুলি, কথা, ইশারা, কান্না কিংবা বিশেষ কোনো আচরণ, হাত-পা নাড়াচাড়ার মাধ্যমে তারা তাদের প্রয়োজন জানানোর চেষ্টা করে। একজন সুস্থ মা নিজ সন্তানের অনুভূতি ঠিকভাবে বুঝে নিয়ে সে অনুযায়ী কাজ করতে সক্ষম হন। শিশুর প্রয়োজন বুঝে মা সাড়া দিলে সে ধীরে ধীরে বুঝতে শেখে– প্রয়োজনে মা তার পাশে আছে। এভাবে সে তার আনন্দ-বেদনা, ভয়-সাহস ইত্যাদি অনুভূতি বুঝে সে অনুযায়ী আচরণ করা শিখে যায়। শিশুর এই অনুভূতি, আচরণ মা তখনই ঠিকভাবে বুঝতে পারবেন, যখন নিজে মানসিকভাবে ভালো থাকবেন।
মা যদি উদ্বেগ, বিষণ্নতা বা মানসিক চাপে থাকেন, তাহলে এটি শিশুর অনুভূতি ও আচরণে প্রতিফলিত হতে পারে।
শিশুর আবেগ নিয়ন্ত্রণে মায়ের ভূমিকা
কোনো একটি পরিস্থিতিতে মা নিজের আবেগ কীভাবে প্রকাশ ও ব্যবস্থাপনা করেন, তা শিশুরা খেয়াল করে। যেমন কোনো একটি খুশির মুহূর্তে মা কীভাবে সাড়া দিচ্ছেন; কী ধরনের আচরণ করছেন; কীভাবে তার আবেগ-অনুভূতি প্রকাশ করছেন, তা শিশু খেয়াল করে থাকে। কোনো কারণে রেগে গেলে যদি মা চিৎকার করেন কিংবা জিনিসপত্র ভাঙচুর করেন কিংবা নিজেকে বেশি বেশি দোষারোপ করতে থাকেন, তাহলে দেখা যায় পরে তার শিশুর মধ্যেও রেগে গেলে এ ধরনের আচরণ করার প্রবণতা তৈরি হয়।
মা নিজে যখন সঠিক ও ইতিবাচক উপায়ে তাঁর নিজের আবেগগুলোকে ম্যানেজ করতে পারবেন, শিশুও মাকে দেখে সেগুলো শিখে সে অনুযায়ী নিজের আবেগকে পরিস্থিতির সঙ্গে মানিয়ে নিয়ে নিয়ন্ত্রণ করা শিখে যায়।
মায়ের মানসিক স্বাস্থ্য সুরক্ষায় করণীয়
মায়ের মানসিক স্বাস্থ্য সুরক্ষায় সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে গর্ভধারণের শুরু থেকেই নিয়মিত ডাক্তারের পরামর্শ নেওয়া। পাশাপাশি সন্তান ধারণ ও লালন-পালন সম্পর্কে মা-বাবা ও পরিবারের সবাই মিলে আলোচনার ভিত্তিতে করণীয় ঠিক করা এবং সন্তান লালন-পালনে সবাই মিলে সহযোগিতা করা। এ ছাড়া আরও যেসব বিষয় নজর রাখা জরুরি, তার মধ্যে রয়েছে মায়ের জন্য পুষ্টিকর খাবার, বিশুদ্ধ পানি ও বিশ্রামের ব্যবস্থা করা। তার প্রতিদিনের কাজে পরিবারের সবাই মিলে সহযোগিতা করতে হবে।
মায়ের শরীর ও মন যেন ভালো থাকে সে জন্য সুস্থ-সুন্দর পারিবারিক ও সামাজিক পরিবেশ বজায় রাখা জরুরি। ভালো লাগে এমন কাজে তাকে উৎসাহিত করতে হবে, যেমন বই পড়া, গান শোনা ইত্যাদি। এ সময় মাকে নিঃশ্বাসের ব্যায়াম করতে হবে এবং প্রয়োজনে পেশাদার মনোবিজ্ঞানী ও নিকটস্থ মানসিক স্বাস্থ্যসেবা প্রদানকারী বা সাইকিয়াট্রিস্টের সহায়তা নিতে হবে।
নুসরাত জাহান ও সাকিলা ইয়াসমিন: যথাক্রমে ম্যানেজার, সিনিয়র সাইকোলজিস্ট, ব্র্যাক ইনস্টিটিউট অব এডুকেশনাল ডেভেলপমেন্ট (বিআইইডি), ব্র্যাক ইউনিভার্সিটি এবং সিনিয়র লেকচারার, ব্র্যাক ইনস্টিটিউট অব এডুকেশনাল ডেভেলপমেন্ট (বিআইইডি), ব্র্যাক ইউনিভার্সিটি
- বিষয় :
- শিশু