ঢাকা বৃহস্পতিবার, ১৬ জানুয়ারি ২০২৫

ক্ষমতায়ন

স্থানীয় সরকারে নারীর অংশগ্রহণ বাড়াতে করণীয়

স্থানীয় সরকারে নারীর অংশগ্রহণ বাড়াতে করণীয়

আকম সাইফুল ইসলাম চৌধুরী

আকম সাইফুল ইসলাম চৌধুরী

প্রকাশ: ২৫ নভেম্বর ২০২৪ | ০০:২২ | আপডেট: ২৫ নভেম্বর ২০২৪ | ০০:২৫

দুনিয়ার একেক দেশে নির্বাচনের ধরন একেক রকম। সেগুলো গণতান্ত্রিক হলেও পদ্ধতি ভিন্ন। কোনো দেশে নির্বাচন হয় ৭ বছর পর। কোথাও ৪ বছর, আবার কোনো দেশে ৫ বছর পর ভোট হয়। কোনো দেশে প্রদত্ত মোট ভোটের অর্ধেকের বেশি না পেলে শীর্ষ দু’জনের মধ্যে আবার ভোট হয়। কোনো দেশে দু’বারের বেশি একই পদে নির্বাচিত হওয়া যায় না। আবার কোনো কোনো দেশে মেয়াদেরই বালাই নেই। মোদ্দা কথা, জনপ্রতিনিধি নির্বাচিত হবে কেমন ধারায়, কেমন আকারে, তা নিজ নিজ দেশের পরিস্থিতির ওপর নির্ভরশীল।

আমাদের দেশে স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানের সর্বনিম্ন ধাপ ইউনিয়ন পরিষদ ও পৌরসভা; মহানগরীর জন্য সিটি করপোরেশন। দেশের প্রতিটি ইউনিয়ন পরিষদই ৯টি ওয়ার্ডে বিভক্ত। বেশির ভাগ পৌরসভায় ৯টি ওয়ার্ড থাকলেও কোনো কোনো পৌরসভায় তার চেয়ে বেশি ওয়ার্ড আছে, তবে তা-ও ৩ গুণিতকে। সাধারণ ওয়ার্ডগুলোতে নারী-পুরুষ নির্বিশেষে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে পারেন। প্রতিটি পৌরসভা ও ইউনিয়ন পরিষদে ৩টি ওয়ার্ড নিয়ে গঠিত হয় সংরক্ষিত নারী আসন। এই নারী আসনে কেবল নারীরাই প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে পারেন। সিটি করপোরেশন, যেমন ঢাকার দুটোর কোনো কোনো নারী আসন তিনটিরও বেশি ওয়ার্ড নিয়ে গঠিত। ইউনিয়ন পরিষদ, পৌরসভা ও সিটি করপোরেশন নির্বাচিত চেয়ারম্যান/মেয়র, সাধারণ আসনের কাউন্সিলর ও সংরক্ষিত নারী আসনের কাউন্সিলরদের নিয়ে গঠিত হয়। সব ইউনিয়ন পরিষদ ও বেশির ভাগ পৌরসভায় এই জনপ্রতিনিধির মোট সংখ্যা ১৩।

নির্বাচনে পুরুষ যতটুকু এলাকায় নির্বাচনী প্রচার-প্রচারণা চালায়, নারীকে সেই একই প্রচার চালাতে হয় ইউনিয়ন পরিষদ ও পৌরসভায় তার ৩ গুণ এলাকায়। সিটি করপোরেশনে আরও বেশি। পুরুষকে একটিমাত্র ওয়ার্ডে সভা, জনসংযোগ, পোস্টার প্রভৃতি কাজে অর্থ ব্যয় করতে হলেও নারীকে তার কমপক্ষে ৩ গুণ নির্বাচনী এলাকায় ৩ গুণ অর্থ ব্যয় করতে হয়। 

১৯৯১ সাল থেকে দেশে সরকার ব্যবস্থা মন্ত্রিপরিষদ শাসিত। রাষ্ট্র সেই থেকে জাতীয় পর্যায়ে ব্রিটিশ ধাঁচের মন্ত্রিপরিষদ শাসিত সরকার দ্বারা পরিচালিত। অন্যদিকে স্থানীয় সরকার ব্যবস্থাপনা চলছে রাষ্ট্রপতি শাসিত সরকার পদ্ধতিতে। দুনিয়ার বেশির ভাগ জায়গায় স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানের চেয়ারম্যান/মেয়র নির্বাচিত হন কাউন্সিলরদের ভোটে। আমাদের দেশে নির্বাচিত হন সরাসরি নির্বাচনী এলাকার সব ভোটারের ভোটে। ঢাকার দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের অধীন জাতীয় সংসদীয় আসন ৭টি ও উত্তরে ৮টি। একজন মেয়র প্রার্থীকে নির্বাচনী লড়াইয়ে কেমন পরিশ্রম করতে হয়, তা সহজেই অনুমেয়। এর ফলে মেয়ররা নিজেদের কাউন্সিলরদের চেয়ে অনেক বেশি এলিট ভাবেন এবং অনেক ক্ষেত্রে কাউন্সিলরকে সহজে গুরুত্ব দেন না। আবার ৩ গুণ বা তার বেশি আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে নির্বাচিত হয়ে আসা সংরক্ষিত আসনের নারী কাউন্সিলররা নিম্নতর শ্রেণির প্রতিনিধি বলে বিবেচিত হন ও উপেক্ষিত থাকেন। শিকার হন বৈষম্যের।

নারীদের ক্ষমতায়ন বিশ্বব্যাপী এখন জনপ্রিয় স্লোগান। এই ক্ষমতায়নের জন্যই আমাদের দেশে স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানসহ জাতীয় সংসদেও নারীদের জন্য সংরক্ষিত আসন রাখা হয়েছে। পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে স্থানীয় সরকার নির্বাচনে প্রতিটি পর্যায়ে নারীদের জন্য ১/৩ অংশ আসন নির্ধারিত। এই আসনগুলো সাধারণ আসনেরই এক-তৃতীয়াংশ, যা প্রতিটি নির্বাচনের আগে পরিবর্তিতভাবে নির্ধারিত হয়। একবারের নির্বাচনে যে আসনগুলো নারীদের জন্য সংরক্ষিত হলো তা পরবর্তী নির্বাচনে সবার জন্য উন্মুক্ত। মোটা দাগে তিন বছরের চক্রাকার পদ্ধতিতে নারী আসনগুলো নির্ধারিত হয়। এর ফলে একজন পুরুষ তার আসনে পরপর তিনবার নির্বাচনে প্রার্থী হওয়ার সুযোগ হারান। সংরক্ষিত আসনে নির্বাচিত বা প্রতিদ্বন্দ্বিতাকারী একজন নারীও পরবর্তী নির্বাচনে সংরক্ষিত আসনের সুবিধা হারান। সংরক্ষিত নারী আসনে নির্বাচন করতে হলে তাঁকে চতুর্থ মেয়াদের নির্বাচনের জন্য অপেক্ষা করতে হয়। ভারতে স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানগুলোর নির্বাচিত সদস্যদের ভোটে পরিষদের সভাপতি নির্বাচিত হন, যা মন্ত্রিপরিষদ শাসিত সরকারেরই প্রতিচ্ছবি।

এই পদ্ধতিতে একটি আসন নারীদের জন্য সংরক্ষিত ঘোষিত হলে একজন উপযুক্ত পুরুষ প্রার্থী ওই আসন থেকে নির্বাচন করতে পারবেন না। আবার উন্মুক্ত আসনের নির্বাচনে একজন নারী ঠিকই প্রার্থী হতে পারবেন। এর ফলে নারীর ক্ষমতায়নের নামে পুরুষের অধিকার খর্ব করা হচ্ছে।
বাংলাদেশে এখন রাষ্ট্র সংস্কারের সময় চলছে। এই সময়ে স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানগুলোর জনপ্রতিনিধি নির্বাচন পদ্ধতি সম্পর্কে একটু ভিন্নতর ধারণা দিতে চাই। বর্তমানে আমাদের স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানগুলোয় নারীর সংখ্যা ১৩ আসনের মধ্যে ৩। অর্থাৎ ২৩%, যা সিকি ভাগেরও কম। আমি মনে করি, এই হার সর্বদা কমপক্ষে এক-তৃতীয়াংশ রাখা হোক। প্রস্তাবিত কাঠামোতে স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানগুলোর নির্বাচনে প্রতিটি আসনে তিনজন প্রতিনিধি নির্বাচনের ব্যবস্থা রাখা যেতে পারে। নারী-পুরুষ নির্বিশেষে যিনি সর্বোচ্চ ভোট পাবেন, তিনি সোনালি সদস্য নামে চিহ্নিত হবেন।
অবশিষ্ট পুরুষ প্রার্থীদের মধ্যে সর্বোচ্চ ভোটপ্রাপ্ত পুরুষ ও নারী প্রার্থীদের মধ্যে সর্বোচ্চ ভোটপ্রাপ্ত নারী রুপালি সদস্য হিসেবে নির্বাচিত হবেন। প্রতিটি ওয়ার্ডে ৩ জন প্রার্থী নির্বাচিত হবেন, যার সবাই নারী বা পুরুষ হবেন না। কমপক্ষে একজন নারী বা একজন পুরুষ প্রতিনিধিত্ব করবেন। ইউনিয়ন পরিষদে বর্তমানের ৯টি ওয়ার্ডের পরিবর্তে ৫টি ওয়ার্ড করলে মোট নির্বাচিত সদস্য হবেন ১৫ জন, বর্তমান অবস্থার চেয়ে পরিষদের মোট সদস্য বৃদ্ধি পাবে মাত্র ২ জন। সরকার ইচ্ছা করলে ওয়ার্ড সংখ্যা ৬ বা ৭ করতে পারে কিংবা ৯-তেও বহাল রাখতে পারে। একইভাবে পৌরসভা ও সিটি করপোরেশনেও ওয়ার্ড সংখ্যা পুনর্বিন্যাস করা যেতে পারে।

মন্ত্রিপরিষদ শাসিত গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে পরিষদ সদস্যদের ভোটে চেয়ারম্যান/মেয়র নির্বাচিত হবেন। চেয়ারম্যান/মেয়র পদে কেবল সোনালি সদস্যগণই প্রার্থী হবেন। একজন করে রুপালি পুরুষ ও নারী সদস্য ভাইস চেয়ারম্যান/মেয়র হতে পারবেন। এক বছর অন্তর চেয়ারম্যান/মেয়র, ভাইস চেয়ারম্যান/মেয়র পদে ভোট গ্রহণ করা হবে। একজন ব্যক্তি পরপর দুই বছরের বেশি চেয়ারম্যান/মেয়র পদে থাকতে পারবেন না। এতে মেয়র বা চেয়ারম্যান বাকি সদস্যদের অবজ্ঞা করবেন না; স্বেচ্ছাচারী হওয়ারও সুযোগ থাকবে না। আইন দ্বারা সোনালি সদস্য, রুপালি পুরুষ সদস্য ও রুপালি নারী সদস্যদের কাজের দায়িত্ব নির্ধারণ করে দেওয়া থাকবে। এ পদ্ধতি কার্যকর হলে স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানগুলোয় নারীদের ন্যূনতম এক-তৃতীয়াংশ আসন নিশ্চিত থাকবে। কোনো কোনো পরিষদে সেই হার বেশিও হতে পারে, তবে তা কোনোভাবেই দুই-তৃতীয়াংশ অতিক্রম করবে না। এতে চেয়ারম্যান/মেয়রদের একক কর্তৃত্বের প্রবণতা হ্রাস পাবে। স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানগুলোয় গণতান্ত্রিক আবহ বিরাজ করবে; কমবে নারী ও পুরুষ জনপ্রতিনিধিদের মধ্যে বিরাজমান বৈষম্য।

আকম সাইফুল ইসলাম চৌধুরী: অবসরপ্রাপ্ত অতিরিক্ত সচিব

আরও পড়ুন

×