ঢাকা শনিবার, ২৫ জানুয়ারি ২০২৫

সমকালীন প্রসঙ্গ

বাংলাদেশে আমলাতন্ত্র সংস্কার: একটি রাজনৈতিক-অর্থনীতি বিশ্লেষণ

বাংলাদেশে আমলাতন্ত্র সংস্কার: একটি রাজনৈতিক-অর্থনীতি বিশ্লেষণ

পেশাদার ও দক্ষ আমলাতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করা দরকার

মোহাম্মদ মিজানুর রহমান

প্রকাশ: ২৯ নভেম্বর ২০২৪ | ০০:১০

সংকটের গোড়া: জন্মের সময়ই মৃত্যুঘন্টা বাজানো হয়েছিল 

১৯৭১ সালে বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর থেকে প্রশাসনিক সংস্কার নিয়ে বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে। সদ্য স্বাধীন দেশে প্রশাসন কাঠামোকে কার্যকর করা ছিল তৎকালীন সরকারের জন্য অত্যন্ত প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ। তাই স্বাধীনতার পরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন উপাচার্য প্রফেসর মুজাফফর আহমেদ চৌধুরীর নেতৃত্বে ১৯৭২ সালে Administrative Service Reorganization Committee (ASRC) গঠন করা হয়। এ কমিশনের মাধ্যমে বাংলাদেশে প্রশাসনিক পুনর্গঠন ও বিন্যাস কার্যক্রম শুরু হয়। বাংলাদেশ রাষ্ট্র পাকিস্তান থেকে পৃথক হয়ে স্বাধীনতা লাভ করে। পাকিস্তান রাষ্ট্র কাঠামো মোটা দাগে বাজার ব্যবস্থাকেন্দ্রিক অর্থনৈতিক মডেলে পরিচালিত ছিল। অর্থনীতিতে সরকারের ভূমিকা থাকলেও তা নিয়ন্ত্রিত ইকোনমি ছিল না। ফলে পাকিস্তান আমলে প্রশাসনিক কাঠামো সে আদলে গড়ে ওঠে। কিন্তু বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর ‘সমাজতন্ত্র’ নতুন দেশের অন্যতম প্রধান মূলনীতি হিসেবে সাংবিধানিকভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়। এর ফলে রাষ্ট্রের প্রকৃতি ও চরিত্র ব্যাপকভাবে পরিবর্তিত হয়; অন্তত বাহ্যিকভাবে। সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র কাঠামো প্রতিষ্ঠার প্রয়াস প্রশাসন ব্যবস্থার ধ্রুপদি মূল্যবোধ এবং ইতোপূর্বে পরিচিত কাঠামোর ওপর ব্যাপক প্রভাব ফেলে। পাকিস্তান আমলে সিভিল সার্ভিস মেধা-ভিত্তিক নিয়োগ পদ্ধতির মাধ্যমে পরিচালিত হতো। কিন্তু বাংলাদেশ রাষ্ট্রে সমাজতান্ত্রিক অঙ্গীকারকে গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে বিবেচনা করার সুপারিশ করা হয়। ফলে মেধা ভিত্তিক নিয়োগের প্রাতিষ্ঠানিক ও প্রায়োগিক ব্যবস্থা রাজনৈতিক পরিবেশ ও আকাঙ্খার অনুগত হয়। 


বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর প্রথম পরিকল্পনা কমিশন রাষ্ট্রের উন্নয়ন নীতি নির্ধারণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করার দায়িত্বপ্রাপ্ত হয়। পরিকল্পনা কমিশনের প্রধান চার জন সদস্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের শিক্ষক ছিলেন। যদিও পরবর্তীতে শাসক শ্রেণির সঙ্গে কমিশনের সদস্যদের দূরত্ব তৈরি হয় এবং ১৯৭৩-৭৪ সালের মধ্যে চারজন সদস্যই পরিকল্পনা কমিশন ত্যাগ করেন। কিন্তু প্রাথমিক পর্যায়ে নীতি-কাঠামোর ভিত্তি তৈরির ক্ষেত্রে পরিকল্পনা কমিশন ব্যাপকভাবে ক্ষমতায়িত ছিল। পরিকল্পনা কমিশনের সাথে জড়িত চার জন সদস্যের তিন জন তাদের অভিজ্ঞতা ও ভাবনা নিয়ে পরবর্তীতে বই লিখেছেন। এসব বই পর্যালোচনায় স্পষ্ট যে, সদস্য স্বাধীন বাংলাদেশের সমাজ মানস ও প্রশাসনিক কাঠামো সমাজতন্ত্রের জন্য প্রস্তুত ছিল না এবং রাজনৈতিক নেতৃত্বের মধ্যেও এ নিয়ে দ্বিধা ছিল। কিন্তু কমিশনের বেশ কিছু সদস্যের মধ্যে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার বিষয়ে জবরদস্তিমূলক দৃঢ়তা ছিল; ফলশ্রুতিতে শুরুতেই পরিকল্পনা কমিশনের সদস্যগণ প্রশাসনের সঙ্গে স্নায়ুবিক সংঘাতে জড়িয়ে যায়। কমিশনের সদস্যদের প্রশাসনিক কোন পূর্ব অভিজ্ঞতা না থাকলেও তাদেরকে উচ্চ মর্যাদা (মন্ত্রী ও প্রতিমন্ত্রী) দেয়া হয়। প্রশাসনের সঙ্গে দ্বন্দ্বের আরও একটি কারণ ছিল যে, পরিকল্পনা কমিশনের সদস্যগণের ধারণা ছিল, পাকিস্তান রাষ্ট্রের অধীনে কর্মরত আমলাতন্ত্র সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে যথেষ্ট সহযোগী নাও হতে পারে। এটি ঠিক যে, রাজনৈতিক নেতৃত্বের মতো প্রশাসনেও সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে যথেষ্ট সন্দেহ ছিল। যাহোক এরকম একটি আদর্শিক দ্বিধা-দ্বন্দের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশে প্রশাসন কাঠামোর ভিত্তি তৈরি হয়। 


পাকিস্তান আমলে আমলাতন্ত্রের নিয়োগ ও পদোন্নতি রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত থাকতে পারলেও বাংলাদেশের নতুন রাজনৈতিক বাস্তবতায় আমলাতন্ত্র রাজনৈতিক নেতৃত্বের অধীনে চলে যায় (জবাবদিহি অর্থে নয়, বরং নিয়ন্ত্রণ অর্থে), ফলে আমলাতন্ত্রের মধ্যে অনিশ্চয়তা তৈরি হয়। এরই মধ্যে ১৯৭৩ সালে সিভিল সার্ভিসে প্রথম নিয়োগ হয়, যা বেশ সমালোচিত হয়। স্বাধীনতার পরে নিয়োগের ক্ষেত্রে গুণগতমানকে খুব গুরুত্ব দেওয়া হয়নি বলে গবেষকরা অভিযোগ করেছেন।


