কয়েকদিন আগে ইএনটি আউটডোরে রোগী দেখছিলাম। এমন সময় ৪৫ বছরের এক ভদ্র মহিলা এসে রোগের ইতিহাস দিতে গিয়ে বললেন, সকালে ঘুম থেকে ওঠে ব্রাশ করতে গিয়ে আয়নায় দেখলেন মুখ একদিকে বাঁকা হয়ে গেছে, ডান চোখ বন্ধ হয় না, কুলি করতে গেলে অন্য পাশে চলে যায়। ডিসেম্বরের শীতের শুরুর আরেক দিন সকালে হঠাৎ পঞ্চম বর্ষের আমার এক ছাত্র ফোন দিয়ে জানাল, তার চাচির হঠাৎ মুখ বাঁকা হয়ে চোখ দিয়ে পানি পড়াসহ উপরোল্লিখিত রোগীর মতো সমস্যাগুলোর কথা। ইতিহাস শুনে মনে হলো, বেলস পালসি।

যদিও ফেসিয়াল প্যারালাইসিসের সঙ্গে শীতের কোনো সরাসরি সম্পর্ক নেই, কিন্তু এই রোগের একটি রিস্ক ফ্যাক্টর হলো, শ্বাসনালির ঠান্ডাজনিত ভাইরাল ইনফেকশন এবং ঠান্ডা লেগে কানের ইনফেকশন, যা এই শীতের সময় সচরাচর বেশি দেখা যায়। এই শীতের মৌসুমে ফেসিয়াল প্যারালাইসিসের ঝুঁকি উল্লেখযোগ্যভাবে বেড়ে যায়। এটি এমন একটি শারীরিক অবস্থা, যেখানে মুখের এক পাশের পেশিগুলো হঠাৎ অবশ হয়ে যায়। সপ্তম ক্রেনিয়াল নার্ভ যে কোনো কারণে আক্রান্ত হওয়ায় ফেসিয়াল মাসলের এক পাশে দুর্বল অথবা প্যারালাইসিস হয়ে যাওয়াকে ফেসিয়াল পালসি বলা হয়। আর যখন সুনির্দিষ্ট কোনো কারণ পাওয়া যায় না তখন একে বলা হয়, বেলস পালসি। এটি যে কোনো বয়সের নারী ও পুরুষ উভয়েরই হতে পারে। তবে পুরুষের তুলনায় নারীদের এই রোগটি বেশি দেখা যায়।

ফেসিয়াল পালসির কারণ
যদিও ফেসিয়াল প্যারালাইসিসের মূল কারণ অনিশ্চিত; তবে এটি ভাইরাল সংক্রমণের কারণে হতে পারে। যেমন হারপিস সিমপ্লেক্স, ইনফু্লয়েঞ্জাসহ বিভিন্ন রকম ভাইরাল ইনফেকশন, মধ্যকর্ণের প্রদাহজনিত ইনফেকশন, ঠান্ডাজনিত কারণে (শীতের সময় মোটরসাইকেল চালানো, শীতের মধ্যে পানিতে নেমে সারারাত মাছ ধরা, শীতে খেলাধুলার পর অতিরিক্ত ঠান্ডা পানি পান করা, শীতে দীর্ঘ ভ্রমণ যাত্রা ইত্যাদি), মস্তিস্কে অথবা মাথার খুলিতে আঘাতজনিত কারণে, কানের অপারেশন-পরবর্তী জটিলতা।

ফেসিয়াল পালসির লক্ষণ
১. আক্রান্ত রোগীর মুখ একদিকে বেঁকে যায়।
২. আক্রান্ত পাশের চোখ বন্ধ হয় না। অনেক সময় আক্রান্ত পাশের চোখে জ্বলে বা পানি পড়ে।
৩. দাঁত দেখাতে গেলে মুখ বেঁকে যায়।
৪. কোনো কিছু খেতে গেলে খাবার একপাশে চলে যায়। খাবার মুখের ভেতরের আক্রান্ত অংশে জমা হয়ে থাকে।
৫. খাবারের স্বাদ কমে যায় বা অনুভব হয় না।
৬. কপাল ভাঁজ করতে পারে না।
৭. হঠাৎ উচ্চ আওয়াজ শুনতে পাওয়া।

চিকিৎসা
উপরোল্লিখিত সমস্যা দেখা দিলে যত দ্রুত চিকিৎসকের শরণাপন্ন হবেন, ততই ভালো। কেননা, স্টেরয়েড বা অ্যান্টিভাইরাল চিকিৎসা ৭২ ঘণ্টার মধ্যে শুরু করলেই সবচেয়ে বেশি উপকার পাওয়া যায়। এ ছাড়া চিকিৎসক বিশেষ ধরনের ব্যায়াম শিখিয়ে দেবেন, যা দিনে কয়েকবার করতে হবে। এই সময় চোখের বিশেষ যত্ন নিতে হবে। যেহেতু চোখ সহজে বন্ধ হয় না, তাই তা শুস্ক হয়ে যায়। চোখের ড্রপ ব্যবহার ছাড়াও রাতে ঘুমানোর সময় বিশেষ প্যাচ ব্যবহার করে চোখ বন্ধ রাখা হয়। খাবার খেতে সমস্যা হলে ধীরে ধীরে তরল বা আধা তরল খাবার খেতে হবে।

বেশিরভাগ বেলস পালসি কয়েকদিন বা কয়েক মাসের মধ্যেই সেরে যায়। কিছু ক্ষেত্রে সমস্যাটা দীর্ঘমেয়াদিও হতে পারে। বেলস পালসি গুরুতর গোছের কোনো রোগ নয়। তবে এ ধরনের উপসর্গ দেখা দিলে দ্রুত নিকটস্থ নাক কান গলা বিশেষজ্ঞ অথবা নিউরোমেডিসিন বিশেষজ্ঞের শরণাপন্ন হবেন। প্রয়োজন হলে পাশাপাশি ফিজিওথেরাপিও নেওয়া লাগতে পারে। সে ক্ষেত্রে একজন বিশেষজ্ঞ ফিজিওথেরাপি চিকিৎসক রোগীর অবস্থা বুঝে প্রয়োজনীয় ফিজিওথেরাপি দিয়ে থাকেন।

শীতে চাই বিশেষ সতর্কতা
শীতের আমেজ উপভোগ করুন দারুণভাবে আর তার সঙ্গে সঙ্গে সতর্ক থাকুন যেন এই রোগে আক্রান্ত না হয়ে পড়েন। মাথা ঢাকার ক্ষেত্রে আমরা কিছুটা উদাসীন থাকি। মাথা, নাক, মুখ, কান- উপযুক্ত শীতের কাপড় দিয়ে ঢেকে চলুন। যতই বিদঘুটে লাগুক না কেন, শীতে টুপি, মাফলার, মাস্ক পরা ছাড়বেন না। শীতের প্রকোপে বাইরে গেলে খেয়াল রাখতে হবে কান দিয়ে যাতে বাতাস না ঢোকে। রাতের শেষ দিকে ঠান্ডা লাগার সম্ভাবনা আছে। তাই ঘুমানোর সময় এ ব্যাপারেও সতর্কতা অবলম্বন করা উচিত। সুস্থ থাকি, সুস্থ রাখি। 

[নাক কান গলা রোগ বিশেষজ্ঞ এবং হেড নেক সার্জন, সিলেট এমএজি ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল]