মানবসম্পদ
যুগের চাহিদা মেটাতে প্রস্তুত হোক উচ্চশিক্ষা

এম. এম. শহিদুল হাসান
এম এম শহিদুল হাসান
প্রকাশ: ১২ ডিসেম্বর ২০২৪ | ০৪:৪৬
গত তিন শতকে উচ্চশিক্ষার বিবর্তন বিভিন্ন দার্শনিকের চিন্তাধারা দ্বারা পরিচালিত হয়েছে, যেখানে তারা ভিন্ন ভিন্ন লক্ষ্য অর্জনে অবদান রেখেছেন: যুক্তি চর্চার বিকাশ, ব্যক্তিগত উন্নয়ন, সমাজের অগ্রগতি এবং বাস্তব সমস্যার সমাধান।
আলোকিত যুগের যুক্তিবাদ ও শিল্প যুগের বাস্তববাদ যেমন শিক্ষা ব্যবস্থাকে রূপ দিয়েছে, তেমনি বিভিন্ন বিকল্প দর্শনের প্রভাবও একটি সমৃদ্ধ ও বৈচিত্র্যময় বৈশ্বিক ধারা তৈরি করেছে। বর্তমান চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের যুগে, যেখানে দ্রুত প্রযুক্তিগত উন্নয়ন এবং গভীর আন্তঃসংযুক্ত বিশ্ব বাস্তবতা, বাংলাদেশের উচ্চশিক্ষাকে পুনর্গঠনের জন্য এই দার্শনিক ধারণাগুলো জানা ও বোঝা গুরুত্বপূর্ণ।
যদিও দার্শনিকরা শিক্ষার আদর্শকে গভীরভাবে প্রভাবিত করেছেন। বিশ্বের দুই প্রাচীনতম বিশ্ববিদ্যালয়– আল-ক্বারাউইয়িন ও বলোনিয়া; এগুলো প্রতিষ্ঠার সময় সরাসরি দার্শনিক কাঠামোর ওপর নির্ভর করেনি। ৮৫৯ সালে মরক্কোতে প্রতিষ্ঠিত আল-ক্বারাউইয়িন প্রথমে একটি মসজিদ হিসেবে যাত্রা শুরু করে এবং পরে ইসলামের স্বর্ণযুগে উচ্চশিক্ষার কেন্দ্র হিসেবে বিকশিত হয়। এটি আরব নারী ফাতিমা আল-ফিহরির দূরদর্শী চিন্তার প্রতিফলন, যিনি ইসলামী কাঠামোর মধ্যে বুদ্ধিবৃত্তিক ও শিক্ষাগত উন্নয়নকে উৎসাহিত করতে আত্মনিবেদিত ছিলেন। অন্যদিকে ১০৮৮ সালে ইতালিতে প্রতিষ্ঠিত বলোনিয়া বিশ্ববিদ্যালয় আইনের ওপর বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করত। এটি অ্যারিস্টটল, সিসেরোর মতো ক্লাসিক্যাল চিন্তাবিদ, রোমান আইনি ঐতিহ্য এবং মধ্যযুগীয় দর্শনের দ্বারা প্রভাবিত ছিল। এই বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষাকে সমাজের চাহিদা ও দার্শনিক প্রেক্ষাপটের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ একটি বাস্তববাদী দৃষ্টিভঙ্গি থেকে পরিচালিত করত।
আধুনিক যুগে রেনে দেকার্তের কার্টেসিয়ান দর্শন উচ্চশিক্ষায় গভীর প্রভাব ফেলেছিল– যেখানে তিনি যুক্তি, বিবেক এবং পদ্ধতিগত অনুসন্ধানের ওপর গুরুত্ব দিয়েছিলেন। দেকার্তের মনের (‘চিন্তাশীল পদার্থ’) এবং দেহের (‘ভৌত পদার্থ’) মধ্যে পার্থক্যের ধারণা যুক্তিবাদী শিক্ষার মডেলের ভিত্তি স্থাপন করেছিল। তাঁর বিখ্যাত উক্তি– ‘Cogito, ergo sum’ (‘আমি ভাবি, তাই আমি আছি’), বুদ্ধিবৃত্তিক যুক্তিকে ইন্দ্রিয়গত বা আবেগীয় অভিজ্ঞতার চেয়ে অগ্রাধিকার দিয়েছিল। এই দর্শন নির্দেশিত যুক্তি, বিশ্লেষণমূলক চিন্তা এবং একাডেমিক ক্ষেত্রে শাখাগত বিশেষায়নের ওপর জোর দেয়। যদিও এটি তৎকালে বিপ্লবাত্মক ছিল, এই কাঠামো বর্তমানে বৈশ্বিক, প্রযুক্তিচালিত বিশ্বের চাহিদা পূরণে সংগ্রাম করছে।