ফলে নতুন রাষ্ট্রে আমলাতন্ত্র একটি দূর্বল প্রতিষ্ঠান হিসেবে আবির্ভূত হয়। অপরদিকে স্বাধীনতার পক্ষ-বিপক্ষ দ্বন্দ্ব সামরিক ও বেসামরিক উভয় প্রকার আমলাতন্ত্রকে নৈতিক ও মূল্যবোধগতভাবে দূর্বল করে। যারা আমলাতন্ত্রের বিরুদ্ধে ছিলেন তারা আপাতত খুশী ছিলেন যে, নতুন সরকার প্রশাসনকে রাজনৈতিক নেতৃত্বের নিয়ন্ত্রণে আনার চেষ্টা করছেন। কিন্তু তারা সহসা দেখতে পান কোনো নিয়ম-নীতি ছাড়া নিয়োগ-পদোন্নতির কার্যক্রম চলছিল। এমনকি যারা কোনো দিন কোনো প্রশাসনিক পদে আসীন ছিলেন না, তাদের অনেকে দেশ স্বাধীনের পরে উচ্চ প্রশাসনিক পদে আসীন হন। প্রশাসনে শুদ্ধি অভিযানের নামে মূলতঃ নিজেদের লোকজনকে নিয়োগ ও পদোন্নতি দেয়া হয়, ফলে এক বিশেষ ধরনের ‘স্পয়েল সিস্টেম’ প্রতিষ্ঠিত হয়। নিয়োগ-পদোন্নতিতে রাজনৈতিক বিবেচনার পাশাপাশি রাষ্ট্রপতির আদেশ জারি করা হয়, যা (রাষ্ট্রপতির আদেশ) পিও-৯ নামে পরিচিত ছিল। এর ফলে কোন কারণ দর্শানো ব্যতিরেকে যে কোন সরকারি কর্মচারিকে চাকুরিচ্যূত করা যেত। চাকুরিচ্যূত কর্মচারির আদালতের আশ্রয় লাভের কোন সুযোগ ছিল না। পিও-৯ বাস্তবিক অর্থে একটি পীড়নমূলক ব্যবস্থা ছিল যা আমলাতন্ত্রকে রাজনৈতিকভাবে অনুগত হতে বাধ্য করে। 


প্রথম পঞ্চ-বার্ষিক পরিকল্পনায় সমাজতান্ত্রিক রূপান্তরে আমলাতন্ত্রের ওপর আস্থা রাখা হয়নি। অর্থাৎ, জাতীয় উন্নয়ন প্রক্রিয়ায় আমলাতন্ত্রের ভূমিকা পূর্বের তূলনায় সংকুচিত করা হয় মর্মে প্রতীয়মান হয়। বরং এ পরিকল্পনায় সমাজতান্ত্রিক সমাজ প্রতিষ্ঠা করার জন্য জনগণের মধ্যে একটি বিশেষ ক্যাডার তৈরির ওপর গুরুত্বারোপ করা হয়। জনগণের বিশেষ ক্যাডার তৈরির জন্য রাজনৈতিক নেতৃত্বকে দায়িত্ব নেয়ার কথা বলা হয়। প্রথম পঞ্চ-বার্ষিক পরিকল্পনায় মেধা ও যোগ্যতা-ভিত্তিক প্রশাসনিক ব্যবস্থার কথা বলা হলেও আমলাতন্ত্র, বিশেষতঃ এর কৌশলগত গুরুত্ব সম্পর্কে  বিশদ আলোকপাত করা হয়নি। অপরদিকে সামগ্রিক প্রশাসনিক কাঠামোকে নিয়ন্ত্রিত অর্থনৈতিক মডেলে বিবেচনা করা হয়। ফলে এ অবস্থায় নৈর্ব্যক্তিক ও পেশাদার সিভিল সার্ভিস ব্যবস্থার গড়ে উঠার কোন সুযোগ ছিল না। বস্তুতপক্ষে, এ পরিকল্পনার মাধ্যমে একটি রাজনৈতিকভাবে অনুগত আমলাতন্ত্র বিকাশের সকল ক্ষেত্র প্রস্তুত করা হয়। ১৯৭৩ সালের সিভিল সার্ভিস নিয়োগ তার সাক্ষ্য বহন করে। 


দেশ স্বাধীনের পর সমাজতন্ত্র বিষয়ে যেহেতু বিভ্রান্তি দেখা দেয় সে সুযোগে রাজনৈতিকভাবে প্রভাবশালী কর্মকর্তাগণ প্রশাসন কাঠামোতে প্রভাব বিস্তারকারী হিসেবে আবির্ভূত হন। শীর্ষ রাজনৈতিক নেতৃত্বের সাথে আত্মীয়তার সুযোগে ভূতপূর্ব পূর্ব পাকিস্তান সিভিল সার্ভিসের শাখা কর্মকর্তা পর্যায়ের একজন কর্মকর্তা নিয়োগ-পদায়নে প্রশাসনের মূল ভূমিকা রাখেন। ফলে অনেক ক্ষেত্রে নীতি প্রতিপালন কঠিন হয়ে পড়ে। অপরদিকে মুজাফফর আহমেদ চৌধুরী কমিশন রিপোর্ট নবীন রাষ্ট্রের প্রেক্ষাপটে সিভিল সার্ভিসের প্রাতিষ্ঠানিক গুরুত্ব তুলে ধরলেও তাও সীমিত আকারে ছিল। সমসাময়িক দেশসমূহের উন্নয়নের পরিপ্রেক্ষিতে জাতীয় উন্নয়ন ও শাসন প্রক্রিয়ায় একটি পেশাদার সিভিল সার্ভিস কৌশলগতভাবে কেন গুরুত্বপূর্ণ তার বড় কোন যৌক্তিকতা কমিশনের প্রতিবেদনে প্রতিভাত হয়নি। একীভূত একটি প্রশাসনিক কাঠামোর সুপারিশ উক্ত কমিশনের একটি গুরুত্বপূর্ণ অবদান হলেও সিভিল সার্ভিসের মূল্যায়নে উক্ত কমিশনের মধ্যে অস্পষ্টতা ছিল। অপরদিকে সমাজতান্ত্রিক নীতি বাস্তবায়নে অঙ্গীকারাবদ্ধ হওয়ার জন্য আমলাতন্ত্রকে পরামর্শ দেয়া হয়েছিল। এর ফলে একটি বিভ্রান্তিকর অবস্থার তৈরি হয় যা সিভিল সার্ভিসকে পেশাগত অস্পষ্টার দিকে ধাবিত করে। পাশাপাশি টেকনিক্যাল সার্ভিসসমূহের অধিক গুরুত্ব তুলে ধরতে যেয়ে আমলাতন্ত্রের ইতোপূর্বে প্রতিষ্ঠিত কাঠামো বা সার্ভিসসমূহকে উপেক্ষা করা হয়। কমিশন প্রতিবেদনের বহু জায়গায় পাকিস্তান সিভিল সার্ভিসের যোগ্যতর অংশ তথা সিএসপিদেরকে বিদ্রুপ বা শ্লেষের ভঙ্গিতে বর্ণনা করেছে। কমিশন ভারতীয় সিভিল সার্ভিসের কার্যকারিতাও বিবেচনা নেয়নি। স্পষ্টতই কমিশন সিভিল সার্ভিসের প্রধান ধারা তথা প্রশাসনিক সার্ভিসকে উপেক্ষা করার নীতি গ্রহণ করে। 
উপরের আলোচনায় দেখা যাচ্ছে যে দ্বিধা-দ্বন্দ্ব ও অবিশ্বাসের রাজনৈতিক পরিবেশে স্বাধীন বাংলাদেশে আমলাতন্ত্র যাত্রা শুরু করে। শুরু থেকে আমলাতন্ত্রের নিয়োগ-পদোন্নতিতে নিয়ম-নীতি উপেক্ষা করার নীতি প্রতিষ্ঠা করা হয়। যেহেতু রাজনৈতিক বিবেচনার প্রভাব খুব শক্তিশালী ছিল তাই আমলাতন্ত্র শুদ্ধিকরণ নীতিরও শিকারে পরিণত হয়। 


কিন্তু সদ্য স্বাধীন ভারতে সম্পূর্ণ বিপরীত চিত্র দেখা যায়। ভারতীয় সিভিল সার্ভিসের (আইসিএস) সদস্যদের ভারতীয় জাতীয়তাবাদী নেতৃবৃন্দ স্পষ্টতই ভালো চোখে না দেখলেও দেশ স্বাধীনের পরে কনস্টিটিউন্ট অ্যাসেম্বেলিতে কার্যকর আমলাতন্ত্র প্রতিষ্ঠা নিয়ে ব্যাপক আলোচনা হয়। আইসিএসদেরকে ব্রিটিশ রাজের তল্পিবাহক হিসেবে অনেক নেতৃবৃন্দ মনে করলেও সর্দার বল্লভভাই প্যাটেল সম্পূর্ণ বিপরীত অবস্থান নেন। তিনি দৃঢ়ভাবে মনে করেন যে ভারতীয় অখন্ডতা রক্ষার জন্য একটি শক্তিশালী আমলাতন্ত্রের প্রয়োজন হবে। তিনি আমলাতন্ত্রকে স্টিল ফ্রেম অব ইন্ডিয়া হিসেবে অভিহিত করেন। প্যাটেল ১৯৪৯ সালের ১০ অক্টোবর কনস্টিটিউন্ট অ্যাসেম্বেলিতে আমলাতন্ত্র নিয়ে এক ঐতিহাসিক বক্তব্য দেন। তিনি শুধু আমলাতন্ত্রের পক্ষেই অবস্থান নেননি, তিনি স্পষ্ট করে বলেছেন আমলাতন্ত্রকে স্বাধীনভাবে কাজ করতে দিতে হবে। ভারতীয় নেতৃবৃন্দের সুচিন্তিত অবস্থানের কারণে ভারতে গণতন্ত্র যেমন স্থায়ী হয়েছে তেমনি আমলাতন্ত্র এখনো নাগরিকদের আশার স্থল হিসেবে টিকে আছে। ১৯৪৭ সালে দেশ স্বাধীনের পর ভারতীয় নেতৃত্বের বিচক্ষণ অংশ আইসিএসকে যেমন সফলভাবে ভারতীয়করণ করেছেন, তেমনি ইন্ডিয়ান অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ সার্ভিসের আওতায় একটি কার্যকর আমলাতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করেছেন। নানা চ্যালেঞ্জ ও সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও আইএএস এখনো সম্মান ও মর্যাদার সাথে দায়িত্ব পালন করছে। ভারতীয় নেতৃবৃন্দ জাতীয় উত্থানের উপাদান হিসেবে আমলাতন্ত্রকে বিবেচনা করেছেন। 


ভারতীয় সিভিল সার্ভিস ১৯৫১ সালে সাধারণ নির্বাচন অসাধারণ সাফল্যের সাথে সম্পন্ন করে। এর মধ্য দিয়ে আমলাতন্ত্র পেশাদারিত্ব, নৈতিকতা এবং রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত থাকার অঙ্গীকারকে সুদৃঢ় করে। ১৯৫১ সালের সাধারণ নির্বাচনের সময় ভারতের ৮৫% জনগণ নিরক্ষর ছিল। সদস্য স্বাধীন দেশে অবকাঠামোগত সুবিধাও তেমন ছিল না। তারপরেও ভারতীয় সিভিল সার্ভিস সুষ্ঠুভাবে নির্বাচন অনুষ্ঠান করতে সক্ষম হয়। ১৯৫১ সালের নির্বাচন ভারতীয় গণতন্ত্রের জন্য লিটমাস টেস্ট ছিল। ভারত সে পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয় এবং এর মাধ্যমে একটি দৃঢ় নির্বাচন ব্যবস্থাও প্রতিষ্ঠা লাভ করে। দেশ স্বাধীনের পর থেকে আইএএস-এর অবসরপ্রাপ্ত সদস্যগণ ভারতীয় নির্বাচন কমিশনের দায়িত্ব পালন করছেন। সরকারি ও বিরোধীদল উভয় পক্ষই ভারতীয় নির্বাচন কমিশনের গ্রহণযোগ্যতার স্বীকৃতি দিয়েছে। ভারতীয় নেতৃবৃন্দ একটি শক্তিশালী সিভিল সার্ভিস প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিল এবং তার ইতিবাচক ফল তারা পেয়েছেন। অপরদিকে বাংলাদেশ সরকার একটি রাজনৈতিকভাবে প্রভাবিত ও নতজানু আমলাতন্ত্র চেয়েছিলেন এবং ফলশ্রুতিতে ১৯৭৩ সালের প্রথম সাধারণ নির্বাচনের মাধ্যমে নির্বাচন ব্যবস্থায় জালিয়াতি ও কারচুপির গোড়াপত্তন হয়। 

 

কেন জনপ্রশাসন অধ্যয়নে রাজনীতি-অর্থনীতি কাঠামোর প্রয়োজন?
বাংলাদেশ সামরিক-আধাসামরিক-দূর্বল গণতান্ত্রিক-কর্তৃত্ববাদী বিভিন্ন শাসন ব্যবস্থার অভিজ্ঞতা লাভ করে। আমলাতন্ত্র বা বৃহৎ অর্থে জনপ্রশাসন এসব শাসন ব্যবস্থা দ্বারা ব্যাপকভাবে প্রভাবিত হয়। বিগত ৫০ বছরে জনপ্রশাসন সংস্কার বা বিন্যাসে অনেক কয়েকটি কমিটি ও কমিশন গঠন করা হয়। বেশ কিছু সংখ্যক কমিশন উন্নয়ন সহযোগীদের প্রত্যক্ষ ভূমিকায় গঠন করা হয়। অতীতের বিভিন্ন কমিশন বা কমিটির প্রতিবেদন পর্যালোচনায় প্রতীয়মান হয় যে বাংলাদেশে জনপ্রশাসন বিষয়ে যথাযথ অবহিত হয়ে সংস্কার বিবেচনা বা জনপ্রশাসন পর্যালোচনা করা হয়নি। জনপ্রশাসনকে রাষ্ট্র পরিচালনার একটি টেকনিক্যাল হাতিয়ার হিসেবে বিবেচনা করা হয়েছে মাত্র।
জনপ্রশাসনকে অধ্যয়ন করতে হলে একটি দেশের রাজনৈতিক বাস্তবতাকে অধ্যয়ন করা জরুরি। জনপ্রশাসন বা আমলাতন্ত্র কোন স্বাধীন চলক নয়। রাজনীতি এবং রাজনীতির মান জনপ্রশাসনের গুণগত মান নির্ধারণ করে থাকে। উপরের আলোচনায় স্পষ্ট যে ভারতীয় আমলাতন্ত্রের স্টিল ফ্রেম হচ্ছে একটি রাজনৈতিক অবস্থান।

 

বিশ্বায়নের কারণে জাতি রাষ্ট্র কোন স্বতন্ত্র প্রপঞ্চ নয়। আঞ্চলিক রাজনীতি-ভূ-রাজনৈতিক স্বার্থ-আন্তর্জাতিক নীতি কাঠামো ও উন্নয়ন অ্যাজেন্ডা ইত্যাদি দ্বারা জাতি রাষ্ট্রের স্বার্থ ও আকাঙ্খা নির্ধারিত বা প্রভাবিত হয়। ফলে আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক বাস্তবতাকে উপেক্ষা করে আমলাতন্ত্রকে বিবেচনা বা বিশ্লেষণ করা বর্তমানে প্রায় অসম্ভব। বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়ার একটি রাষ্ট্র। দক্ষিণ এশিয়া একটি প্রাণবন্ত ও বর্ধনশীল অঞ্চল। কিন্তু এটি একই সঙ্গে একটি সংঘাতপূর্ণ এলাকাও। আঞ্চলিক বাণিজ্যের পরিমান নির্দেশ করে যে এ অঞ্চলে যে ধরণের বাণিজ্যিক সহযোগিতা হওয়া উচিত ছিল বাস্তবতা তার থেকে ভিন্ন। এখানে আঞ্চলিক সহযোগিতার প্লাটফর্ম দীর্ঘ দিন ধরে অকার্যকর। অপরদিকে ইন্দো-প্যাসিফিক নিয়ে বৃহৎ শক্তিবর্গের প্রতিযোগিতা দক্ষিণ এশিয়ার দেশসমূহের আন্তঃদেশীয় সম্পর্কে প্রভাব ফেলছে। তাই পরিবর্তনশীল জাতীয়, আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে রাষ্ট্রকে যেমন অধ্যয়ন করতে হবে, তেমনি সে আলোকে আমলাতন্ত্রের ভূমিকার পুনর্বিন্যাস করতে হবে। পরিবর্তনশীল পরিস্থিতিতে আমলাতন্ত্র জাতীয় স্বার্থ রক্ষায় সক্ষম কী না সে আলোকে আমলাতন্ত্রকে বিবেচনা করতে হবে। 

 

প্রতিটি রাষ্ট্রে বাজার এখন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। সরকারি খাত নানা কারণে ক্রমেই সংকুচিত হচ্ছে। বেসরকারি খাত ঠিক তেমনি স্ফীত হচ্ছে। এর ফলে রাষ্ট্র ও বাজারের সম্পর্ক জটিল থেকে জটিলতর হচ্ছে। রাজনীতিতে ব্যক্তিখাতের ক্রমবর্ধনশীল প্রভাব জননীতির উপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। অনেক ক্ষেত্রে জননীতি বা রাষ্ট্র স্বার্থান্বেষী মহলের নিয়ন্ত্রনে চলে যাচ্ছে, যার নেতিবাচক অভিঘাত নাগরিকদের জন্য কখনো কখনো খুব মারাত্মক হচ্ছে। স্টেট ক্যাপচার বা পলিসি ক্যাপচার থেকে রাষ্ট্রকে রক্ষা করার ক্ষেত্রে আমলাতন্ত্র কি কোন ভূমিকা পালন করতে পারে? অথবা এ ধরনের ভূমিকার ক্ষেত্রে কেমন আমলাতন্ত্র প্রয়োজন? এসব প্রশ্নের উত্তরের সাথে রাজনৈতিক কাঠামো খুব ঘনিষ্ঠভাবে জড়িত। পাশাপাশি রাষ্ট্রে অ-রাষ্ট্রীয় অংশীজনও ক্রমে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে। জননীতিতে তাদের প্রভাব বিস্তৃত হচ্ছে। অ-রাষ্ট্রীয় অংশীজনের অনেকে পাশ্চাত্যের দেশসমূহের সাথে জৈবিকভাবে জড়িত এবং তাদের অনুদানের উপর নির্ভরশীল। তবে এদের নেতৃত্ব শিক্ষা ও পেশাগত দক্ষতায় উন্নত। ফলে সমাজে সরকার এবং রাজনৈতিক কাঠামোর বাইরে সমান্তরাল একটি এলিট বন্দোবস্ত তৈরি হচ্ছে- যা সবসময় জনকল্যাণকামী নাও হতে পারে। এ নতুন বাস্তবতায় বিভিন্ন ধর্মী অংশীজনের সাথে আমলাতন্ত্র কিভাবে জনস্বার্থ বা রাষ্ট্রীয় স্বার্থ রক্ষা করবে তা বিশ্লেষণে সমাজের সামাজিক-রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক বাস্তবতা বিবেচনা করা প্রয়োজন। 

 

একটি দুর্বল আমলাতন্ত্রের সঙ্গে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা বিশেষত নির্বাচন ব্যবস্থার সম্পর্ক বিশ্লেষণ করাও জরুরি। কোন রাজনৈতিক এলিট যদি নির্বাচনী ব্যবস্থায় একচেটিয়া প্রভাব কায়েম করতে চায় তাহলে আমলাতন্ত্রকে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে রাজনৈতিক আজ্ঞাবহ করার প্রচেষ্টা করবে। এ ধরনের প্রক্রিয়ার বৈধতা তৈরির জন্য সাধারণতঃ শাসক গোষ্ঠী একটি জনতুস্টবাদী বয়ান তৈরি করে যাতে শাসক শ্রেণির সাথে মূল্যবোধের সামঞ্জস্যপূর্ণ অপরাপর গোষ্ঠীর সংযোগ হয় এবং এর মাধ্যমে রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানসমূহের ওপর একচেটিয়া প্রভাব তৈরি হয়। অপরদিকে আমলাতন্ত্রের শীর্ষ পর্যায়ে একবার রাজনৈতিক আজ্ঞাবহ নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠা করতে পারলে পরবর্তীতে স্বয়ংক্রিয়ভাবে রাজনৈতিক প্রভাব বা একচেটিয়াত্ব টেকসই হয়। এ সময় আমলাতন্ত্র শাসক শ্রেণির সাথে যুথবদ্ধ অপরাপর গোষ্ঠীর সাথে একতাবদ্ধ হওয়ার চেষ্টা করে। ফলশ্রুতিতে জাতীয় উন্নয়ন নীতি ও সরকারি প্রতিষ্ঠানের উপর শাসক গোষ্ঠীর জবরদস্তি মালিকানা নিশ্চিত হয়, যা প্রকারান্তরে স্টেট ক্যাপচার নিশ্চিত করে। বাংলাদেশের বিগত কয়েকটি সাধারণ নির্বাচন পর্যালোচনা করলে এটি স্পষ্ট হয় যে, রাজনৈতিক এলিট শ্রেণি অত্যন্ত পরিকল্পিতভাবে আমলাতন্ত্রকে রাজনৈতিক লক্ষ্য হাসিলের স্বার্থে ব্যবহার করেছে। কোন আমলাতন্ত্র যখন রাজনৈতিকভাবে ব্যবহৃত হয় তখন তার পক্ষে প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতা ধরে রাখা সম্ভবপর হয় না। ফলে উন্নয়ন নীতি এবং ভূ-রাজনৈতিক বিষয়ে আজ্ঞাবহ হওয়ার কোন বিকল্প থাকে না। দীর্ঘ মেয়াদে জনগণের কাছে এ ধরনের আমলাতন্ত্র গ্রহণযোগ্যতা হারায়। অপরদিকে রাষ্ট্রীয় সক্ষমতা নষ্ট হয়।    

 

বাংলাদেশে আমলাতন্ত্র অধ্যয়নে বা সংস্কারে আমলাতন্ত্রের যে ভূমিকা সবসময় উপেক্ষিত থাকছে
পূর্বেই উল্লেখ করা হয়েছে যে বাংলাদেশে আমলাতন্ত্রকে সংকীর্ণভাবে দেখা হয়েছে। সরকারের সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের একটি হাতিয়ার হিসেবে বিবেচনা করা হয়েছে। উন্নয়ন নীতি, জাতীয় সক্ষমতা, আন্তঃরাষ্ট্রীয় সম্পর্ক নির্ধারণ, গণতান্ত্রিক উন্নয়ন, অ-রাষ্ট্রীয় ও বিজনেস এলিটদের সাথে সমন্বয়ের পরিপ্রেক্ষিতে বিবেচনা করা হয়নি। বিভিন্ন সরকারি দপ্তবে বা মাঠ প্রশাসনে সেবা প্রদানের দৃষ্টিভঙ্গিতে সকলে সাধারণভাবে জনপ্রশাসনকে বিবেচনা করতে বেশি স্বাচ্ছন্দবোধ করে। এর অন্যতম একটি কারণ হচ্ছে আমলাতন্ত্রের সদস্যগণসহ রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ ও অপরাপর অংশীজন একটি পেশাদার এবং বিশ্বস্ত আমলাতন্ত্রের মূল্য বুঝার ক্ষেত্রে যথেষ্ট ওয়াকিবহাল নন। সেবা প্রদান আমলাতন্ত্র বা সরকারি কর্মচারিদের একটি গুরুত্বপূর্ণ কর্তব্য। তবে আরো গুরুত্বপূর্ণ হলো কৌশলগত বিষয়ে এবং জননীতিতে বিশেষজ্ঞের ভূমিকা পালন করা। বাংলাদেশের অ-রাষ্ট্রীয় অংশীজন স্বার্থগত কারণে আমলাতন্ত্রকে জবাবদিহিতায় আনতে চায়। তবে আমলাতন্ত্রের কৌশলগত ভূমিকাকে অবদমিত করে শুধু সেবা প্রদানের ক্ষেত্রে সীমাবদ্ধ রাখতে চায়। এর একটি মৌলিক উদ্দেশ্য হল অ-রাষ্ট্রীয় অংশীজন (এলিট সিভিল সোসাইটি) শাসক শ্রেণির সাথে রাজনৈতিক সমঝোতার ভিত্তিতে সরকারি প্রশাসন কাঠামো ও নীতি অবকাঠামোকে প্রভাবিত করতে চায় এবং ক্ষেত্র বিশেষে তারা ব্যাপকভাবে সফল হয়েছে। এসব ক্ষেত্রে এলিট সিভিল সোসাইটি উন্নয়ন সহযোগী এবং তাদের সহযোগী গণমাধ্যমের সহায়তা পেয়ে থাকে। তাই বাংলাদেশে আমলাতন্ত্র নিয়ে নেতিবাচক বয়ান তৈরি হয়েছে, কিন্তু পেশাদার আমলাতন্ত্রের গুরুত্ব নিয়ে কোন বিশ্লেষণাত্মক আলোচনা দেখা যায় না। যেহেতু বাংলাদেশে যথাযথ নির্বাচন হয় না এবং নির্বাচন প্রক্রিয়াকে মোটামুটি ঠিক রাখার জন্য ক্রান্তিকালীন সরকার প্রতিষ্ঠা করতে হয়, তাই এলিট সিভিল সোসাইটি এসব সরকারকে নিয়ন্ত্রণ করার জন্য আমলাতন্ত্রের বিরুদ্ধাচারণকে নিজেদের অভ্যন্তরীণ অ্যাজেন্ডা হিসেবে তৈরি করেছে। একটি বিষয় লক্ষ্যণীয় যে বাংলাদেশের এলিট সিভিল সোসাইটি, যা পাশ্চাত্যের শক্তিধর রাষ্ট্রসমূহের কর্মসূচি বাস্তবায়নে অঙ্গীকারাবদ্ধ, অন্যান্য দেশের স্বভাবজাত সিভিল সোসাইটির মতো ওয়াচডগ না হয়ে এস্টাবলিশমেন্টের অংশ হওয়ার সুযোগের অপেক্ষায় থাকে। 

 

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর সময়ে বৈশ্বিক দক্ষিণের বেশ কিছু নতুন দেশ অর্থনৈতিক উন্নয়নের সম্ভাবনা তৈরি করে এবং এসব দেশের অনেকে ব্যাপকভাবে সফল হয়। এ পরিপ্রেক্ষিতে আমলাতন্ত্র গবেষকদের নিকট আগ্রহের বিষয়ে পরিণত হয়। ইতোমধ্যে অর্থনৈতিক উন্নয়নে প্রতিষ্ঠানের ভূমিকা নিয়ে অর্থনীতিবিদগণ গবেষণা শুরু করেন। জাপান দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হয়, কিন্তু দ্রুততম সময়ে অর্থনীতি পুনরুদ্ধার করতে সক্ষম হয়। জাপানের অর্থনৈতিক অগ্রগতি নিয়ে মার্কিন রাষ্ট্র বিজ্ঞানী চালমার জনসন ১৯৮২ সালে MITI and the Japanese Miracle (Johnson, 1982) নামে একটি সাড়া জাগানো বই লিখেন। ১৯২৫-১৯৭৫ সাল পর্যন্ত ৫০ বছরে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ও উন্নয়ন নীতি নিয়ে তিনি আলোচনা করেন। তিনি উপসংহার টানেন যে অন্যান্য শর্তের সাথে জাপানি আমলাতন্ত্র উন্নয়ন প্রক্রিয়ায় ব্যাপক ভূমিকা পালন করে। তিনি উন্নয়ন যাত্রায় আমলাতন্ত্রের ভূমিকাকে গৌরবোজ্জ্বল করার জন্য জাপানি আমলাতন্ত্রকে ‘অর্থনৈতিক আমলাতন্ত্র’ হিসেবে বিশ্লেষণ করেন। 