সময়ের প্রবাহে কার্টেসিয়ান আদর্শের সমালোচনার পাশাপাশি এর পরিপূরক হিসেবে বিকল্প দার্শনিক দৃষ্টিভঙ্গির উদ্ভব ঘটে। সতেরো শতকের শেষের দিকে জন লকের অভিজ্ঞতাবাদী দর্শন অভিজ্ঞতামূলক শিক্ষার ওপর জোর দেয়, যেখানে তিনি যুক্তি দিয়েছিলেন যে জ্ঞান অর্জিত হয় ইন্দ্রিয়গত অভিজ্ঞতা এবং পরিবেশের সঙ্গে পারস্পরিক ক্রিয়ার মাধ্যমে। লকের সাম থটস কনসার্নিং এডুকেশন (১৬৯৩) বইটি শিক্ষা ব্যক্তিগত প্রেক্ষাপট এবং সমাজের প্রয়োজন অনুযায়ী সাজানোর পক্ষে ছিল, যা বুদ্ধিবৃত্তিক ও ব্যবহারিক শিক্ষার মধ্যে সেতুবন্ধ তৈরি করে।
আঠারো শতকে জেরেমি বেনথামের উপযোগবাদী নীতি শিক্ষাকে সামাজিক কল্যাণ এবং ব্যবহারিক উপযোগিতার সঙ্গে সংযুক্ত করে, যার ফলস্বরূপ বৃত্তিমূলক ও পেশাগত প্রোগ্রামের উদ্ভব ঘটে। উনিশ শতকের গোড়ার দিকে উইলহেম ফন হামবোল্ট ‘বিল্ডাং’ ধারণাটি প্রবর্তন করেন, যা সমগ্র ব্যক্তিত্ব বিকাশে জোর দেয়– সমালোচনামূলক চিন্তা, সৃজনশীলতা এবং বুদ্ধিবৃত্তিক স্বাধীনতার মাধ্যমে। হামবোল্ট শিক্ষাদান এবং গবেষণার সমন্বয় করেন, যা প্রথম ১৮১০ সালে বার্লিন বিশ্ববিদ্যালয়ে বাস্তবায়িত হয়। এটি আধুনিক লিবারেল আর্টস এবং গবেষণা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিত্তি স্থাপন করে। তবে সমালোচকরা যুক্তি দেন, অভিজাত শিক্ষার জন্য বিকশিত হামবোল্টের নীতিগুলো ব্যাপক শিক্ষা ব্যবস্থায় কার্যকরভাবে প্রয়োগ করা কঠিন, যেখানে দক্ষতা, মানসম্পন্ন পাঠ্যক্রম এবং কর্মসংস্থানযোগ্যতাকে অগ্রাধিকার দেওয়া হয়। তদুপরি তাঁর দর্শনের তাত্ত্বিক জ্ঞানের প্রতি জোর প্রায়ই ব্যবহারিক, বৃত্তিমূলক বা বাজারকেন্দ্রিক দক্ষতাকে উপেক্ষা করে। ফলে স্নাতকরা আধুনিক শ্রমবাজারে কম প্রস্তুত থাকে।
শিল্প যুগে জন ডিউয়ের বাস্তববাদী দর্শন অভিজ্ঞতাভিত্তিক শিক্ষা এবং সমাজের অগ্রগতির সঙ্গে শিক্ষার সংযুক্তির ওপর জোর দেয়। বিশ্ববিদ্যালয়গুলো ক্রমবর্ধমানভাবে শিল্প ও প্রশাসনিক চাহিদার সঙ্গে মানিয়ে নিতে শুরু করে, ফলে শাখাগত বিশেষায়ন এবং স্ট্যান্ডার্ড পাঠ্যক্রম আরও দৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়।
শতাব্দীপ্রাচীন মডেলগুলো এখন চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের রূপান্তরমূলক চাহিদার সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলা সম্ভব নয়। কারণ দ্রুত প্রযুক্তিগত অগ্রগতি, স্বয়ংক্রিয়তা, সর্বদা বিকশিত চাকরির বাজার এবং বৈশ্বিক আন্তঃসংযুক্ততা উচ্চশিক্ষাকে সংস্কার করার প্রেক্ষাপট তৈরি করেছে, যাতে স্নাতকরা একটি অনিশ্চিত ভবিষ্যতের জন্য প্রস্তুত হতে পারে। যখন রুটিন কাজগুলো স্বয়ংক্রিয় হয়ে যাচ্ছে তখন জটিল এবং উদ্ভাবনচালিত পরিবেশে আবেগীয় বুদ্ধিমত্তা, সহানুভূতি, সৃজনশীলতা, সমালোচনামূলক চিন্তা, উদ্ভাবন, উদ্যোগ এবং অভিযোজনযোগ্যতার মতো মানবিক বৈশিষ্ট্যগুলো অপরিহার্য হয়ে উঠছে।
বর্তমানের বৈচিত্র্যময় ও বিভিন্নতার যুগে আবেগীয় বুদ্ধিমত্তা কার্যকর যোগাযোগ ও সহযোগিতার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। অন্যদিকে সমস্যা সমাধান, রেজিলেন্স বা স্থিতিস্থাপকতা এবং ক্রিয়েটিভিটি বা সৃজনশীলতার মতো অভিযোজনযোগ্য দক্ষতা প্রযুক্তিচালিত বিশ্বে সফল হতে অপরিহার্য। এই দক্ষতাগুলো জ্ঞানীয়, আবেগীয় এবং অভিজ্ঞতামূলক মাত্রার সঙ্গে গভীরভাবে সম্পর্কিত। ফলে এমন একটি শিক্ষা মডেলের প্রয়োজন, যা এই তিনটি দিককে একত্র করে।
ঐতিহ্যগতভাবে উচ্চশিক্ষাকে একটি একক প্রক্রিয়া হিসেবে দেখা হতো। যেখানে শিক্ষার্থীদের একক পেশার জন্য প্রস্তুত করা হতো, যা সাধারণত শিল্প বা ব্যুরোক্রেটিক ভূমিকার সঙ্গে সম্পর্কিত ছিল। তবে আজকাল পেশাগত জীবন আর একরৈখিক নয়; মানুষ প্রায়ই পেশা পরিবর্তন করে বা বিভিন্ন ভূমিকা একত্র করে (যেমন– আর্টিফিসিয়াল ইন্টেলিজেন্স স্বাস্থ্যসেবায় কাজ করা ইঞ্জিনিয়াররা বা উদ্যোক্তা হিসেবে কর্মরত চিকিৎসকরা)। পাশাপাশি পেশাগত চাহিদা দ্রুত পরিবর্তনশীল হওয়ায় নতুন প্রযুক্তি বা উদ্ভাবনের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে সক্ষম হওয়ার দক্ষতা অত্যাবশ্যক হয়ে উঠেছে। উদাহরণস্বরূপ, সফটওয়্যার ডেভেলপারদের এখন শুধু কোডিং নয়, প্রজেক্ট ম্যানেজমেন্ট বা ডেটা অ্যানালিটিকস সম্পর্কেও জানতে হয়।
এই পরিবর্তিত বাস্তবতা উচ্চশিক্ষাকে এমন একটি রূপ দিতে বলছে, যা বাঁধাধরা, একক মাপের মডেলের পরিবর্তে আরও গতিশীল, নমনীয় এবং শিক্ষার্থীকেন্দ্রিক। এর উদ্দেশ্য হলো শিক্ষার্থীদের অভিযোজনযোগ্যতা, আন্তঃবিষয়ক দক্ষতা এবং উদ্ভাবনী চিন্তাধারার বিকাশ ঘটানো, যাতে তারা চতুর্থ শিল্পবিপ্লব যুগের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় সফল হতে পারে।
বাংলাদেশ ধীরে ধীরে চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে, যেখানে আধুনিক প্রযুক্তি ধীরগতিতে হলেও শিল্প, সেবা এবং প্রশাসনের বিভিন্ন ক্ষেত্রে অন্তর্ভুক্ত হচ্ছে। এই গুরুত্বপূর্ণ সন্ধিক্ষণে উচ্চশিক্ষার রূপান্তর কেমন হবে তা এক মৌলিক প্রশ্ন হয়ে দাঁড়িয়েছে। যদিও শিক্ষা ব্যবস্থায় বড় ধরনের পরিবর্তন গ্রহণে দেশের শিক্ষক সমাজে ঐতিহাসিকভাবে অনীহা লক্ষ্য করা যায়, তবুও উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে একটি ভারসাম্যপূর্ণ দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণ করা প্রয়োজনীয়। আশা করা যায়, এ ধরনের পন্থা স্নাতকদের জন্য অভিযোজনযোগ্য দক্ষতা নিশ্চিত করবে; যা চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের চাহিদা মেটানোর পাশাপাশি স্থানীয় ও বৈশ্বিক শ্রমবাজারে টিকে থাকার ক্ষমতা দেবে। এই রূপান্তরের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় সমন্বিত ও কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণের সময় এখনই। বাংলাদেশ এর বাস্তবায়নের জন্য সক্রিয় প্রস্তুতির দিকে তাকিয়ে রয়েছে।
এম. এম. শহিদুল হাসান: প্রাক্তন উপাচার্য, ইস্ট ওয়েস্ট ইউনিভার্সিটি এবং অধ্যাপক (অব.), বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়
shahidul7371@gmail.com
- বিষয় :
- মানবসম্পদ