জাপানের অগ্রগতিকে সূত্র ধরে পরবর্তীতে আরো বেশ কিছু দেশ যারা এশিয়ার বাঘ হিসেবে পরিচিতি লাভ করে অর্থনৈতিক অগ্রগতি অর্জন করে। এর মধ্যে দক্ষিণ কোরিয়া, হংকং, সিঙ্গাপুর, তাইওয়ান উল্লেখযোগ্য। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার এসব দেশকে ডেভলপমেন্টাল স্টেট হিসেবে উল্লেখ করা হয়। এসব দেশে মূলত বাজার নয় বরং সরকার প্রধান ভূমিকা পালন করে, যা আমলাতন্ত্রের মাধ্যমে সম্পাদিত হয়। বিশ্বব্যাংক এসব দেশের উন্নয়নকে স্বীকৃতি দিতে গিয়ে ১৯৯৩ সালে The East Asian Miracle (WB, 1993) নামে একটি বই প্রকাশ করে যেখানে এসব দেশের উন্নয়ন আখ্যানের ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ করা হয়। অনেক খ্যাতিসম্পন্ন অর্থনীতিবিদ ও রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ডেভলপমেন্টাল স্টেট এর উপর গবেষণা করেন। তাদের বিশ্লেষণে রাজনীতি-নিরপেক্ষ কিন্তু অর্থনৈতিক নীতি-পদ্ধতি বিষয়ে দক্ষ আমলাতন্ত্র এসব দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে প্রধান ভূমিকা পালন করেছে। এশিয়ান বাঘ বলে পরিচিত এসব দেশ পরবর্তীতে শক্তিশালী গণতান্ত্রিক দেশ হিসেবে রুপান্তরিত হয়। এমনকি দ্বিতীয় প্রজন্মের ডেভলপমেন্টাল স্টেট হিসেবে মালয়েশিয়া ও ইন্দোনেশিয়া উন্নয়ন ও গণতন্ত্রকে সমানভাবে এগিয়ে নিচ্ছে। Evans & Rauch (1999) ৩৫টি দেশের ১৯৭০-১৯৯০ পর্যন্ত অর্থনৈতিক উন্নয়ন পর্যালোচনা করে অর্থনৈতিক উন্নয়নে দক্ষ আমলাতন্ত্রের উপর গুরুত্বারোপ করেছেন। ২০১৮ সালে McKinsey & Company ৭১টি উদীয়মান দেশের ৫০ বছরের অর্থনৈতিক উন্নয়ন পর্যালোচনা করেছে। তাদের মতে যে ১৮ টি দেশ দীর্ঘ মেয়াদি অগ্রগতি লাভ করেছে সেখানে আমলাতন্ত্র ভালো ভূমিকা রেখেছে। একইভাবে Besley, Burgess, Khan, and Xu (২০২২) পেশাদার আমলাতন্ত্রের সাথে উন্নয়নের ইতিবাচক যোগসূত্র পেয়েছেন। 

 

ইতোপূর্বে আলোচনা করা হয়েছে যে আধুনিক রাষ্ট্র নানা রকম জাতীয়, আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক সমীকরণ ও পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে পরিচালিত হতে হয়। এরকম অবস্থায় রাষ্ট্রের সার্বিক সক্ষমতা ও নীতি সক্ষমতা উভয়ই দক্ষ আমলাতন্ত্রের উপর নির্ভর করে। আমলাতন্ত্রের মাধ্যমে মুলতঃ রাষ্ট্র তার শক্তি বা সক্ষমতার প্রকাশ ঘটায়। দূর্বল আমলাতন্ত্র বস্তুতঃপক্ষে নীতি নেতৃত্ব উন্নয়ন সহযোগী ও তাদের পরামর্শকদের উপর ন্যস্ত করে থাকে। এ বিষয়ে Rahman (2011, 2018, 2024) এবং Rahman & Quadir (2018) বিস্তারিত আলোচনা করেছে। প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতা তৈরির জন্য OECD-ভূক্ত দেশসমূহ নিয়মিত আমলাতন্ত্র নিয়ে গবেষণা ও সংস্কার কার্যক্রম পরিচালনা করে থাকে । এসব দেশে সিনিয়র সিভিল সার্ভিস বা এক্সিকিউটিভ সার্ভিস নামে আলাদা সার্ভিস তৈরি করা হয়েছে যাতে সরকার কার্যকর নীতি সহায়তা পেতে পারে। সিঙ্গাপুরের উন্নয়নে আমলাতন্ত্রের ভূমিকা ব্যাপকভাবে স্বীকৃত। এজন্য আমলাতন্ত্রকে ভার্চুয়াস সাইকেল হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে। জাতিসংঘ টেকসই উন্নয়ন অভীষ্ট অর্জনে দক্ষ ও পেশাদার আমলাতন্ত্রের উপর গুরুত্বারোপ করেছে।   

 

ডেভলপমেন্টাল স্টেটস এবং ওইসিডি-দেশসমূহের অভিজ্ঞতায় দেখা যায় যে আমলাতন্ত্রকে রাষ্ট্রীয় ও নীতি সক্ষমতার আলোকে বিবেচনা করা হয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশের ক্ষেত্রে এ বিবেচনাটি একদমই ক্ষীণ; সার্ভিস ডেলিভারি এবং জেলা প্রশাসনের কার্যপরিধির লেন্সে আমলাতন্ত্রকে বিবেচনা করা হয়। রাজনীতি-নিরপেক্ষতা ও পেশাদারিত্ব উন্নত দেশসমূহের সিভিল সার্ভিসের মূল বৈশিষ্ট্য, কিন্তু রাজনীতিকরণ বাংলাদেশের আমলাতন্ত্রের প্রধান নিয়ামক হয়ে উঠেছে। ফলে সিভিল সার্ভিস রাষ্ট্রের জন্য কোন কার্যকর উপাদান হিসেবে বিবেচিত হতে পারছে না এবং জনমানসে সিভিল সার্ভিসের প্রভাব এবং মর্যাদা হ্রাস পাচ্ছে। একটি ভালো সিভিল সার্ভিস শুধু উন্নয়নের প্রধান চলক নয়, বরং অনেক ক্ষেত্রে একটি রাষ্ট্রের কোমল শক্তিও বটে। উন্নয়নশীল দেশসমূহের মধ্যে ভারতীয় আমলাতন্ত্র অন্যান্য দেশ বা অংশীজনের নিকট হতে বেশ সম্মান পায়। কিন্তু বাংলাদেশের আমলাতন্ত্র সে অর্থে খুব বেশি মর্যাদা পায় না। এর প্রধান কারণ হলো অভ্যন্তরীণভাবে বাংলাদেশের আমলাতন্ত্র মর্যাদা হারিয়ে ফেলেছে। রাজনীতিবিদগণ আমলাতন্ত্রের মর্যাদা বৃদ্ধিকে গুরুত্বপূর্ণ মনে করেননি। বরং অনুগত করাকে প্রধান দায়িত্ব মনে করেছেন। ফলে আমলাতন্ত্রের অবনমনের মাধ্যমে প্রকৃত প্রস্তাবে জাতীয় সক্ষমতার অবনমন করা হয়েছে।  

 

আগামীর সংস্কার : যেসব বিষয় প্রাধান্য পাওয়া জরুরি
২০২৪ সালের আগস্ট মাসের পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ একটি ক্রান্তিকাল অতিক্রম করছে। উন্নয়ন, শাসন ব্যবস্থা ও শাসনতন্ত্র ইত্যাদি বহুবিধ ক্ষেত্রে সরকার বিভিন্ন কমিশন গঠন করেছে। আশা করা হচ্ছে এসব কমিশনের সুপারিশসমূহ বাস্তবায়নের মাধ্যমে বাংলাদেশ মানবাধিকার সংবেদনশীল গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র হিসেবে গড়ে উঠবে। জনপ্রশাসন সংস্কার সরকারের অন্যতম প্রধান অগ্রাধিকার। তাই এজন্যও একটি কমিশন গঠন করা হয়েছে। অতীতের অভিজ্ঞতায় বলা যায় যদি যথাযথভাবে অবহিত  না হয়ে সুপারিশ করা হয় তাহলে কমিশনের সুপারিশ আত্মঘাতি হতে পারে। এমতাবস্থায়, নিম্নে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় উপস্থাপন করা হলো যা একটি পেশাদার ও দক্ষ সিভিল সার্ভিস বা আমলাতন্ত্র গঠনে সহায়তা করতে পারে এবং সার্বিকভাবে জনপ্রশাসনকে উন্নত করবে। 

 

কাঠামো ও তত্ত্বগত বিষয়

বাংলাদেশের ভূ-রাজনৈতিক অবস্থানের আলোকে আমলাতন্ত্রের গুরুত্ব উপলব্ধি করা এবং পেশাদার ও দক্ষ আমলাতন্ত্র প্রতিষ্ঠাকে রাজনৈতিক অ্যাজেন্ডা বানানো
বাংলাদেশের ভূ-অবস্থান একটি সংবেদনশীল অঞ্চলে। পূর্বে বলা হয়েছে দক্ষিণ এশিয়া একটি জটিল অঞ্চল। এখানে সম্ভাবনা ও সংঘাত একই সমতলে চলমান। তাই বাংলাদেশের আমলাতন্ত্রকে শুধু একটি প্রশাসনিক প্রপঞ্চ হিসেবে নয় বরং রাষ্ট্রের সামগ্রিক সক্ষমতা, মর্যাদা, স্বার্থ সমুন্নত করতে পারে এমন প্রতিষ্ঠান হিসেবে বিবেচনা করতে হবে। ফলে নীতি নির্ধারনী মহলকে আমলাতন্ত্রের এই সম্প্রসারণশীল ভূমিকা ও অবস্থানকে আন্তরিকভাবে গ্রহণ করতে হবে এবং সে আলোকে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। সর্দার বল্লভভাই প্যাটেল যেমন ১৯৪৯ সালে ভারতীয় আমলাতন্ত্রকে রক্ষা করেছিলেন, বাংলাদেশে তেমন নেতৃত্ব আজ প্রয়োজন যিনি আমলাতন্ত্রের গুরুত্ব বুঝতে সক্ষম। বিশ্ব যেভাবে বিবর্তিত হচ্ছে তাতে আমলাতন্ত্রকে স্ট্রেটেজিক এসেট ও সফট পাওয়ার হিসেবে গড়ে তুলতে হবে। জেলা প্রশাসনের বা মাঠ প্রশাসনের সার্ভিস ডেলিভারির সীমিত দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে আমলাতন্ত্রকে বিবেচনা করার সময় শেষ হয়েছে। জাতীয় সার্বভৌমত্ব রক্ষার সাথে একটি দক্ষ ও পেশাদার আমলাতন্ত্র ঘনিষ্ঠভাবে জড়িত। আমলাতন্ত্রের নৈতিক ও জ্ঞানগত মানকে এমন পর্যায়ে নিতে হবে যাতে সকল অংশীজন সম্মান ও শ্রদ্ধার সাথে সরকারি কর্মচারিদের সাথে মিথস্ক্রিয়া করে। এ ধরণের আমলাতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে হলে রাজনৈতিক অঙ্গীকার প্রয়োজন। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো এটি রাজনৈতিক অ্যাজেন্ডা বানাতে হবে। দক্ষিণ কোরিয়া, তাইওয়ান, জাপান, সিঙ্গাপুর এবং হালের রুয়ান্ডা ইত্যাদি দেশে পেশাদার আমলাতন্ত্র একটি রাজনৈতিক অঙ্গীকার।  

 

নীতি নেতৃত্ব  পুনরুদ্ধার করা এবং রাষ্ট্রীয় সক্ষমতা দৃঢ় করা  
বাংলাদেশের নীতি নেতৃত্বের মালিকানা দীর্ঘ দিন ধরে উন্নয়ন সহযোগী ও পরামর্শকদের হাতে গিয়েছে। নৈতিক ও পেশাগতভাবে আমলাতন্ত্রকে এমন পর্যায়ে নিতে হবে যাতে নীতি নেতৃত্ব পুনরুদ্ধারে সক্ষম হয়। নীতি নেতৃত্ব পুনরুদ্ধার হলে রাষ্ট্রীয় সক্ষমতা বৃদ্ধি পাবে। নীতি নেতৃত্ব পুনরুদ্ধার এবং জাতীয় সক্ষমতা বৃদ্ধির অন্যতম শর্ত হবে আমলাতন্ত্রকে নৈতিকতা ও জবাবদিহিতার আওতায় স্বাধীনভাবে কাজ করার সুযোগ দেয়া। নীতি নেতৃত্বের জন্য প্রশাসন ও পররাষ্ট্র সার্ভিসের নিয়োগ পদ্ধতিকে আরো প্রতিযোগিতামূলক ও দক্ষতামূলক করতে হবে। বর্তমান পদ্ধতির বাইরে এসে অধিকতর বিশ্লেষণাত্মক করতে হবে। উন্নত দেশ ও প্রতিষ্ঠানসমূহের নিয়োগ পদ্ধতি প্রয়োজেন বিবেচনা করা যেতে পারে। আমলাতন্ত্রে যোগ্য কর্মকর্তা নিয়োগ না পেলে কখনই নীতি নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব হবে না। কোন রাষ্ট্র যদি উন্নয়ন নীতি প্রণয়নে স্বাধীন না হয় তাহলে প্রকৃত সার্বভৌমত্ব প্রশ্নের সন্মুখীন হতে বাধ্য। 

 

সরকারি চাকুরিজীবীদেরকে আইনগতভাবে দলীয় রাজনীতিমুক্ত ও মেধাভিত্তিক করা
সরকারি চাকুরিকে শক্তভাবে দলীয় রাজনীতিমুক্ত করতে হবে এবং দৃঢ়ভাবে শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা করতে হবে। আমলাতন্ত্র এবং সামগ্রিকভাবে জনপ্রশাসনকে পেশাদার করতে হলে নৈতিকতার সংস্কৃতিকে কর্মক্ষেত্রে দৃঢ় করতে হবে। তাই নিয়োগ, বদলি ও পদোন্নতিতে স্বচ্ছতা ও মেধাকে নিশ্চিত করতে হবে এবং সুরক্ষা দিতে হবে। প্রয়োজনে স্বাধীন মেরিট প্রটেকশন কমিশনার নিয়োগ দিতে হবে। পদোন্নতির প্রক্রিয়াকে সম্পূর্ণভাবে উন্মুক্ত করতে হবে। কেউ পদোন্নতি না পেলে কী কারণে পদোন্নতি হয়নি তা জানাতে হবে এবং পরবর্তী পদোন্নতির শর্তও জানাতে হবে। নিয়োগ-পদোন্নতি রাজনীতিমুক্ত হলে প্রশাসনিক অনেক সংকট এমনিতেই কেটে যাবে। এ লক্ষ্যে সিভিল সার্ভিস আইনকে যুগোপযোগী করতে হবে।

নৈতিকতাকে সিভিল সার্ভিসের গুরুত্বপূর্ণ শর্ত করা
বাংলাদেশের আমলাতন্ত্রে নৈতিকতার প্রভাব খুব কম। তাই আইনগতভাবে নৈতিকতাকে শক্তিশালীভাবে আমলাতন্ত্রের কাঠামোতে নিতে হবে। এ জন্য একটি শক্ত ‘স্বার্থের সংঘাত’ আইন করতে হবে। ব্যক্তিগত স্বার্থ, অভিলাষ যাতে সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়াকে প্রভাবিত না করে তা দৃঢ়ভাবে নিশ্চিত করতে হবে। বেতনের বাইরে কোন সম্মানী গ্রহণকে চাকুরিরত সিভিল সার্ভেন্টদের জন্য নিষিদ্ধ করতে হবে। জুনিয়র সহকর্মীর মত প্রকাশের স্বাধীনতাকে নিশ্চিত করতে হবে এবং সিদ্ধান্ত গ্রহণে সিনিয়রদের স্বেচ্ছাচারি (আর্বিটারি) ক্ষমতাকে সীমিত করতে হবে। 

প্রায়োগিক বিষয়
(১) আমলাতন্ত্রসহ সামগ্রিকভাবে জনপ্রশাসনে দক্ষতা বৃদ্ধির জন্য বিনিয়োগ বাড়াতে হবে। বেতন এমন পর্যায়ে দিতে হবে যাতে মেধাবীরা সরকারি চাকুরিতে আকৃষ্ট হয় এবং সম্মানিত বোধ করে। বেতনের বাইরে অন্য সকল আর্থিক সুবিধাকে নিষিদ্ধ করতে হবে। সরকারি ও অটোনোমাস সকল প্রতিষ্ঠানে একই বেতন স্কেল দিতে হবে। 

(২) স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা দৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠা করতে হবে। এ জন্য প্রয়োজনে একটি বাস্তবসম্মত কাঠামো তৈরি করে তার প্রয়োগ নিশ্চিত করতে হবে। সিঙ্গাপুর মডেলকে বিবেচনা করা যেতে পারে। উচ্চ পর্যায়ের সকলকে সম্পদ বিবরণী দাখিল করতে হবে। সরকারি চাকুরি হতে অবসরের পর কর্মকর্তা পর্যায়ের ব্যক্তিগণকে (৯ম গ্রেড এবং তদুর্ধ্ব) অন্ততঃ পাঁচ বছর উন্নয়ন সহযোগীর কনসালটেন্ট হওয়া নিষিদ্ধ করতে হবে।  

(৩) সিভিল সার্ভিসের পেশাগত সার্ভিসসমূহের কর্মকর্তাদেরকে নিজ নিজ পেশায় দক্ষ ও বিশেষজ্ঞ হিসেবে গড়ে উঠার সুযোগ দিতে হবে। প্রকৌশলী, শিক্ষক, কৃষিবিদ, চিকিৎসক যাতে প্রকৃত অর্থে যোগ্য হয় সেজন্য পদ মর্যাদা ও প্রশিক্ষণ ব্যবস্থাকে আরো উন্নত করতে হবে। 

(৪) স্বচ্ছভাবে সেবা দেয়া নিশ্চিত করার জন্য প্রচলিত বিধি-বিধান পরীক্ষা করে আপডেট করার ব্যবস্থা করতে হবে। সকল অধিদপ্তরের জনবল ও কাজ পর্যালোচনা করে আপডেট করতে হবে। 

(৫) বর্তমান ক্যাডার সংখ্যা নতুন করে পরীক্ষা করে পুনর্বিন্যাস (সীমিত) করতে হবে। প্রয়োজনে দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য দেশের সিভিল সার্ভিস ব্যবস্থাকে বিবেচনা করা যেতে পারে।  

 

উপসংহার:
বৈশ্বিক অভিজ্ঞতা আমাদেরকে এ শিক্ষা দেয় যে প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতা ছাড়া কোন রাষ্ট্র স্থিতিশীল ও উন্নয়নকামী হতে পারে না। বাংলাদেশ সময়ে সময়ে অস্থিতিশীলতার ঘূর্ণাবর্তে পড়ার অন্যতম কারণ হলো বাংলাদেশে যোগ্য রাজনৈতিক নেতৃত্ব ও আমলাতন্ত্র গড়ে না উঠা। জটিল বিশ্ব ব্যবস্থায় বাংলাদেশকে টিকে থাকতে হলে পেশাগতভাবে দক্ষ এবং নৈতিকভাবে উন্নত আমলাতন্ত্র প্রতিষ্ঠাকে অন্যতম প্রধান অগ্রাধিকার হিসেবে বিবেচনা করতে হবে। ভারত মাত্র তিনজন নির্বাচন কমিশনার (যারা সবসময় আইএএসের প্রাক্তন সদস্য) দ্বারা ১৫০ কোটির বেশি জনসংখ্যার একটি দেশে নির্বাচন পরিচালনা করে। কিন্তু মাত্র ১৮ কোটি মানুষের দেশে নির্বাচন পরিচালনার জন্য আমাদেরকে একটি পৃথক নির্বাচনী প্রশাসনিক কাঠামো তৈরি করতে হয়েছে যে জন্য রাষ্ট্রীয় কোষাগার হতে নিয়মিত ব্যয় বহন করতে হচ্ছে। এ অতিরিক্ত ব্যয় আমলাতন্ত্রের ব্যর্থতার জন্য। বাংলাদেশের নির্বাচন ব্যবস্থা ধ্বংসের প্রধান কারণ হলো রাজনীতিবিদদের নিকট আমলাতন্ত্রকে রাজনৈতিকভাবে নিয়ন্ত্রণ করার সুযোগ থাকা। তাই দেশে ভালো নির্বাচন ব্যবস্থা তৈরি, উন্নয়ন-প্রবৃদ্ধি এগিয়ে নেয়া, সুশাসন প্রতিষ্ঠা ইত্যাদি সকল ক্ষেত্রের জন্য উন্নত নৈতিকতা সম্পন্ন ও দক্ষ আমলাতন্ত্রের বিকল্প নেই। 

 

দক্ষিণ এশিয়ার ভূ-রাজনৈতিক বাস্তবতায় বাংলাদেশের এলিট সিভিল সোসাইটির ভূমিকা বিশ্লেষণ করলে প্রতীয়মান হয় যে তারা কোন দিন বাংলাদেশে পেশাদার আমলাতন্ত্র প্রতিষ্ঠাকে গুরুত্বপূর্ণ অ্যাজেন্ডা বানাতে দিবে না। তারা আমলাতন্ত্রের নেতিবাচক দিক সামনে এনে আমলাতন্ত্রের অধিক্ষেত্রকে সংকুচিত করার পরামর্শ দেয়। এসব এলিট এক দিক থেকে যেমন আমলাতন্ত্রের মূল্য সম্পর্কে খুব বেশি অবহিত নয়, তেমনি দক্ষ আমলাতন্ত্র তাদের জন্য চ্যালেঞ্জ হতে পারে সে কারণেও পেশাদার আমলাতন্ত্রের অ্যাজেন্ডাকে জনপ্রিয় করে না। তাই স্থানিকভাবে উত্থিত নাগরিক সমাজ, সাধারণ মানুষ, দায়িত্বশীল রাজনৈতিক দলসমূহকে পেশাদার আমলাতন্ত্র প্রতিষ্ঠার বিষয়টিকে রাজনৈতিক অ্যাজেন্ডায় প্রতিষ্ঠা করতে হবে। মনে রাখা দরকার দক্ষ ও সৃজনশীল আমলাতন্ত্র ছাড়া উন্নয়ন এগিয়ে নেয়া বা সংহত করা কোনটাই সম্ভব নয়। ডেভলপমেন্টাল স্টেট এর আমলাতন্ত্র বিশ্লেষণ করে বাংলাদেশের আমলাতন্ত্রকে পুনর্গঠন করার পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। 

ড. মোহাম্মদ মিজানুর রহমান: সহযোগী গবেষক (অনাবাসিক), ইন্সটিটিউট অব ডেভলপমেন্ট পলিসি, ইউনিভার্সিটি অব অনটার্প, বেলজিয়াম
mohammadmizanur.rahman@uantwerpen.be
 

আরও পড়ুন

×